WBBSE (West Bengal Board of Secondary Education) Class 8 History Chapter 2 Questions and Answers
Atit o Aityaja Questions and Answers | অতীত ও ঐতিহ্য – আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উত্তর
১। ভেবে দেখো খুঁজে দেখো
ক-স্তম্ভের সঙ্গে খ-স্তম্ভ মিলিয়ে লেখো :
ক-স্তম্ভ | খ-স্তম্ভ |
1. অযোধ্যা | A. প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ |
2. ১৭৬৪ খিস্টাব্দ | B. সাদাৎ খান |
3. স্বত্ববিলোপ নীতি | C. বক্সারের যুদ্ধ |
4. লাহোরের চুক্তি | D. মহীশুর |
5. টিপু সুলতান | E. লর্ড ডালহৌসি |
২। ঠিক শব্দটি বেছে নিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করো
ক) ওরঙ্গজেবের শাসনকালে মুর্শিদকুলি খান ছিলেন বাংলার– (দেওয়ান/ফৌজদার/নবাব)।
খ) আহমদ শাহ আবদালি ছিলেন– মারাঠা/আফগান/পারসিক)।
ঘ) ব্রিটিশ কোম্পানিকে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানির অধিকার দেন– সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম/সম্রাট ফাররুখশিয়র/সন্রাট ওরঙ্গজেব)।
ঙ) স্বেচ্ছায় অধীনতামূলক মিত্রতার নীতি মেনে নিয়েছিলেন– (টিপু সুলতান/সাদাৎ খান/নিজাম)।
৩। অতি সংক্ষেপে উত্তর দাও (৩০-৪০টি শব্দ)
ক) ফাররুখশিয়রের ফরমানের গুরুত্ব কি ছিল?
উত্তর : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাসে মােগল সম্রাট ফারুখশিয়রের ফরমান অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক ওর (Orme) এই ফরমানকে কোম্পানির ম্যাগনা কার্টা’ বা ম’হাসনদ’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক সি. আর. উইলসন-এর মতে—এই ফরমান লাভ ছিল কোম্পানির একটি সত্যিকারের কূটনৈতিক সাফল্য। বলা বাহুল্য, এর মাধ্যমে কোম্পানির প্রাপ্ত পুরােনাে অধিকারগুলি নতুনভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ কোম্পানির এই সব অধিকারের বিরােধী হলেও, তার পক্ষে এই অধিকারগুলি সরাসরি অস্বীকার করা সম্ভব য ছিল না। এই অধিকারগুলি অর্জন করে কোম্পানি অন্যান্য ইওরােপীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতা ও সুযােগ-সুবিধার অধিকারী হয়। সর্বোপরি, এই ফরমান ভারতে ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে।
খ) কে, কীভাবে ও কবে হায়দরাবাদে আঞ্চলিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
উত্তর : ১৭২০ – ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মোগল দরবারের তুরানী গোষ্ঠীর নেতা “নিজাম- উল- মূলক ” হায়দারাবাদ কে কেন্দ্র করে তাঁর প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং এর মাধ্যমেই হায়দরাবাদে আঞ্চলিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।
নিজাম-উল-মূলক মোগল দরবারের তুরানী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি মোগল দরবারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কাজ করেন। মহম্মদ শাহের আমলে সৈয়দ ভাতৃদ্বয়ের যে একচ্ছত্র ক্ষমতা তৈরি হয়েছিলো তিনি তাঁর বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তাঁর সুনেতৃত্বে সৈয়দ ভ্রাতা হুসেন আলি যুদ্বে নিহত হন। তাঁর এই ভূমিকায় কৃতজ্ঞ সম্রাট মহম্মদ শাহ নিজাম কে দক্ষিণের সুবাদার পদে নিয়োগ করেন। সম্রাট ফারুখশিয়রের কাছ থেকে তিনি ” নিজাম – উল – মূলক” এবং সম্রাট মহম্মদ শাহের থেকে তিনি ” আসফ ঝা” উপাধি পান।
১৭২২ -১৭২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ নিজাম কে আবার মোগল দরবারে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু সেখানে তাঁর সঙ্গে সম্রাটের মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি আবার দক্ষিণাত্য ফিরে যান এবং সেখানেই তিনি স্বাধীন ভাবে হায়দারাবাদ রাজ্য শাসন করতে থাকেন। তাই আমরা বলতে পারি ১৭২৪ -১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ ঠিক এই সময়েই তিনি হায়দরাবাদে স্বাধীন আঞ্চলিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যা শুরু হয়ে যায়। সেই সুযোগে ইংরেজ শক্তি এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে।
গ) “পলাশির লুণ্ঠন” কাকে বলে?
