মগধের উত্থান | Rise and Growth of Magadha Empire

মগধের উত্থান | Rise and Growth of Magadha Empire

মগধ

মগধ ছিল বর্তমান গয়া ও পাটনা জেলা নিয়ে গঠিত। এর আদি রাজধানী ছিল রাজগৃহ বা রাজগীর বা গিরিব্রজ। মগধের মধ্য দিয়েও গঙ্গা প্রবাহিত ছিল। বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধে হর্ষঙ্ক বংশ রাজত্ব করে। শেষ পর্যন্ত মগধকে কেন্দ্র করে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে।

মগধের উত্থানের কারণ

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধ রাজ্য ছিল বিহারের পাটনা ও গয়া জেলা নিয়ে গঠিত। ১৬টি মহাজনপদের মধ্যে শেষপর্যন্ত প্রধান হয়ে ওঠে ৪টি – কোশল, মগধ, বৎস এবং অবন্তী। এই চারটির মধ্যে শেষ পর্যন্ত মগধ সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে এক অখণ্ড রাজ্য স্থাপন করে। মগধের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য মগধের রাজবংশগুলির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। হ্যঙ্ক বংশের বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ বংশের শিশুনাগ, কালাশােক ; নন্দবংশের মহাপদ্মনন্দ প্রমুখ রাজারা একাগ্রভাবে মগধের রাজ্যবিস্তার নীতি অনুসরণ করে চলেন।   

মগধে পরপর অসাধারণ যােগ্যতাসম্পন্ন নৃপতি সিংহাসনে বসার দরুণ উন্নতি অব্যাহত থাকে। এখানে বংশানুক্রমিক রাজবংশ ছিল না, যখনই কোনাে রাজবংশের শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে তখন তাকে উচ্ছেদ করে নতুন রাজবংশ যােগ্যতার সঙ্গে শাসন চালাতে পেরেছে। এই বিষয়টি মগধের উন্নতির মূলে বিশেষ সাহায্য করে।   মগধ মন্ত্রী ও কূটনীতিবিদদের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ লােকেদের সাহায্য পেয়েছে। অজাতশত্রুর বিখ্যাত মন্ত্রী ছিল—বাসসাকার, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী কৌটিল্য, অশােকের মন্ত্রী রাধাগুপ্ত ছিলেন সে যুগের ভারত বিখ্যাত কূটনীতিবিদ।

মগধের ভৌগােলিক অবস্থান মগধের শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। মগধের মধ্যদিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। মগধরাজ্য ছিল সুরক্ষিত। গঙ্গা, শােন, চম্পা নদী মগধকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ছিল। এর ফলে কোনাে শত্রু সহসা আক্রমণ করতে পারত না। মগধের রাজধানী রাজগৃহ ছিল সুরক্ষিতস্থান এর চারদিকে ছিল পাঁচটি পাহাড় ও পাথরের উচু প্রাচীর। মগধের পরবর্তী রাজধানী সুরক্ষিত ছিল পাটলীপুত্র। গঙ্গা ও শােনের সঙ্গমস্থানে ছিল পাটলীপুত্র।   

মগধের জনশক্তি ছিল বিশাল। জনশক্তির দ্বারা মগধের রাজারা বিশাল পদাতিক বাহিনী গঠন করেন। মগধের অধীনে ছিল বিরাট হস্তিবাহিনী। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল—মহাশিলা, কন্টক, কান্ডার, রথমুষলের নাম পাওয়া যায়।   মগধের সাম্রাজ্যবাদে অর্থনৈতিক কারণ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। মগধের কৃষি ও খনিগুলিকে চালানাের জন্য লােক বলের অভাব ছিল। গঙ্গা ও শশানের জলধারায় প্লাবিত হওয়ার কারণে মগধে জমি ছিল উর্বর, শস্যের ফলন ছিল খুব বেশি। সাধারণত বছরে দুবার এই সমস্ত জমিতে নানা রকম ফসল ফলতাে। ঐতিহাসিক রােমিলা থাপার বলেন যে “মগধের কৃষি অর্থনীতি নির্ভর করে একটি সাম্রাজ্য কাঠামাে গঠনের সম্ভাবনা প্রথম জন্মলাভ করে।”   

মগধের সমৃদ্ধির অপর কারণ ছিল মগধের খনিজ সম্পদ। খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে দৈনন্দিন জীবনে ও যুদ্ধের জন্যে অস্ত্র নির্মাণে লােহার ব্যাপক ব্যবহার আরম্ভ হয়। বৈদিক যুগের শেষ দিকে লােহার লাঙ্গলের ব্যবহার হয়। গৃহস্থালির কাজের যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য লােহা লাগত। সবচেয়ে বেশি লােহা লাগত যুদ্ধের অস্ত্র তৈরির কাজে। মগধের লােহার খনিগুলি ছিল তার সামরিক শক্তির গর্ভগৃহ। মগধ এই লােহার খনির উপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছিল। মগধ শক্তিশালী হওয়ার ফলে আগ্রাসী হয়ে ওঠে।

ব্যাসাম, রােমিলা থাপার প্রমুখের মতে গঙ্গার উপর মগধের নিয়ন্ত্রণ এবং বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ছিল তার উত্থানের মূলে। গঙ্গা নদীর একটি বড়াে অংশ ছিল মগধের ভেতরে। গঙ্গার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য পাওয়ার জন্য মগধ প্রতিবেশী রাজ্যগুলি দখল করে। প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য দখলের পর বিখ্যাত চম্পা বন্দরটি মগধের অধিকারে আসে। কোশলকে পরাস্ত করে কাশীবা বারাণসী দখল করলে গঙ্গার বেশির ভাগ মগধের অধিকারে আসে। এরপর গঙ্গার উত্তরতীরে লিচ্ছবিদের পরাস্ত করে বৈশালী দখল করলে গঙ্গার দুই উপকূল মগধের অধিকারে আসে এবং মগধ বাণিজ্য ও সমৃদ্ধিকে প্রতিষ্ঠা করে।

