ভারত ও ভারতের বাইরে বৈপ্লবিক আন্দোলন (Revolutionary Movement in India and abroad)
বাংলায় বৈপ্লবিক আন্দোলন
অনুশীলন সমিতি (১৯০২) : বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শে ব্যারিস্টার পি. মিত্র-এর সভাপতিত্বে কলকাতায় অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির অপর দুই সদস্য ছিলেন বারিন্দ্র কুমার ঘােষ ও যতীন্দ্র নাথ ব্যানার্জি। ২১নং মদন মিত্র লেনে অনুশীলন সমিতি গঠিত হয়। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় পুলিনবিহারি দাশ অনুশীলন সমিতি গঠন করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তারা বর্তমান রণনীতি’ নামে একটিপুস্তিকা প্রকাশ করে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ভুপেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় ও বারীন্দ্রকুমার ঘােষের সহযােগিতায় যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশিত হয়। \’মুক্তি কোন পথে’ শিরােনামে তারা একটি বই প্রকাশ করে।যুগান্তর দল : ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে অনুশীলন সমিতির স্মৃতি ক্রমশ মুছে গিয়ে এই দল যুগান্তর নামে পরিচিতি পায়। যুগান্তর দল দুর্গা পূজা করত। এই দলের প্রধান সদস্য ছিলেন বারীন্দ্রকুমার ঘােষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। বােমা তৈরির শিক্ষা নিতে মেদিনীপুরের হেমচন্দ্র দাস কানুনগাে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে প্যারিসে যান। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বারীন ঘােষ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার ও স্যার এন্ডু ফ্রেজারকে (গভর্নর) হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট অ্যালেন সাহেবের উপর গুলি চলে। চন্দননগরের মেয়র তাদ্দিভেলের বাড়িতে বােমা পড়ে। কুষ্টিয়ার পাদ্রী হিকেন বথেমকে গুলি করা হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০ এপ্রিল দুই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি কিংসফোর্ডকে (বাংলার মুখ্য প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট) হত্যার চেষ্টা করেন কিন্তু তারা ভুল করে মিসেস কেনেডি ও কন্যাকে হত্যা করেন। এই ঘটনাটি ঘটে বিহারের মজঃফরপুরে। প্রফুল্ল চাকি গুলি করে আত্মহত্যা করেন ও ক্ষুদিরাম বসু মােকামাঘাটে ধরা পড়েন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট তার ফাঁসি হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর বােমা মামলা শুরু হয়। অরবিন্দ, বারীন্দ্র সহ মােট ৪৭জন বিপ্লবীকে নিয়ে। নরেন গোঁসাই নামে জনৈক বিপ্লবী রাজসাক্ষী হলে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্র বসু দুই বিপ্লবী জেলের মধ্যে নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন। বিচারে তাদের দুজনের ফাঁসি হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘অনুশীলন সমিতি’ ও ‘যুগান্তর\’ নিষিদ্ধ হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলায় সরকারি উকিল আশুতােষ বিশ্বাস ও ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট শামসুল আলম হাইকোর্টের ভেতরে গুলিতে নিহত হন।
বাংলার আরাে কয়েকটি গুপ্ত সমিতি হল ময়মনসিংহের সাধনা ও সুহৃদ সমিতি, ফরিদপুরের ব্রতী সমিতি, ঢাকার সংঘ সমিতি। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহমূলক জনসভা নিবারক আইন সরকার প্রবর্তন করেন।
মহারাষ্ট্র : অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে মহারাষ্ট্রে বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের নেতৃত্বে প্রথম গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। তাকে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য রােহিলা সর্দার ইসমাইল খাঁ ৫০০ জন্য রােহিলা দিয়ে সাহায্যে সম্মত হন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ফাড়কেকে বন্দী করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর করা হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে যক্ষ্মাতে তার মৃত্যু হয়। ফাড়কেকে ভারতের বৈপ্লবিক \’জাতীয়তাবাদের জনক’ বলা হয়।
ঠাকুর সাহেব উদয়পুরে গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে দামােদর হরি চাপেকর ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর নামে দুই ভাইয়ের উদ্যোগে পুনায় বিনাশী সঙ্গ নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পুনায় প্লেগকে কেন্দ্র করে চাপেকার ভ্রাতৃদ্বয় মি. র্যান্ড ও লে. আয়াস্ট কে হত্যা করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিনায়ক দামােদর সাভারকর \”মিত্রমেলা\” নামে একটি সঙঘ স্থাপন করেন নাসিকে। এই সঙঘটি ছিল। মহারাষ্ট্র তথা ভারতের প্রথম বৈপ্লবিক সঙঘ। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ‘অভিনব ভারত’ প্রতিষ্ঠা করেন সাভারকরের বড় ভাই গণেশ সাভারকর। এর সদস্যরা ছিলেন মির্জা আব্বাস, হেমচন্দ্র দাস, পি. এন. বাপাট, আচার্য কৃপালনি, বি. জে. খের প্রমুখ। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সাভারকর লন্ডনে যান এবং তিনি বােম্বাইয়ের বিপ্লবীদের কাছে অস্ত্র ও বােমা তৈরীর নিয়মাবলী পাঠান। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অনন্ত লক্ষ্মণ কানহেরি নাসিকের জেলাশাসক জ্যাকসনকে হত্যা করেন, বিচারে তার ফাঁসি হয়। ১৯০৯-১০ খ্রিস্টাব্দে নাসিক ও গােয়ালিয়র ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় ও লন্ডনে সাভারকরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তার ২৬ বছর কারাদন্ড হয়। দেশবাসী তাঁকে \’বীর সাভারকর’ উপাধি দেয়।
মহারাষ্ট্রের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য গুপ্ত সমিতি ছিল বালসমাজ, আর্যবান্ধব সমাজ, ইত্যাদি। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাসুদেব চাপেকর ডেভিডকে হত্যা করেন।
পাঞ্জাব : ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে প্রবাসী বাঙালী জে. এম. চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সাহারানপুরে প্রথম বিপ্লবী কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এই সমিতির কর্মকেন্দ্র রুড়কিতে স্থানান্তর করা হয়। এর সদস্যরা ছিলেন লালা দয়াল, অজিত সিং, সুফী অম্বাপ্রসাদ প্রমুখ। পাঞ্জাবে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন রাসবিহারী বসু। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর বড়লাট হার্ডিঞ্জের উপর চন্দননগরের তৈরী বােমা নিক্ষেপ করেন বসন্ত বিশ্বাস। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে পাঞ্জাবের সহকারী পুলিশ কমিশনার গর্ডনকে হত্যার জন্য রাসবিহারীর নির্দেশে লাহােরে লরেঞ্জ গার্ডেনে বােমা রাখা হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ আমীর চঁাদ, অবােধবিহারী, বালমুকুন্দ ও বসন্ত বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারী দেশজুড়ে সামরিক ডাক দেন রাসবিহারী বসু। যতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়কে বাংলা,নলিনী মুখােপাধ্যায়কে জব্বলপুর ও শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে বারানসীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কৃপাল সিং নামে জনৈক বিশ্বাসঘাতক এই সংবাদ ফাস করে দিলে ১৯ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের দিন ধার্য হয়। সেই দিনটিও তিনি ব্রিটিশদের জানিয়ে দেন। বিপ্লবী পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