উত্তর : বাংলার মসনদে বসে মিরজাফর ইংরেজ কোম্পানি ও ক্লাইভকে প্রভূত অর্থ ও নানা উপঢৌকন দান করেন। এর ফলে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। এছাড়া কোম্পানি নানাভাবে বাংলার আর্থিক সম্পদ শােষণ করতে থাকে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক টমসন (Edward Thompson) ও গ্যারাট (G. T. Garratt)-এর মতে, বাংলার মানুষের শেষ রক্তবিন্দু শুষে না নেওয়া পর্যন্ত ইংরেজরা তাদের শােষণ অব্যাহত রেখেছিল। এই ঘটনাকে ‘পলাশি লুণ্ঠন’ (Plassey plunder) বলা হয়।
ঘ) দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা বলতে কী বোঝো?
উত্তর : ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নবাব মিরজাফরের মৃত্যু হলে তার পুত্র নাজমুদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। তিনি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলার প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনার অধিকার ছেড়ে দেন। ক্লাইভ বাংলার নবাবের সঙ্গে যে ব্যবস্থা গড়ে তােলেন তা দেওয়ানি ব্যবস্থা বা দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থার স্রষ্টা হলেন লর্ড ক্লাইভ।
ঙ) ব্রিটিশ রেসিডেন্টদের কাজ কী ছিল?
উত্তর : ব্রিটিশ শক্তি ভারতে ২০০ বছর শাসন চালিয়েছিল। এই দুশো বছরের শাসন কালে ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর কর্মচারী এদেশে আসতে শুরু করেন। প্রথমে যখন কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা ছিলো তখন কোম্পানির প্রচুর বেতন প্রাপ্ত কর্মচারী এদেশে আসেন এবং এখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে এদেশের সঙ্গে মিশে যান।পরে রানী ভিক্টোরিয়া যখন কোম্পানির শাসন শেষ করে ভারত কে সম্পূর্ণ ভাবে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নিয়ে আসেন তখন ইংরেজ সেনা ও ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্ত কর্মচারীও এদেশে আসতে শুরু করেন জলের স্রোতের মতন। এরা এদেশে এসে মূলত ইংরেজ সরকারের হয়েই কাজকর্ম করতো কিন্তু কোথাও যেন এদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জীবনযাপন প্রভাব ফেলতো তাদের মননের উপর।সমাজের কিছু প্রাচীন প্রথা, কুসংস্কার নাড়া দিতো তাদের মনকে, ফলে সতিদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ এর মতো আইন তাঁরা কঠোর হাতে দমন করেছিলো। যদিও অধিকাংশ ব্রিটিশরাই ভারতীয়দের নেটিভ বলে ডাকতো। ভালো রেস্টুরেন্ট,বারে ভারতীয় দের প্রবেশ সম্পূর্ণ নীষিদ্ধ ছিলো..কম যোগ্যতা নিয়ে বহু ব্রিটিশ কর্মচারী সরকারি উচ্চ পদে নিযুক্ত থাকতো। সেই একই যোগ্যতা নিয়ে ভারতীয় দের স্থান হতো অনেক নীচে। অবশ্য আরেকটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলো ব্রিটিশ রেসিডেন্টরা ভারতীয় দের কাছে। তাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহিত্যের প্রতি টান অনুভব করে তাদের আচার, আচরণ, কথাবার্তা দেখে, বিজ্ঞান কে জানতে শেখে, বুঝতে শেখে , ব্রিটিশ দের মতো সব কিছু যুক্তি, তর্ক দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যে নবজাগরণের ঢেউ ভেসে বেড়াচ্ছিলো। দেরি হলেও সেই ঢেউ এসে পৌঁছায় ভারতেও, যা পরবর্তী কালে ভারত কে ঔপনিবেশিকতা মুক্ত স্বাধীন ভারতের জন্ম দিতে সহায়ক করে।
৪। নিজের ভাষায় লেখো (১২০-১৬০টি শব্দ)
