মৌর্য বংশের উত্থান ও পতন | মৌর্য সাম্রাজ্য | Mauryan Empire

মৌর্য বংশের উত্থান ও পতন | মৌর্য সাম্রাজ্য | Mauryan Empire

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চন্দ্রগুপ্ত

মৌর্য ২৫ বছর বয়সে নন্দ সম্রাট ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করে পাটলিপুত্র দখল করেন ৩২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন কৌটিল্য বা চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত। ৩১২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তার সাম্রাজ্য নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

   ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস নিকাটোর-এর সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জয়লাভ করেন ও সেলুকাসের সঙ্গে তাঁর সন্ধি হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে সেলুকাস কাবুল, কান্দাহার হিরাট এবং বালুচিস্তান চন্দ্রগুপ্ত ছেড়ে দেন। বিনিময়ে চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০টি যুদ্ধ-হক্তি দান করেন। সেলুকাস মেগাস্থিনিসকে তার দূত হিসাবে পাটলিপুত্রে প্রেরণ করেন, ভারত সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ‘ইন্ডিকা’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।   জৈন শাস্ত্র পরিশিষ্টপার্বণ অনুযায়ী জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্মও গ্রহণ করেন, এবং শেষ জীবনে জৈন পণ্ডিত ভদ্রবাহুর সঙ্গে মহীশূরে শ্রাবণবেলগােলায় যান এবং সেখানে অনশনে প্রাণত্যাগ করেন। চন্দ্রগুপ্ত পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে আরব সাগর; উত্তরে হিমালয় হিন্দুকুশ থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ু ও মহীশূর পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য নিজ শাসনে আনেন। ড. হেমচন্দ্র রায়ের মতে, ভারতে প্রথম ঐতিহাসিক বৃহৎ সাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে গ্রীকরা বলত স্যাণ্ড্রাকোট্টাস বা মুক্তিদাতা। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পত্নী দুর্ধরার পুত্র বিন্দুসার ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিতার সিংহাসনে বসেন।

বিন্দুসার

বিন্দুসারের উপাধি ছিল ‘অমিত্রঘাত। গ্রীকরা তাঁকে বলত ‘অমিত্ৰচ্যাট’। বিন্দুসারের সময় দক্ষিণভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত বিস্তৃতি ঘটে। তিবৃতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত তারানাথ ষষ্ঠশতকে ভারত পরিভ্রমণ করেন। তারানাথের মতে বিন্দুসার ১৬টি রাজ্য জয় করেন।

বিন্দুসার যুবরাজ অশােককে তক্ষশীলার প্রজাদের বিদ্রোহ দমন করতে পাঠান। গ্রিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিন্দুসার শান্তিপ্রিয় রাজাছিলেন। তিনি সিরিয়ার গ্রিকরাজা প্রথম অ্যান্টিওগাসের কাছে এক পত্র পাঠিয়ে কিছু মিষ্ট মদ্য, শুকনাে ডুমুর ও একজন গ্রিক দার্শনিক পাঠাতে বলেন। অ্যান্টিওগাস বলেন যে গ্রিকদের দার্শনিকদের ক্রয় বিক্রয় করার নিয়ম নেই। বিন্দুসারের দরবারে ডেইমাক্স নামে এক রাজদূত পাঠান। মিশরের গ্রীকরাজা টলেমি বিন্দুসারের দরবারে ডায়ােনিসাস নামে এক দূত পাঠান। বিন্দুসারের আমলে পেট্রোক্লেশ নামে এক গ্রিক নাবিক ভারতমহাসাগরে অভিযান করে বহুতথ্য জোগাড় করেন।   বিন্দুসার আজীবিক ধর্মের প্রতি খুব অনুরাগী ছিলেন। পিঙ্গল বৎস নামে একজন আজীবিক ভবিষ্যৎ বক্তা বা জ্যোতিষি তাঁর দরবারে ছিল। যখন অশােক জন্মগ্রহণ করেন তখন তিনি বলেন যে সে-ই পরবর্তী রাজা হবে। অশােক প্রথমে উজ্জয়িনীতে ভাইসরয় বা প্রতিনিধি ছিলেন। বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশােক সরাসরি উজ্জয়িনী থেকে পাটলিপুত্রে এসে সিংহাসনে বসেন।

মেগাস্থিনিস : সেলুকাস নিকেটার মেগাস্থিনিস নামে একজন দূত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভাতে পাঠান। মেগাস্থিনিস কাবুল ও পাঞ্জাব ভ্রমণ করে মৌর্য রাজধানী পাটলিপুত্রে আসেন। মেগাস্থিনিস ভারতীয় ভাষা এবং ভারতের প্রথাগুলাে বুঝতেন না। তবু সে তাঁর অভিজ্ঞতাগুলাে ‘ইন্ডিকা’ নামক একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।

মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থ হারিয়ে গেছে। কিন্তু কিছু কিছু বিবরণ এখনাে অক্ষত আছে স্ট্রাবাে, আরিয়ান, ডায়ােডােরাস, এবং অন্যান্য লেখকদের বিবরণে। ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে আলােকপাত করা হয়েছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাগরিক এবং সামরিক শাসনতন্ত্র সম্পর্কে। এছাড়া এ দেশের মাটি, জলবায়ু, পশুপাখি, উদ্ভিদ এবং মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও আলােচনা করা হয়েছিল।

‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে রাজপথগুলি বিস্তীর্ণ ছিল উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে পাটলিপুত্রের দিকে এবং রাজপথের দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৪০ কিমি। প্রতিমাইল রাস্তা লােহার ফলক দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র গঙ্গা ও শােন নদীর সংযােগস্থলে অবস্থিত ছিল।

পাটলিপুত্র নগরী লম্বায় ৯/ মাইল এবং চওড়ায় ১১ মাইল।   রাজপ্রাসাদ ছিল কাঠের তৈরি। আধুনিক নগরী কুমরাহারের কাছে রাজপ্রাসাদ অবস্থিত ছিল। প্রাসাদের চারিদিকে ছিল উদ্যান এবং পরিখা। সেখানে বিভিন্ন প্রকার মাছ ছিল। প্রাসাদের স্তম্ভগুলাে সােনালী লতা এবং রূপার পাখি দ্বারা খােদিত ছিল। বাগানে ময়ূরকে পােষ মানানাে হত এবং পায়রা রাখা হত।   রাজা সবসময় প্রাসাদে থাকতেন। তার সঙ্গে থাকত নারী দেহরক্ষী বাহিনী। যুদ্ধের সময় রাজা জনসমক্ষে আসতেন। শিকার ছিল রাজকীয় বিনােদন এবং রাজা শিকারে যেতেন সশস্ত্র নারী দেহরক্ষী নিয়ে।

অশােক এবং তার উত্তরসূরিগণ

বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত অশােকের নাম পুরাণে পাওয়া যায় একজন মৌর্য সম্রাট হিসাবে। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস্ প্রিন্সেপ অশােকের ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে অশােকের আরাে অনেক লিপি আবিষ্কার করা হয়েছে।

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে অন্য একটি শিলালিপি ‘মাস্কি’ আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে অশােককে “প্রিয়দর্শী” বলা হয়েছে। “প্রিয়দর্শী” অশােকের দ্বিতীয় নামরূপে ঘােষিত হয়েছে। বিন্দুসারের মৃত্যুর সময় অশােক ছিলেন উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ থেকে জানা যায় অশােক তার ৯৯ জন ভাই-কে হত্যা করেন। তার বড় ভাই ছিলেন সুসিমা যিনি ছিলেন তক্ষশিলার শাসনকর্তা। একমাত্র তার ছােটো ভাই তিস্যকে হত্যা করেন নি। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথের মতে অশােক তার ছয়টি ভাইকে হত্যা করেন। পঞ্চম শিলালিপিতে অশােক উল্লেখ করেছেন তার ভাইদের পরিবার, তার ভগিনী এবং আত্মীয়দের কথা। চার বছর গৃহযুদ্ধ চলার পর অশােক তার ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেন ২৬৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। এজন্য তাকে বলা হয় চন্ডাশােক’ বা ‘ধর্মাশােক’।

অশােক প্রথম জীবনে ছিলেন উজ্জয়িনী শাসনকর্তা। পরে তক্ষশীলায় প্রজাবিদ্রোহ হলে তাকে সেখানে পাঠানাে হয়। তক্ষশিলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে অশােক তার যােগ্যতা দেখান। অশােকের মাতার নাম ছিল ধর্মা বা সুভদ্রাঙ্গি। তিনি ছিলেন বিন্দুসারের গ্রীক জাতীয় পত্নী। এলাহাবাদ লিপি থেকে জানা যায় তার একাধিক পত্নী ছিল। তাঁর প্রথমা পত্নী ছিল দেবী। দ্বিতীয়ার নাম ছিল কারুকী। অশােকের কয়জন পুত্রছিল তা সঠিক জানা যায় না। তবে তার কয়েকজন পুত্র হলেন তীব্র, কুনাল, জলৌকা, মহেন্দ্র ইত্যাদি এবং কন্যার মধ্যে সঙঘমিত্রার নাম জানাযায়।

অশােকের রাজত্বে সর্বপ্রথম উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ। তার রাজত্বের প্রথম তেরাে বছর তাঁর নীতি ছিল স্বদেশে রাজ্য বিস্তার এবং বিদেশে গ্রীক রাজাদের সঙ্গে মিত্রতা। অশােকের রাজত্বের অষ্টম বছরে ২৬০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মতান্তরে ২৬১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দেড় লক্ষ লােক মারা যায় এবং বহু লােক বন্দী বা নিরুদ্দেশ হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে অশােক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। ভব্রু শিলালিপি থেকে জানা যায় যে কলিঙ্গ যুদ্ধের দুবছর পর বৌদ্ধপণ্ডিত উপগুপ্তের নিকট বৌদ্ধধর্মের দীক্ষা নেন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙেঘর প্রতি তার বিশ্বাস বেড়ে যায়।

তাঁর সময় পাটলিপুত্রে ২৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তৃতীয় বৌদ্ধসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন মােগলিপুত্র তিস্য। অশােক তৃতীয় বৌদ্ধসঙ্গীতির পরে কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে নির্বাচিত করে কিছু স্থানে পাঠান বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য। কাশ্মীর ও গান্ধারে পাঠানাে হয় মােধন্তিকা বা মােজমন্তিকাকে। মহাদেবকে পাঠানাে হয় মহিষমণ্ডলে। রক্ষিতকে পাঠানাে হয় বানভাসিতে। জনধর্ম রক্ষিতকে পাঠানাে হয় অপরন্তকে।

মহাধর্মরক্ষিতকে পাঠানাে হয় মহরথে। মহারক্ষিতকে পাঠানাে হয় জনতে। মজঝিমাকে পাঠানাে হয় হিমালয় অঞ্চলে। সােনা ও উত্তারাকে পাঠানাে হয় সুবর্ণভূমিতে এবং মহেন্দ্র ও সঙ্ঘমিত্রাকে পাঠানাে হয় শ্রীলঙ্কাতে। ‘জন’ শব্দটি গ্রীক শব্দ। যার আগের অর্থ ছিল ধর্মরক্ষিত। এই শব্দটি অভারতীয় সন্ন্যাসী-বােঝাতে ব্যবহার করা হয়। রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালিপি থেকে জানা যায় যে অশােকের শাসনকর্তা (Governor) তুসাপ্পা ছিল পশ্চিম ভারতের পার্সিয়ান অথবা গ্রিক শাসনকর্তা।

অশােকের দ্বিতীয় শিলালেখ থেকে জানা যায় যে তাঁর সাম্রাজ্য দক্ষিণসীমান্ত চোল, পান্ড্য, সত্যপুত্র, কেরলপুত্র ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এরাজ্যগুলাে ছিল প্রমেত অর্থাৎ সীমান্তবর্তী রাজ্য। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীর মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং অশােক শ্রীনগর শহর প্রতিষ্ঠা করেন। খােটান (মধ্য এশিয়া) সম্ভবত মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তিব্বতীয় মতে অশােক এই অঞ্চল পরিদর্শন করেন। বর্তমান নেপাল মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। অশােকের মেয়ে নেপালের এক অভিজাতকে বিবাহ করেন।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের খুব নিকট সম্পর্ক ছিল। শ্রীলঙ্কার শাসক তিস্য অশােকের কাছে একজন আদর্শ ব্যক্তি ছিলেন। অশােক তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সঙঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সিংহলে পাঠান এবং মূল বােধিবৃক্ষের একটি শাখা তিস্যর কাছে পাঠান। আসল বােধি বৃক্ষটি সপ্তম খ্রিস্টাব্দে গৌড় রাজ শশাঙ্ক কেটে ফেলেন। ত্রয়ােদশ শিলালিপিতে উল্লেখ আছে যে, অশােক ধর্ম প্রচার ও কুটনৈতিক সম্পর্কের জন্য পশ্চিমের গ্রীক রাজাদের নিকট দূত পাঠান। পাঁচজন রাজার নাম হল সিরিয়ার রাজা দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাসথিওস (সেলুকাস নিকেটারের পৌত্র), মিশরের রাজা দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাস, ম্যাসিডনের রাজা অ্যান্টিগােনাস গােনাডাস, কাইরিনের রাজা ম্যাগাস, এপিরাসের রাজা আলেকজান্ডার।   

অশােকের প্রধান রাণী ছিলেন আসন্ধিমিতা। আসন্ধিমিতার মৃত্যুর পর তিস্যরাখা প্রধান রাণীর মর্যাদা পান। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের মতেতিস্যরাখা বােধিবৃক্ষে আঘাত করেন। অন্যরাণী ছিল কারুকী। তিনি ছিলেন ধার্মিক এবং দানশীল। তাঁর পুত্রের নাম ছিল তিভর। অশােকের তৃতীয় স্ত্রীর নাম ছিল পদ্মাবতী এবং তাঁর পুত্রের নাম ছিল কুনাল। অশােকের দুই কন্যা ছিল। একজন সঙ্ঘমিত্রা ও অন্যজন চারুমতি। চারুমতি বিবাহ করেন নেপালের এক ক্ষত্রিয় দেবপালকে। অশােকের পৌত্রের মধ্যে ছিল সম্প্রতি (কুনালের পুত্র) এবং দশরথ উল্লেখযােগ্য।   সিংহলীয় গ্রন্থ মহাবংশ’ অনুসারে অশােকের রাজত্বের ২৭ বছরে তাঁর রাণী আসিন্ধমিতা মারা যান। তার চার বছর পরে ২৩৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দেতিস্যরাখা প্রধান রাণীর মর্যাদা পান এবং দুবছর পরে বিষ প্রয়ােগে বােধিবৃক্ষের ক্ষতির চেষ্টা করেন। অশােক অনেক কষ্টে বােধিবৃক্ষের একটি ক্ষুদ্র অংশ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এই গল্প ফাহিয়েনের রচনাতে পাওয়া যায়।

পুরাণের মতে মৌর্য সাম্রাজ্য ১৩৭ বছর টিকেছিল। এরমধ্যে প্রথম তিন রাজা রাজত্ব করেন ৭০ বছর। পরবর্তী রাজাগণ রাজত্ব করেন ৪৭ বছর। অশােকের মৃত্যুর পর মৌর্যসাম্রাজ্য দুটিভাগে ভাগ হয়। যথা পূর্ব ও পশ্চিম। পশ্চিম অংশে রাজত্ব করত কুনাল। এবং তারপর কিছুদিন রাজত্ব করেন সম্প্রতি। পূর্ব অংশের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। এখানে রাজত্ব করেন দশরথ। দশরথের নাম মৎসপুরাণে পাওয়া যায়। তিনি নাগার্জুন পাহাড়কে আজিবিবাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। পুরাণমতে দশরথ আট বছর রাজত্ব করেন। পুরাণ মতে কুনালও আট বছর রাজত্ব করেন। সম্প্রতি ২২৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেন। সম্প্রতি নয় বছর রাজত্ব করেন। এরপর সিংহাসনে বসেন শালিসুক। শালিসুক ১৩ বছর রাজত্ব করেন। শালিসুকের পরে সিংহাসনে বসেন সােমবর্মন বা দেববর্মন। তিনি ৭ বছর রাজত্ব করেন। তারপর সিংহাসনে বসেন শতধাবন। তিনি ৪ বছর রাজত্ব করেন। মৌর্য বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন বৃহদ্রথ। তিনি ৭ বছর রাজত্ব করেন। বৃহদ্রথের ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ তাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন ১৮৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয়।

অশােকের শিলালেখ এবং তাদের স্থান-

অশােকের শিলালিপিগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। পর্বতলিপি বা পর্বতগাত্রে খােদিত লিপি, স্তম্ভ লিপি বা পাথরের স্তম্ভের গায়ে খােদাই করা লিপি, গুহার গায়ে খােদাই করা লিপি। অশােকের শিলালিপিগুলি অধিকাংশই ব্রাহ্মীলিপিতে প্রাকৃত ভাষায় রচিত। উত্তর পশ্চিমে প্রাকৃত ভাষায় এবং খরােষ্টী লিপিতে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। কিছু কিছু গ্রিক লিপিতে রচিত। কিছু কিছু অ্যারামাইক ভাষায় খােদিত।

অশােকের শিলালিপিগুলি থেকে জানা যায় কলিঙ্গ যুদ্ধের বিবরণ, কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে তার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার ফলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ, বৌদ্ধধর্মের সংহতি রক্ষার চেষ্টা করা, অশােকের ধম্মনীতি, অশােকের ধম্মপ্রচারের প্রচেষ্টা, অশােকের শাসন ব্যবস্থা, বৈদেশিক সম্পর্ক, ভারতের সাধারণ মানুষের অবস্থা ও তৎকালীন সমাজব্যবস্থা।   অশােক ১৪টি প্রধান প্রস্তরলিপি খােদাই করেন। এই ১৪টি লিপি ভারতের ১০টি জায়গাতে প্রাপ্ত হয়েছে। জায়গাগুলি হল কলসী, গিরনার, সােপারা, ধৌলি, যৌগদ্র, ইরাগুড়ী, সান্নতি, মানসেরা, সারাজগুড়ি এবং কান্দাহার। কলিঙ্গের ধৌলি এবং যৌগড় নামক স্থানে যে ১ থেকে ১৪ লিপি পাওয়া যায় তাতে একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়ােদশ লিপি নেই। তার জায়গায় অশােক কলিঙ্গবাসীদের জন্য দুটি আলাদা লিপি দিয়েছেন। এর নাম হল ‘স্বতন্ত্র কলিঙ্গ লিপি’।[ ১-৪ শিলালিপি লেখ খােদিত হয় অশােকের রাজত্বের দ্বাদশ বছরে।১৪ লিপি লেখ খােদিত হয় অশােকের রাজত্বের আঠারাে বছরে।বরাবর গুহা লেখ খােদিত হয় অশােকের রাজত্বের উনিশ বছরেলুম্বিনি স্তম্ভ লেখ খােদিত হয় অশােকের রাজত্বের কুড়ি বছরে।নিগলিসাগর লেখ খােদিত হয় অশােকের রাজত্বের কুড়ি বছরে।১–৬ স্তম্ভলিপি খােদিত হয় অশােকের রাজত্বের ছাৰ্বিশ বছরে।৭ম স্তম্ভলিপি তার রাজত্বের ২৭ বছরে খােদিত হয়। ]

অশােকের অপ্রধান শিলালিপির সংখ্যা হল ১২টি। এর মধ্যে বৈরাট, রূপনাথ, মাস্কি, নিত্যুর, মন্দগিরি, গাভীমঠ, ব্রহ্মগিরি, গুজ্জর, বাহাপুর, অরৌর, সামারাম, ইরাগুড়ি, প্যাঙ্গোরারিয়া, গুজর, লামঘন, কান্দাহার, জাতিঙ্গ রামেশ্বর, পালকিগন্ডু, উদেগ্যলম, সন্নতি নামক জায়গাগুলি থেকে ওই ১২টি শিলালিপি খুঁজে পাওয়া গেছে।

অশােকের প্রধান স্তম্ভলিপিগুলির সংখ্যা ৭টি। এরমধ্যে ৬টি পাওয়া গেছে। এই ৬টি মনােলিথিক পিলার বা স্তম্ভের ওপর খােদিত। এই ৬টি পাওয়া গেছে ৫টি স্থান থেকে। স্থানগুলি হল মীরাট, কোশাম্বী, লৌরী ও আরারাস, লৌরি ও নন্দনগড় এবং বিহারের রামপূর্বা। যষ্ঠ স্তম্ভলিপিটি পাওয়া গেছে দিল্লির তােপরা নামক স্থানে। এটা চতুর্দশ শতাব্দীতে ফিরােজ শাহ তুঘলক পাঞ্জাব থেকে দিল্লী নিয়ে যান। তাঁর অপ্রধান স্তম্ভলিপিগুলির সংখ্যা হল ১৩টি। তারমধ্যে ১০টি খােদাই করা ছিল,  ৩টি খােদাই করা ছিল না। এই ১০টি পাওয়া গেছে রামপূর্বা, লৌরি ও আরারাস, লৌরিও নন্দনগড়, রুমিনদেই, নিগলফ, সারনাথ, কোশাম্বী, দিল্লী তােপরা, দিল্লী মীরাট, সাঁচি, স্থান থেকে। এছাড়া তিনটি পাওয়া গেছে রামপূর্বা, কলুহা, সংকীশ নামক স্থানে।
কলিঙ্গ শিলালিপি ১৫ এবং ১৬ নম্বর ২৫৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লেখা হয়। চতুর্দশ শিলালিপি এবং দুটি বরাবর পাহাড়ের গুহালিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল ২৫৮-২৫৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। নেপালে দুটি স্মৃতিলিপি খােদিত হয়েছিল ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। শিলালিপিগুলি খােদিত হয়েছিল ২৪৩-২৪২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। অশােক তিনটি অপ্রধান শিলালিপি মাস্কি, দত্তপুর এবং নিত্যুরে। নিজেকে ‘পিয়দর্শী’ বা ‘দেবানাম প্রিয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।

• অশােকের ১৪টি শিলালিপির বিবরণ সমূহ-

1. প্রথম শিলালিপিতে তিনি পশুহত্যা, পশুশিকার এবং বিভিন্ন উৎসব নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছেন। শুধুমাত্র দুটি ময়ূর ও একটি হরিণকে হত্যা করা যায় উৎসর্গের জন্য।
2. তিনি মানুষের এবং পশুদের চিকিৎসার কথা বলেছেন। এছাড়া রাস্তাঘাট নির্মাণ, কুঁয়াে তৈরি এবং রাস্তার পাশে গাছ লাগানাের কথা বলেছে দ্বিতীয় শিলালেখে।
3. তৃতীয় শীলালেখে রয়েছে রাজুক, প্রাদেশিক ও যুক্তা ইত্যাদি কর্মচারীদের কথা। এছাড়া শ্রমণ এবংব্রাহ্মণদের স্বাধীনতার কথাও রয়েছে।
4. চতুর্থ শিলালেখে ভেরীঘােষকে ধর্মঘােষে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া রাজুকদের বিচারের ক্ষমতা আছে বলে বলা হয়েছে।
5. পঞ্চম শিলালেখে উল্লেখ রয়েছে ধর্মমহামাত্রদের নিয়ােগের কথা। এটি তার রাজত্বের চতুর্দশ বছরে সৃষ্টি। এখানে আরও বলা হয়েছে ধর্ম মহামাত্রদের দ্বারা বন্দিদের নৈতিক উন্নতির কথা।6. যষ্ঠ শিলালেখে মন্ত্রিপরিষদের কথা রয়েছে। এছাড়া পুলিশানি এবং প্রতিবিদিকরদের কথা বলা হয়েছে।
7. সপ্তম শিলালেখে উল্লেখ রয়েছে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি এবং মনের বিশুদ্ধতা প্রাপ্তির উপায়।
৪. অষ্টম শিলালেখে বুদ্ধগয়ার সম্বােধিতে অশােকের ধর্মযাত্রার কথা রয়েছে তাঁর রাজত্বের দশম বছরে।
9. নবম শিলালেখে বলা হয়েছে বিভিন্ন অপ্রয়ােজনীয় উৎসব, নৈতিকতা এবং নৈতিক ব্যবহারের কথা। এছাড়া শ্ৰমণ এবং ব্রাহ্মণদের প্রতি দানধ্যানের কথা রয়েছে।
10. দশম শিলালেখে উল্লেখ করা হয়েছে যে রাজা যশ বা খ্যাতি চান না। ধম্মের প্রধানগুণের কথা বলা হয়েছে।
11. একাদশ শিলালেখে ধম্মের নীতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে বয়স্কদের শ্রদ্ধা করা, প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকা, বন্ধু, শ্ৰমণ এবং ব্রাহ্মণদের দান করা, ভৃত্য ও দাসদের প্রতি ভালাে ব্যবহার করার ওপর।
12. দ্বাদশ শিলালেখে উল্লেখ করা হয়েছে ইতিঝক-মহামাতা কথা। মানুষের নৈতিক উন্নতি, ধর্মসহিষ্ণুতা ও ভগবানের প্রতি বিশ্বাসের কথা রয়েছে।
13. ত্রয়ােদশ শিলালিপিতে রয়েছে কলিঙ্গযুদ্ধের কথা। এটি তার রাজত্বের নবম বছরে খােদিত হয়। এছাড়া গ্রীস দেশে তার ধম্মবিজয়ের কথাও রয়েছে।
14. চতুর্দশ শিলালেখে উল্লেখ রয়েছে শিলালেখ করার উদ্দেশ্য।
অশােকের দুই এবং ত্রয়ােদশ শিলালেখে উল্লেখ রয়েছে পান্ড্য চোল এবং শ্রীলঙ্কায় তার ধর্মপ্রচার। অশােকের সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভলিপি হল রামপূর্বা, সবচেয়ে ছােট স্তম্ভলিপি হল রুমেনদেই, সবচেয়ে সুরক্ষিত স্তম্ভলিপি হল লৌরিয়নন্দনগড় এবং সবচেয়ে প্রাচীন স্তম্ভলিপি হল বাখিরা বা কলুহা, সর্বশেষ স্তম্ভলিপি হল সারনাথ। কান্দাহার শিলালেখ গ্রীক এবং অ্যারামাইক ভাষায় লেখা। বরাবর গুহা লিপি সংখ্যায় তিনটি। এখানে রাজাকে প্রিয়দর্শী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আজীবিকদের জন্য এই গুহালিপি উৎসর্গ করা হয়েছে।

অশােকের ধম্ম : অশােকের ব্যক্তিগত ধর্ম ছিল বৌদ্ধধর্ম, তিনি তাঁর শিলালিপির দ্বারা জনগণের কাছে যে ধম্মমত প্রচার করেন তা ছিল ধর্ম বা ধৰ্ম্ম। পালিভাষায় ধর্মকে বলা হয় ধম্ম। মাস্কি লিপিতে তিনি প্রথম ‘ধম্ম’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। অশােকের নবম শিলালেখে তিনি ধম্মের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অশােক প্রত্যেকব্যক্তিকে কতকগুলি নৈতিক গুণ অনুসরণের কথা বলেন। এগুলি ছিল দয়া, দান, সত্য কথা বলা, পবিত্রতা পালন, ভদ্রতা বা নম্রতা পালন, সৎ কর্ম করা ইত্যাদি। যাতে এইগুণগুলি দৈনন্দিন জীবনে পালিত হয় এজন্য অশােক কতকগুলি আচরণবিধি নির্দেশ করেন।

অশােকের ধম্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(a) প্রাণীহত্য করা থেকে বিরত থাকা এবং প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করা, (১নং শিলালেখ)। এবং অর্থহীন ও অপ্রয়ােজনীয় ধর্মীয় ও ব্যায়বহুল, এড়িয়ে চলা (নবম শিলালেখ)।
(b) দক্ষ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা (ষষ্ঠ শিলালেখ), দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলে সামাজিক উন্নতি করা (দ্বিতীয় শিলালেখ)।
(c) প্রাণীদের প্রতি হিংসা না করা (চতুর্থ শিলালেখ), ব্রাহ্মণ, শ্রমণ প্রভৃতির প্রতি উদার ব্যবহার করা (তৃতীয় শিলালেখ)।
(d) দাসভৃত্যদের প্রতি মানবিক ব্যবহার এবং কয়েদিদের প্রতি সরকারি আধিকারিকদের ভাল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে (পঞ্চম শিলালেখ)। এছাড়া ধর্মমহামাত্রদের নিয়ােগের কথা বলা হয়েছে।
(e) সকল শ্রেণীর প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা রয়েছে (৭ম ও ১২তম শিলালেখে)।
(f) ভেরীঘােষের পরিবর্তে ধর্মঘােষের কথা রয়েছে অর্থাৎ যুদ্ধজয়ের পরিবর্তে ধর্মবিজয়ের কথা বলা হয়েছে (ত্রয়ােদশ শিলালেখে)।

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা

কৌটিল্য সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব প্রচার করেন। তার মতে হিন্দুরাষ্ট্র চিন্তায় ছিল একটি মণ্ডল বা চক্র। এই চক্রের সাতটি অঙ্গ বা শাখা ছিল। যার দ্বারা রাষ্ট্রের চাকা চলত। এই সাতটি অঙ্গ হল (a) স্বামিন (রাজা) (b) অমাত্য (মন্ত্রী), (c) জনপদ (অঞ্চল জনসংখ্যা) (d) দুর্গ, (e) কোষ (Treasury) (f) বল (সেনা), (g) মিত্র। রাজা ছিল এই সাতটি অঙ্গের প্রধান, তিনি ছিলেন রাজচক্রবর্তী। রাজারা নিজেদের দেবানাংপ্রিয় অর্থাৎ দেবতাদের প্রিয় বলে দাবি করতেন। অশােক ষষ্ঠ শিলালেখে বলেছেন “সবে মুনিষে প্রজা মম।” অর্থাৎ সকল মানুষই আমার সন্তান।
মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে বিভিন্ন পদমর্যাদার মন্ত্রী ছিল। মন্ত্রীগণ ছিলেন রাজার ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা। তাদের বেতন ছিল বার্ষিক ৩৮ হাজার পান। বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অত্যন্ত অভিজ্ঞ বিশ্বাসী ব্যক্তি এই পদে নিযুক্ত হত। এছাড়া ছিল মন্ত্রী পরিষদ। মন্ত্রী পরিষদ ছিল পুরােহিত, মহামন্ত্রী, যুবরাজ, সেনাপতি ইত্যাদিদের নিয়ে গঠিত। এরা মন্ত্রীর অপেক্ষা নীচু ছিল। এদের বেতন ছিল বার্ষিক ১২ হাজার পান। জরুরী অবস্থায় এরা একত্রে পরিষদে বসে সিদ্ধান্ত নিত। মতবিরােধ হলে ভূমিষ্ঠ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের মত গৃহীত হত।
রাজাকে সাহায্যের জন্য মন্ত্রীরা ছাড়া অমাত্য নামে কর্মচারী থাকত। অমাত্যরা বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পদ পেতেন। এদের হাতে অর্থ, বিচার, প্রশাসন ইত্যাদি বিভাগের দায়িত্ব ছিল। অর্থশাস্ত্রে অধ্যক্ষ’ নামে একশ্রেণীর কর্মচারী ছিল যারা বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পেত। অর্থশাস্ত্রে এদের সংখ্যা হল ৩২। এছাড়া অর্থশাস্ত্রে ‘সমাহর্তা’ ও ‘সন্নিধাতা’ নামে দুই শ্রেণীর অমাত্যের উল্লেখ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় প্রশাসন

মৌর্যশাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রিকতা খুব প্রবল ছিল। এই শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে বিরাজ করতেন রাজা। রাজার বিচার বিভাগীয় কর্তব্য কম ছিল না; রাজা সারাদিন রাজসভায় বসে থেকে প্রজাদের আর্জি শুনতেন এবং বিচার করতেন। এমনকী তার অঙ্গ সংবাহনের সময় তিনি সভা ছেড়ে যেতেন না।
রাজাকে শাসন কার্যে সাহায্য করার জন্য মন্ত্রী পরিষদ ছিল। গ্রিক লেখকরা এদের বলতেন উপদেষ্টা ও রাজস্ব সংগ্রাহক। রাজ্যের শাসন পরিচালনার জন্য রাজা নানাবর্গের কর্মচারী নিয়ােগ করতেন। এই সকল ‘উচ্চ কর্মচারীরা’ ‘অমাত্য’ ও ‘সচিব’ নামে পরিচিত ছিলেন। মেগাস্থিনিস এদের একটি স্বতন্ত্র জাতি বলে ভুল করেন। এরা সকলেই অভিজাত শ্রেণী। বৌদ্ধ সাহিত্যে “অমাত্যকুল” কথাটির উল্লেখ দেখা যায়।
রাজা বহুসংখ্যক গুপ্তচর নিয়ােগ করতেন। মেগাস্থিনিস এদের বলেছেন “ওভারসিয়ার”। গুপ্তচর প্রদেশের কাজকর্মের উপর কড়া নজর রাখতেন।

সামরিক বিভাগ বা সামরিক প্রশাসন

মেগাস্থিনিস মৌর্য সামরিক বিভাগের ৩০ সদস্যের ৬ সমিতির কথা বলেছেন। এই ৬ সমিতি নৌবহর, যােগাযােগ সরবরাহ বিভাগে, পদাতিক, অশ্বারােহী, রথবাহিনী, হস্তিবাহিনী বিভাগের দায়িত্ব বহন করতাে। মেগাস্থিনিস বলেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সেনাবাহিনীতে ৬ লক্ষ স্থায়ী সেনা ছিল। এই সেনাবাহিনী গঠিত ছিল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লােকজন নিয়ে। তারা রাষ্ট্র থেকে নিয়মিত বেতন পৈত। সেনাবাহিনীতে যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ছিল। সাধারণত চারটি ঘােড়ার দ্বারা রথ টানা হ’ত। প্রতিটি রথে দুজন করে সেনা থাকতাে, পদাতিক বাহিনীর হাতে থাকত প্রশস্ত তরবারি। এছাড়া অন্যান্য অস্ত্রের মধ্যে ছিল বর্শা, তীর ও ধনুক।

পৌর এবং স্থানীয় শাসন

মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রের নগর শাসনের জন্য ৩০ জন সদস্য দ্বারা গঠিত ৬টি সমিতির উল্লেখ করেছেন। এই সমিতিগুলি ছিল স্বয়ংশাসিত। প্রতি সমিতিতে থাকতে পাঁচজন সদস্য। এই সমিতিগুলি হল যথাক্রমে—(a) শ্রমশিল্প, (b) বৈদেশিকদের তদারকি, (c) জন্ম ও মৃত্যুর হিসাব রক্ষা (d) খুচরা ও পাইকারি বিক্রয় পরিচালনা (e) শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রয়ব্যবস্থা, (f) বিভিন্ন দ্রব্যের বিক্রিত দাম হ’তে (১/১০) কর আদায়। মেগাস্থিনিস শহরের আধিকারিক (Officer) দের “এস্তেনােমাই” “যদি মেগাস্থিনিসের বর্ণনা সত্য হয় তবে মৌর্য শাসন ছিল পুলিশী শাসন”—এই মন্তব্য ঐতিহাসিক বেসান্ত-এর।

মেগাস্থিনিস স্থানীয় আধিকারিকদের বলেছেন “এগ্রোনােমাই”। তারা জলসেচ, জমি পরিমাপ, বন আইন কার্যকর করা, কৃষিকাজ দেখাশােনা করা, খনি, ছুতােরের কাজ ও ধাতু শিল্পের তত্ত্বাবধান করতাে। তাছাড়াও রাজস্ব সংগ্রহ, রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রস্তর ফলক নির্মাণ করার কাজও তারা দেখাশােনা করতাে।

জনগণ এবং সমাজ

মেগাস্থিনিস ভারতীয় সমাজের জাতিব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। মেগাস্থিনিস বৃত্তি বা জীবিকার ভিত্তিতে জাতি বিভাগ করেছেন। মেগাস্থিনিসের “ইন্ডিকা” গ্রন্থে ভারতের ৭টি জাতির অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই ৭টি জাতি হ’ল—(a) দার্শনিক (ব্রাহ্মণ), (b) কৃষক, (c) ব্যাধ এবং শিকারী, (d) শিল্পী ও কারিগর (e) যােদ্ধা বা সৈন্য (f) পরিদর্শক, (g) রাজার পরামর্শদাতা ও সম্পত্তির মূল্যনির্ধারক।

মৌর্যযুগে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল না বলে মেগাস্থিনিস বলেছেন। মেগাস্থিনিসের মতে সব ভারতীয়রা স্বাধীন; তাদের মধ্যে একজনও ক্রীতদাস নেই। আসলে গ্রীসে দাসদের প্রতি যেরকম কঠোর ব্যবহার করা হত ভারতে তা কখনাে করা হত না। ভারতের দাসরা ছিল সম্ভবত “গৃহদাস”।
মৌর্য ফৌজদারী শাসনব্যবস্থা ছিল কঠিন—কারাদণ্ড, অঙ্গচ্ছেদ, প্রাণদণ্ড, প্রভৃতি কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে জরিমানা করার প্রথা ছিল।

ধনী লােকেরা নগরে বসবাস করতাে। তারাছিল বিলাসী ও আরামপ্রিয়। কৃষক, গৃহপতি ও অন্যান্য লােকেরা সাধারণত জনপদে বসবাস করতাে। জনগণ ছিল সৎ ও সরল। সাধারণত চুরি ডাকাতির ঘটনা ঘটতাে না। লােকেরা রাত্রে সদর দরজা খুলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতেন।

সমাহর্তা ছিল রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান। স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক ছিলেন রাজুক। রাজস্ব আসত ভূমি, জলসেচ, শুল্ক আদায়, রাস্তাকর, দোকানকর, ফেরীঘাটকর, বন, পতিত জমি, চাষযােগ্য জমি, হস্তশিল্প, জুয়া ইত্যাদি থেকে। অন্যান্য শ্রেণীর আয়ছিল পিণ্ডকর যেটি গ্রামের লােকেরা দিত। এছাড়া ছিল সেনাভক্তম কর। যে অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে সেনাবাহিনী যেত সেখানে কর দিতে হত। সন্নিধাতা ছিল রাজস্ববিভাগের প্রধান। তিনি ছিলেন কোষগৃহ, বা কোষাগারের প্রধান পরিদর্শক বা তত্ত্বাবধায়ক। ভূমিরাজস্বের হার ১/৬ বা ১/৪ শতাংশ।

মৌর্য সেনাবাহিনীতে ৬ লক্ষ পদাতিক, ৩০ হাজার অশ্বারােহী, ৯ হাজার হস্তিবাহিনী ও ৮ হাজার রথবাহিনী ছিল। এটি ছিল সেনাপতির তত্ত্বাবধানে। পদাতিক বাহিনীর প্রধান হলাে পদাধ্যক্ষ, হস্তিবাহিনীর প্রধান হলাে হস্তাধ্যক্ষ, অশ্ববাহিনীর অশ্বাধ্যক্ষ, রথবাহিনীর রথাধ্যক্ষ, নৌবাহিনীর নবাধ্যক্ষ এবং বর্মবাহিনীর আযুধাগারাধ্যক্ষ। কৌটিল্য বিভিন্ন শ্রেণীর যােদ্ধার কথা বলেছেন। যারা বংশগত সেনাবাহিনীতে আসত তাদের বলা হত মৌলা। যারা বণিক এবং বৈশ্যসম্প্রদায় থেকে সেনাবাহিনীতে আসত তাদের বলা হত ভৃত্যক’। যারা বন্য উপজাতি থেকে সেনাবাহিনীতে আসত তাদের বলা হত ‘অটবিল’। যারা বিভিন্ন আত্মীয় বা নিকট সম্পর্কের থেকে আসত তাদের বলা হত মিত্রবল। কৌটিল্যর মতে সেনাপতিরা বাৎসরিক বেতন পেতেন ৪৮ হাজার পান, প্রশস্ত পেতেন ২৪ হাজার পান, নায়ক পেতেন ১২ হাজার পান, মুখ্য পেতেন ৮ হাজার পান, অধ্যক্ষ পেতেন ৪ হাজার পান, এছাড়া একজন সাধারণ সৈনিক পেতেন ৫০০ পান। বেতন নগদে দেওয়া হত।

কৌটিল্য দু-প্রকারের বিচারব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন, যথা ধর্মাস্ত্রীয় ও কুণ্টকশােধন। প্রথমটি ছিল দেওয়ানী আদালত ও দ্বিতীয়টি ছিল ফৌজদারী আদালত। আঞ্চলিক বিচারালয়গুলিতে বিচার করত অমাত্য ও প্রদেষ্টিন নামক কর্মচারী। কৌটিল্য চারপ্রকারের আইনের উৎসের কথা বলেছেন। যথা ধর্ম (পবিত্র আইন), ব্যয়বরাহ চরিতম এবং রাজশাসন। ফৌজদারী শাসন ছিল কঠোর। জরিমানা, কারাদণ্ড, অঙ্গচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি শাস্তি দেওয়া হত। পুলিশ চৌকি অবস্থিত ছিল শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রে। ৮০০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল স্থানীয় বা জনপদ। ৪০০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল দ্রোণমুখ। ২০০টি গ্রাম নিয়ে কর্বাচিকা এবং ১০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল সংগ্ৰহন। জেলখানাকে বলা হত বন্ধনগর। বিভিন্ন পুলিশ লকআপকে বলা হত চরক। জেলের প্রধানকে বলাহত বন্ধনগরাধ্যক্ষ। অশােক তার ২৬ বছরের রাজত্বের ২৫ বার জেল থেকে কয়েদি মুক্তির ব্যবস্থা করেন।

দু-প্রকারের গুপ্তচর ছিল। “সমস্থা’ বা স্থায়ী গুপ্তচর এবং যারা সর্বদা ঘুরে বেড়াত তাদের বলা হত ‘সঞ্চার’। ছাত্র, গৃহী এবং বিষকন্যাদের নিয়ােগ করা হত গুপ্তচরবৃত্তিতে। কৌটিল্য পুণ্য রাজনৈতিক দূতকে বলেছেন নিশরি এস্থার্ত দূত। যখন কোনাে দূত আলােচনার জন্য যেত তখন তাকে বলা হত ‘পরিমিতার্থ দূত’। শাসনহার দূত ছিল বিশেষদৃত। রাজপরিবারের তত্ত্বাবধায়ক যিনি রাজপরিবারের রান্নার কাজ দেখাশােনা করতেন তাকে বলা হত দৌবারিক।

প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসন

অশােকের সময় মৌর্য সাম্রাজ্য পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশগুলি হল উত্তরাপথ (রাজধানী তক্ষশিলা), অবন্তীৱাত্তা (রাজধানী উজ্জয়িনী), দক্ষিণাপথ (রাজধানী সুবর্ণগিরি), কলিঙ্গ (রাজধানী তােশালি) এবং প্রাচ্য (রাজধানী পাটলিপুত্র)। ভাইসরয় বা শাসনকর্তা এইসব প্রদেশগুলিতে শাসন করত। আর্যপুত্র বা যুবরাজদের সাধারণত নিয়ােগ করা হত এইসব প্রদেশগুলির শাসনকার্যে। এছাড়া প্রদেষ্ট্রি বা প্রাদেশিক নামে কর্মচারী নিয়ােগ করা হত। তাদের কাজ ছিল রাজস্ব, বিচার ইত্যদির তত্ত্বাবধান করা। তারা সমাহর্তাদের সরাসরি সাহায্য করত।   

জেলার প্রধান ছিল রাজুক। তাকে সাহায্য করত যুক্তসি নামে কর্মচারী। পাঁচটা থেকে দশটা গ্রাম নিয়ে গঠিত হত গােপ এবং স্থানিক। গােপের কাজ ছিল হিসাব রক্ষা করা এবং স্থানিকের কাজ ছিল রাজস্ব সংগ্রহ করা। গ্রামের শাসনের দায়িত্ব ছিল গ্রামনি নামক কর্মচারীর উপর। পৌরশাসন ব্যবস্থা ছিল নাগরিক কর্মচারীদের উপরে।   মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি ছিল অতিকেন্দ্রিকতা। মৌর্য শাসন ব্যবস্থা ছিল প্রথম ভারতীয় রাজকীয় শাসনব্যবস্থা। মৌর্য শাসন ব্যবস্থার অনুপ্রেরণায় মুঘল ও ব্রিটিশরা ভারতে শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলে।

মৌর্য অর্থনীতি

মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় পাঁচ প্রকারের জমির মালিকানা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এগুলি হল—(a) কৃষকের বংশানুক্রমিক মালিকানাভিত্তিক জমি।(b) সমষ্টিগত মালিকানাভিত্তিক জমি।(c) গৃহপতি বা বড়াে মাপের জমিদার।(d) সীতা জমির মালিকানা ছিল রাজার।(e) রাজ্য মালিকানা। মৌর্যযুগে রাজা এবং রাজ্য বা রাষ্ট্রের মধ্যেকোনাে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য ছিল না।   জমির মালিকানাকে ধর্মশাস্ত্রে “স্বামীত্ব” বলা হয়েছে। মৌর্য যুগেদু-ধরনের জমির কথা বলা হয়েছে। যথা—(a) কৃষকের জমি বা চাষযােগ্য জমি। (b) রাজার খাস জমি বা সীতা জমি।   মৌর্য যুগে দু-ধরনের রাজস্বের কথা জানা যায়। যথা—ভাগ এবং বলি। ভাগ ছিল রাষ্টজমি অর্থাৎ কৃষকদের মালিকানা বা সমষ্টিগত মালিকানার জমি থেকে রাজস্ব হিসাবে ১/৬ ভাগ রাজস্ব গ্রহণ। এজন্য জেমিনী রাজাকে ‘ষট ভাগিশ’ অর্থাৎ ছয় ভাগের এক ভাগ ভােগকারী বলেছেন। আর ‘বলি’ ছিল অতিরিক্ত ভূমি কর। লুম্বিনী শিলালিপি থেকে জানা যায় যে বুদ্ধের জন্মস্থানের জন্যে অশােক প্রজাদের প্রদেয় ভাগ কর কমিয়ে ১/৪ শতাংশ করেন এবং বুলিকর লােপ করেন লুম্বিনী অঞ্চলে।

মৌর্যযুগে সাধারণত ১/৬ বা ১/৪ শতাংশ হারে কর গ্রহণ করা হত। গ্রামগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হত। যথা—উচ্চ, মধ্য এবং নিম্নগুণ সম্পন্ন যে সব গ্রাম থেকে সৈন্য সংগৃহীত হত, সেই সব গ্রামকে পরিহার অর্থাৎ কর মুক্ত বলে ঘােষণা করা হত। লবণ উৎপাদন সরকারের একচেটিয়া অধিকার ছিল। মহাস্থানগড় শিলালিপিতে গাঙ্গেয় উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের কথা জানা যায়।

মৌর্যযুগের সমাজ ব্যবস্থা 

মৌর্যযুগে বৈশ্য এবং শূদ্রদের মধ্যে ব্যবধান অনেক কমে এসেছিল। এদের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি। সমাজে ব্রাহ্মণদের মুখ্যস্থান ছিল।   

মৌর্যযুগে সমাজে নারীরস্থান খুব উঁচুতে ছিল না। পুরুষেরা বহু বিবাহ করত। সতীদাহ প্রথা বিদ্যমান ছিল। নারীদের গুপ্তচরের কাজে, রাজার দেহরক্ষার কাজে, রাজপ্রাসাদের রক্ষী প্রভৃতি কাজে নিয়ােগ করা হত। ইতিঝক মহামাত্র নামে কর্মচারীরা নারীদের উন্নতির প্রতি দৃষ্টি রাখত। গণিকাধ্যক্ষ ছিলেন পতিতাদের দেখাশােনার প্রধাণ, কর্মচারী।   

অর্থশাস্ত্রে এবং জাতকে দাস ব্যবস্থার কথা আছে। দাসদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হত। ভাড়াটে শ্রমিকরা সমাজে দাসদের থেকে অনেক বেশি সম্মান পেত। ভিস্তির ছিল বেগার শ্রমিক। তাদের জোর করে কাজে লাগানাে হত। এর জন্য কোনাে পারিশ্রমিক তারা পেত না।

মৌর্যযুগের শিল্পকলা

অশােকের পূর্বে স্থাপন্ত সৌধগুলি কাঠের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। অশােকের সময় থেকে পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। পাথরের ব্যবহার শুরু হওয়ার প্রধান কারণ ছিল অ্যাকামেনীয় পারসিকদের প্রভাব। মৌর্যযুগের শিল্পকলাকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। যথা-(a) স্তম্ভ স্থাপত্য (b) স্কুপ স্থাপত্য (c) গুহা স্থাপত্য (d) রাজপ্রাসাদের স্থাপত্য এবং (e) টেরাকোটা স্থাপত্য।   পিলার বা থামগুলি দু-ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিল। (a) লাল এবং সাদা বেলেপাথর এবং (b) হলুদবর্ণের সুন্দর দানা বিশিষ্ট কঠিন বেলেপাথর। পাথরগুলি সাধারণত মথুরা এবং চুনার থেকে আনা হত। পাথর কাটা এবং খােদাই করার কাজে নিয়ােজিত দক্ষ শ্রমিকরা সাধারণত তক্ষশিলা থেকে আসত। রাজধানী ছিল স্তম্ভের তৃতীয় ভাগ। এটিতে তিনটি ভাগ ছিল। যথা—(a) কিছু পশুর চিত্র সুন্দরভাবে খােদাই করা। তাদের মধ্যে সিংহ এবং হাতির প্রাধান্য বেশি ছিল। (b) পশুদের মধ্যে পবিত্র ‘ধর্মচক্র’-এর চিহ্ন খােদাই করা হত। ধর্মচক্রে ২৪টি দণ্ড ছিল। (c) ঘণ্টার আকৃতি চূড়া বা উল্টানাে পদ্মের আকার।   সারনাথের সিংহ-শীর্ষ স্তম্ভ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন ভারত সরকার এটিকে জাতীয় প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করেছে। চূড়াটি ৭ ফুট উঁচু। সারনাথের ৪টি সিংহমূর্তি পরস্পরের দিকে পিছন করে দাঁড়ান অবস্থায় খােদাই করা। সিংহগুলির পিঠের উপর একটি চক্র। এতে ৩২টি শিক আছে। চূড়ার নিচের দিক ঘণ্টার আকৃতি বা ওল্টানাে পদ্মের মতাে। এর ওপরে চারটি পশুর মূর্তি খােদাই করা হয়েছে। যথা—হাতী, ঘােড়া, যাঁড় ও সিংহ। বৈদিক মতে এটা চারটি দিকের প্রতীক। প্রতিটি প্রাণীর প্রতীকের পাশে ছিল একটি করে চক্র। এই চক্রে ছিল ২৪টি শিক।   

মৌর্য যুগের স্থাপত্যগুলিতে বিভিন্ন শিল্পসুষমা ব্যবহার করা হয়েছে। যথা–(a) বেসনগরের যক্ষীমূর্তি (b) পারঘাম যক্ষমূর্তি (e) দিবারগঞ্জ-এর চৌরিভালুকের মূর্তি এবং (d) ধৌলির পাথরের সিংহমূর্তি।   

স্তুপ হল গােলাকার ইট বা পাথরের তৈরি কঠিন গুহাস্তম্ভ। কথিত আছে যে অশােক ৮৪,০০০ ক্রুপ নির্মাণ করেন। ভূপালের কাছে সাঁচীর স্তুপটি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্তুপটির ব্যাস ছিল ১২১.৫ ফুট। উচ্চতা ছিল ৭৭.৫ ফুট।

মৌর্যযুগের আর একটি ঐতিহ্য হল গুহাস্তম্ভ। গুহাগুলির ভিতরের দেওয়াল ছিল পালিশ করা এবং আয়নার মতাে চকচকে। এগুলি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বসবাস করার জন্য (বিহার) নির্মাণ করা হয়। উপাসনা গৃহ এবং সভাগৃহ (চৈত্য) নির্মাণের উদ্দেশ্যে গুহা স্তম্ভ খােদাই করা হয়। অশােক এবং নাতি দশরথ এরূপ অনেক গুহা নির্মাণ করেন বােধগয়ার কাছে বরাবর পাহাড়ে দুটি বরাবর গুহা-সুদাম এবং লােমাস ঋষিতে দেখা যায় পাথরের স্থাপত্যের উপর কাঠের কাজ।

রাজধানী পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদ এবং হলঘর ছিল সবচেয়ে সুন্দর এবং অত্যাশ্চর্য। রাজপ্রাসাদের আয়তন দেখে ৪০০ খ্রিস্টাব্দে ফা-হিয়েন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। পাটনার কাছে কুমরাহারে ঐ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিল একশত থাম বিশিষ্ট হল ঘরটি। “পারঘাম মূর্তি এবং সারনাথের স্তম্ভ ভারতীয় ভাস্কর্য শিল্পের আলফা এবং ওমেগা হিসাবে গণ্য করা যায়”—বলেছেন মার্শাল।   

অহিচ্ছত্র, পাটলিপুত্র এবং তক্ষশিলাতে টেরাকোটা শিল্পের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলি ছিল প্রাচীন মূর্তি, দেব-দেবীর মূর্তি, খেলনা, পাশা, অলংকার এবং পুতি। খেলনাগুলিতে পশুতে টানা চাকা ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে হাতি ছিল প্রিয়। অলংকারগুলি ছিল গােলাকার। এগুলি ব্যবহার করা হত অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষাপাবার জন্য।অর্থশাস্ত্র : কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র রচনা করেন। অর্থশাস্ত্রের রচনা আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে শুরু হয়। কৌটিল্যের অপর নাম ছিল চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত। একটি তালপাতায় রচিত প্রাচীন পুঁথি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে মহীশূরের ডঃ আর. শ্যামাশাস্ত্রী আবিষ্কার করেন। এই পুঁথিতে ভট্টস্বামীনের টীকা ছিল। ডঃ আর শ্যামাশাস্ত্রী ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশ করেন এবং ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এটি ইংরাজিতে অনুবাদ করা হয়। বােম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ আর. পি কাঙ্গল বহু বছর ধরে এই পুঁথির পাঠোদ্ধার এবং অনুবাদ করার কাজে নিয়ােজিত থাকেন। এই গ্রন্থটিতে ১৫টি অধিকরণ বা বই ছিল। এক নম্বর বইটিতে ছিল ১৫০টি অধ্যায়এবং পদ্যে লেখা এবং ১৮০টি প্রকরণ ছিল। কৌটিল্য দুটি বিষয়ের উপর খুব গুরুত্ব আরােপ করেন। এই দুটি বিষয় হল—(a) আন্তর্জাতিক প্রশাসনের বিভিন্ন দিক এবং বিষয়ের উপর বিশ্লেষণ।(b) রাজ্যগুলাের মধ্যে সম্পর্ক যেহেতু রাজ্যগুলাে বৃত্তাকারে পরিবেষ্টিত।

কৌটিল্যের নীতিসমূহ বিশ্বজনীন গ্রহণযােগ্য। কীভাবে আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তােলা যায় এবং আদর্শ রাষ্ট্রের গঠনের উপাদান সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে বিশদ আলােচনা করা হয়েছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত অধ্যক্ষগণ :

1. আকরাধ্যক্ষ খনি এবং ধাতুশিল্পের প্রধান নিয়ন্ত্রক।
2. অক্ষ পাতালাধ্যক্ষ হিসাব বা অ্যাকাউন্ট বিভাগের প্রধান।
3. অশ্বাধ্যক্ষ অশ্বারােহী বাহিনীর প্রধান।
4. আয়ধাগারাধ্যক্ষ অস্ত্র কারখানার প্রধান।
5. বন্ধনাগারাধ্যক্ষ কারাগার বা জেলের প্রধান পরিচালক।
6. দেবতাধ্যক্ষ মন্দিরসমূহের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক।
7. দূতাধ্যক্ষ জুয়াখেলার প্রধান নিয়ন্ত্রক।
8. গণিকাধ্যক্ষ বিনােদন বিভাগের প্রধান।
9. গাে-অধ্যক্ষ গরুর পালের প্রধান নিয়ন্ত্রক।
10. হস্তি অধ্যক্ষ হস্তী বাহিনীর প্রধান।
11. খনি অধ্যক্ষ খনির প্রধান পরিচালক।
12. কোষাধ্যক্ষ কোষাগারের প্রধান।
13. কোষাগারাধ্যক্ষ অস্ত্রাগারের প্রধান।
14. কৃপাধ্যক্ষ বনজ উৎপাদনের প্রধান নিয়ন্ত্রক।
15. লক্ষনাধ্যক্ষ ট্যাকশাল বা মুদ্রা তৈরি বিভাগের প্রধান।
16. লবণাধ্যক্ষ লবণ কমিশনার।
17. লােহাধ্যক্ষ ধাতুর নিয়ন্ত্রক বা পরিচালক।
18. মনাধ্যক্ষ সময় পরিমাপ এবং সময়ের হিসাব রাখার নিয়ন্ত্রক।
19. মদ্রাধ্যক্ষ পাসপাের্ট অফিসার।
20, নাগবানাধ্যক্ষ হস্তী রক্ষী কর্মী।
21. নবধ্যক্ষ জাহাজ চলাচলের নিয়ন্ত্রক।
22. পণিধ্যক্ষ বাণিজ্য বিভাগের পরিচালক।
23. পট্টনাধ্যক্ষ বন্দর এবং পােতাশ্রয়ের নিয়ন্ত্রক।
24. পট্টিধ্যক্ষ পদাতিক বাহিনীর প্রধান।
25. পৌটাধ্যক্ষ ওজন এবং পরিমাপের নিয়ন্ত্রক।
26. রথাধ্যক্ষ রথবাহিনীর প্রধান।
27. সমস্থাধ্যক্ষ ব্যক্তিগত বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক।
28. সীতাধ্যক্ষ চাষযােগ্য জমির পরিচালক।
29. শুল্কাধ্যক্ষ আমদানি রপ্তানী এবং নগর শুল্কের
পরিচালক।
30. সুনাধ্যক্ষ জীব জন্তুর রক্ষাকারী এবং পশুহত্যার
নিয়ন্ত্রণকারী।
31. সুরাধ্যক্ষ মদ্য পানীয়ের নিয়ন্ত্রক।
32. সূত্রাধ্যক্ষ বস্ত্রশিল্পের আধিকারিক।
33. সুবর্ণাধ্যক্ষ মূল্যবান ধাতু এবং রত্নের নিয়ন্ত্রক।
34. ভিভিটাধ্যক্ষ পতিত জমির নিয়ন্ত্রক।

মৌর্যযুগের অধীনস্থ কর্মচারীবৃন্দ :

1. চোরারাজু চোর ধরার কাজে নিয়ােজিত কর্মচারী।
2. গণিকাধ্যক্ষ পতিতাদের প্রধান কর্মচারী।
3. হস্তি পাকা মাহুত।
4. করণিক হিসাবরক্ষক।
5. কর্মিক কাজের আধিকারিক।
6. নড়িপাল নদী রক্ষক বা গার্ড।
7. নাগবনপাল হাতির বনপাল বা রক্ষাকারী।
8. নিবন্ধক জমা খরচের হিসাবরক্ষক।
9. নির্ধায়ক ভাণ্ডার রক্ষক।
10. পাদপাসিক পশুচারণের সীমানা রক্ষক।
11. পাণিঅধিস্থাটার রিটেল আউটলেট ম্যানেজার।
12. পরিকর্মিকা অ্যাটেনড্যান্ট বা যােগদানকারী।
13. রূপদর্শক মুদ্রা পরীক্ষাকারী।
14. সৈনিক বর্ডার বা সীমান্ত রক্ষাকারী।
15. সংখ্যায়ক হিসাবরক্ষক বা Accountant.
16. তজ্জাত মূল্য স্থিরকারী বিশেষজ্ঞ।
17. তৎপুরুষ করণিক বা clerk.
18. বনচারিকা শিকারী অনুসরণকারী বা Tracker,
19. বনপাল। বনকর্মী বা বনরক্ষাকারী।
20. উপযুক্ত অধীনস্থ আধিকারিক।

Short Notes on Mauryan Empire (মৌর্য বংশের উত্থান ও পতন)

  1. মগধের সিংহাসনে মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠিত হয় (৩২৪ খ্রীষ্ট পূর্ব)।
  2. চন্দ্রগুপ্ত এর অপর উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে গ্রীক শাসনের অবসান ঘটানো।
  3. আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য তার সেনাপতিদের মধ্যে বিভক্ত হয়। সিরিয়া ও ভারতবর্ষ- সহ পশ্চিম এশিয়া তার সেনাপতি সেলুকাস এর ভাগে পরে। ফলে তাকে চন্দ্রগুপ্ত র মুখোমুখি হতে হয়।
  4. দুই পক্ষের আদৌ কোনো যুদ্ধ হয়েছিল কিনা বা যুদ্ধ হলে তার ফলাফল কি হয়েছিলো সেই সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। অবশ্য তাদের মধ্যে একটা সন্ধির কথা উল্লেখ আছে। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী সেলুকাস অনেক জায়গা চন্দ্রগুপ্ত কে ছেড়ে দেন এবং নিজ কন্যা হেলেনের সঙ্গে বিবাহ দেন।
  5. সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত র রাজসভায় মেগাস্থিনিস নামে একজন গ্রীক দূতকে পাঠান। তিনি ৩০৪ খ্রীষ্ট পূর্ব থেকে ২৯৯ খ্রীষ্ট পূর্ব পর্যন্ত পাটলিপুত্রে ছিলেন।
  6. শক রাজা রুদ্রদামণের জুনাগড় শিলালিপি থেকে জানা যায় যে তিনি পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র বা গুজরাট জয় করেন। এখানে তার শাসনকর্তা পুষ্যগুপ্ত জলসচের জন্য সুদর্শন হ্রদ খনন করেন।
  7. এছাড়া তিনি দক্ষিণ ভারত ও জয় করেন বলে জৈন গ্রন্থ থেকে জানতে পারি।
  8. চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন ছেড়ে দেবার পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে বসেন।
  9. তার উপাধি ছিল আমিত্রাঘাত বা শত্রুনিধনকারি। তার রাজত্বকাল এর কোনও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না।
  10. পিতার মতো তিনিও গ্রীকদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখেন। সিরিয়ার রাজা সেলুকাস এর পুত্র প্রথম অন্টিওকাস তার রাজসভায় ডেইমেকস নামে এক দূত পাঠান।
  11. মিশর রাজা টলেমি ফিলা- ডেলফাস তার রাজসভায় ডাইওনিসাস নামে জনৈক দূত পাঠান।
  12. বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন।
  13. পালি ভাষায় রচিত দুটি সিংহলী গ্রন্থ মহাবংশ ও দীপবংশ এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থ দিব্যবদান থেকেও তার রাজত্বকাল সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।
  14. পিতার রাজত্বকালে তিনি উজ্জয়িনি ও তক্ষশিলার শাসনকর্তা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর অশোক তার নিরানব্বই জন ভ্রাতা কে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
  15. ২৭৩ খ্রীষ্ট পূর্ব অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তাঁর রাজ্য অভিষেক হয় চার বছর পর ২৬৯ খ্রীষ্ট পূর্বাবদে।
  16. সম্রাট অশোক রাজ্য অভিষেকের নবম বর্ষে ২৬০ খ্রীষ্ট পুর্বাবদে তিনি বাংলার সুবর্ণরেখা নদী থেকে গোদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানে অবস্থিত বর্তমান উড়িষ্যা ও অন্ধ্রের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন।
  17. বানিজ্যিক সার্থের তাগিদে মগধের পক্ষে কলিঙ্গ জয় অপরিহার্য ছিল। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপি থেকে কলিঙ্গ যুদ্ধের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। এই যুদ্ধে এক লক্ষ লোক নিহত, দেড় লক্ষ লোক বন্দী এবং বহু সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান।
  18. কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা অশোকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি অনুশোচনায় ভোগেন এবং মানসিক শান্তি লাভের আশায় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।
  19. তিনি রাজ্য বিজয় এর পরিবর্তে ধম্মবিজয় নীতি গ্রহণ করেন। রাজ্যের সর্বত্র প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ হয়। এমনকি রাজকীয় রন্ধন শালা তেও প্রাণী হত্যা রদ করা হয়। তিনি ঘোষণা করেন যে সকল প্রজাই তার সন্তান।
  20. শুধু মাত্র নিজ রাজ্যেই নয়, তিনি বিভিন্ন দেশেও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ধর্ম দূতদের পাঠান।
  21. মহারাষ্ট্রে মহাধর্মরক্ষিত, উত্তর কানাডায় রক্ষিত, ব্রহ্ম দেশ ও তার দক্ষিণ পূর্বে শোন ও উত্তর এবং সিংহল এ যান তার পুত্র ও কন্যা মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা।
  22. অশোকের প্রচারের ফলে ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। শিল্পকর্মে তিনি কাঠের পরিবর্তে পাথরের ব্যবহার শুরু করেন।এর ফলে তক্ষন শিল্পে বিবর্তন আসে।
  23. তিনি ৮৪ হাজার স্তূপ নির্মাণ করেন। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি পালি ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপি ব্যবহার করেন।
  24. পৃথিবীর রাজতন্ত্রের ইতিহাসে রাজ কর্তব্যের এমন মহান আদর্শ আর কেউ স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায় না। তাই তাকে রাজর্ষি বলা হয়।
  25. সম্রাট অশোকের মৃত্যু হয় আনুমানিক ২৩২ খ্রিস্ট পূর্বে। তার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
  26. পুরাণ ও বানভট্ট এর হর্ষচরিত এ মগধের শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথ এর উল্লেখ আছে। তার শুঙ্গ বংশীয় সেনাপতি পুষ্যমিত্র তাকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন।
  27. এইভাবে মগধের সিংহাসনে মৌর্য বংশের অবসান হয় এবং শুঙ্গ বংশের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

Short Question-Answer on Mauryan Empire (মৌর্য বংশের উত্থান ও পতন)

  1. মৌর্য বংশ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
    উঃ মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
  2. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কখন সিংহাসনে আরােহণ করেন ?
    উঃ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিঃ পূঃ ৩২৪ অব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন।
  3. কোন মৌর্য সম্রাটকে ‘ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সার্বভৌম সম্রাট’ বলা হয় ?
    উঃ মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে ‘ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সার্বভৌম সম্রাট’ বলা হয়।
  4. মেগাস্থিনিস কে ছিলেন?
    উঃ মেগাস্থিনিস ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় সেলুকাস প্রেরিত গ্রিক দূত।
  5. ইন্ডিকার লেখক কে?
    উঃ ইন্ডিকার লেখক হলেন মেগাস্থিনিস।
  6. অর্থশাস্ত্র কে রচনা করেন?
    উঃ অর্থশাস্ত্র রচনা করেন চাণক্য বা কৌটিল্য।
  7. কৌটিল্য কে ছিলেন?
    উঃ কৌটিল্য ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা।
  8. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কোথায় দেহত্যাগ করেন?
    উঃ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মহীশুর রাজ্যের শ্রবণবেলগােলায় দেহত্যাগ করেন।
  9. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কোন ধর্মাবলম্বী ছিলেন ?
    উঃ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
  10. অমিত্রাঘাত কার উপাধি ?
    উঃ বিন্দুসারের উপাধি ছিল অমিত্রাঘাত।
  11. অশােক কখন সিংহাসনে আরােহণ করেন?
    উঃ অশােক খ্রিঃ পূঃ ২৭৩ অব্দে (মতান্তরে, খ্রিঃ পূঃ ২৬৯ অব্দে) সিংহাসনে আরােহণ করেন।
  12. মৌর্যবংশের তৃতীয় সম্রাট কে ছিলেন?
    উঃ মৌর্যবংশের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন সম্রাট অশােক।
  13. দেবানামপ্রিয় ও প্রিয়দর্শী উপাধি কে গ্রহণ করেন ?
    উঃ অশােক দেবানামপ্রিয় ও প্রিয়দর্শী উপাধি গ্রহণ করেন।
  14. অশােকের প্রধানা মহিষী কে ছিলেন ?
    উঃ অশােকের প্রধানা মহিষী ছিলেন তিষ্যরক্ষিতা।
  15. অশােকবাদ কী ?
    উঃ বৌদ্ধ ধর্মের সংশােধিত সংস্করণ রূপে অশােকের ধর্মমতকে অশােবাদ বলা হয়।
  16. ‘সব মুনিষে পজা মমা (সকল মানুষই আমার সন্তান)–কার উক্তি ?
    উঃ সম্রাট অশােকের উক্তি।
  17. কে সর্বপ্রথম অশােকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন ?
    উঃ জেমস প্রিন্সেপ সর্বপ্রথম অশােকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন।
  18. ভারতে বিদেশি আক্রমণের সুচনা কে করেন?
    উঃ পারস্যের আকেমনীয় বংশের রাজা কাইরাস বা কুরুস (খ্রিঃ পূঃ ৫৫৮-৫৩০ অব্দ) ভারতে
    বিদেশি আক্রমণের সূচনা করেন।
  19. আলেকজান্ডার কখন ভারত আক্রমণ করেন ?
    উঃ আলেকজান্ডার খ্রিঃ পূঃ ৩২৭ অব্দে ভারত আক্রমণ করেন।
  20. তক্ষশিলার কোন ভারতীয় শাসক প্রথমে আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন ?
    উঃ তক্ষশিলার রাজা অন্তি প্রথম আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।
  21. আলেকজান্ডার কোন দেশের রাজা ছিলেন ?
    উঃ আলেকজান্ডার গ্রিস দেশের ম্যাসিডনের রাজা ছিলেন।
  22. রেশম পথ (Silk route) কী ?
    উঃ চিনের বিখ্যাত রেশম বস্ত্রাদি মধ্য এশিয়ার যে পথ ধরে ইরান ও রােম সাম্রাজ্যে বাণিজ্য হত, তা রেশম পথ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত।
  23. মৌর্য বংশের শেষ সম্রাটের নাম কী ?
    উঃ মৌর্য বংশের শেষ সম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ।
  24. পুষ্যমিত্র শুঙ্গা কে ছিলেন ?
    উঃ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ছিলেন মগধে শুঙ্গবংশের প্রতিষ্ঠাতা যিনি শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন।
  25. মৌর্যযুগে সমাজ কীসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ?
    উঃ মৌর্যযুগের সমাজ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ছিল সমাজের চারটি প্রধান বর্ণ। এছাড়া ছিল অনেক নীচ বর্ণের মানুষ।
  26. কীভাবে গ্রিসের সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে ?
    উঃ আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলে গ্রিসের সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে।
  27. প্রাক-মৌর্য ও মৌর্যযুগের অর্থনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য কী ছিল ?
    উঃ প্রাক-মৌর্য ও মৌর্যযুগের অর্থনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল নগর জীবন ও বাণিজ্য নির্ভরতা।

আরো পড়ুন :

হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা
বৈদিক সভ্যতা
ষোড়শ মহাজনপদ
মগধের উত্থান
মৌর্যওর ভারত | সাতবাহন বংশ | কুষান শাসন
সাতবাহন বংশ | কুষান শাসন
গুপ্ত সাম্রাজ্য
বলভীর মৈত্রক বংশ | বাকাটক বংশ | মৌখরী বংশ | কলিঙ্গ | বাংলা | থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশ
চোল বংশ | চালুক্য বংশ | পল্লব বংশ
ভারতের ইতিহাস

Leave a Comment

Scroll to Top