ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা | Preamble to the Indian Constitution

ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা | Preamble to the Indian Constitution

1. প্রস্তাবনা বলতে কী বােঝায়?

উত্তর : প্রস্তাবনা হল সংবিধানের মুখবন্ধ। বর্তমান যুগে প্রায় সকল দেশে লিখিত সংবিধানের প্রারম্ভে একটি করে প্রস্তাবনা যুক্ত করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হল পথিকৃৎ।

2. প্রস্তাবনার উদ্দেশ্য কী?

উত্তর : প্রস্তাবনার উদ্দেশ্য হল দেশের মৌলিক আইন হিসাবে সংবিধানের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলি ব্যাখ্যা করা। অর্থাৎ প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে আমরা সংবিধান রচয়িতাদের মনােভাব, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা জানতে পারি।

3. প্রস্তাবনার গুরুত্বটি ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর : প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে আমরা সংবিধানের উৎস এবং সংবিধানের আইনগত ও নৈতিক ভিত্তির পরিচয় পেয়ে থাকি। অর্থাৎ, সংবিধানের উৎপত্তিস্থল কী, কোন্ যুক্তিতে সংবিধানকে মৌলিক আইন-রূপে গণ্য করা হবে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রস্তাবনা থেকে পাওয়া যায়।

4. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে কীভাবে তাঞ্চন করা হয়েছে?

উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্ররূপে অঙ্কন বা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

5. ভারতীয় সংবিধানে সার্বভৌম কথাটির অর্থ কী?

Ans. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সার্বভৌম’ শব্দটির দ্বারা বােঝানাে হয়েছে যে, ভারত রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আনুগত্যলাভে সমর্থ এবং বৈদেশিক অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক হল স্বাধীনতার। অর্থাৎ, আভ্যন্তরীণ বিষয়েই হােক অথবা বৈদেশিক ব্যাপারেই হােক উভয় ক্ষেত্রেই ভারত সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন।

6. ভারতীয় সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শটি স্বীকৃত হয়েছে। তবে এই সমাজতন্ত্র ইউরােপীয় সমাজতন্ত্র থেকে পৃথক। মূলত ভারতকে একটি সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করাই হল এই সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য। তাই ভারতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছে।

7. ভারতীয় সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : ভারত যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তা প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হল যে, ভারত রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের উপর ভিত্তিশীল নয়। তবে একথার অর্থ এই নয় যে, ভারত রাষ্ট্র ধর্মবিরােধী হবে, অথবা এখানে ধর্মের কোনাে স্থান নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য হল যে, ভারত রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলবে।

8. ভারতীয় সংবিধানে ‘গণতন্ত্র’ কথাটির অর্থ কী?

Ans. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক শব্দটি ব্যবহারের তাৎপর্য সম্পর্কে বলা যায় যে, সংবিধানের উদ্দেশ্য হল সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা। এরূপ গণতন্ত্র বলতে বােঝায় সকল প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা পরিচালিত সরকার এবং এরূপ সরকার জনগণের নিকট দায়ী থাকবে।

9. ভারতীয় সংবিধানে ‘সাধারণতন্ত্র’ কথাটির অর্থ কী?

Ans. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে ঘােষণা করা হয়েছে। ভারতকে সাধারণতন্ত্র বলে অভিহিত করার তাৎপর্য হল এই যে, ভারতে রাজা বা রাজতন্ত্রের কোনাে স্থান নেই। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি, যিনি পরােক্ষভাবে নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য নির্বাচিত হন। এছাড়া এখানে স্ত্রী-পুরুষ, বর্ণ, ধর্মনির্বিশেষে সকলেই নির্বাচন করার, নির্বাচিত হবার অধিকার ভােগ করে।

10. ‘আমরা, ভারতের জনগণ’ কথাটির তাৎপর্য কী?

Ans. ‘আমরা, ভারতের জনগণ’—কথাটির তাৎপর্য হল ভারতীয় জনগণই চরম সার্বভৌম ক্ষমতার আধার। সুতরাং, জনগণ বা জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে গণপরিষদই সংবিধান রচনা করার ও গ্রহণ করার ক্ষমতা লাভ করেছে। আদালতও এই ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়েছে।

11. ভারতীয় সংবিধানের আইনগত ভিত্তি কী?

উত্তর : সংবিধানকে মৌলিক বা চরম বিধি হিসাবে মান্য করা হয়। কারণ চরম আইন প্রণেতা (Supreme-lawgiver) জনসাধারণ কর্তৃক ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়েছে। সুতরাং, চরম বিধি হিসাবে সংবিধান সরকার এবং সাধারণ আইনের উর্দ্ধে। ইহাই হল সংবিধানের আইনগত ভিত্তির সারমর্ম।

12. ভারতীয় সংবিধানের নৈতিক ভিত্তিটি লেখ।

Ans. ভারতীয় সংবিধানকে মান্য করার পেছনে নৈতিক ভিত্তি রয়েছে। কারণ সর্বোচ্চ আইন হিসাবে সংবিধান হল দেশের সর্বোচ্চ আইনশৃঙ্খলার ভিত্তি। সুতরাং তাকে অমান্য করা হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেবে। এছাড়া সংবিধান যেহেতু জনগণ কর্তৃক রচিত ও গৃহীত হয়েছে সেহেতু প্রতিটি লােকের সংবিধানকে মান্য করার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।

13. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় কিভাবে সংবিধানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যাত হয়েছে?