মগধে ছিল মিশ্র সংস্কৃতি ও মিশ্র আদর্শের প্রবণতা। উত্তর ভারতের আর্য সংস্কৃতির প্রবাহ উত্তরপ্রদেশ পার হয়ে যখন মগধে পৌছায়, তখন তার জোর অনেকটা কমে গিয়েছিল। অপরদিকে পূর্বভারতে অনার্য সংস্কৃতির রেশ মগধে তখনও কিছুটা ছিল। সুতরাং মগধ এই উভয় সংস্কৃতির মিলনে এক নতুন শক্তি পেয়েছিল। আর্য মানসিকতা ও অনার্য বাহুবলে মগধ হয়ে ওঠে দুর্বার।

প্রাচীন যুগে ঐক্যবদ্ধ ভারত রাষ্ট্র স্থাপনের আদর্শ বিশেষভাবে দেখা যায়। ধর্মশাস্ত্রগুলি রাজচক্রবর্তী, একরাট, বিরাট, সম্রাট প্রভৃতি উপাধির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রেরণা দেয়। মগধের রাজবংশগুলি এই আহ্বান উপেক্ষা করেনি।

মগধের সাম্রাজ্য বিস্তার

মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে মগধের আদি রাজবংশ ছিল শিশুনাগ বংশ। কিন্তু বৌদ্ধ ‘মহাবংশ’ এবং অশ্বঘােষের ‘বুদ্ধচরিত’ – বলা হয়েছে যে মগধে প্রথম বিখ্যাত হর্যঙ্ক রাজবংশ ছিল। এই বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন বিম্বিসার। বিম্বিসার ৫৪৭ থেকে ৪৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার পিতা ছিলেন ভট্টীয়। বৌদ্ধ মহাবংশ অনুসারে তিনি ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন বৃজির সেনাপতি। তার উপাধি ছিল শ্রেণিক। বিম্বিসার কোশলরাজ মহাকোশলের কন্যা কোশলদেবীকে বিবাহ করে কাশী বা বারাণসী যৌতুক হিসাবে পান। এর ফলে কাশী হতে বিম্বিসার ১ লক্ষ মুদ্রা রাজস্ব পেতেন। তিনি লিচ্ছবি রাজকন্যা চেল্লানাকে বিয়ে করেন। এর ফলে গঙ্গার উত্তর তীরে বৈশালী রাজ্যের মিত্রতা মগধের ক্ষমতা বা মর্যাদা বাড়ায়। তিনি বিদেহ রাজকন্যা বাসবীকে বিয়ে করেন। তিনি পাঞ্জাবের মদ্র রাজকন্যা ক্ষেমাকে বিয়ে করেন। বিম্বিসার যখন প্রতিবেশী অঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধে রত হন তখন লিচ্ছবি রাজা চেতক এবং কোশল রাজ প্রসেনজিৎ নিরপেক্ষ ছিলেন। ফলে বিম্বিসার সহজে অঙ্গরাজ্য আক্রমণ করে জয়লাভ করেন।

অঙ্গরাজ্য আক্রমণের দ্বারা বিম্বিসার মগধের রাজ্যবিস্তারের যে সূচনা করেন অশােকের কলিঙ্গ বিজয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। অঙ্গরাজ ব্ৰহ্মদত্ত বিম্বিসারের পিতাকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন। বিম্বিসার ব্রহ্মদত্তকে পরাস্ত ও হত্যা করে অঙ্গরাজ্য মগধের অন্তর্ভুক্ত করেন। চম্পা বন্দর অধিকারের ফলে দক্ষিণ ভারত ও সুদূর প্রাচ্যের বাণিজ্য মগধের হাতে আসে।

তক্ষশীলার রাজা পুকুসতীর কাছে তিনি দূত পাঠান। অবন্তীরাজ প্রদ্যোতের চিকিৎসার জন্য তিনি তার বৈদ্য জীবককে পাঠান। বিম্বিসার তাঁর কাজের সুবিধার জন্য তিনটি দপ্তর শুরু করেন। যথা বিচারবিভাগ (ভােহরিক), শাসনবিভাগ (সর্বার্থক) সমরবিভাগ (সেনানায়ক)। তিনি পথঘাট ও নদীবাঁধ নির্মাণ করেন।

বিম্বিসার বুদ্ধের ভক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। তবে জৈন ধর্মগ্রন্থে বলা হয় যে তিনি জৈন ধর্মের অনুরাগী ছিলেন। সম্ভবত তিনি উভয় ধর্মকে সমান শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বৌদ্ধ সঙঘকে বসবাসের জন্য করন্ত বেনুবন নামে একটি উদ্যান দান করেন। বৌদ্ধশাস্ত্র মতে বিম্বিসার তাঁর পুত্র অজাতশত্রুর হাতে নিহত হন।

বিম্বিসারের পর অজাতশত্রু মগধের সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজত্বকাল ৪৯৫-৪৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তার রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা ছিল কোশলের সঙ্গে মগধের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোশল রাজ প্রসেনজিৎ পরাস্ত হয়ে তার কন্যা ভজিরাকুমারীর সঙ্গে অজাতশত্রুর বিয়ে দেন। অজাতশত্রুর সঙ্গে লিচ্ছবি, বৃজি গণরাজ্যের যুদ্ধে কোশল লিচ্ছবির পক্ষ নেয় তখন কোশল রাজ ছিলেন বিদুদাভ। তিনি প্রতিবেশী শাক্যগণরাজ্য জয় করে কোশলের অন্তর্ভুক্ত করেন। এর অল্পকাল পরেই কোশল রাজ্যের পতন ঘটে।