ক) অষ্টাদশ শতকে ভারতে প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থানের পিছনে মুঘল সম্রাটদের ব্যক্তিগত অযোগ্যতাই কেবল দায়ী ছিল? তোমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর : ইতিহাস প্রমান করে যে, কোনো সাম্রাজ্যই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। যেমন উত্থান আছে তেমন তাঁর পতনও আছে। মুঘল সাম্রাজ্য ও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে ভারতের বুকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাদের পর একমাত্র মুঘল রাই এদেশে অনেকদিন শাসন কায়েম রেখেছিল। মুঘল শাসক বাবর থেকে শুরু করে ঔরঙ্গজেব সকলেই তাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের কিছু পুরাতন প্রথা যেমন জায়গীরদারী প্রথা, মনসবদার প্রথা, বিরাট সেনাদল, অতিবড়ো সাম্রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, উত্তরাধিকারী সমস্যা এই সমস্ত সাম্রাজ্য কে একবারে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছিলো। ফলে ভগ্নপ্রায় সাম্রাজ্যের অনেক জায়গাতেই আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হয়েছিলো। ধংসম্মুখ মোগল সাম্রাজ্যের উপর বাংলার মুর্শিদকুলি খাঁ, মহীশুরে হায়দার আলি, পেশবা বংশের নেতৃত্বে মারাঠা শক্তি ও পাঞ্জাবে শিখ শক্তির উত্থান ঘটে। মুঘল রাজবংশের উত্তরাধিকার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা প্রথা না থাকায় সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর সকল পুত্রই সিংহাসন দাবী করতো। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ও তাঁর তিন পুত্র গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। উত্তরাধিকারী দের নিজেদের দ্বন্দ্বের সুযোগে দরবারের ক্ষমতালোভী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতরা বিভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করে ক্ষমতা বাড়াতো। যে যুবরাজ সিংহাসনে বসতেন তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক ওমরাহ দের ক্রীড়নকে পরিণত হতেন ফলে তাঁর পক্ষে সাম্রাজ্যের জন্য উচিত ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হতো, যা সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের পিছনে একটা গুরুত্ব পূর্ণ কারণ ছিলো।
মোগল দরবারে বিভিন্ন অভিজাত গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্ব এই সাম্রাজ্যের ভাঙনের আরো একটা বড়ো কারণ ছিলো। ঔরঙ্গজেবের আমলে অভিজাতরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। দরবারের উচ্চপদ গুলির জন্য তাদের মধ্যে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাট গণ প্রত্যেকেই এদের রাজনীতির স্বীকার হন। ফলে তাদের পক্ষে সাম্রাজ্যের হিতকর কার্য সম্পাদন অপেক্ষা নিজেদের সিংহাসন রক্ষাতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হতো।
একজন সুদক্ষ, দূরদৃষ্টিম্পন্ন সম্রাটের প্রয়োজন ছিলো ঔরঙ্গজেব পরবর্তী সময়ে। কিন্তু এই সময় কোনো সুযোগ্য সম্রাটের দেখা মেলেনি। উত্তর ও দক্ষিণ সমান ভাবে বিস্তৃত এই সাম্রাজ্যের দেখাশোনা করার জন্য একটি সুশাসন ব্যাবস্থারও প্রয়োজন ছিলো। ঔরঙ্গজেব পরবর্তী কোনো মুঘল সম্রাট এই বিষয়ে তাদের বিশেষ স্বাক্ষর দিয়ে যেতে পারেন নি। তাছাড়া বহু কাল ধরে চলে আসা এই সাম্রাজ্যে বিস্তর ঘুণ ধরে গিয়েছিলো যা হয়তো একদিন এই সাম্রাজ্য কে বিনাশ করতোই। তাই এই সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটেছিলো সাম্রাজ্যের বহু প্রান্তে। মোগল দরবারের এককালীন উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই এই সব আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটিয়েছিলেন।
তাই আমরা বলতে পারি আঞ্চলিক শক্তির উত্থানে মুঘল সম্রাট দের ব্যক্তিগত অযোগ্যতা দায়ী ছিলো। কিন্তু তা সমগ্র কারণ নয়। পুরাতন ব্যাবস্থা কে আঁকড়ে ধরে থাকা মুঘল সাম্রাজ্য পরিবর্তন আনতে চায়নি। স্থবির, প্রগতিহীন সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত এবং অতীতে তাই – ই হয়েছিলো।