উত্তর : প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সংবিধানের উদ্দেশ্য হল সকল নাগরিকের মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়, চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সুযােগের সমতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও জাতির ঐক্য ও সংহতিকল্পে সকলের মধ্যে ভ্রাতৃভাব প্রতিষ্ঠা ও বর্ধন করা।

14. ভারতীয় সংবিধানের আইনগত ও নৈতিক ভিত্তিটির বিরুদ্ধে সমালােচনা লেখাে।

উত্তর : ভারতীয় সংবিধানে আইনগত ও নৈতিক ভিত্তিটির বিরুদ্ধে সমালােচনা করে বলা হয় যে, সংবিধান রচনাকারী গণপরিষদ ভারতীয় জনগণ কর্তৃক সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। অথবা গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান গৃহীত হবার পর তা জনগণের অনুমােদনের জন্য গণভােটে পেশ করা হয়নি। যেমন—আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়।

15. তুমি কি মনে কর ভারতীয় জনগণই ভারতের সংবিধান রচনা করেছে?

উত্তর : ভারতীয় জনগণই ভারতীয় সংবিধানের উৎপত্তিস্থল ও ভিত্তি, এই যুক্তির বিরুদ্ধে সমালােচনা করা হয়েছে। কারণ ভারতীয় গণপরিষদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হননি। সুতরাং, ভারতীয় সংবিধান জনসাধারণ কর্তৃক রচিত হয়েছে এই যুক্তি সমর্থনযােগ্য নয়।

16. ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭’–এর তাৎপর্য কী ?

উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের আইনগত ভিত্তি হল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন, যা ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭’ (Indian Independence Act, 1947)। এই আইন বলেই ভারত স্বাধীন হয় এবং চূড়ান্ত ক্ষমতাসম্পন্ন গণপরিষদ গঠিত হয়।

17. কত খ্রিস্টাব্দে এবং কোন্ দেশের সংবিধানে সর্বপ্রথম প্রস্তাবনা যুক্ত হয়? তারপর কোন্ কোন্ দেশের সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায় ?

উত্তর : ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মার্কিন সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা যুক্ত হয়। তারপর জাপান, আয়ারল্যাণ্ড, ব্রহ্মদেশ প্রভৃতি দেশের সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়।

18. প্রস্তাবনা থেকে কী জানা যায় ?

উত্তর : প্রস্তাবনা থেকে সংবিধানের আদর্শগত ভিত্তি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অনুমােদনের প্রকৃতি জানা যায়। এছাড়া সরকারী কাঠামাের ধরন-ধারণ, সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।

19. কবে ভারতীয় গণপরিষদ আইনগতভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়?

উত্তর : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্টের পর জাতীয় গণপরিষদ আইনগতভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়।

20. প্রস্তাবনায় ভারতকে কী বলে অভিহিত করা হয়েছে?

উত্তর : প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

21. কত খ্রিস্টাব্দে ও কততম সংশােধন অনুসারে ভারতকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে?

উত্তর : ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের 42তম সংশােধন অনুসারে ভারতকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

22. ভারতীয় সংবিধানের শুরুতে এবং শেষে কোন্ শব্দগুলি যুক্ত করা হয়েছে ?

উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের শুরুতে ‘আমরা ভারতের জনগণ’ এই ব্দগুলি যুক্ত হয়েছে। আর প্রস্তাবনাটি শেষ হয়েছে, ‘আমাদের গণপরিষদে আজ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে নভেম্বর এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।”

23. কে. ভি. রাও (K.V. Rao) তাঁর কোনাে গ্রন্থের প্রস্তাবনায় ‘আমরা ভারতের জনগণ’ কথাগুলি ব্যাখ্যা করেছেন? তিনি এই কথাগুলির দ্বারা কি বােঝাতে চেয়েছেন?

উত্তর : কে. ভি. রাও তাঁর ‘Parliamentary Democracy in India’ গ্রন্থের প্রস্তাবনায় ‘আমরা ভারতের জনগণ’ কথাগুলি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কথাগুলির দ্বারা বােঝানাে হয়েছে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় ক্ষেত্রে ভারতে ব্রিটিশরাজ ও দেশীয় নৃপতিদের সার্বভৌম ক্ষমতার অবসান ঘটেছে।

24. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমরা ভারতের জনগণ কথাগুলি সমালােচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুটি যুক্তির উল্লেখ কর।

উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমরা ভারতের জনগণ কথাগুলি সমালােচিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে যুক্তিগুলি হল :
(a) সমালােচকরা বলেন, পৃথিবীর কোনাে দেশের সংবিধানই জনগণের দ্বারা রচিত হয়নি বা হতেও পারে না।
(b) ভারতীয় গণপরিষদকে ভারতীয়দের প্রকৃত প্রতিনিধি বলা যায়।
(c) ভারতীয় সংবিধানের আইনগত ভিত্তি বলতে ভারতের জনগণকে বােঝায় না।

25. কটি কারণে ভারতীয় সংবিধানের শুরুতে একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত হয়েছে? কারণগুলি উল্লেখ করাে।

উত্তর : মূলত তিনটি কারণে ভারতীয় সংবিধানের শুরুতে একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত হয়েছে। কারণগুলি হল :
(a) সংবিধানের উৎস, আইনগত ভিত্তি ও নৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে প্রস্তাবনা ইঙ্গিত দেয়।
(b) প্রস্তাবনায় সংবিধানের উদ্দেশ্য, নীতিগুলি ও সংবিধানের তারিখের উল্লেখ আছে।
(c) প্রস্তাবনা সংবিধানের কার্যকরী অংশের অস্পষ্ট শব্দ বা বাক্য ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

Leave a Comment

Scroll to Top