অজাতশত্রুর দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছিল লিচ্ছবি রাজ চেতকের সঙ্গে। চেতক কর্তৃক অজাতশত্রুর বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের আশ্রয়দান ছিল এই যুদ্ধের উপলক্ষ। কিন্তু বৌদ্ধ জাতকে বলা হয়েছে যে গঙ্গার উপর একটি বন্দর এবং একটি খনির অধিকার নিয়ে মগধ ও লিচ্ছবিদের মধ্যে বিরােধ বাধে। লিচ্ছবিরা আত্মরক্ষার জন্য মল্ল বৃজিসহ ৩৬ টা গণরাজ্য নিয়ে মগধের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। এছাড়া কোশল ও অবন্তী মগধের বিরােধিতা করে। অজাতশত্রু, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাটোল গ্রাম বেছে নেন। বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে গৌতমবুদ্ধের সহানুভূতি গণরাজ্যের প্রতি ছিল। ৯টি লিচ্ছবি, ৯টি মল্ল ও ১৮টি কাশী কোশল উপজাতি গণরাজ্য বৃজির নেতৃত্বে মগধের বিরােধিতা করে। ১৬ বছর যুদ্ধের পর গণরাজ্যগুলির পতন ঘটে। এই জয়ের ফলে গণরাজ্যগুলি মগধের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। অজাতশত্রু এই যুদ্ধে মহাশীলাকন্টক ও রথমুশল নামে দুধরণের অস্ত্র ব্যবহার করেন। গঙ্গার উত্তর তীর অধিকার করে মগধ আরাে ২০০ যােজন রাজ্যবিস্তারে সমর্থ হয়। অজাতশত্রু বৈশালী অধিকার করায় কোশল দুর্বল হয়ে পড়ে।

অজাতশত্রু শেষ জীবনে বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ দেখান বলে জানা যায়। ভারহুতের ফলক চিত্রে ভগবান তথাগতের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের চিত্র খােদিত আছে। তিনি রাজগৃহের চারদিকে কয়েকটি ধাতুনির্মিত চৈত্য স্থাপন করেন। তার আমলে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়।

অজাতশত্রুর পরে মগধের সিংহাসনে বসেন উদয়িন বা উদয়ভদ্র। পুরাণে অবশ্য কথিত আছে, অজাতশত্রুর পরে মগধের সিংহাসনে বসেন দর্শক। উদয়িনের প্রধান কৃতিত্ব ছিল গঙ্গা ও শােনের সংযােগস্থলে অবস্থিত পাটলিপুত্র নগরের নির্মাণ। উদয়িনের সময় অবন্তী রাজা পালকের সঙ্গে বিরােধ তীব্র হয়ে ওঠে, যদিও উদয়িন অবন্তীকে ধ্বংস করতে পারেন নি। উদয়িনের পর অনিরুদ্ধ, মুন্ড প্রমুখ প্রভৃতি মগধের সিংহাসনে বসেন। বৌদ্ধ কিংবদন্তী অনুসারে এরা সবাই ছিল পিতৃহন্তা। এই বংশের শেষ রাজা নাগদশককে হত্যা করে তার সভাসদ শিশুনাগ মগধ অধিকার করলে হযঙ্ক বংশের পতন হয়।

শৈশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিশুনাগ। তিনি ছিলেন বৈশালীর ভূতপূর্ব রাজপুত্র। তিনি অবন্তীর রাজা প্রদ্যোৎ বংশের গৌরব ধ্বংস করেন। অবন্তীর রাজা অর্ষকের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য শিশুনাগ কিছুদিন গিরিব্রজে রাজধানী স্থানান্তর করেন। গৃহযুদ্ধে বিক্ষত অবন্তী মগধের আক্রমণে পরাস্ত ও অধিকৃত হলে শিশুনাগ তার রাজধানী পিতৃরাজ্য বৈশালীতে স্থানান্তর করেন। তিনি সম্ভবত বৎস রাজ্য অধিকার করেন। তার রাজত্বকাল ছিল ৪১২-৩৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

শিশুনাগের পর মগধের সিংহাসনে বসেন কাকবংশ বা কালাশােক। তার আমলে মগধ উত্তরভারতের শ্রেষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হয়। তিনি মগধের রাজধানী পাকাপাকিভাবে পাটলীপুত্র নগরে স্থাপন করেন। তার আমলে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। গ্রীক লেখক কাটিয়াসের রচনা থেকে জানা যায়, জনৈক শূদ্র কালাশােকের রাণীর প্রেমিক ছিলেন। তিনি রাণীর সহায়তায় কালাশােকের দশ পুত্র ও কালাশােককে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। এই শূদ্র ছিল ইতিহাস বিখ্যাত মহাপদ্মনন্দ, তিনি শৈশুনাগ বংশকে উচ্ছেদ করে নন্দবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।

মহাপদ্মনন্দের পিতা ছিলেন এক জন শূদ্র এবং তার মাতা শূদ্র কন্যা। মহাপদ্মের ‘নন্দ’ উপাধি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায়। বৌদ্ধমতে তার নাম উগ্রসেন। গ্রিকরা এটা উচ্চারণ করেছে আগ্রামেস। মহাপদ্ম খুবই শক্তিশালী রাজা ছিলেন, তাকে ‘সর্বক্ষত্রিয়ােচ্ছেত্তো’ অর্থাৎ সকল ক্ষত্রিয় রাজার উৎখাতকারী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তিনি কোশলরাজ্য পুরােপুরি মগধের অধীনে আনেন। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুম্ফা শিলালিপিতে একটি জলপ্রণালী তৈরির ব্যাপারে মহাপদ্মের নাম পাওয়া যায়। কলিঙ্গ জৈন তীর্থঙ্করের একটি মূর্তি নিয়ে যান বলে বলা হয়েছে।