মীরাটের সেনা ছাউনিতে প্রচারকার্য চালাতে গিয়ে পিংলে ১০টি বােমাসহ ধরা পড়েন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী বসু পি. এন. ঠাকুর ছদ্মনামে জাপানে চলে যান ও এক জাপানী মহিলাকে বিবাহ করে সেখানে বৈপ্লবিক কর্মকান্ড গড়ে তােলেন। প্রথম লাহাের ষড়যন্ত্র মামলায় ২৪জনের ফাঁসি ও ২৭ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। কিন্তু বড়লাটের আদেশে ৭জনের ফাঁসি ও ১৭ জনের যাবজ্জীবন হয়। ৭ জনের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন পিংলে, কর্তার সিং, জগত সিং, হরনাম সিং প্রমুখ। ১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় লাহাের ষড়যন্ত্র মামলায় ৬ জনের ফাঁসি ও ৪৫ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ঘটে। তৃতীয় লাহাের ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯১৬-১৬) ৫ জনের ফাঁসি হয়।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভগত সিং, আজাদ ও রাজগুরু লাহােরের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশােধ নিতে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৮ এপ্রিল ভগত সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে বােমা নিক্ষেপ করেন পাবলিক নিরাপত্তা বিল ও ট্রেডস ডিসপিউট বিলের প্রতিবাদে। ভগত সিং, রাজগুরু ও শুকদেব এর বিরুদ্ধে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহাের ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। এই তিনজনের ফাঁসি হয়। যতীন দাস লাহাের ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলাকালীন ৬৪ দিন অনশনে প্রাণত্যাগ করেন।
কোমাগাতামারু ও তােষামারু (১৯১৪-১৫) : বাবা গুরদীৎ সিং জাপানি কোমাগাতামারু নামে একটি জাহাজ ভাড়া করে ৩৭৬ জন যাত্রীকে নিয়ে কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৩ মে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে জাহাজটি কানাডার ভ্যাঙ্কুবারে পৌছয়। কিন্তু কানাডা সরকার জাহাজটি কানাডা ত্যাগে বাধ্য করে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর জাহাজটি বজবজে এলে ইংরেজ সরকার বিশেষ ট্রেনে সকলকে পাঞ্জাবে পাঠানাের ব্যবস্থা করে। কিন্তু যাত্রীরা আপত্তি করলে সামরিক বাহিনী গুলি চালায়। ফলে ১৮ জনের মৃত্যু হয় ও ২০০ জনকে বন্দী করে পাঞ্জাবে পাঠানাে হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে ১৭৩ জন শিখ যাত্রীকে নিয়ে তােমারু নামে একটি জাহাজ আমেরিকা থেকে কলকাতা এলে যাত্রীদের বন্দী করে পাঞ্জাবে পাঠানাে হয়। এদের মধ্যে ১০০ জনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড ও ৭৩ জনকে নজরবন্দী করে রাখলে তারা পালিয়ে গিয়ে বিপ্লবী দলে নাম লেখান।
হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসােসিয়েশান : ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় কানপুরে। প্রতিষ্ঠা করেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, যােগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রামপ্রসাদ বিসমিল। ১৯২৫-এর ৭ আগস্ট কাকোরি ট্রেন লুঠ করেন এই প্রতিষ্ঠানের সভ্যরা। রামপ্রসাদ বিসমিল, রােশনলাল, আসফাকুল্লা, রাজেন্দ্র লাহিড়ী ধরা পড়েন ও চন্দ্রশেখর আজাদ পালিয়ে যান। এই ৪ জনের বিরুদ্ধে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করা হয়।
হিন্দুস্থান সােসালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসােসিয়েশান : ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুস্থান সােসালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসােসিয়েশান প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রশেখর আজাদ। এই সংগঠনের উল্লেখযােগ্য সদস্য ছিলেন বিজয় কুমার সিনহা, শিবভার্মা, জয়দেব কাপুর, ভগবতীচরণ ভােরা, ভগত সিং, শুকদেব, বটুকেশ্বর দত্ত প্রমুখ।
হিন্দুস্থান সােসালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি : ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লির ফিরােজ শাহ কোটলায় এই সংগঠন গঠিত হয়। প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভগত সিং, যতীন্দ্রনাথ সান্যাল, অজয় ঘােষ ও ফনীন্দ্রনাথ ঘােষ। এই বাহিনীর নাম হয় HSRA। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে দিল্লীর কাছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর এই সংগঠন বােমা রাখে বড়লাট আরউইনের ট্রেন উড়িয়ে দেবার জন্য। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফ্রেব্রুয়ারি এলাহাবাদের আলফ্রেড পার্কে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে চন্দ্রশেখর আজাদ মারা যান। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ ভগত সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাসি হয়। ভগত সিং প্রথম \’ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তিনি নওজোয়ান ভারতসভা নামে একটি যুবসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
• অন্যান্য বৈপ্লবিক কার্যকলাপ :
1. ভারতমাতা অ্যাসােসিয়েশনের সদস্য বাঞ্চি আইয়ার ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনেভেলির জেলাশাসক অ্যাসকে গুলি করে হত্যা করেন ও নিজে আত্মহত্যা করেন।
2. শ্রীরামপুরে জীতেন্দ্রনাথ লাহিড়ী জার্মানি থেকে ফিরে এসে বাংলায় বিপ্লবী দলে নাম লেখান। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (M. N. Roy) সি. মার্টিন ছদ্মনামে বাটাভিয়া যান। কলকাতার বিপ্লবী বড়া কোম্পানির ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬ হাজার কার্তুজ লুঠ করেন। বিপ্লবীরা শ্রমজীবী সমবায় ও হ্যারি এন্ড সনস নামে দুটি দোকান খােলেন এবং উড়িষ্যার বালেশ্বরে খােলা হয় ইউনিভার্সাল এম্পােরিয়াম। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি থেকে অ্যানিলার্টেন, হেনরী এস. ও মাভেরিক নামে তিনটি জাহাজে অস্ত্র আসার কথা ছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট এর সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় (বাঘাযতীন) ও তার চার সঙ্গীর যুদ্ধ হয় উড়িষ্যার বুড়িবালাম নদীর তীরে। এতে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান, বাঘাযতীন বালেশ্বরে হাসপাতালে মারা যান, মনােরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন দাশগুপ্তের ফাসি হয়। জ্যোতিষ পাল কারাগারে মারা যান।
