মারাঠা শক্তির উত্থান ও পতন | মারাঠা সম্রাট | ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ

মারাঠা শক্তির উত্থান ও পতন

বালাজি বিশ্বনাথ (১৭১৩-১৭২০)

১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে শাহু বালাজি বিশ্বনাথকে পেশােয়া পদে নিয়ােগ করেন এবং সেনাকর্তা উপাধি দেন। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে খেদ-এর যুদ্ধে শাহু সাতারা দখল করেন। এবং সাতারার সিংহাসনে বসেন। বালাজি বিশ্বনাথ সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে একটি সন্ধি করেন ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে। মুঘলরা শাহুকে নিজ রাজ্যের রাজা হিসাবে স্বীকার করেন এবং শাহুকে ছটি মুঘল প্রদেশ (ঔরঙ্গাবাদ, বেরার, বিদর, বিজাপুর, গােলকুন্ডা ও খান্দেশ) এর চৌথ ও সরদেশমুখী কর আদায়ের অনুমতি দেন। শাহু মুঘলদের বার্ষিক ১০ লক্ষ টাকা কর দিতে সম্মত হন। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে মারাঠা নৌবাহিনীর প্রধান কঙ্গোজি আংরের সঙ্গে বালাজি বিশ্বনাথের নােনাবেলার সন্ধি হয়। ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের সঙ্গে সন্ধিকে স্যার রিচার্ড টেম্পল ‘মারাঠা সাম্রাজ্যের ম্যাগনাকার্টা’ বলে অভিহিত করেন।

প্রথম বাজিরাও (১৭২০-১৭৪০)

১৭২০ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সে পেশােয়া পদে বসেন। তিনি গেরিলাযুদ্ধ পদ্ধতিতে পারদর্শী ছিলেন। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে বলপুরের যুদ্ধে, ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে পালখেটের যুদ্ধে, ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে ধাবােই-এর যুদ্ধে এবং ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে দুরাইশারাই-এর যুদ্ধে নিজামকে পরাস্ত করেন। দুরাইশারাই সন্ধি দ্বারা নিজামের কাছ থেকে মালব ও বুন্দেলখন্ড দখল করেন। নিজামের সঙ্গে ধাবই-এর যুদ্ধের ফলে নিজাম শাহুকে মারাঠা অধিপতি ও দাক্ষিণ্যাত্যে চৌথ ও সরদেশমুখী অধিকারের অধিকারী বলে মেনে নেন। দুরাইশরাই সন্ধি দ্বারা প্রথম বাজিরাও নিজামের থেকে ৫০ লক্ষ টাকা পান। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে জানজিরার সিদ্ধিদের তিনি পরাস্ত করে বিতাড়িত করেন। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাজিরাওয়ের ভাই চিমজি আপ্পারাও-এর নেতৃত্বে । মারাঠারা পাের্তুগীজদের পরাজিত করে সলসেট ও বেসিন দখল করেন। প্রথম বাজিরাওয়ের সময় নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন। প্রথম বাজিরাও \’হিন্দু-পাদ-পাদশাহি’র আদর্শ প্রচার করেন।
   প্রথম বাজিরাওয়ের সময় মারাঠা শক্তি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যথা বরােদার গায়কোয়াড, নাগপুরের ভোসলে, ইন্দোরের হােলকার, গােয়ালিয়রের সিন্ধিয়া এবং পুনার পেশােয়া। প্রথম বাজিরাওকে বলা হয় মারাঠা জাতির নেপােলিয়ান ও মারাঠা জাতির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা।

বালাজি বাজিরাও (১৭৪০-১৭৬১)

১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে শাহুর মৃত্যুর পর রাজারামকে সিংহাসনে বসান এবং পরবর্তীকালে তাকে সাতারায় বন্দী করে রাখেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আহম্মদ শাহের সঙ্গে তাঁর সন্ধি হয়। মুঘল সম্রাট উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল, আগ্রা ও আজমীরের চৌথ আদায়ের দায়িত্ব বালাজি বাজিরাওকে দেন। তার আমলে মারাঠারা, মহীশূর,কর্ণাটক, অ্যাটক এবং পাঞ্জাব দখল করে। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে উদগীরের যুদ্ধে মারাঠারা নিজামকে পরাস্ত করে। ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁর সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধি হয় ও আলিবর্দী বার্ষিক ১২লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে আফগান নেতা আহম্মদশাহ আবদালীর হাতে মারাঠারা পরাস্ত হয়। বালাজি বাজিরাও-এর ভাই সদাশিব রাও, পুত্র বিশ্বাস রাওসহ অন্যান্য মারাঠা নেতা এবং ১৮ হাজার মারাঠা সেনা নিহত হয়। বালাজি বাজিরাও ভগ্ন হৃদয়ে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন মারা যান।

প্রথম মাধবরাও (১৭৬১-১৭৭২)

মালব ও বুন্দেলখন্ড মারাঠা সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং জাঠ ও রাজপুতরা মারাঠাদের চৌথ দানে বাধ্য হয়। মুঘলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে দিল্লীর সিংহাসনে বসতে সাহায্য করেন এবং হায়দারআলিকে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে নিজামের কাছে মারাঠারা পরাস্ত হয় ও নিজাম শিবানির দৌলতাবাদ, আসীরগড় ও আহম্মদনগর দুর্গ দখল করেন। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে নিজাম পুনা লুঠ করেন জ্ঞানজি ভোসলে গােপাল রাও পটবর্ধনের সহযােগিতায়। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাক্ষসভূবনের যুদ্ধে মারাঠার নিজাম সেনাপতি ভিত্তাল সুন্দরকে পরাস্ত করেন। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মাধবরাওয়ের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় শাহ আলমকে সিংহাসনে বসানাের জন্য তিনি মহাদজি সিন্ধিয়াকে পাঠান।

নারায়ণ রাও (১৭৭২-১৭৭৩)

নারায়ণ রাও সিংহাসনে বসলে কাকা রঘুনাথ রাও তাকে হত্যা করে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে নিজে পেশােয়াপদ দখল করেন। কিন্তু নানাফড়নবীশ ও অন্যান্য মারাঠা নেতা রঘুনাথ রাওকে মানতে অস্বীকার করেন এবং মৃতনারায়ণ রাওয়ের বিধবা পত্নী গঙ্গাবাই এর একটি পুত্রসন্তান হলে মারাঠা নেতৃবৃন্দ রঘুনাথ রাওকে বিতাড়িত করে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মাধবরাও বা মাধবরাও নারায়ণকে পেশােয়া পদে প্রতিষ্ঠিত করেন।

প্রথম ঈঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮২)

রঘুনাথ রাও পেশােয়া পদ পুনরুদ্ধারের জন্য ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৭ মার্চ ইংরেজদের সঙ্গে সুরাটের সন্ধি করেন। সন্ধির শর্তানুসারে স্থির হয় রঘুনাথ রাওকে ইংরেজ ২৫০০ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে ও তার ব্যয় রঘুনাথ রাও বহন করবেন। রঘুনাথ রাও সুরাট ও ব্রোচ-এর রাজস্বের এক অংশ এবং সলসেট ও বেসিন ইংরেজদের দিতে রাজি হন। রঘুনাথ রাও ও ইংরেজদের যুগ্ম বাহিনী আরাসের যুদ্ধে পেশােয়াকে পরাস্ত করে ১৭৭৫ এর মে মাসে। ওয়ারেন হেস্টিংস সুরাট সন্ধি মানেন নি ও কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট সুরাটের সন্ধি বাতিল করে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে পুরন্দরের সন্ধি করেন। সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা রঘুনাথ রাওয়ের পক্ষ ত্যাগ করে এবং রঘুনাথ রাওকে গুজরাটের কোষারগাঁওয়ে বসবাস করার এবং বছরে তিনলক্ষ টাকার বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করেন। সলসেট ও থানা ইংরেজরা পায় এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ১২লক্ষ টাকা নিয়ে দ্বিতীয় মাধবরাওকে পেশােয়া বলে মেনে নেয়। ভারতের মেকিয়াভেলি’ নানাফড়নবীশের কাছে রঘুনাথ রাও ও ইংরেজদের সকল চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। নানা ফড়নবীশের আসল নাম ছিল বালাজি জনার্দন এবং ফড়নবীশ ছিল তার পদ। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে তেলেগাঁওয়ের যুদ্ধে ইংরেজরা পরাস্ত হয় এবং ওয়াড়গাঁওয়ের সন্ধি করে। ওয়ারেন হেস্টিংস সন্ধি মানেন না ও যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে মহাদজি সিন্ধিয়ার মধ্যস্থতায় পেশােয়া ও ইংরেজদের মধ্যে সবাইয়ের সন্ধি হয়।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০৩-১৮০৫)

১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মহান রাজনীতিবিদ নানাফড়নবীশকে বন্দী করেন মিখেল তিলাে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে মারাঠারা টিপু সুলতান ও ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে নিজামের সঙ্গে খারদার চুক্তি করে। নানাফড়নবীশের বদলে মারাঠা রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন নরপন্থ চক্রদেব। দৌলতরাও সিন্ধিয়া ও যশবন্তরাও হােলকার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব হলে দ্বিতীয় বাজীরাও সিন্ধিয়ার পক্ষ নেন এবং হােলকারের কাছে পরাস্ত হয়ে পালান। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বাজিরাও ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের চুক্তি করেন। সিন্ধিয়া ও ভোসলে বেসিনের চুক্তি মানতে অস্বীকার করলে আর্থার ওয়েলেসলি ১৮০৩-০৫ খ্রিস্টাব্দে অসই, ওয়াড়গাঁও, দিল্লী ও লাসওয়ারির যুদ্ধে সিন্ধিয়া ও ভেঁসলেকে পরাস্ত করে। ইংরেজদের সঙ্গে ভোঁসলে সুরজ, অর্জুনগাঁও ও দেওগাঁওয়ের সন্ধি স্বাক্ষর করেন ও অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতি মেনে নেন। হােলকার এরপর ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে দিগের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে রণজিৎ সিং-এর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে রণজিৎ সিং ফিরিয়ে দেন। কিন্তু ওয়েলেসলি স্বদেশে ফিরে গেলে হােলকার রক্ষা পান।

তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৮১৯)

গায়কোড়দের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন গঙ্গাধর শাস্ত্রী। পেশােয়ার বিশ্বস্ত মন্ত্রী ত্রিম্বকজি ডিংলেকে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এলফিনস্টোন গ্রেপ্তার করলে পেশােয়া ক্ষুব্ধ হন। কোম্পানী পিন্ডারী দস্যুদের দমনে উদ্যোগী হলে পিন্ডারী নেতা করিম খাঁ, ওয়াশিল মহম্মদ ও চিতু পেশােয়ার সঙ্গে যােগ দেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস পেশােয়াকে পুনার সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। সন্ধির শর্তানুসারে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও মারাঠা সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব ত্যাগ করেন, রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেন এবং বিনা অনুমতিতে কারাের যােগাযােগ স্থাপনে বিরত থাকেন।
   পেশােয়া বিদ্রোহ ঘােষণা করলে সিন্ধিয়া, হােলকার ও ভোসলে তার সঙ্গে যােগ দেয়। ভোসলের আগ্লা সাহেব ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে সীতাবলদীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ফিটজেরাল্ডের কাছে পরাস্ত হন। তিনি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নেন। হােলকার বিতল বা ভিটল রাও ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছে মাহিতপুরের যুদ্ধে পরাস্ত হন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে পেশােয়া কোরেগাঁও, কিরকি এবং অস্টির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতি মেনে নেন। পেশােয়া পদ লুপ্ত করে তার রাজ্য কোম্পানীর সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ও তাকে বার্ষিক ৮.৫ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়ে বিরে নির্বাসন দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বাজিরাও ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। সারা রাজ্যে শিবাজির বংশধর প্রতাপ সিংহকে বসানাে হয়। দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের দত্তকপুত্র ছিলেন নানাসাহেব বা ধপন্থ।
   ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস শাহবাদের যুদ্ধে করিম খা ও আসমান খানকে পরাস্ত করেন। পিন্ডারীদের দমন করতে কোটা বুন্ডি, ভােপাল, যােধপুর ও জয়পুরের রাজাদের সঙ্গে সন্ধি করেন। তাতিয়া যােগ ও ম্যালকমের মধ্যস্থতায় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ৬ জানুয়ারী মান্দাশাের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দ্বিতীয় মলহর রাও হােলকার ও ইংরেজদের মধ্যে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে গোয়লিয়রের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দৌলতরাও সিন্ধিয়া ও ইংরেজদের মধ্যে।

Leave a Comment

Scroll to Top