খ) পলাশির যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের মধ্যে কোনটি ব্রিটিশ কোম্পানির ভারতে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? তোমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন মুর্শিদাবাদের ২৩ মাইল দূরে নদীয়ার পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ কোম্পানির সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ ও বাংলার নবাব সিরাজ- উদ-দৌলার মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ খুব অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে জয়লাভ করেন।এই যুদ্ধে সিরাজের নিজের দরবারের লোকজন ই বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মীরজাফর , মিরকাশিম,জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখ ক্লাইভের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় কে সুনিশ্চিত করে।
সিরাজের পর গোপন চুক্তি অনুসারে মীরজাফর বাংলার সিংহাসনে বসেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে নবাবের আসন থেকে সরিয়ে মিরকাসিম কে বাংলার সিংহাসনে বসানো হয়।
মিরজফরের মতো মিরকাশিম অতটাও অযোগ্য ছিলেন না। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই মিরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ বাঁধে এবং শেষ পর্যন্ত তা বক্সারের যুদ্ধ অবধি পৌঁছায়।১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের 22 সে অক্টোবর অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা, দিল্লির বাদশাহ শাহ আলম কে সঙ্গে করে মিরকাশিম ইংরেজ দের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মনরো এই সম্মিলিত বাহিনী কে খুব সহজেই পরাজিত করে শেষ জয়ের হাসি হাসেন।
যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ও যুদ্ধের ব্যাপকতার দিক থেকে বিচার করে পলাশীর যুদ্ধ কে শুধুমাত্র একটি খণ্ডযুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এই যুদ্ধের ফলাফল যুদ্ধ হওয়ার বহু পূর্বেই ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া এই যুদ্ধে ইংরেজ রা শুধুমাত্র বাংলার সিংহাসনের উপর তাদের কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংরেজ আধিপত্য এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, ভারতের সম্রাট তথা দিল্লীর বাদশাহ পরাজিত হন এবং মিরকাশিমের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় প্রকৃত স্বাধীন নবাবী শাসনেরও অবসান ঘটে। এক ঢিলে তিন পাখি মারতে সক্ষম হয় তারা । ঐতিহাসিক স্মিথ এর মতে পলাশী ছিল কয়েকটি কামানের লড়াই, এবং বক্সার ছিলো চূড়ান্ত বিজয়।
আমিও নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে ও ঐতিহাসিক দের মতামত যাচাই করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশী যুদ্ধ অপেক্ষা ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের বক্সারের যুদ্ধ কোম্পানীর ভারতে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইংরেজ দের রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রকৃত সূচনা হয় মূলত এই যুদ্ধ থেকেই।
গ) মিরকাশিমের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানির বিরোধের ক্ষেত্রে কোম্পানির বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসার কী ভূমিকা ছিল? বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার প্রভাব কী হয়েছিল?