3. বারানসীতে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ চালাতেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, গিরিজা দত্ত, নলিনী মুখার্জি ও কাপলে। ১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে বারানসী ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। শচীন্দ্রনাথের দ্বীপান্তর হয় (শচীন্দ্রনাথ বন্দীজীবন গ্রন্থ লেখেন)। বিপ্লব দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ৪নং ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাকট এবং ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাশ করেন।
4. ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবীরা মাষ্টারদা বা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। সঙ্গে ছিলেন লােকনাথ বল, গণেশ ঘােষ প্রমুখ। নারী বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ১৯ এপ্রিল ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে বিপ্লবীদের জালালাবাদের পাহাড়ে যুদ্ধ হয়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরােপিয় ক্লাবে আক্রমণ করে মারা যান। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে এক বিশ্বাসঘাতক সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেন ও তাঁর ফাসি হয়।
বাংলার বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামে একটি গােষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন হেমচন্দ্র ঘােষ। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগষ্ট ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালে বিনয় বসু পুলিশের ইনসপেকটর জেনারেল লােম্যানকে গুলি করে হত্যা করেন ও ঢাকার পুলিশ সুপারিনটেনডেনট হাডসনকে গুলি করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন। কারা বিভাগের অধিকর্তা সিম্পসনকে এবং ক্রেগ নামে এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করেন। লালবাজারের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে রাইটার্সে তাদের অলিন্দ যুদ্ধ হয়। বাদল গুপ্ত আত্মহত্যা করেন। বিনয় বসু আত্মহত্যা করতে গিয়ে আহত হন এবং পরে মারা যান। দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসির আদেশ দেন বিচারক আর. গারলিক।
বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আর. গারলিককে হত্যা করেন, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘােষ মেদিনীপুরের জেলাশাসক পেডিকে, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রদ্যোত ভট্টাচার্য। ডগলাসকে, ও ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্ত বার্জকে হত্যা করে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে শান্তি ঘােষ ও সুনীতি চৌধুরি নামে দুই স্কুল ছাত্রী কুমিল্লার জেলাশাসক স্টিভেনসনকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ডায়াশেসন কলেজের ছাত্রী বীণা দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার গভর্নর জ্যাকসনকে গুলি করে।
• ভারতের বাইরে বিপ্লবী কার্যকলাপ :
1. বার্লিনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ফন বেনহার্টির ‘জার্মান ও পরবর্তী যুদ্ধ’ গ্রন্থে বলা হয় যে, বাংলার বিপ্লবীরা জার্মানির পক্ষ নিয়ে ইংরেজদের ঘায়েল করবে। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে বার্লিন কমিটির পক্ষ থেকে কাবুলে পাঠানাে হয়। মৌলানা বরকতুল্লা ও ওবেদুল্লা সিন্ধিয়া কাবুলে একটি অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বন্ধুভাবাপন্ন ভারতীয়রা জার্মান সমিতি গঠন করে। এর নাম বার্লিন কমিটি।
2. ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল পার্টি : এটি জুরিখে প্রতিষ্ঠা করেন চম্পক রমন পিল্লাই। এই কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন হরদয়াল, তারকনাথ, বরকতুল্লা, চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী ও হেরম্বলাল।
3. প্যারিস ইন্ডিয়ান সােসাইটি : প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভিখাজি রুস্তম কামা। তাকে ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী বলা হয়। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন সর্দার সিং রানা, এম. পি. টি. আচার্য, কে, আর, কোতােয়াল। সর্দার সিং রানা বন্দেমাতরম, তলােয়ার, ইন্ডিয়ান ফ্রিডাম ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করতেন।
4. প্যান ইসলামিক পার্টি : মহেন্দ্র প্রতাপ এর প্রতিষ্ঠাতা ও এর প্রধান দপ্তর ছিল কাবুলে। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন এবং বরকতুল্লা হন প্রধান সচিব ও ওবেদুল্লা স্বরাষ্ট্র সচিব। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ওবেদুল্লা একটি সিল্কের কাপড়ের উপর একটি গােপন পত্র লিখে মক্কায় মৌলবী মামুদ হাসান কে পাঠান। পত্রটি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গেলে মুসলিম বিপ্লবীদের গ্রেফতার করা হয়। স্নিক লেটার কন্সপিরেশি বা রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে।
5. গদর পার্টি : ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সানফ্রানসিসকোতে গদর পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন লালা হরদয়াল ও সােহন সিং ভাকনা। গদর শব্দের অর্থ বিপ্লব। এর প্রধান দপ্তর ছিল যুগান্তর আশ্রম (সানফ্রানসিসকো)। সােহন সিং ভাকনা ছিলেন সভাপতি। লালা হরদয়াল ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারী। কাসিরাম ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। গদর পার্টির পুরােনাে নাম ছিল হিন্দু অ্যাসােসিয়েশান। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে দলের মুখপাত্র গদর পত্রিকা প্রকাশিত হয় গুরুমুখী, হিন্দী, ইংরাজী ও উর্দু এই চারটি ভাষায়।6. ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া শহরে তারকনাথ দাস ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ফ্রি হিন্দুস্থান পত্রিকা প্রকাশ করতেন।
7. ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ইন্ডিয়ান হােমরুল সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা। তিনি ইংল্যান্ডে ইন্ডিয়ান সােসিওলজিস্ট নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউস নামে একটি ছাত্রাবাস (ভারতীয় ছাত্রদের জন্য) নির্মাণ করেন। শ্যামজি প্যারিসে চলে গেলে সাভারকরের উপর ইন্ডিয়া হাউসের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ১ জুলাই মদনলাল ধিংড়া নামে এক তরুণ ইংরেজ সিভিলিয়ান কার্জন ওয়াইলিকে হত্যা করেন। বিচারে ধিংড়ার ফাঁসি হয়।
৪. ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জাপানে রাসবিহারী বসু দ্য ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও মহাত্মা গান্ধী :-মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) : ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ২ অক্টোবর গান্ধীর জন্ম গুজরাটের পােরবন্দরে। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারী পাশ করেন। তিনি রাজকোট ও বােম্বাইয়ে আইন ব্যবসায়ে ব্যর্থ হন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে দাদা আবদুল্লা এ্যান্ড কোং-এর মামলা লড়তে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। দক্ষিণ আফ্রিকায় পিটার মারিটসবার্গ স্টেশনে ট্রেন থেকে গান্ধীকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়। ডেভিড থোরোর ‘সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স\’ (Civil Disobedience), লিও টলস্টয়ের ‘কিংডম অফ গড\’ এবং জন রাসকিনের ‘আন টু দি লাস্ট’ বইগুলি তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ডারবানে তিনি ফোনেক্স ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাটালে টলস্টয় ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ান\’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে গান্ধী-স্মুট চুক্তি হয়। তিনি নাটালে নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস স্থাপন করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ গান্ধীজির কার্যকলাপ পর্যালােচনার জন্য গােখলেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠান। গােখলের অনুরােধে গান্ধী লন্ডন হয়ে ভারতে ফিরে আসেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। গােখলেকে তিনি রাজনৈতিক গুরু এবং টলস্টয়কে তিনি আধ্যাত্মিক গুরু মানতেন। গান্ধীর পিতা ছিলেন কাবা গান্ধী ও মাতা ছিলেন পুতলিবাঈ। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ৪৬ বছর বয়স্ক গান্ধীজি গুরু গােপালকৃষ্ণ গােখলের পরামর্শে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সবরমতী আশ্রম স্থাপন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশকে সাহায্যের জন্য কাইজার-ই-হিন্দ স্বর্ণপদক পান। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি চম্পারণে ভারতের প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। নীলকরেরা, স্থানীয় কৃষকদের ৩/২০ অংশ জমিতে নীল চাষে বাধ্য করত। একে বলা হত তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা। রাজকুমার শুক্লা গান্ধীজিকে চম্পারণে যেতে আহ্বান করেন। গান্ধীজির সঙ্গে এই আন্দোলনে ছিলেন। ব্রজকিশাের, রাজেন্দ্র প্রসাদ, গান্ধীজির ব্যক্তিগত সচিব মহাদেব দেশাই, নরহরি পারেখ, জে. বি. কৃপলনী, এ. এন. সিনহা এবং গােরক্ষ প্রসাদ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে চম্পারণ কৃষিবিল পাশ হয়। এতে তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা বিলােপ করা হয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি গুজরাটের খেড়ায় আন্দোলন করেন। এই আন্দোলনে গান্ধীজির সঙ্গে ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, বি. বি. প্যাটেল, এ. সারাভাই। সরকার যে তদন্ত কমিশন বসান তাতে ছিলেন বিঠলভাই প্যাটেল ও জি. কে. পারেখ। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি আমেদাবাদে মিল শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। গান্ধীজির সঙ্গে ছিলেন অনসূয়া বেন। আন্দোলনের চতুর্থ দিনে মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন ৩৫% বাড়িয়ে দেন।রাওলাট আইন : ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বিচারপতি রাওলাটের নেতৃত্বে রাওলাট কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন স্যার বাশিল স্কট, স্যার ভানি লােভেট, সি, ভি, কুমার স্বামী শাস্ত্রী এবং প্রভাস চন্দ্র মিত্র। রাওলাট কমিটি সিডিশন কমিটি নামেও পরিচিত ছিল। ১৯১৮
খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি রিপাের্ট পেশ করে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি বিলটি কেন্দ্রীয় আইনসভায় তােলা হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ বিলটি আইনে পরিণত হয়। রাওলাট আইনকে কালা আইন আখ্যা দিয়ে গান্ধীজি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৬ এপ্রিল সারা ভারতে হরতালের ডাক দেন। এটিই ভারতবর্ষে প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল গান্ধীজিকে দিল্লি পালওয়াল স্টেশনের কাছে গ্রেপ্তার করা হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড : ১০ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের দুই নেতা ড. সত্যপাল ও সঈফুদ্দিন কিচলুকে গ্রেপ্তার ও বিনা বিচারে অজ্ঞাতস্থানে রাখা হয় এবং গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করা হলে জনগণ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে জনগণ বৈশাখী মেলা উপলক্ষে সমবেত হয়। অমৃতসরের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আর, ডায়ার সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে ১০ মিনিট ধরে ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালান প্রায় ১০ হাজার মানুষের ওপর। সরকারি মতে ৩৭৯ জন মারা যান ও ১২০০ জন আহত হন। সামরিক শাসনকর্তা ও ডায়ার অমৃতসরে সান্ধ্য আইন জারি করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে উধম সিং জেনারেল ও ডায়ারকে হত্যা করেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য সরকার হান্টার কমিশন বসান। কংগ্রেসের তরফ থেকে অনুসন্ধানের জন্য চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়ােগ করা হয়। এই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, জয়াকার ও আব্বাস তায়েবজি।