তিনি মহামাত্র, প্রাদেশিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি কর্মচারীদের দ্বারা সাম্রাজ্যকে সুশাসন করার ব্যবস্থা করেন। তিনি জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি করে কৃষির উন্নতির চেষ্টা করেন। মহাপদ্ম সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন। ডা. আর.কে.মুখার্জির মতে, “উত্তরভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট ছিলেন মহাপদ্মনন্দ”, তার-ই প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্য গঠিত হয়। তার রাজধানী পাটলীপুত্রে পর্ষ, উনবর্ষ, পাণীনি, কাত্যায়ণ, বররুচী প্রভৃতি পণ্ডিতরা বাস করতেন। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রির মতে, নন্দরাজারা পাণীনির ব্যাকরণ ব্যবহার ও যবনলিপি বা গ্রীক লিপির পাঠোদ্ধার করেন।

মহাপদ্মকে নিয়ে মােট ৯ জন নন্দরাজার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়। মহাপদ্মনন্দের পরবর্তী আটজন ছিল তার পুত্র। কেউ কেউ এই আটজনকে তার ভ্রাতা বলেছেন। শেষ নন্দরাজা ধননন্দের সম্পর্কে গ্রীক ও ভারতীয় সূত্র থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। গ্রীক লেখকরা তার বিরাট সামরিক শক্তির উল্লেখ করেছেন। ২০ হাজার অশ্বারােহী, দুই লক্ষ পদাতিক ২২ হাজার রথ ও তিন হাজার রণ হস্তি নিয়ে তার সেনাদল গঠিত ছিল। বিশাল সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য ধননন্দ প্রজাদের উপর কর বাড়ান। ফলে নন্দরাজাদের উপর প্রজা বিক্ষোভ দেখা দেয়। কৌটিল্য এই সুযােগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে দিয়ে ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করান। ফলে মগধের সিংহাসনে মৌর্য বংশের শাসন শুরু হয়।

প্রাচীন ভারতীয় প্রজাতন্ত্র

জৈন, বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ ধর্মগ্রন্থ অনুসারে উত্তর ভারতে কিছু কিছু স্বশাসিত প্রজাতান্ত্রিক গােষ্ঠী ছিল। পালি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে বুদ্ধের জীবদ্দশায় উত্তরভারতে দশটি প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের নাম পাওয়া যায়। যথা কপিলাবস্তু, শাক্য, মল্লর, কুশীনগর এবং পাবা, বৈশালী, লিচ্ছবি ছিল সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য।   শাক্যরা ছিল ভারত এবং নেপালের সীমান্তে একটি গােষ্ঠী। রাজা বিরুদ্ধক এই গণরাজ্য বা প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য আক্রমণ করে কোশল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।   মল্লরা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমটি ছিল পাবা এবং দ্বিতীয়টি ছিল কুশীনগর। অজাতশত্রু মল্লরাজ্য জয় করে মগধের অন্তর্ভুক্ত করেন।

গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলি হল—

(a) কপিলাবস্তুর শাক্য (b) বৈশালীর লিচ্ছবি (c) মল্লর পাবা (d) মল্লর কুশীনগর (e) রামগ্রামের কোলিয়া (f) শাসসুমাসার ভাগ (g) পিপ্পিলি বনের মৌরীয় (h) কেশপুত্তর কালামা (i) মিথিলার বিদেহ (j) কুন্ধল গ্রামের ন্যায়। পারসিক ও গ্রীক আক্রমণ—খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ইরানের আকেমনিয় রাজবংশের শাসনকালে পারসিক বা ইরানীয়রা ভারতের কিছু অংশজয় করেছে বলে জানা যায়। ভারতের আর্য পরবর্তী বৈদেশিক আক্রমণ বলতে পারসিক আক্রমণকে ধরা হয়। এ সম্পর্কে আমরা গ্রীক ঐতিহাসিক হােরােডােটাস, জেনােফোন, মেগাস্থিনিসের রচনা থেকে এবং পারসিক বাহিস্তান নাক্সই রুস্তম লিপি থেকে তথ্য পাই।

পারসিক সম্রাট কাইরাস বা কুরুশ ৫৮৮-৫৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে ভারতে অভিযান করেন। হেরােডােটাস বলেন যে কাইরাস আফগানিস্তান ও গান্ধার জয় করেন। তিনি অ্যানাতােলিয়া এবং ব্যবিলন জয় করে মিশর পর্যন্ত অগ্রসর হন। কাইরাস আফগানিস্তানের ঘােরবন্দ উপত্যকার কপিশ নগর জয় করেন। ক্যামবিশে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তার পিতার মতাে সফল ছিলেন না।   

অ্যাকেমনিয়াে বংশের প্রথম সম্রাট প্রথম দরিয়াস ৫২২ থেকে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্ব মধ্যে সিন্ধু উপত্যকার গান্ধার অঞ্চল জয় করেন। নাক্স-ই-রুস্তম লিপি ও হামদান স্বর্ণ-রৌপ্য লিপি থেকে জানা যায় যে গান্ধার, সিন্ধু ও পাঞ্জাব দরায়ুসের রাজ্যভূক্ত ছিল। তার রাজধানী সুসার কাঠের প্রাসাদ তৈরী করতে গান্ধার থেকে সেগুন কাঠ আনা হয়।   দরায়ুসের পর পারসিক সিংহাসনে বসেন জারেক্সিস। তিনি গ্রীস আক্রমণে ব্যস্ত থাকার জন্য ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে নজর দিতে পারেননি। গ্রীস আক্রমণের জন্য তিনি যে বিশাল সেনাদল গঠন করেন তাতে ভারতীয় পদাতিক ও অশ্বারােহী সেনা ছিল বলে জানা যায়। হেরােডােটাস তাদের গান্ধারীয় ও ভারতীয় বলেছেন।   