উত্তর : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ – উদ- দৌল্লা পরাজিত হবার পর মিরজাফর সিংহাসনে বসেন। মিরজাফর ছিলেন একেবারে ইংরেজদের হাতের পুতুল। ক্লাইভ মিরজাফর কে নামমাত্র সম্মান করতো এবং মিরজফরের হাত দিয়ে প্রচুর পরিমানে অর্থ আত্মসাৎ করতে শুরু করেছিল। অযোগ্য মিরজাফর শেষ পর্যন্ত ইংরেজ দের এই বাড়বাড়ন্ত সহ্য করতে না পেরে ইংরেজ দের শত্রু চুঁচুড়ার ওলন্দাজ দের সঙ্গে ইংরেজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ইংরেজরা নিজেদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে বিনা অজুহাতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মিরজাফর কে সিংহাসন থেকে হটিয়ে মিরকাশিম কে সিংহাসনে বসায়।
১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ফারুখশিয়র যে ফরমান জারি করেছিলেন তাতে কোম্পানি বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। এই অধিকার কেবলমাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকেই দেওয়া হয়েছিলো, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো কর্মচারীকে নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো কর্মচারীরাই এই ফরমান সঠিক ভাবে মানতেন না। তাঁরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা চালাতেন অবাধে। এই ব্যক্তিগত ব্যবসায় নবাবের ভীষণ ক্ষতি হতে থাকে। তিনি যেমন প্রত্যেক বণিকের ব্যবসা হেতু উপযুক্ত রাজস্ব পেতেন না তেমনি বাংলার বণিকরা এই অসম প্রতিযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্রুদ্ধ মিরকাশিম দেশীয় বনিকদের উপরও বানিজ্য শুল্ক তুলে নেন যা ইংরেজদের স্বার্থে ভীষণ আঘাত দেয়। ইংরেজরা এর বিরোধীতা করলে মিরকাশিমের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রকাশ্য দ্বন্দ শুরু হয়।
বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে বাংলার বুকে চরম নৈরাজ্য নেমে আসে। ইস্ট ইন্ডিয়া দায়িত্ত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব ক্ষমতা হীন দায়িত্বের অধিকারী হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলা কে অর্থনৈতিক দিক থেকে একেবারে পঙ্গু করে দিতে থাকে। এর ফলস্বরূপ ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বুকে নেমে আসে এক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ যা, “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর” নামে পরিচিত।
ঘ) ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অধীনতামুলক মিত্রতার নীতি থেকে স্বত্ববিলোপ নীতিতে বিবর্তনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
উত্তর : ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুদক্ষ বড়োলার্ট লর্ড ওয়েলেসলি ও লর্ড ডালহৌসি র গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। ব্রিটিশ কোম্পানির এই সব উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা ছোট ছোট রাজ্যগুলি দখল করার জন্য বিভিন্ন ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করে। শুধুমাত্র যুদ্ধ দ্বারা যে সমগ্র ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন সম্ভব নয় তা তারা উপলব্ধি করতে থাকে সাম্রাজ্য সূচনার প্রথম পর্বেই।
প্রথমেই আলোচনা করা যাক “অধীনতামূলক মিত্রতা” নীতির কথা। ১৭৯৮ লর্ড ওয়েলেসলি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তন করেন। এই নীতির মাধ্যমে তিনি ভারতীয় রাজন্যবর্গ দের ভয় দেখিয়ে তাঁদের অধীনে ইংরেজ সৈন্য রাখতে বাধ্য করেন পরিবর্তে অন্যান্য রাজা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন রাজন্যবর্গদের কে। এই ব্যবস্থা ছিলো মূলত সার্বভৌম রাজ্যগুলির নিজেদের সেনাবাহিনী ধ্বংস করে ইংরেজদের অধীন হতে বাধ্য করা। দুর্বল ভারতীয় রাজন্যবর্গ ইংরেজদের এই ফাঁদ বুঝতে না পেরে তাদের আনুগত্য নিয়ে বসে যা লর্ড ওয়ালেসলি র “অধীনতামূলক মিত্রতা ” নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য সফল হতে সাহায্য করে।
“অধীনতামূলক মিত্রতা ” নীতির দ্বারা দেশীয় রাজ্য গুলির সেনাবাহিনীকে ভেঙে তো দেওয়া হলো কিন্তু সম্পূর্ণ গলাধঃকরণ সম্ভব হলো না। পরবর্তী কালে ব্রিটিশ কোম্পানির এই স্বপ্নকে সফল করলেন লর্ড ডালহৌসি তাঁর স্বত্ত্ব বিলোপ নীতির দ্বারা। এই নীতির মূল কথায় ছিলো কোম্পানির সৃষ্ট বা কোম্পানির আশ্রিত কোনো করদ রাজ্যের রাজার পুত্র সন্তান না থাকলে সেই রাজ্য কোম্পানি দখল করবে। ডালহৌসির এই নীতি “অধীনতামূলক মিত্রতা ” নীতি গ্রহণ কারী রাজ্য গুলিকে বিপাকে ফেলে। অনেক আশ্রিত রাজ্যের রাজারই পুত্র সন্তান না থাকায় তা সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো সাতারা, সম্বলপুর, নাগপুর, উদয়পুর, ঝাঁসি ইত্যাদি।
এইভাবে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের “অধীনতামূলক মিত্রতা” নীতি থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দের “স্বত্ববিলোপ নীতিতে ” বিবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল ভারতের প্রায় তিন চতুর্থাংশে। তাই আমরা বলতে পারি ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুশো বছরের শাসনকালের বীজ অনেকটাই পোতা হয়ে গিয়েছিলো এই ” অধীনতামূলক ও স্বত্ববিলোপ ” নীতির মাধ্যমে।
ঙ) মুর্শিদকুলি খান ও আলিবর্দি খান-এর সময়ে বাংলার সঙ্গে মুঘল শাসনের সম্পর্কের চরিত্র কেমন ছিল?