খিলাফত আন্দোলন : তুরস্কের সুলতান খলিফা ছিলেন মুসলিম জগতের ধর্মগুরু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যােগ দেয়। যুদ্ধের শেষে তুরস্কের সঙ্গে সেভর-এর সন্ধি হয়। তুরস্ক সাম্রাজ্যের কিছু অংশ ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয় এবং খলিফার মর্যাদা খর্ব করা হয়। খলিফার সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতীয় মুসলমানেরা খিলাফত আন্দোলন শুরু করেন। মহম্মদ আলি, সওকত আলি, মৌলনা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ, হজরত মােহানি প্রভৃতি মুসলমান নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স প্রতিষ্ঠিত হয় এপ্রিল মে মাসে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌয়ে অল ইন্ডিয়া খিলাফত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শেঠ চোট্টানি ছিলেন সভাপতি ও সওকত আলি ছিলেন সেক্রেটারি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা অধিবেশনে খিলাফত কনফারেন্সের সভাপতি হন মৌলনা আবুল কালাম আজাদ। গান্ধীজি খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং কাইজার-ই হিন্দ স্বর্ণপদক ফেরত দিয়ে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স করাচি অধিবেশনে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে মুসলমানদের পদত্যাগ করার দাবি করা হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে খলিফা পদের অবসান ঘটলে ভারতে খিলাফত আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা শেষ হয়।অসহযােগ আন্দোলন (১৯২০-২২) : ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে। গান্ধীজি অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বরাজ অর্জনের জন্য একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ, মদন মােহন মালব্য, বিপিনচন্দ্র পাল, অ্যানি বেসান্ত, জিন্না গান্ধীজির এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন কিন্তু মতিলাল নেহেরুর সহযােগিতায় গান্ধীজির প্রস্তাব পাশ হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নাগপুর অধিবেশনে অহিংস অসহযােগের প্রস্তাব পুনরায় গৃহীত হয়। কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসাবে স্থির হয় ‘স্বরাজ’, পন্থা হিসাবে স্থির হয় \’অহিংস অসহযােগ’ ও নেতা হন গান্ধীজি। অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচী হিসাবে সরকারি চাকরি, অনুষ্ঠান, খেতাব, আইনসভা ইত্যাদি বর্জন, অন্যদিকে গঠনমূলক কর্মসূচীর মধ্যে ছিল দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সালিশি বাের্ড গঠন, মাদক বর্জন, চরকা ও খদ্দরের প্রচলন ইত্যাদি। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, কাশী বিদ্যাপীঠ, বিহার বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, বেঙ্গল ন্যাশন্যাল ইউনিভারসিটি প্রভৃতি প্রতি
ষ্ঠিত হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মতিলাল নেহেরু, বিঠলভাই প্যাটেল, বল্লভভাই প্যাটেল, চক্রবর্তী রাজা গােপালাচারী প্রমুখ আইন ছেড়ে এই আন্দোলনে যােগ দেন। সুভাষচন্দ্র বসু আই. সি. এস, এর চাকরি ছেড়ে অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দেন। তিলক স্বরাজ তহবিল\’ গঠিত হয়, এই তহবিলে, ১ কোটি টাকা জমা পড়ে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারতে এলে বােম্বাই ও কলকাতায় ধর্মঘট হয়। বাসন্তীদেবী, সরােজিনী নাইডু জ্যোতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, উর্মিলা দেবী, হেমাভা মজুমদার প্রমুখ নারী এই আন্দোলনে যােগ দেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলার চৌরী চৌরা নামে দুটি গ্রামের উত্তেজিত জনতা ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারে। অহিংস আন্দোলন সহিংস পথে গেলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। ১০ মার্চ গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করে ৬ বছর কারাদন্ড ও জওহরলাল নেহেরুকে ১৮ মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়।স্বরাজ্য দল : ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে গয়া কংগ্রেস অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, হাকিম আজমল খাঁ, বিঠল ভাই প্যাটেল, মালব্য, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, কেলকার, জয়াকার, সত্যমূর্তি প্রমুখ পরিবর্তনের সমর্থক (Prochanger) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ও আইনসভায় প্রবেশের পক্ষে মত দেন। অন্যদিকে বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. আনসারি, চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারী প্রমুখ ছিলেন পরিবর্তনের বিরােধী (No Changer)। তাঁরা সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরিবর্তনের সমর্থকেরা ভােট পায় ৮৯০টি ও বিরােধিরা পায় ১৭৪০টি। মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারী স্বরাজ্য দল গঠন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন সভাপতি ও মতিলাল নেহেরু ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে ৬২ লক্ষ লােক অংশ নেয়। কেন্দ্রীয় আইনসভায় ১০১টি আসনের মধ্যে স্বরাজ্য দল পায় ৪২টি আসন। বােম্বাই, যুক্ত প্রদেশ ও আসামে, এই দল সাফল্য পায়। বাংলা এবং মধ্যপ্রদেশে এই দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেবিঠলভাই প্যাটেল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভাপতি বা স্পিকার নির্বাচিত হন। স্বরাজ্য দল মুসলমান সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদী দল বা Nationalist Party গঠন করেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে বাংলার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মাদ্রাজে শেষাগ্ৰী আইয়ার, বম্বের পরাঞ্জপে, উত্তর প্রদেশের চিন্তামণি, এইচ. কুঞ্জরু প্রমুখ নেতা পরাস্ত হন। চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন ও সুভাষচন্দ্র বসু মুখ্যকার্যনিবাহী অফিসার নির্বাচিত হন। বল্লভভাই প্যাটেল আমেদাবাদ কর্পোরেশনের, জহরলাল নেহেরু এলাহাবাদ কর্পোরেশনের, রাজেন্দ্র প্রসাদ পাটনা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। স্বরাজ্য দল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার মুদিমান কমিটি ও লি কমিশনের রিপাের্টের প্রতিবাদ করে।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে স্বরাজ্য দল তিনভাগে ভাগ হয় যথা, পুরানাে স্বরাজ্য দল, রেসপনসিভিস্ট (Responsivist), ইন্ডিপেনডেন্ট কংগ্রেস পার্টি। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে ১০৪ আসনের মধ্যে স্বরাজ্য দল পায় ৪০টি আসন। বাংলায় তারা অধিকাংশ আসন পায়। বিহার ও উড়িষ্যাতে রেসপনসিভিস্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশে স্বরাজ্য দল হেরে যায়।