শেষ অ্যাকেমনিয়াে সম্রাট তৃতীয় দরায়ুসের সঙ্গে মাসেডনীয় বীর আলেকজান্ডারের গওগা মেলা ও আরবেলার যুদ্ধে পারসিকদের পক্ষে কিছু ভারতীয় সেনা যুদ্ধ করে বলে জানা যায়। এরপর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণে ভারতে পারসিক অধিকার ধ্বংস হয়।

ভারতে পারসিক বিজয়ের কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় নি। হুইলার বলেন পারস্যের কাছ থেকে ভারতবর্ষে লােহার ব্যাপক ব্যবহার ও মুদ্রা তৈরীর কৌশল শিখেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের উপর পারস্যের প্রভাব ব্যাপকভাবে দেখা যায়। মৌর্য সম্রাটরা কেশ সংস্কার ইত্যাদি উৎসব পারস্যের অনুকরণে করতেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পাটলিপুত্রের কাষ্ঠনির্মিত প্রাসাদ পারস্যের পার্সিপােলি প্রাসাদের অনুকরণ বলে মনে করা হয়। ভারতে পাথর খােদাই করে স্তম্ভ নির্মাণ ও তার গায়ে লিপি খােদাই করার চল পারসিকদের অনুকরণে তৈরী হয়। পারসিক মুদ্রা দারিক ও সেকেলের অনুকরণে মৌর্যমুদ্রা তৈরী হয়। অশােকের লেখ, লিপি ও নিপিষ্ট শব্দগুলি পারসিক ভাষা থেকে গৃহীত বলে মনে করা হয়। মহাযান বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পারস্যের জরথ্রষ্টীয় ধর্মের কিছু যােগ ছিল।   

পারসিকদের পরে ভারতবর্যে গ্রীকরা আক্রমণ করে। পিতা ফিলিপের মৃত্যুর পর আলেকজান্ডার ৩৩৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেন। ৩২৯ খ্রি. পূর্বাব্দের মধ্যে আলেকজান্ডার সমগ্র পারস্য জয় করেন এবং তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয় পারস্য থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত। ৩২৭ খ্রি.পূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ অভিযান করেন। এইসময় উত্তর-পশ্চিম ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল।

গ্রীক লেখকরা মােট ২৭টি রাজ্যের নাম দিয়েছেন। এই রাজ্যগুলি হল—(a) অশ্বক (b) নিশা (c) পুস্কলাবতী (d) গান্ধার (e) অভিসার (f) ছােট পুরুরাজ্য (g) বড়াে পুরুরাজ্য (h) সৌভূতি (6) শিবি (j) ক্ষুদ্রক (k) মৌসিকান্স (1) পটলেনি (m) আদ্রেষ্টায়ী (n) কথাই অয় (0) মল্লই (p) অম্ব (q) ক্ষত্রি (r) অক্সিক্যান্স (s) শ্যামবস (t) অশ্বষ্ঠ ইত্যাদি।

৩২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বত পার হয়ে ৪০০০০ সেনা নিয়ে আলেকজান্ডার ভারতের মাটিতে পা রাখেন। জালালাবাদের কাছে নিকিয়ানগরে এসে তিনি সিন্ধুর পশ্চিম তীরের রাজাদের কাছে বশ্যতা দাবি করেন। এই সময় তক্ষশীলার রাজা অম্ভি তাঁর কাছে ৬৫টি হাতি ও ৩০০টি ষাঁড় উপঢৌকন দেন এবং বশ্যতা স্বীকার করেন। অন্তি ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বাসঘাতক। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে ভারতের ইতিহাসে দেশদ্রোহিতার এটাই ছিল প্রথম উদাহরণ। সীমান্ত অঞ্চলের রাজা শশীগুপ্তও বিনাযুদ্ধে আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেন।

আলেকজান্ডার বাহিনী প্রথম বাধা পায় পুষ্কলাবতীয় রাজা অষ্টকের কাছ থেকে, ৩০ দিন ধরে গ্রীকরা অষ্টক রাজার দুর্গ অবরােধ করে। শেষপর্যন্ত অষ্টক রাজা পরাজিত ও নিহত হন। ম্যাসিডােনিয় সেনারা অ্যাটকের কাছে সিন্ধু নদের উপর একটি সেতু তৈরি করেন এবং তারা আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে প্রধান বাহিনী আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

আলেকজান্ডার তাঁর মূল বাহিনী নিয়ে কাবুল নদের উত্তরদিক দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় অশ্বক রাজ্যের থেকে প্রবল বাধা পান। তিনি পশ্চিম অশ্বক রাজ্যকে পরাজিত করে পূর্বঅশ্বক রাজ্যে ঢুকে পড়েন। এই রাজ্যের রাজা তাঁর রাজধানী মুশকাবতী থেকে প্রবল বাধা দেন। অশ্বকদের ভাড়া করা ৭০০০ সেনা প্রবল যুদ্ধ করে। আলেকজান্ডার এই যুদ্ধে আহত হন। অশ্বক রাজা যুদ্ধে মারা যান।

৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আলেকজান্ডার তার অগ্রগামী সেনাদের তৈরি সেতুদিয়ে সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশীলা নগরীতে ঢুকে পড়েন। তক্ষশীলা থেকে আরাে এগিয়ে পূর্বে ঝিলামের তীরে উপস্থিত হন। এই নদীর অপরদিকে ছিল বড়াে পুরু রাজ্য। বড়ােপুরু একাই আলেকজান্ডারকে বাধা দিতে মনস্থির করেন। আলেকজান্ডার তার সঙ্গে সাক্ষাৎকরার জন্য পুরুরাজাকে দূত পাঠালে পুরু রাজা জানিয়ে দেন যে, যুদ্ধ ক্ষেত্রেই দেখা হবে। গ্রীক ঐতিহাসিকদের মতে পুরুর অধীনে ছিল ৩০০০০ পদাতিক, ৪০০০ অশ্বারােহী, ৩০০ রথ, দুইশত রণহস্তি।

৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ক্ষাররী প্রান্তরে উভয়পক্ষের তুমুল যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধকে বলে হিদাম্পিসের বা ঝিলামের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পুরু দারুণ বীরত্বের সঙ্গে লড়েও বন্দী হন। পুরু রাজার ব্যক্তিগত বীরত্বে আলেকজান্ডার মুগ্ধ হন। তিনি পুরুকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং পুরুকে সামন্ত সেনাপতি হিসাবে নিয়ােগ করেন।

সিন্ধু নদের মােহনায় বিখ্যাত পটলনী নগর আলেকজান্ডার আক্রমণ করেন ৩২৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। পটলনী নগরী জয় ছিল ভারতের মাটিতে তার শেষ জয়। এরপর আলেকজান্ডার দেশে ফিরে যাওয়া মনস্থির করেন। তিনি তার সেনাবাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করেন। একভাগ নিয়ারকাসের অধীনে সমুদ্র পথে ফিরে যায়। দ্বিতীয়ভাগ কান্দাহারের পথে ফিরে যায়। আলেকজান্ডার নিজে ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বালুচিস্তানের পথে পারস্যে ফিরে যান। ৩২৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তিনি পারস্যে ফেরেন। ৩২৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ব্যবিলনে তার মৃত্যু হয়।

আলেকজান্ডার হিন্দুকুশ পর্বত পার হবার পর ভারতে মােট ২ বছর ৫ মাস ছিলেন। এর মধ্যে ১০ মাস তিনি উত্তর পশ্চিমে উপজাতিদের দমন করেন। সিন্ধু থেকে বিপাশা পর্যন্ত জয় করতে তিনি ৭ মাস ব্যয় করেন। ফেরার পথে ঝিলাম ও সিন্ধুর মােহানা অঞ্চলের উপজাতিদের দমন করতে আরও ১০ মাস ব্যয় করেন। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে তিনি ১৯ মাস ভারতে অবস্থান করেন।

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতের যােগ ঘনিষ্ঠ হয়। গান্ধার শিল্প গড়ে ওঠে ভারত ও গ্রীক শিল্পের সমন্বয়ে। মুদ্রা ও রূপার দ্রাক্ষমায় গ্রিক প্রভাবের পরিচয় দেয়। ভারতবর্ষে দাস প্রথার উদ্ভব হয়। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্রীকপ্রভাব দেখা যায়।
ভারতীয় সংস্কৃত নাটকে যবনিকা বা পর্দার ব্যবহার শুরু হয়। গ্রিকদের ভারত আক্রমণের ফলে ভারত ইতিহাসের সন তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় এবং ভারতের লিখিত ইতিহাস রচনা শুরু হয়।

Short Notes on Magadha Empire (মগধের উত্থান)

  1. খিষ্টপূর্ব ৬ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হর্যঙ্ক বংশীয় রাজা বিম্বিসার মগধের সিংহাসন এ বসেন। তিনি ছিলেন মগধের প্রথম উল্লেখযোগ্য নরপতি এবং তার সময় থেকেই মগধের উত্থানের সূচনা হয়। তার শ্রেনিক বা সেনিয় উপাধি নিয়েও পণ্ডিতরা একমত নন।
  2. বিম্বিসার মাত্র পনেরো বছর বয়সে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেই সময় মগধের সিংহাসন দক্ষিণ বিহারের পাটনা গয়া জেলার মধ্যে সীমিত ছিল। তিনি মগধের সেনাবাহিনী কে নতুন ভাবে সজ্জিত করেন। তিনি সাধারণ মানুষদের নিয়ে সেনাবাহিনী গঠন করেন।
  3. প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পিত হলো যুবরাজের উপর।
  4. লোহা নির্মিত অস্ত্র দিয়েও সজ্জিত করা হয় সেনাবাহিনীকে।
  5. বিভিন্ন মহাজনপদগুলির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তিনি মগধের শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হন।
  6. বিম্বিসার এর অন্যতম রাজবৈদ্য ছিলেন জীবক।
  7. তার রাজ্যে ৮০ হাজার গ্রাম ছিল এবং তার রাজধানী ছিল গীরিব্রজ বা বর্তমান রাজগীর।
  8. তার সময় উচ্চ শ্রেণীর কর্মচারী রা তিনভাগে বিভক্ত ছিল। সর্বাথক, ব্যাবহারিক এবং সেনানায়ক।
  9. বিম্বিসার জমি জরিপ করে রাজস্ব ধার্য করতেন।
  10. গ্রামগুলি স্বাতত্ত্ব শাসন ভোগ করতে।
  11. ফসলের এক দশমাংশ কর হিসাবে আদায় করা হতো।
  12. তার আমলে বহু রাস্তাঘাট নির্মিত হয়।
  13. মগধ এ অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।
  14. বিম্বিসার বৌদ্ধ ও জৈন দুই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বৌধসংঘ কে বেনুবন দান করেন।
  15. মগধের পরবর্তী শাসক ছিলেন বিম্বিসার এর দ্বিতীয় পত্নী লিচ্ছবি রাজকন্যা চেল্ল- নার গর্ভজাত পুত্র অজাতশত্রু। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তিনি ছিলেন চম্পার শাসক। তার উপাধি ছিল কুনিক। তিনি ছিলেন এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক।
  16. তিনি প্রথমেই কোশল এর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি লিচ্ছবী রাজ্যের বিরুদ্ধেও তার দ্বিতীয় যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
  17. যুদ্ধ চালানোর অসুবিধা দেখা দেওয়ায় অজাতশত্রু গঙ্গা ও শোন নদীর সঙ্গমস্থলে পাটলি গ্রামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে এখানে মগধের রাজধানী পাটলিপূত্র নগরী গড়ে ওঠে।
  18. অজাতশত্রু যুদ্ধে মহা -শিলা- কণ্টক ও রথমুসল নামে দুটি নতুন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেন। প্রথম টি ছিল একটি উৎক্ষেপণ যন্ত্র,আর দ্বিতীয় টি হলো তীক্ষ্ম লৌহ ফলকযুক্ত এবং ধাতুনির্মিত একধরনের দুর্ভেদ্য রথ।
  19. প্রথম জীবনে বৌদ্ধ বিদ্বেষী হলেও পরবর্তীকালে অজাতশত্রু র মনোভাবে পরিবর্তন আসে এবং তিনি বুদ্ধ দেবের শরণাপন্ন হন। বুদ্ধ দেবের তিরোধানের পর রাজগৃহে যে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গিতির অনুষ্ঠান হয় তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
  20. জৈন ধর্মের প্রতিও তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং মহাবীরের সঙ্গে তার একাধিকবার সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়।
  21. অজাতশত্রু র পর কে বা কারা সিংহাসনে বসেন এই নিয়ে পুরাণ এবং বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি তে নানা মতপার্থক্য আছে। অজাতশত্রু র পর উদয়ভদ্র বা উদইন , অনিরুদ্ধ, মুণ্ড ও নাগদশক পরপর চারজন রাজা মগধের সিংহাসনে বসেন।
  22. উদয়ভদ্র বা উদয়িন এর প্রধান কৃতিত্ব হলো গঙ্গা ও শোন নদীর সঙ্গম স্থলে পাটলিগ্রমকে কেন্দ্র করে পাটলিপুত্র নগরীর নির্মাণ এবং সেখানে মগধের রাজধানী স্থানান্তর।
  23. তবে অজাতশত্রু র পর পর যারা যারা সিংহাসনে বসেছিলেন তারা সকলেই ছিলেন পিতৃহন্তা ও অযোগ্য শাসক।
  24. এই অবস্থায় সভাসদ শিশুনাগ হর্যঙ্ক বংশের শেষ নরপতি নগদশক কে হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করেন।
  25. শিশুনাগের পর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র কালাশোক বা কাকবর্ণ। তার আমলে মগধ উত্তর ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়। তিনি স্থায়ী ভাবে মগধের রাজধানী স্থানান্তর করেন পাটলিপূত্রে।
  26. তার আমলে বৈশালি তে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীত অনুষ্ঠিত হয়।
  27. হর্ষ চরিত এবং গ্রীক লেখকদের রচনা থেকে জানা যায় যে মহাপদ্ম নন্দ নামে জনৈক শুদ্র বংশীয় ব্যাক্তি কালা- শোক ও তার দশ পুত্র কে ছুরি কা ঘাতে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন। এইভাবে মগধের সিংহাসনে নন্দ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
  28. নন্দ বংশের রাজত্বকাল ছিল ৩৬৪ থেকে ৩২৪ খ্রিস্ট পূর্ব।
  29. মহাপদ্মনন্দ বিখ্যাত নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা।
  30. পুরাণ এবং জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্র গ্রন্থে তাকে নীচ বংশ সম্ভূত বা শুদ্র বলা হয়েছে।
  31. পুরাণের মতে মহা -পদ্ম নন্দ হলেন শিশুনাগ বংশের শেষ সম্রাট ও এক শুদ্র রমণীর সন্তান।বৌদ্ধ গ্রন্থে তাকে উগ্রসেন অর্থাৎ বিশাল বাহিনীর সেনাপতি বলা হয়েছে।
  32. মহা পদ্মের পূর্বে আর কোনও ভারতীয় নরপতি এত বড়ো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতে পারেননি।
  33. পুরাণে তাকে এক -রাট, দ্বিতীয় পরশুরাম বলা হয়েছে।
  34. ডক্টর রধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় এর মতে” মহাপদ্ম নন্দ ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট।”
  35. মহা -পদ্ম -নন্দ এর পর তার আট পুত্র একে একে মগধের সিংহাসনে বসেন। এদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
  36. মহা – পদ্ম – নন্দ এবং তার আট জন উত্তরাধিকারী কে একসঙ্গে নবনন্দ বলা হয়।
  37. এই বংশের শেষ রাজা ধননন্দ গ্রীক বীর আলেকজান্ডারে সমসাময়িক ছিলেন। তিনি এক সুবিশাল সাম্রাজ্য ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অধিপতি ছিলেন। তার সামরিক বলের ভয় এই গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের বিশ্ব জয়ী সেনাদল মগধের উপর আক্রমণ হানতে সাহস পায় নি।
  38. বিশাল সেনাবাহিনী পোষণ করার জন্য তিনি জনসাধারণের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দেন। এরফলে প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। যা চন্দ্রগুপ্ত এর মৌর্য বংশের উত্থানের সহায়ক হয়।
  39. চন্দ্রগুপ্ত র বংশ পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। কেউ তাকে ক্ষত্রিয় বংশজাত,আবার কেউ তাকে কুল- হীন বলেছেন। আবার বৌধগ্রন্থে তাকে মোরীয় গোষ্ঠীর নেতা র পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  40. চন্দ্রগুপ্ত এর উত্থানের সবথেকে বড় সহায় ছিলেন নন্দ শাসন বিদ্বেষী জনৈক বিচক্ষণ ব্রাহ্মণ চানক্য, কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত।
  41. চন্দ্রগুপ্ত নন্দ দের উচ্ছেদের জন্য গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ কালে তার সহযোগিতা চান। আলেকজান্ডার তার নির্ভীক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে হত্যার আদেশ দেন। চন্দ্রগুপ্ত কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে বিন্ধের ঘন অরণ্যে আশ্রয় নেন। অরণ্যের যবন, কিরাত, কম্বোজ প্রভৃতি জাতির মানুষ দের নিয়ে তিনি একটি সেনাদল গড়ে তোলেন। অর্থশাস্ত্রে এদের আয়ুধ- জীবিন অর্থাৎ যারা অস্ত্রের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে বলে বলা হয়েছে।
  42. চন্দ্রগুপ্ত প্রথম বার যখন পাটলিপুত্র র উপর আক্রমণ হানেন, তখন তিনি পরাজিত হন। দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় তিনি জয়ী হন এবং ধননন্দ নিহত হন।

Short Question-Answer on Magadha Empire (মগধের উত্থান)

  1. মৌর্যদের আগে প্রাচীন ভারতের অর্থনীতি কীরপ ছিল ?
    উঃ মৌর্যদের আগে প্রাচীন ভারতের অর্থনীতি ছিল কৃষি ও কুটিরশিল্পভিত্তিক।
  2. হিদম্পিসের যুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়েছিল ?
    উঃ হিদম্পিসের যুদ্ধ আলেকজান্ডার ও পুরুরাজের মধ্যে হয়েছিল।
  3. খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের একটি প্রজাতান্ত্রিক জনপদের নাম উল্লেখ করাে।
    উঃ বৃজি (বা মল্ল) ছিল খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের একটি প্রজাতান্ত্রিক জনপদ।
  4. ষােড়শ মহাজনপদের মধ্যে কোন্ মহাজনপদ কালক্রমে সাম্রাজ্যে পরিণত হয় ?
    উঃ ষােড়শ মহাজনপদের মধ্যে মগধ কালক্রমে সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
  5. মগধের প্রাচীনতম রাজধানীর নাম কী ছিল ?
    উঃ মগধের প্রাচীনতম রাজধানীর নাম ছিল গিরিব্রজ।
  6. রাজগৃহ-এ কে মগধের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন?
    উঃ বিম্বিসার রাজগৃহ-এ মগধের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
  7. বিম্বিসার কে ছিলেন?
    উঃ বিম্বিসার ছিলেন মগধের হর্ষঙ্ক বংশের রাজা।
  8. বুদ্ধদেবের সমসাময়িক মগধের শাসক কে ছিলেন?
    উঃ বুদ্ধদেবের সমসাময়িক মগধের শাসক ছিলেন বিম্বিসার।
  9. অজাতশত্রু কে ছিলেন ?
    উঃ অজাতশত্রু ছিলেন মগধের সম্রাট ও বিম্বিসারের পুত্র।
  10. কুণিক কার উপাধি?
    উঃ অজাতশত্রুর উপাধি কুণিক।
  11. উদয়িন কে ছিলেন?
    উঃ উদয়িন ছিলেন হর্ষঙ্ক বংশীয় সম্রাট অজাতশত্রুর পুত্র। তাঁর আমলে পাটলিপুত্র নগরীর নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়।
  12. হর্ষঙ্ক বংশের শেষ সম্রাট কে ছিলেন ?
    উঃ নাগদশক ছিলেন হর্ষঙ্ক বংশের শেষ সম্রাট।
  13. পাটলিপুত্র নগরী কোথায় অবস্থিত ছিল ?
    উঃ পাটলিপুত্র নগরী বর্তমান পাটনার কাছে গঙ্গা ও শােন নদীর  সংগমস্থলে অবস্থিত ছিল।
  14. পাটলিপুত্র নগরী কে প্রতিষ্ঠা করেন ?
    উঃ পাটলিপুত্র নগরী অজাতশত্রু নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পুত্র উদয়ন বা উদয়ভদ্র এই নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন।
  15. শিশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ?
    উঃ শিশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিশুনাগ।
  16. মগধের কোন সম্রাট বৈশালীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন ?
    উঃ মগধের সম্রাট শিশুনাগ বৈশালীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
  17. নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ?
    উঃ নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহাপদ্ম নন্দ।
  18. নন্দ বংশের শেষ রাজা কে ছিলেন ?
    উঃ নন্দ বংশের শেষ রাজা ছিলেন ধননন্দ।

আরো পড়ুন :

হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা
বৈদিক সভ্যতা
ষোড়শ মহাজনপদ
মৌর্য বংশের উত্থান ও পতন
মৌর্য বংশের উত্থান ও পতন
সাতবাহন বংশ | কুষান শাসন
গুপ্ত সাম্রাজ্য
বলভীর মৈত্রক বংশ | বাকাটক বংশ | মৌখরী বংশ | কলিঙ্গ | বাংলা | থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশ
চোল বংশ | চালুক্য বংশ | পল্লব বংশ
ভারতের ইতিহাস

Leave a Comment

Scroll to Top