উত্তর : বাংলায় স্বাধীন নবাবী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। ভাগ্যহীন মুর্শিদকুলির জন্ম দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয় একজন মুসলিমের কাছে। পারস্যে তাঁর বাল্যকাল কাটে এবং সেখানকার শিক্ষা, সংস্কৃতি তাঁকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে। এরপর তিনি ভাগ্যসূত্রে আবার ভারতে ফিরে আসেন এবং দক্ষিণাত্য -এ অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন বেরার প্রদেশে ” দেওয়ান ” হিসাবে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর দক্ষতার পরিচয় পেয়ে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে হায়দ্রাবাদের ” দেওয়ান ” নিযুক্ত করেন।। দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ মুর্শিদকুলি খাঁর আনুগত্য ঔরঙ্গজেব কে মুগ্ধ করে। ঔরঙ্গজেব তাঁকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে “দেওয়ান ” করে তাঁকে বাংলায় পাঠান এবং বছরখানেকের পরই তাঁর কাজের প্রতি মুগ্ধতায় তাঁকে ” মুর্শিদকুলি খাঁ” উপাধি দেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলার ” সুবাদার ” নিযুক্ত হন।
মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন একজন বিচক্ষণ , দক্ষ চারিত্রিক ভাবে দৃঢ় সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি ঔরঙ্গজেবের মতোই আড়ম্বরহীন সাধারণ জীবন যাপন করতেন। বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিলো প্রশ্নাতীত। তিনি ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ত্ব অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে পালন করতে সক্ষম হন। বাংলায় শান্তি- শৃঙ্খলা ফিরে আসে তাঁর সময়কালে। মোগল সাম্রাজ্যের চরম বিশৃঙ্খলার দিনেও তিনি দিল্লির বিরুদ্ধে কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করেন নি বরং নাম মাত্র সম্মান প্রদর্শন করে বাংলায় এক স্বাধীন নববীর পত্তন করেন।
মুর্শিদকুলি খাঁ – এর পর সুজাউদ্দিন খাঁ সরফরাজ খাঁ এবং তারপর আলিবর্দী খাঁ সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময়কাল ছিল ১৭৪০ – ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর সময়কালে বাংলায় মোটেই শান্তিপূর্ন অবস্থা বজায় ছিলো না। তবুও তিনি এ ব্যাপারের কখনো মুঘল সম্রাটের দ্বারস্থ হন নি। তিনি কোনো বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল্লির সম্রাটের আনুগত্যও অস্বীকার করেন নি। তিনি সর্বদা মুঘল শাসনের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেই বাংলার সমস্ত বিপদ মোকাবিলা করেছেন। কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিলো না তাঁর শাসন ব্যবস্থায়। বহু হিন্দু কর্মচারী কাজ করতো তাঁর সেনাদলে। তাই আমরা বলতে পারি মুর্শিদকুলি খাঁ সর্বদা যেমন মুঘল শাসন ব্যবস্থা তথা মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে বাংলায় নিজের কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন তেমনি তাঁর অনুরূপ পদাঙ্ক অনুসরণ করে আলীবর্দী খাঁ ও সেই একই পথে হেঁটে ছিলেন।