সাইমন কমিশন : ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শাসনব্যবস্থা পর্যালােচনা করতে সাইমন কমিশন নিযুক্ত হয় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিশনে কোনাে ভারতীয় সদস্য ছিল না। এ জন্য একে অল হােয়াইট কমিশন বলা হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি সাইমন কমিশন বােম্বাই আসে। মুসলিম লিগের সভাপতি মহম্মদ ইয়াকুব সাইমন কমিশন বয়কট করেন। মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা এবং লিবারেল ফেডারেশন সাইমন কমিশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাইয়ে ‘সাইমন ফিরে যাও’ ধ্বনি ওঠে। লালা লাজপত রায় কমিশন-বিরােধী মিছিল পরিচালনা কতে গিয়ে পুলিশের হাতে প্রহৃত হন। জওহরলাল নেহেরু ও গােবিন্দবল্লভ পন্থ পুলিশের হাতে প্রহৃত হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি কমিশন তার রিপাের্ট পেশ করে। এই রিপাের্টের ভিত্তিতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন রচিত হয়।কংগ্রেসের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতসচিব বার্কেহেড সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তােলেন। এর জবাবে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহেরু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে এম. এ. আনসারির নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সাইমন কমিশনের বিরােধিতা করা হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে বােম্বাই মিটিংয়ে মতিলাল নেহেরুকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে একটি কমিটি গঠিত হয় ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা করতে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সর্বদলীয় লক্ষ্ণৌ সম্মেলনের অধিবেশনে মতিলাল নেহেরু সংবিধানের খসড়াটি পেশ করেন। এটি নেহেরু রিপাের্ট নামে পরিচিত। মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্না এবং হিন্দুমহাসভার নেতা এম. আর. জয়াকার এই রিপাের্টের বিরােধিতা করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ মুসলিম লিগের দিল্লী অধিবেশনে মহম্মদ আলি জিন্নাহ নেহেরু রিপাের্টের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ দফা দাবি পেশ করেন। নেহেরু রিপাের্টে ভারতের জন্য ডােমিনিয়ন স্ট্যাটাস দাবি করা হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর লর্ড আরউইন বলেন ভারতকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসন দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু উইনস্টন চার্চিল ভারতকে ডােমিনিয়ন-এর মর্যাদা দানকে এক গুরুতর অপরাধ বলে মনে করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩১ ডিসেম্বর লাহাের কংগ্রেস অধিবেশনে রাভি নদীর তীরে জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। গান্ধীজি ৬ বছর কারাবাসের পরে আবার লাহাের কংগ্রেস অধিবেশনে যােগ দেন। কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সমিতি থেকে বামপন্থী সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গারকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি কংগ্রেসের নবগঠিত কার্যনিবাহী সমিতির বৈঠকে স্থির হয় ২৬ জানুয়ারী স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালিত হবে।
আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-৩৪) : আন্দোলন শুরুর পূর্বে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজি সরকারের কাছে ৩০ দফা দাবি পেশ করেন তার ‘ইয়ং ইন্ডিয়া\’ পত্রিকার মাধ্যমে গান্ধীজি লবণ আইন ভঙ্গের জন্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ ডান্ডি অভিযান করেন। গান্ধীজির সঙ্গে ৭৮ জন (মতান্তরে ৭৯) স্বেচ্ছাসেবী ২৪ দিনে ২৪১ মাইল পথ অতিক্রম করে ডান্ডি পৌছন। ৬ এপ্রিল গান্ধীজি স্বহস্তে লবণ তৈরী করে লবণ আইন ভঙ্গ করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন।
আইন অমান্য আন্দোলন তামিলনাড়তে নেতৃত্ব দেন চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারি, অন্ধ ও উড়িষ্যার গােপবন্ধু চৌধুরী (উৎকলমণি), বােম্বাইয়ে যমুনালাল বাজাজ, পাঞ্জাবে তারা সিং, উত্তর প্রদেশে কালকাপ্রসাদ, বিহারে রাজেন্দ্র প্রসাদ, মণিপুরে রাণী গুইডিলু, আসামে তরুণ রাম ফুকোন, এলাহাবাদে এম, এন, রায়, বাংলার যতীন্দ্রমােহন সেনগুপ্ত প্রমুখ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। মহিলাদের মধ্যে কমলা নেহেরু, স্বরূপরানি নেহেরু, সরােজিনী নাইডু, বাসন্তীদেবী, উর্মিলাদেবী, সরলাবালা দেবী, লীনা নাগ প্রমুখ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশের চৌকিদারী কর, লবণকর, মাদকদ্রব্য ও ভূমিকর না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানাে হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গান্ধীবাদী নেতা সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গফফর খান। তিনি খুদা-ই-খিদমদগার বা ঈশ্বরের সেবক দলের প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলের সদস্যরা লাল পােশাক পরত বলে এদের লাল কুর্তা বলা হত। গান্ধীজি সুরাট জেলার ধসানায় সরকারি লবণ গােলা দখলের সিদ্ধান্ত নিলে প্রথমে গান্ধীজিকে এবং তারপর আব্বাস তায়েবজিকে সরকার গ্রেফতার করলে সরােজিনী নাইডুর নেতৃত্বে অভিযান চালানাে হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ১ এপ্রিল বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল এবং ২৭ এপ্রিল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের প্রেস অর্ডিন্যান্স পুনঃপ্রবর্তিত হয়।গান্ধী-আরউইন চুক্তি (১৯৩১) : তেজবাহাদুর সপু, ড. জয়াকার এবং অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ গান্ধী-আরউইন চুক্তি বা দিল্লী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে গান্ধীজি ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় গােলটেবিল বৈঠকে যেতে রাজি হন।গােলটেবিল বৈঠক : প্রথম গােলটেবিল বৈঠক ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় ১২ নভেম্বর ১৯৩০। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩১ অক্টোবর লর্ড আরউইন তার ঘােষণাপত্র জারি করেন। প্রথম গােলটেবিল বৈঠকের সভাপতি ছিলেন র্যামসে ম্যাকডােনাল্ড। ১৬ জন সদস্য ব্রিটিশ রাজনৈতিক পার্টিথেকে, ১৬ জন সদস্য ভারতীয় রাজ্য থেকে এবং ৫৭ জন সদস্য ব্রিটিশ ভারত থেকে প্রথম গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দেন। মুসলিম লিগের হয়ে যােগ দেন মহম্মদ আলি, মহম্মদ সফী, জিন্না, আগা, খান এবং ফজলুল হক। হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে মুঞ্জে ও জয়াকার যােগ দেন। ইন্ডিয়ান লিবারাল ফেডারেশানের পক্ষ থেকে যােগ দেন তেজবাহাদুর সপ্রু, চিন্তামণি, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী। শিখসম্প্রদায়ের পক্ষে যােগ দেন সর্দার উজ্জ্বল সিং। ডিপ্রেসড ক্লাসের পক্ষে যােগ দেন ড. বি. আর, আম্বেদকর। প্রথম গােলটেবিল বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ICS ও IPS পরীক্ষা ভারতবর্যে নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীকে ভারতীয়করণ করা হবে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জন্য একজন মন্ত্রী নিয়ােগ করা হবে। ভারত থেকে ব্রহ্মদেশ আলাদা করা হবে। বােম্বাই থেকে সিন্ধু প্রদেশ আলাদা করা হবে। প্রদেশগুলােকে স্বশাসন দান করা হবে। দ্বিতীয় গােলটেবিল বৈঠক ৭ সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে। এই বৈঠকে আরাে ৩১ জন নতুন প্রতিনিধি যােগদান করেন। গান্ধীজি ৬ ডিসেম্বর লন্ডন ত্যাগ করেন ও ২৮ ডিসেম্বর শূন্য হাতে বােম্বাই ফিরে আসেন। এই বৈঠকে যােগদানকারীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য নেতারা ছিলেন আম্বেদকর, সপু, জয়াকার, সরােজিনী নাইডু, মালব্য প্রমুখ।