৫। কল্পনা করে লেখো (২০০টি শব্দের মধ্যে)
ক) ধরো তুমি নবাব আলিবর্দি খান-এর আমলে বাংলার একজন সাধারণ মানুষ তোমার এলাকায় বর্গ আক্রমণ হয়েছিলো । তোমার ও তোমার প্রতিবেশীর মধ্যে বর্গিহানার অভিজ্ঞতা বিষয়ে একটি কথোপকথন লেখো।
উত্তর : হাসান মিঞা :—— ( হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছেন ফকির মিঞার ধরে) ফকির মিঞা কোথায় তুমি ?? তোমার ধানের গোলায় চারটি ধান হবে নাকি মিঞা ?? ঘরের আঙিনায় সাবিনা বেগম ছেলে দুটোকে নিয়ে বসে বসে কাঁদছে। ছেলে দুটো আর পেটে খিল দিয়ে থাকতে পারছে না মিঞা !! হবে দুটো ধান ?? ছেলে দুটোকে ওই সিদ্ধ করেই পাতে দেবো।।
ফকির মিঞা :—– কি কথা বলো হাসান ভাই। ধানের গোলায় কি চাল আছে ভাই, সব যে শেষ, ছেলে – মেয়ে দুটোকে আজ একসপ্তাহ হলো কলমির শাক সেদ্ধ করে খাওয়াচ্ছি। ধান পাবো কোথায়?? বর্গীরা এসে সব যে শেষ করে দিয়ে গেলো ভাই। ধানের জমি, আখের খেত, ভরা পুকুর সব যে শেষ করে দিলো গো। ঘোড়ার পায়ে ছারখার করে দিলো আমার সোনার ধান। চোখের সামনে সোনার ধান মাটির ধূলোর সঙ্গে মিশে গেলো সব!! এখন সেই সোনার ধান কোথায় পাবো ভাই।
হাসান মিঞা :—- নবাব ‘জহাঁপনা ‘ বলেছেন এবার বর্গীরা এলে তিনি তাঁদের আচ্ছা সবক দেবেন। কিন্তু মিঞা এইবার যা ক্ষতি করে দিলো তা পূরণ হবে কি করে ??? বাড়ি টা পর্যন্ত আস্ত রাখেনি। দালান ভেঙে চুরমার করে গেছে ওই বর্গীরা। নবাবের দেওয়া বিশাল সামিয়ানার নীচে বাস করছি আমরা। নবাব বলেছেন তিনি নাকি সব ঠিক করে দেবেন । কিন্তু “আল্লাহ ” ই জানে কবে সব ঠিক হবে !!
ফকির মিঞা :—- জানো ভাই হাসান তাঁতীগ্রামের সব তাঁতী পালিয়ে গেছে বড়ো শহর কলকাতায়। তাঁদের আর দাদন দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাঁরা এখন বেগার খাটতে শহর মুখী হয়েছে। ঘরের মেয়ে, বউদের যে কোথায় লুকিয়ে রাখি ভেবে পাচ্ছি না। বর্গীরা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেও প্রায় আধমরা করে রেখে গেলো। সবসময় যেনো বর্গীদের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
হাসান মিঞা :— তা তুমি ঠিক বলেছ ভাই। যে ভয়াবহতা দুদিন আগে দেখলাম সেই আতঙ্ক সহজে যে কাটার নয় গো ভায়া। ‘নবাব ‘ সাহস দিচ্ছেন উঠে দাঁড়াবার। চলো ভায়া আরেকবার উঠে দাঁড়ানোর সাহস করি। নবাব আমাদের দরদ নিশ্চয় বুঝবেন।
ফকির মিঞা :— হম ভায়া। নবাবের কথাতেই তো আবার বুক বাঁধছি নতুন করে। ঘরে ধান নেই, জমিতে ফসল নেই, মেয়ে বউদের ইজ্জত চলে গেছে, গোয়ালের গরু, বাছুর সব মারা গেছে , ছেলে পিলে গো পেটে খিল দিয়ে শাক সিদ্ধ খাচ্ছে। তারপরেও ” নবাব আলিবর্দীর কথায় বুক বাঁধছি আমরা। আল্লাহ সব যেনো ঠিক করে দেয় মিঞা। নবাব আমাদের রক্ষাকর্তা, তিনি নিশ্চয় প্রজাদের কথা ভাববেন।
খ) ধরো তুমি ব্রিটিশ কোম্পানির একজন কর্তাব্যক্তি। ”৭৬-এর মন্বত্তর”-এর সময় তুমি বাংলায় ঘুরলে তোমার কী ধরনের অভিজ্ঞতা হবে? মন্বন্তরের সময়ে মানুষকে সাহায্যের জন্য কোম্পানিকে কী কী করতে পরামর্শ দেবে তুমি?
উত্তর : আমি হেনরি বোল্টস। ব্রিটিশ “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর” এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। আমি কোম্পানীর ব্যাবসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসাও শুরু করেছি বাংলায় । কিন্তু ইদানিং যে দুর্ভিক্ষ বা মহামারী শুরু হয়েছে তাতে আমার ব্যক্তিগত এবং কোম্পানির ব্যাবসা দুটোই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কয়েকদিন আগে ব্যক্তিগত ব্যাবসার কাজে কিছু কাঁচা মাল সংগ্রহের জন্য বেরিয়েছিলাম কলকাতা থেকে একটু বাইরের দিকে। সেখানে যে অবস্থা চোখে পড়লো তা দেখে আমি রীতিমতো ভয় পেয়েগেছি। খাবার নেই, জল নেই মানুষ বুভুক্ষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো ব্রিটিশ দেখলেই তাঁর হাতে , পায়ে গিয়ে খাবার ভিক্ষা চাইছে। কত বৃদ্ধ, শিশু মারা গেছে এবং থরে থরে তাদের দেহ সাজানো আছে রাস্তায় কারণ সৎকার টুকু করার জন্য পর্যাপ্ত জিনিসই নেই মানুষের কাছে। জোয়ান মানুষ গুলো যেনো এক একটা কঙ্কাল। ধুতি পরিহিত অর্ধনগ্ন শরীর গুলো রাস্তায় বসে ভাতের ফ্যানের জন্য পাগলের মতো চিৎকার করছে। ঘরের মেয়ে, বউরা স্বেচ্ছায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তাদের ছেলে, মেয়েদের মুখে দুটো ভাত দেবার আশায়। সবাই যেনো বিক্রেতা, ক্রেতা কেউ নেই। এই রকম পরিস্থিতির আমি কোনদিন সম্মুখীন হইনি। আমি কেনো, আমার মতে ব্রিটিশ কোম্পানির কোনো কর্মচারীই এইরকম দুর্ভিক্ষ দেখেনি। কোম্পানির অধীনস্ত বাংলার এই অবস্থার খবর যদি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পৌঁছায় তাহলে আমাদের হয়তো খুব তাড়াতাড়িই এই দেশ ছাড়তে হবে। ইংরাজি “১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ” বা বাংলার “১১৭৬ সনের ” এই দুর্ভিক্ষ বাংলার ইতিহাসে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যাবে।
মন্বন্তরের সময় মানুষকে সাহায্য করতে হলে প্রথমেই কোম্পানিকে “দ্বৈত শাসন” ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। রেঁজা খাঁ, সিতাব রায়ের মতো অত্যাচারী রাজস্ব আদায় কারী কর্মচারীদের বিতাড়িত করতে হবে। অবিলম্বে প্রচুর খাদ্যশস্যের জোগান দিতে হবে প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে এবং কলকাতার অলিতে , গলিতে। কোম্পানির দায়িত্বজ্ঞান হীন বনিকদের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করাতে হবে। যে সমস্ত কালোবাজারিরা খাদ্যশস্য মজুত রেখে অযথা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি করছে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উপযুক্ত সেচ, খাল খনন করে কৃষক দের আবার কৃষিকার্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধুমাত্র প্রকৃতির বৃষ্টির উপর নির্ভর না করে নদীর জল ও কূপ খনন করে কৃষিকার্যে কৃষকদের উৎসাহী করতে হবে। চিরস্থায়ী ব্যবস্থার মতো ভূমি ব্যবস্থার অবিলম্বে পরিবর্তন আনতে হবে। তাছাড়া এদেশের বনিকদের ব্যবসার জন্য যে শুল্ক দিতে হয় তা তুলে দিতে হবে ইংরেজ বনিকদের মতো। এই শুল্কের জন্য প্রায় অধিকাংশ এদেশীয় বনিকরাই তাঁদের ব্যবসা গুটিয়ে দিয়েছে। বাংলার তাঁতিদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে যাতে তাঁরা এই ব্যবসায় লভ্যাংশ না পেয়ে, হতাশ না হয়ে পড়েন। মোট কথা কোম্পানিকে একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী মেনে ব্যবসা করতে হবে। বেশি, বেশি রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয়, তাঁর জন্য অবিলম্বে কোম্পানিকে একজন বিচক্ষণ ও বিশেষজ্ঞ “বাংলার গভর্নর” নিযুক্ত করতে হবে।
Read More :