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত লন্ডনে তৃতীয় গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস তৃতীয় গােলটেবিল বৈঠক বয়কট করে। শুধুমাত্র ৪৬জন প্রতিনিধি এই অধিবেশনে যােগ দেন। সেক্রেটারী অফ স্টেটস ছিলেন স্যামুয়েল হােড়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হােয়াইট পেপার প্রকাশ করা হয় এবং হাউস অফ কমন্স-এ উত্থাপন করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে এটি প্রকাশিত।
আইন অমান্য আন্দোলন দ্বিতীয় পর্যায় : দ্বিতীয় গােলটেবিল বৈঠকে গান্ধি-আরউইন চুক্তির শর্তাদি কার্যকরী না হওয়ায়, উত্তরপ্রদেশে খাজনা বন্ধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জওহরলাল নেহেরু ও পুরুষােত্তমদাস ট্যান্ডনকে কারারুদ্ধ করা হয়। উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আবদুল গফফর খান-এর লাল কুর্তা বাহিনীকে বেআইনি ঘােষণা করা হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি সরকার চারটি নতুন দমনমূলক অর্ডিন্যান্স জারি করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গান্ধীজিকে বন্দি করা হয়। সরকারের দমন নীতি বৃদ্ধি পায়। বিলেতের ইন্ডিয়া লীগ পরিচালিত ডেলিগেশান রিপাের্টে দমন নীতির দিকটি প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজির কারামুক্তির পর তিনি হরিজন আন্দোলনে মনােনিবেশ করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিহারে ভূমিকম্পের পর এই আন্দোলন চাপা পড়ে যায়। ৪ মে পাটনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনঅমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়।আগস্ট আন্দোলন বা ভারতছাড়াে আন্দোলন : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে ভারতসরকার ভারতকে যুদ্ধরত দেশ ঘােষণা করে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে রামগড় অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট বড়লাট লিনলিথগাে ঘােষণা করেন যে—(1) যুদ্ধান্তে ভারতকে ডােমিনিয়ানেরমর্যাদা দেওয়া হবে। (2) বড়লাটের কার্যনির্বাহী সমিতিতে ভারতীয় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। (3) ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন করা হবে। (4) যুদ্ধান্তে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে। এটি আগষ্ট ঘােষণা নামেপরিচিত। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বড়লাটের কার্যনির্বাহী সমিতিতে সদস্যসংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ যােগ দেয়নি। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসুর ফরওয়ার্ড ব্লক দল আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ অক্টোবর গান্ধীজির নির্দেশে বিনােবা ভাবে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, রাজাগােপালাচারী সহ প্রায় ২৫০০ সত্যাগ্রহী কারাবরণ করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দেজার্মানি কর্তৃক রাশিয়া আক্রান্ত হলে কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধ প্রচেষ্টার সামিল হয়।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ জাপানের হাতে রেঙ্গুনের পতন হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী চার্চিল মন্ত্রীসভার সদস্য আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠান। ২৩ মার্চ তিনি দিল্লী পৌছান। ২৯ মার্চ ভারতের নেতৃবৃন্দের সামনে তিনি একটি প্রভাব রাখেন। এই প্রস্তাব ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। কংগ্রেস, শিখ, হিন্দু মহাসভা, ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন, ভারতীয় খ্রিস্টান ক্রিপস মিশনের বিরােধিতা করেন। মুসলিম লিগ ও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের র্যাডিক্যাল ডেমোেক্রটিক পার্টি ক্রিপস মিশনকে স্বাগত জানায়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট বােম্বাইয়ের নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে ভারতছাড়াে আন্দোলন-এর প্রস্তাব পাশ হয়। গান্ধীজি ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে\’ বা \’Do or Die\’-এর ডাক দেন।
৭ আগস্ট গান্ধীজি ও সরােজিনী নাইডুকে বন্দী করে আগা খানপ্যালেসে রাখা হয়। কংগ্রেসকে বেআইনি ঘােষণা করে কংগ্রেসের অপর নেতাদের বন্দী করা হয়। গান্ধীজির উপর আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ সৃষ্টি হয়। গান্ধীজি অনশন আন্দোয়ান করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রতি-সরকার ও সমান্তরাল সরকার গড়ে ওঠে। বােম্বাইয়ে অরুণা আসফ আছিল ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মিছিলে ৪ জন মারা যান ও ১৬৯ জন আহত হন। সারাতে প্রতি-সরকার গড়ে ওঠে ওয়াই, বি, চৌহান ও নানা পাতিলের নেতৃত্বে। মদন ঝা বিহারে সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। উত্তরপ্রদেশের বালিয়াতে চিতু পান্ডে একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে বলেন স্বরাজ তহশিলদার। উড়িষ্যার বালাশােরে স্বরাজ পঞ্চায়েত গঠিত হয় এবং উড়িষ্যাতে রক্ষা বাহিনী গঠিত হয়। উড়িষ্যার স্বাক্ষ্মণ নায়েক নামে কংগ্রেস নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আসামে শান্তি সেনাবাহিনী নিয়ােগ করা হয়। মেদিনীপুরের তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তার সর্বাধিনায়ক ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত ও তার দুই বিশিষ্ট অনুগামী অজয় মুখার্জি ও সুশীল ধাড়া সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম, মহিষাদল ও তমলুক এই চারটি থানা ছিল জাতীয় সরকারের অধীন। তমলুক, নন্দীগ্রাম ও মহিষাদলে বিদ্যুত্ত্বাহিনী বা জাতীয় বাহিনীর প্রতিষ্ঠা হয়। ৭৩ বছরের তমলুকের হােগলা গ্রামের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা মিছিল পরিচালনা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তিনি পরিচিত \’গান্ধী বুড়ি\’ নামে। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ১৭ ডিসেম্বর ১৯৪২ থেকে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে শাসন করে। ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত নেতাদের মধ্যে ছিলেন অচ্যুত পট্টবর্ধন, অরুণা আসফ আলি, রামমনােহর লােহিয়া, বিজু পট্টনায়ক, সুচেতা কৃপলনী, গােপীনাথ বরদলি,শাদিক আলি, জয়প্রকাশ নারায়ণ, ছােটুভাই, আর পি, গােয়েঙ্কা, নরেন্দ্র দেব, যােগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেটা, চন্দ্রকান্ত জাবেরি, বিলধর বাবুবাই, দয়াভাই প্যাটেল, বিঠল দাস প্রমুখ। নারীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন আসামের ১৩ বছরের কিশােরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভােগেশ্বরী ফুকননী প্রমুখ।নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনী : ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র বসু কটকে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবী। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কটকের রেভেন্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়েন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ICS পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান পান। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেন্ট্রাল মােরাল সায়েন্সে ট্রাইপস পরীক্ষা পাশ করে দেশে ফেরেন। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে জাতীয় আন্দোলনে যােগ দিয়ো ন্যাশনাল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি স্বরাজ’ নামে একটি ইংরাজি পত্রিকা বের করেন। সি. আর. দাশ তাঁকে বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রধান দায়িত্বে বসান। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার হ্ন। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেট নামেএকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাকে বন্দি করে রেঙ্গুনে পাঠান হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সমিতি থেকে তাকে শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার-কে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ডেমােক্র্যাটিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি AITU\”-এর সভাপতি হন। জামশেদপুরের টিস্কোর লেবার অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। জেলে বন্দি অবস্থায় তিনি কলকাতার মেয়র হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চে তিনি ভিয়েনা যান। তিনি অষ্ট্রিয়া ইন্ডিয়া সােসাইটি স্থাপন করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি Indian Struggle নামে গ্রন্থটি লেখেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে ফেরেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে শর্তাধীন মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি হন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন ও জওহরলাল নেহেরুকে প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হতে চাইলে গান্ধীজি পট্টভিসীতারামাইয়াকে প্রার্থী করেন। কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র ১৮৫০টি ও সীতারামাইয়া ১৩৭৭ ভােট পায়। নেতাজী জয়লাভ করেন ২০৩ ভােটে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ৩ মে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। সুভাষচন্দ্র সভাপতি ও সর্দার শার্দুল সিং কভিশের সহসভাপতি হন। এছাড়া অন্যান্যরা ছিলেন বিহারের সহজানন্দ ও বােম্বাইয়ের নরিম্যান। নেতাজির লেখা একটি গ্রন্থ হল ‘তরুণের স্বপ্ন\’। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই সুভাষচন্দ্রকে বন্দী করা হয়। ২ ডিসেম্বর অসুস্থতার জন্য কলকাতায় এলগিন রােডে নিজ গৃহে তাকে বন্দী করে রাখা হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি তিনি কলকাতা ত্যাগ করেন, জিয়াউদ্দিন ছদ্মনামে তাঁর ভাইপাে শিশির বসুর সঙ্গে। বিহারের গােমাে স্টেশন থেকে তিনি পেশােয়ার যান। আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়া যান। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ তিনি জার্মানিতে হাজির হন। তিনি হিটলার ও মুসােলিনির সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনে আজাদ হিন্দুস্থান বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির হাতে বন্দী ৪০০ ভারতীয় সেনা নিয়ে তিনি একটি সেনাদল গঠন করেন। জার্মানিতে বন্দী সেনাদল তাকে প্রথম ‘নেতাজী’ আখ্যায় ভূষিত করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জুলাই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠিত হয়। প্রায় ৪০ হাজার ভারতীয়দের নিয়ে পাঞ্জাবের ১৪নং রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মােহন সিং এই বাহিনী গড়ে তােলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগ গঠন করেন জাপানে এবং সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মােহন সিং ও নিরঞ্জন সিং গিলকে বন্দী করা হয়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন ডুবােজাহাজে করে সঙ্গী হবিবুর রহমানের সঙ্গে নেতাজি জার্মানী থেকে জাপানের টোকিওতে আসেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তােজো তাকে অভ্যর্থনা জানান। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই নেতাজী সিঙ্গাপুরে পৌছান, ৪ জুলাই রাসবিহারী বসু নেতাজীর হাতে ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের দায়িত্ব দেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের২৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে নেতাজি আজাদ হিন্দবাহিনীর নেতৃত্ব নেন। ৫ জুলাই তিনি দিল্লী চলাে’ ডাক দেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড এবং নেহেরু ব্রিগেড ছিল। বালকবালিকাদের নিয়ে গঠিত ছিল বাল সেনাদল। ঝাসির রানি ব্রিগেডের নেত্রী ছিলেন শ্রীমতি লক্ষ্মী স্বামীনাথন। বাছাবাছা সেনা নিয়ে গঠিত হয় সুভাষ ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন শাহনওয়াজ খান।১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর নেতাজী সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেন। ২৩ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। জাপান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি প্রভৃতি ৭টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। ৬ নভেম্বর তােজো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন।