উদারনীতিবাদ, মার্কসবাদ, ফ্যাসিবাদ ও গান্ধিবাদ

উদারনীতিবাদ, মার্কসবাদ, ফ্যাসিবাদ ও গান্ধিবাদ | Liberalism, Marxism, Fascism and Gandhism

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

  1. উদারনীতিবাদকে কয়টি অর্থে ব্যবহার করা হয় এবং কী কী?
    উত্তর: উদারনীতিবাদকে দুটি অর্থে ব্যবহার করা হয়। যথা—সংকীর্ণ অর্থে এবং ব্যাপক অর্থে।
  2. ‘Liberalism’ শব্দটির উৎপত্তি হয় কোন স্পেনীয় শব্দ থেকে ?
    উত্তর: স্পেনীয় ‘Liberales’ শব্দ থেকে Liberalism শব্দটির উৎপত্তি হয়।
  3. উদারনীতিবাদকে কটি ভাগে ভাগ করা যায় এবং কী কী?
    উত্তর: উদারনীতিবাদকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—(ক) সনাতন উদারনীতিবাদ এবং (খ) আধুনিক উদারনীতিবাদ
  4. উদারনীতিবাদের মূলনীতি কী?
    উত্তর: উদারনীতিবাদের মূলনীতি হল ব্যক্তি-স্বাধীনতা।
  5. ‘Liberalism’ এর উৎপত্তি হয় কোন্ লাতিন শব্দ থেকে ?
    উত্তর: ‘Liberalism’-এর উৎপত্তি হয় লাতিন শব্দ ‘Liber’ থেকে। যার অর্থ হল স্বাধীন।
  6. মার্কসবাদ কাকে বলে ?
    উত্তর: রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন ও মাও সে-তুং-এর আলােচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মার্কসবাদ নামে পরিচিত।
  7. মার্কসবাদের তিনটি মূলনীতি কী?
    উত্তর: মার্কসবাদের তিনটি মূলনীতি হল— (ক) দ্বন্দ্বতত্ত্ব, (খ) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং (গ) উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব।
  8. উৎপাদন কাকে বলে?
    উত্তর: মানুষের কর্মদক্ষতা, বিভিন্ন বস্তু ও শক্তির দ্বারা সৃষ্ট বস্তুতে যার উপযােগিতা আছে তাকে উৎপাদন বলে।
  9. কয়েকটি বুর্জোয়া বিপ্লবের নাম উল্লেখ করাে।
    উত্তর: কয়েকটি বুর্জোয়া বিপ্লবের নাম হল—
    (ক) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব, (খ) ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং (গ) ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের বিপ্লব
  10. মার্কসবাদ হল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার সমষ্টি”—উক্তিটি কার?
    উত্তর: ভি. আই. লেনিন বলেন, “মার্কসবাদ হল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার সমষ্টি”।
  11. State and Revolution’ গ্রন্থটির প্রণেতা কে?
    উত্তর: ‘State and Revolution’ গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন ভি.আই.লেনিন।
  12. “A Contribution to the Critique of political Economy”- গ্রন্থটির প্রণেতা কে?
    উত্তর: “A Contribution to the Critique of political Economy”-গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন কার্ল মার্কস
  13. ‘সর্বোদয়’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ কী?
    উত্তর: ‘সর্বোদয়’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ সকলের কল্যাণ।
  14. উদারনীতিবাদের অর্থ কী?
    উত্তর: রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরােধিতা করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির উপযােগী স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করাই হল উদারনীতিবাদ।
  15. ‘ব্যক্তির স্বার্থ হল প্রকৃত স্বার্থ’—এটি কার উক্তি ?
    উত্তর: উদারনীতিবাদী দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম বলেছেন, ব্যক্তির স্বার্থ হল প্রকৃত স্বার্থ’।
  16. মার্কসবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মার্কসের প্রধান সহযােগী কে ছিলেন?
    উত্তর: ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মার্কসবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মার্কসের প্রধান সহযােগী ছিলেন।
  17. লেনিন রাষ্ট্রকে কী বলে অভিহিত করেছেন?
    উত্তর: লেনিন রাষ্ট্রকে শ্রেণি শােষণের যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। “The State is an organ of class rule”
  18. ‘দাস ক্যাপিটেল’ গ্রন্থের রচয়িতা কে?
    উত্তর: কার্ল মাকর্স হলেন ‘দাস ক্যাপিটেল’ গ্রন্থের রচয়িতা।
  19. ‘বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শােষিতের মহােৎসব”— এটি কার উক্তি?
    উত্তর: ভি. আই. লেনিন বলেছেন,—“বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শােষিতের মহােৎসব”।
  20. শ্রমিক কাকে বলে ?
    উত্তর: শ্রমের বিনিময়ে যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের শ্রমিক বলা হয়।
  21. কখন, কার নেতৃত্বে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হয় ?
    উত্তর: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হয়।।
  22. “Hence everything for the State- -উক্তিটি কার?
    উত্তর: ইটালির ফ্যাসিবাদী নেতা মুসােলিনি
    বলেছেন,—“Hence everything for the State”.
  23. “My nationalism is internationalism” —উক্তিটি কার?
    উত্তর: “My nationalism is internationalism”—এই উক্তিটি করেছেন গান্ধিজি
  24. “Unto This Last” বইটির রচয়িতা কে ?
    উত্তর: “Unto This Last” বইটির রচয়িত হলেন জন রাস্কিন
  25. কীভাবে রাজনৈতিক তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে ?
    উত্তর: স্যাবাইনের অভিমত হল ‘ব্যাবহারিক রাজনীতির অংশ হিসাবে রাজনৈতিক তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে।
  26. মার্কসবাদের প্রধান উৎস লেখাে।
    উত্তর: জার্মান চিরায়ত দর্শন, ফরাসি সমাজতন্ত্র এবং ব্রিটিশ অর্থনীতি হল মার্কসবাদের প্রধান উৎস।
  27. কার্ল মার্কসের জন্ম ও মৃত্যু হয় কত খ্রিস্টাব্দে?
    উত্তর: কার্ল মার্কসের জন্ম হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে
  28. কত খ্রিস্টাব্দে ‘Communist Manifesto’ প্রণীত হয়?
    উত্তর: ‘Communist Manifesto’ প্রণীত হয় ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে
  29. গান্ধিজির রাষ্ট্রহীন সমাজের নাম কী ?
    উত্তর: গান্ধিজির রাষ্টহীন সমাজের নাম হল রামরাজ্য।
  30. ফ্রিডম্যান উদারনীতিবাদ বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন?
    উত্তর: ফ্রিডম্যানের মতে উদারনীতিবাদ হল আপন আপন ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি।
  31. শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন কারা?
    উত্তর: উদারনীতিবাদী দার্শনিকগণ শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন।
  32. মার্কস এঙ্গেলস-এর রচিত প্রধান গ্রন্থটির নাম কী?
    উত্তর: মার্কস এঙ্গেলস-এর রচিত প্রধান গ্রন্থটির নাম হল ‘Communist Manifesto’।
  33. ‘আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস’ উক্তিটি কার?
    উত্তর: “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস”—এ কথা বলেছেন মার্কস ও এঙ্গেলস।
  34. কত খ্রিস্টাব্দে ‘দাস ক্যাপিটেল’ (Das Capital) গ্রন্থ রচিত হয়?
    উত্তর: ‘দাস ক্যাপিটেল’ (Das Capital) গ্রন্থটি রচিত হয় ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে
  35. ‘চরিত্রের উপর পরিবেশের প্রভাব’ তত্ত্বের প্রবক্তা কে?
    উত্তর: ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওয়েন হলেন ‘চরিত্রের উপর পরিবেশের প্রভাব তত্ত্বের প্রবক্তা।
  36. উৎপাদন পদ্ধতির কয়টি দিক ও কী কী?
    উত্তর: উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক আছে- উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক।
  37. “যে সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্য থাকে সেই সমাজে সুষ্ঠু জনমত তৈরি হতে পারে না” -এ কথা কে বলেছেন?
    উত্তর: ল্যাস্কি বলেছেন,—“যে সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্য থাকে সেই সমাজে সুষ্ঠু জনমত তৈরি হতে পারে না।”
  38. ফ্যাসিবাদের মূল বক্তব্য কী?
    উত্তর: ফ্যাসিবাদের মূল বক্তব্য হল রাষ্ট্রের অধীনে থেকে রাষ্ট্রের নির্দেশে ব্যক্তিকে কাজ করতে হবে।
  39. মুসােলিনির দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ কী?
    উত্তর: সাম্রাজ্যবাদকে মুসােলিনি জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে গণ্য করেছেন।
  40. জন রাস্কিনের কোন বইটি গান্ধিজির চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল ?
    উত্তর: জন রাস্কিনের লেখা ‘Unto this Last’ গ্রন্থটি গান্ধিজির চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল।
  41. মার্কসের মতে ‘ভিত্তি’ ও ‘উপরি কাঠামাে’ কী ?
    উত্তর: মার্কসের মতে অর্থনীতি হল ‘ভিত্তি’ এবং তার উপর গড়ে ওঠা আইন, কলা, ধর্ম, সাহিত্য প্রভৃতি হল সমাজের ‘উপরি’ কাঠামাে।
  42. শ্রেণিবিভক্ত সমাজের প্রথম পর্যায়ের নাম কী ?
    উত্তর: শ্রেণিবিভক্ত সমাজের প্রথম পর্যায়ের নাম হল দাস সমাজ।
  43. গান্ধিজির চিন্তাধারার সারবস্তু কী?
    উত্তর: গান্ধিজির সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার মূল কথা হল—অহিংসা, সত্যাগ্রহ এবং সর্বোদয়।
  44. ‘সর্বোদয়’ ধারণাটি কোন দার্শনিকের নামের সঙ্গে যুক্ত ?
    উত্তর: গান্ধিজির নামের সঙ্গে ‘সর্বোদয়’ ধারণাটি যুক্ত।
  45. সনাতন বা প্রাচীন উদারনীতিবাদ কোনটি?
    উত্তর: সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উদারনীতিবাদ সনাতন বা প্রাচীন উদারনীতিবাদ নামে পরিচিত।
  46. ‘On Liberty’ গ্রন্থের রচয়িতা কে?
    উত্তর: জন স্টুয়ার্ট মিল হলেন ‘On Liberty’ গ্রন্থের রচয়িতা।
  47. উপযােগিতাবাদ বা হিতবাদের প্রবক্তা কে?
    উত্তর: জেরেমি বেন্থাম হলেন উপযােগিতাবাদ বা হিতবাদের প্রবক্তা।
  48. বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কারা?
    উত্তর: মার্কস ও এঙ্গেলস হলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা।
  49. ‘সত্তাই চেতনাকে নির্ধারিত করে, চেতনা সত্তাকে নির্ধারিত করে না’ -কার উক্তি?
    উত্তর: ‘সত্তাই চেতনাকে নির্ধারিত করে, চেতনা সত্তাকে নির্ধারিত করে না’ —এই উক্তিটি করেছেন কার্ল মার্কস
  50. কোন্ কোন্ অর্থনীতিবিদের দ্বারা মার্কস বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন?
    উত্তর: ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথডেভিড রিকার্ডোর দ্বারা মার্কস বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
  51. শ্রেণি কাকে বলে?
    উত্তর: এমিল বার্নস-এর মতে, একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে সমাজের এরূপ এক একটি অংশ হল এক-একটি শ্রেণি।
  52. মার্কস ও এঙ্গেলস কার বস্তুবাদী ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
    উত্তর: মার্কসএঙ্গেলস ফয়েরবাখের বস্তুবাদী ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
  53. ফ্যাসিবাদ কী ?
    উত্তর: স্বৈরাচারী রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি বিশেষ রূপ হল ফ্যাসিবাদ।
  54. ফ্যাসিবাদ কী ধরনের দলব্যবস্থায় বিশ্বাসী?
    উত্তর: ফ্যাসিবাদ এক দলীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাসী।
  55. সর্বহারা শ্রেণি কাকে বলে ?
    উত্তর: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যারা নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের সর্বহারা শ্রেণি বলা হয়।
  56. ‘সাম্রাজ্যবাদ পরজীবী বা ক্ষয়িয় পুঁজিবাদ’ -উক্তিটি কার?
    উত্তর: ‘সাম্রাজ্যবাদ পরজীবী বা ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ’ —এই উক্তিটি করেছেন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক লেনিন
  57. রামরাজ্য কী?
    উত্তর: গান্ধিজির মতে, সর্বপ্রকার শােষণহীন এবং সাম্য ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ সম্পন্ন সমাজকেই রামরাজ্য বলা হয়।
  58. আধুনিক উদারনীতিবাদ কোনটি?
    উত্তর: বিংশ শতাব্দীর উদারনীতিবাদ আধুনিক উদারনীতিবাদ নামে পরিচিত।
  59. ‘রাজনৈতিক তত্ত্ব’ কাকে বলে?
    উত্তর: রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত বিশেষ চিন্তাভাবনাকে ‘রাজনৈতিক তত্ত্ব’ বলে।
  60. ‘সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুখ’ নীতির প্রবক্তা কে?
    উত্তর: ‘সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুখ’ নীতির প্রবক্তা হলেন বেন্থাম
  61. কার্ল মার্কস-এর রচিত দুটি গ্রন্থের নাম লেখাে।
    উত্তর: কার্ল মার্কস-এর রচিত দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল —‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টে’এবং ‘দাস ক্যাপিটেল’
  62. হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে রূপান্তরিত করেছেন কে?
    উত্তর: কার্ল মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে রূপান্তরিত করেছেন।
  63. বুর্জোয়া বলতে কাদের বােঝানাে হয় ?
    উত্তর: উৎপাদনের উপাদান যাদের হাতে থাকে তাদেরকে বুর্জোয়া বলা হয়।
  64. কখন, কার নেতৃত্বে ইটালিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয় ?
    উত্তর: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মুসােলিনির নেতৃত্বে
    ইটালিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়।
  65. “চিরন্তন যুদ্ধের মাধ্যমেই মানবজাতি সমৃদ্ধ হয়েছে, শান্তির পক্ষে মানবজাতির ধ্বংস  অনিবার্য।” —একথা কে বলেছেন?
    উত্তর: জার্মানির ফ্যাসিবাদী নেতা হিটলার বলেছেন,—“চিরন্তন যুদ্ধের মাধ্যমেই মানবজাতি সমৃদ্ধ হয়েছে, শান্তির পক্ষে নবজাতির ধ্বংস অনিবার্য”।
  66. মার্কস-এর মতে শ্রেণিসংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি কী?
    উত্তর: শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাই হল মার্কসের মতে শ্রেণিসংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি।
  67. কার্ল মার্কসের ইতিহাস-ভিত্তিক দর্শনের নাম কী?
    উত্তর: ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হল কার্ল মার্কসের ইতিহাস ভিত্তিক দর্শন।
  68. সনাতন উদারনীতিবাদের কয়েকজন প্রবক্তার নাম লেখাে।
    উত্তর: কয়েকজন সনাতন উদারনীতিবাদী দার্শনিক হলেন বেন্থাম, হার্বাট স্পেনসার, জেমস মিল, অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডো প্রমুখ।
  69. আধুনিক উদারনীতিবাদের কয়েকজন প্রবক্তার নাম লেখাে।
    উত্তর: কয়েকজন আধুনিক উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিক হলেন হবহাউস, বার্কার, ল্যাস্কি, রুজভেল্ট, চেম্বারলেন প্রমুখ।
  70. কখন উদারনীতিবাদের উৎপত্তি হয়?
    উত্তর: সপ্তদশ শতকে উদারনীতিবাদের উৎপত্তি হয়।
  71. মার্কস-এর দৃষ্টিতে ইতিহাসের চালিকাশক্তি কী ?
    উত্তর: মার্কস-এর মতে বিপ্লব হল ইতিহাসের চালিকা শক্তি।
  72. মার্কসবাদের ভিত্তি কী ?
    উত্তর: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল মার্কসবাদের ভিত্তি।
  73. “ফ্যাসিবাদ এক অভিজ্ঞতাবাদী বা বাস্তববাদী প্রত্যয়, কোনাে তত্ত্ব বা মতবাদ নয়।” -এ কথা কে বলেছেন?
    উত্তর: ইটালির ফ্যাসিবাদী নেতা মুসােলিনি বলেছেন,— “ফ্যাসিবাদ এক অভিজ্ঞতাবাদী বা বাস্তববাদী প্রত্যয়, কোনাে তত্ত্ব বা মতবাদ নয়।”
  74. ফ্যাসিবাদ কী ধরনের জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী?
    উত্তর: উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হল ফ্যাসিবাদ।
  75. “শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে”— কারা এ কথা বলেছেন?
    উত্তর: মার্কসবাদী দার্শনিকরা বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে।”
  76. বিশ্বশান্তিকে কাপুরুষের স্বপ্ন’ (‘A Cowards dream’) বলে অভিহিত করেছেন কে?
    উত্তর: মুসােলিনি বিশ্বশান্তিকে ‘কাপুরুষের স্বপ্ন’ বলে অভিহিত করেছেন।
  77. “আমার কল্পনায় গ্রাম-স্বরাজ হল একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রজাতন্ত্র”—একথা কে বলেছেন?
    উত্তর: গান্ধিজি বলেছেন, “আমার কল্পনায় গ্রাম-স্বরাজ হল একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রজাতন্ত্র”।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। রাজনৈতিক তত্ত্ব’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত এক বিশেষ ধরনের চিন্তাভাবনাকে ‘রাজনৈতিক তত্ত্ব বলা হয়। ফ্রান্সিস বেকারের ভাষায়, রাজনৈতিক তত্ত্ব’ হল রাষ্ট্র, সরকার ও তার বিভিন্ন রূপ এবং কার্যাবলিকে সাময়িক লাভালাভের ভিত্তিতে পর্যালােচনা না করে মানুষের চিরন্তন প্রয়ােজন, আকাঙ্ক্ষা, মতামতের অনুধাবন ও মূল্যায়নের তথ্য হিসাবে স্বীকৃতি। অর্থাৎ, রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সংগঠিত ধ্যানধারণার সমষ্টিই হল রাজনৈতিক তত্ত্ব।

প্রশ্ন ২। রাজনৈতিক তত্ত্বগুলিকে মূলত কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
উত্তর: বিদ্যমান রাজনৈতিক তত্ত্বগুলিকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়—(ক) উদারনীতিবাদ ; (খ) মার্কসবাদ ; (গ) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ।

প্রশ্ন ৩। উদারনীতিবাদ কাকে বলে?
উত্তর: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে, উদারনীতিবাদ হল একটি ধারণা যা সরকারের পদ্ধতি ও নীতি হিসেবে, সমাজ সংগঠনের নীতি হিসাবে এবং ব্যক্তি ও লােকসমাজের জীবনাদর্শ হিসাবে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে। প্রকৃত প্রস্তাবে উদারনীতিবাদ হল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কতকগুলি তত্ত্বের সমন্বয়।

প্রশ্ন ৪। উদারনীতিবাদের উদ্ভব কখন ও কাদের হাতে হয় ?
উত্তর: সপ্তদশ শতকে ইউরােপে অর্থাৎ ১৬৪০-এর দশকে সংঘটিত ইংল্যান্ডের পিউরিটান বৈপ্লবিক আন্দোলনের মাধ্যমে উদারনীতির আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ঘটে। হ্যারিংটন, লক, বেন্থাম, জে,এস. মিল, হার্বাট স্পেনসার ধ্রুপদি তথা সনাতন উদারনীতিবাদের প্রবক্তা।

প্রশ্ন ৫। সনাতন উদারনীতিবাদের কয়েকটি মৌল নীতি লেখাে।
উত্তর: (ক) পৌর স্বাধীনতা, (খ) ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, (গ) সামাজিক স্বাধীনতা, (ঘ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, (ঙ) পারিবারিক স্বাধীনতা ইত্যাদি সনাতন উদারনীতির মৌল নীতি।

প্রশ্ন ৬। উদারনীতিবাদের কয়েকটি মৌলনীতি বা বৈশিষ্ট্য লেখাে।
উত্তর: (ক) স্বাধীনতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরােপ ; (খ) শান্তিপূর্ণ পথে সাংবিধানিক ভাবে সমাজের পরিবর্তন ; (গ) জনগণের সার্বভৌমত্ব ; (ঘ) নিরপেক্ষ আদালত ; (ঙ) একাধিক রাজনৈতিক দলের অবস্থিতি ইত্যাদি।

প্রশ্ন ৭। উদারনীতিবাদের কয়েকটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করাে।
উত্তর: (ক) উদারনীতিবাদ অত্যন্ত নমনীয় এবং সরলীকৃত দর্শন। তাই দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয় ; (খ) অর্থনৈতিক সাম্য কার্যত অস্বীকৃত ; (গ) উদারনীতিবাদ পুঁজিবাদের জন্মদাতা ও পৃষ্ঠপােষক ; (ঘ) উদারনীতিবাদ হল একটি বুর্জোয়া দর্শন।

প্রশ্ন ৮। উদারনীতিবাদের মার্কসীয় সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: মার্কসবাদীদের মতে, উদারনীতিবাদ হল পুঁজিবাদের আর এক রূপ। তাই তারা এর তীব্র বিরােধিতা করেন। উদারনীতি ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যতা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। উদারনীতিবাদকে বলা হয় গণতন্ত্রের প্রাণ।

প্রশ্ন ৯। উদারনৈতিক গণতন্ত্র বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: যে গণতন্ত্রে শাসক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা উন্মুক্ত প্রতিযােগিতায় নির্বাচিত হয় এবং জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল থাকে, তাকে উদারনৈতিক গণতন্ত্র বলে। Political freedom বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা হল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র।

প্রশ্ন ১০। উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্রের দুটি লক্ষ্য উল্লেখ করাে।
উত্তর: (১) সর্বাধিক জনগণের সর্বাধিক কল্যাণসাধন করা ;
(২) দেশের জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতায় পৌর ও অর্থনৈতিক অধিকার পরিবেশিত করা।

প্রশ্ন১১। উদারনৈতিক চিন্তাবিদরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিচার করেন ?
উত্তর উদারনীতিবাদের চিন্তাবিদরা বিশ্বাস করেন একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে অবাধ প্রতিযােগিতার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব।

প্রশ্ন ১২। মার্কসবাদ কী?
উত্তর: মার্কসের ভাবশিষ্য লেনিনের ভাষায়, “মার্কসবাদ হল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালা।” মার্কসীয় তাত্ত্বিক এমিল বার্নসের ভাষায়, মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব। এর নামকরণ করা হয়েছে মার্কসের নামানুসারে। প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদ হল একটি সঠিক সমাজ দর্শন, একটি সামগ্রিক চিন্তাধারা। মার্কসবাদ হল দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এটি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি সামগ্রিক তত্ত্বচিন্তা। যে-কোনাে জ্ঞান শৃঙ্খলাতেই এর প্রয়ােগ সম্ভব।

প্রশ্ন ১৩। মার্কসবাদের উৎস কী?
উত্তর: (ক) জার্মান দর্শন ; (খ) ইংরেজ অর্থশাস্ত্র এবং (গ) ফরাসি সমাজতন্ত্র হল মার্কসবাদের প্রধান তিনটি উৎস।

প্রশ্ন ১৪। মার্কসবাদের মূল নীতিগুলি কী কী?
উত্তর: মার্কসবাদের মূল নীতিগুলি হল—(ক) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ; (খ) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ; (গ) শ্রেণিসংগ্রাম ; (ঘ) উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব ; (ঙ) বিপ্লব তত্ত্ব এবং (চ) রাষ্ট্র।

প্রশ্ন ১৫। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: মানবসমাজ ও তার ইতিহাসের ব্যাখ্যায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বের প্রয়ােগকেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ বলা হয়। মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নিরিখে ইতিহাসের ধারা ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসের মতে, মানবসমাজের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এই শ্রেণিসংগ্রামের ফলে সমাজ পরিবর্তিত, বিকশিত ও উন্নত হয়। সামগ্রিকভাবে সমাজে এই পরিবর্তন ও অগ্রগতির মূলে যে নিয়ন্ত্রণ শক্তি বা বিধিবিধান রয়েছে, সেই বিষয়ে সাধারণ তত্ত্ব হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদী। প্রশ্ন

১৬। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কী?
উত্তর: মার্কসীয় দর্শন হল বস্তুবাদী দর্শন। মার্কসের মতে পৃথিবী বস্তুময়। বস্তুই প্রধান এবং তার ভাব অর্থনৈতিক অবস্থার অনুগামী। বাস্তব জগতে প্রতিটি বস্তুই পরস্পর নির্ভরশীল, গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল। প্রকৃতি ও তার বস্তুগুলির মধ্যে স্ববিরােধ বা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর ফলে বস্তুর পরিবর্তন ঘটে। দ্বন্দ্বশীল শক্তির দুটি দিক রয়েছে। বাদ এবং প্রতিবাদ। উভয়ের মধ্যে সংঘাতের ফলে সৃষ্ট নতুন উন্নততর অবস্থা হল সম্বাদ। এর মধ্যেও সংঘাত সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে আবার নতুনতর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সমাজের পরিবর্তন ও রূপান্তর এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াতেই সম্পন্ন হয়। ধনতন্ত্রকে বাদ’ এবং শ্রমিকশ্রেণিকে প্রতিবাদ হিসাবে ধরে নিলে সমাজতন্ত্র হল সম্বাদ।

প্রশ্ন ১৭। শ্রেণির সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: এমিল বার্নসের ভাষায়—“একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে সমাজের এইরকম এক-একটি অংশ হল এক-একটি শ্রেণি”। লেনিনের মতে শ্রেণি হল জনগােষ্ঠীর সেই বৃহৎ অংশ যারা সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান, উৎপাদনের উপকরণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, শ্রমের সামাজিক সংগঠনে তাদের ভূমিকা এবং তাদের ব্যবহার্য সামাজিক সম্পদের পরিমাণ এবং তা অর্জন করার পদ্ধতি একে অন্যের থেকে পৃথক।

প্রশ্ন ১৮। “শ্রেণিসংগ্রাম’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: মার্কস তাঁর তত্ত্বে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছেন। মার্কসের মতে আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া প্রতিটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। দাস সমাজে দাস ও দাস মালিকদের মধ্যে সংগ্রাম, সামন্ততন্ত্রে সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসদের মধ্যে সংগ্রাম এবং আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সংগ্রাম শ্রেণিসংগ্রামের দৃষ্টান্ত। মার্কসের মতে, শ্রেণিসংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিতে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত

প্রশ্ন ১৯। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব কাকে বলে?
উত্তর: শ্রমিকগণ শ্রমের দ্বারা যেসব দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করে তার সমপরিমাণ মজুরি সে পায় । উৎপন্ন সামগ্রীর বিনিময়ের মূল্য থেকে যে পরিমাণ মজুরি শ্রমিককে দেওয়া হয় না বা বঞ্চিত করা হয় তাই হল উদ্বৃত্ত মূল্য। এই উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব মার্কসের নিজস্ব আবিষ্কার। এই উত্ত মূল্য ফাঁকি দিয়েই পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজিকে স্ফীত করে।

প্রশ্ন ২০। বিপ্লবের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: আভিধানিক অর্থে বিপ্লব হল সমাজের হঠাৎ এক হিংসাত্মক পরিবর্তন। মার্কসীয় তত্ত্বে ব্যাপক অর্থে বিপ্লবের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মার্কসীয় ধারণা অনুযায়ী, বিপ্লব হল সামগ্রিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন যা সমাজের অধিকাংশ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের দ্বারা সম্পন্ন হয় আর এটা সম্পন্ন করতে গিয়ে শক্তি প্রয়ােগ করা হবে কী না তা নির্ভর করে সেই শ্রেণির ওপর যাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব পরিচালিত হয়।

প্রশ্ন ২১। “উৎপাদন শক্তি” বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: উৎপাদনের উপাদান এবং শ্রমের সমন্বয়ে উৎপাদন শক্তির উদ্ভব হয়। এক-কথায় উৎপাদন শক্তি’ বলতে শ্রমিক ও তার শ্রমশক্তি এবং আনুষঙ্গিক হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিকে বােঝায়।

প্রশ্ন ২২। উৎপাদন সম্পর্ক কাকে বলে ?
উত্তর: উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় মানুষে মানুষে তথা শ্রমিকে শ্রমিকে গড়ে ওঠা উৎপাদনভিত্তিক পারস্পরিক যােগাযােগই হল উৎপাদন সম্পর্ক।

প্রশ্ন ২৩। গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ কাকে বলে ?
উত্তর: ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ বলতে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যৌথ আদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্ট রাষ্ট্রদর্শকে বােঝায়। এই মতবাদে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এই উপাদান বিপ্লব এবং শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়।

প্রশ্ন ২৪। গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে দুটি পার্থক্য লেখাে।
উত্তর: (ক) মার্কসবাদে রাষ্ট্রকে শ্রেণিশাসন ও শােষণের যন্ত্র হিসাবে বর্ণনা করে এর অবলুপ্তি কামনা করা হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজবাদে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। (খ) মার্কসবাদে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপ্লবের অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজবাদে শ্রেণিসমঝােতা এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।

প্রশ্ন ২৫। লুম্পেন প্রলেতারিয়েত কাদের বলা হয় ?
উত্তর: মার্কস Class Struggle in France গ্রন্থে চোর, অপরাধী, ভবঘুরে প্রভৃতি ইতর শ্রেণির লােকদের লুম্পেন প্রলেতারিয়েত হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এরা রীতিমত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সমাজের প্রগতিতে এদের কোনাে ভূমিকা নেই।

প্রশ্ন ২৬। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে।
উত্তর: (ক) সমাজতন্ত্রে প্রত্যেকেই তার সাধ্যমতাে পরিশ্রম করে এবং পরিশ্রম অনুযায়ী ভােগ করে। কিন্তু সাম্যবাদে প্রত্যেকে সাধ্যমতাে পরিশ্রম করে এবং তারা প্রয়ােজনমতাে ভােগ করে। (খ) সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রও থাকে আবার শ্রেণিদ্বন্দ্বও থাকে। কিন্তু সাম্যবাদে রাষ্ট্রেরও অবলুপ্তি ঘটে এবং শ্রেণিদ্বন্দ্ব থাকে না।

প্রশ্ন ২৭। মার্কসবাদে সমাজ বিকাশের কোন্ পাঁচটি স্তরের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: মার্কসবাদে সমাজ বিকাশের যে পাঁচটি স্তরের কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল-(ক) আদিম সাম্যবাদী সমাজ, (খ) দাস সমাজ, (গ) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, (ঘ) পুঁজিবাদী সমাজ এবং (৪) সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

 

বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। উদারনীতিবাদ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: প্রাচীনকালে গ্রিক দার্শনিকেরা ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে মত প্রচার করে উদারনীতিবাদের গােড়াপত্তন করেছেন। আধুনিক উদারনীতিবাদের সমর্থক হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। তিনি তার “On Liberty” গ্রন্থে বলেছেন,—“মানুষ তার নিজের ওপর, তার দেহ ও মনের ওপর সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিশেষ করে মানুষের আত্মকেন্দ্রিক কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
উদারনীতিবাদ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় মতবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ল্যাস্কি বলেছেন, ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় উদারনীতিবাদের জন্ম হয়। বিশ শতকের প্রথম দিকে এর গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। বর্তমানে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে একটা বড়াে চ্যালেঞ্জ হিসাবে এই মতবাদ আত্মপ্রকাশ করেছে।
   উদারনীতিবাদ বা Liberalism শব্দটি লাতিন শব্দ Liber থেকে এসেছে। Liber কথাটির অর্থ হল স্বাধীন। সুতরাং, উদারনীতিবাদের অর্থ হল—ব্যক্তিস্বাধীনতার মতবাদ। যে মতবাদ ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের উপর গুরুত্ব আরােপ করে, স্বাধীনতার অধিকার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অধিকার প্রভৃতিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে, তাকে বলা হয় উদারনীতিবাদ।
এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছে। আবার মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করেছে।

প্রশ্ন ২। উদারনীতিবাদের মূল নীতি বা বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উত্তর: উদারনীতিবাদকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায়। সনাতনী উদারনীতিবাদ ও আধুনিক উদারনীতিবাদ। এই উভয়ের সমন্বয়ে উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য বা নীতিগুলি বর্ণনা করা হলঃ
(ক) ব্যক্তিস্বাধীনতা:
উদারনীতিবাদ ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করে। উদারনীতিবাদ স্বাধীনতার ওপর কোনাে নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী নয়। কারণ, এই মতবাদ মনে করে নিয়ন্ত্রণ থাকলে ব্যক্তির বিকাশ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না।
(খ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি:
উদারনীতিবাদ নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। কারণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলে নাগরিক কাজকর্মে উৎসাহ পায়। ফলে দেশে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে।
(গ) রাজনৈতিক সাম্য:
উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যনীতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকলে সমান অধিকার পাবে। এই সাম্যনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারের লক্ষ্য হবে সব মানুষের কল্যাণসাধন করা।
(ঘ) নিরপেক্ষ আদালত:
উদারনীতিবাদ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ আদালত রাখার পক্ষপাতী। এই আদালত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা করে।
(ঙ) বহুদলীয় ব্যবস্থা:
উদারনীতিবাদীরা গণতন্ত্রে একাধিক দল রাখার পক্ষপাতী। একাধিক দল থাকলে জনগণ স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। বিরােধীদল সরকারের সমালােচনা করে তাঁর স্বৈরাচারী কার্যকলাপে
বাধা দান করে।
(চ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা:
উদারনীতিবাদীরা উদারনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা অবাধ বাণিজ্যনীতি সমর্থন করে। তারা অর্থনৈতিক কাজকর্মের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী নয়।
(ছ) শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তন:
উদারনীতিবাদ বিপ্লবের পথে সমাজের পরিবর্তন চায় না। তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন করতে চায়।
(জ) ধর্মনিরপেক্ষতা:
উদারনীতিবাদের আর একটি গুরুত্বপূণ নীতি হল, ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল- প্রত্যেকে তার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা সুযােগসুবিধা প্রদান করবে না।
(ঝ) সার্বিক ভােটাধিকার:
উদারনীতিবাদে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের নীতি স্বীকৃত হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ,  ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই স্বাধীনভাবে ভােট দিতে পারে।
(ঞ) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা:
উদারনীতিবাদ সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতি গণসংযােগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা স্বীকার করে।
এই স্বাধীনতার ফলে তারা সরকারের কাজের সমালােচনা করতে পারে। তাতে সরকার সংযত হয়ে চলতে চেষ্টা করবে। ফলে জনগণ সরকারের কাছ থেকে সঠিক সেবা পায়।

প্রশ্ন ৩। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের গুরুত্ব কী ?
উত্তর: উদারনীতিবাদ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বে আছে এক বিশাল ঐতিহ্য। সমাজতান্ত্রিক
সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপ থেকে যে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল উদারনীতিবাদ। এই মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল। ড: অমল মখােপাধ্যায়ের মতে, “ইউরােপীয় ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে উদারনীতিবাদ ব্যাপক পরিবর্তনের বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে এসেছিল।” উদারনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়। এই তত্ত্বের প্রভাবে মানুষ অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তিবাদী হতে শুরু করে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অন্যান্য অধিকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। এই মতবাদের ফলে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

প্রশ্ন ৪। উদারনীতিবাদকে কোন কোন দিক থেকে সমালােচনা করা যায়?
উওর: মার্কসবাদীরা বিভিন্ন দিক দিয়ে উদারনীতিবাদের সমালােচনা করেছেন।
প্রথমত, উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যের কথা বলেছেন কিন্তু অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলেনি। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন,—অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্য ও অধিকার অর্থহীন।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে স্বীকার করার ফলে বিত্তশালীরাই জনমত গঠনের মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। সেজন্য এখানে প্রকৃত জনমত গড়ে উঠতে পারে না।।
তৃতীয়ত, এখানে বিচারকেরা উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আসে। তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। কারণ, নিজের জীবনে দারিদ্র্য না থাকলে দারিদ্র্যের জ্বালা বােঝা কষ্টকর।
চতুর্থত, উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত করতে চায়। অথচ ব্যক্তির বিকাশের জন্য যে পরিবেশ দরকার, রাষ্ট্র তা সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
পঞ্চমত, উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সমাজে বৈষম্য থাকলে সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ রূপায়িত হতে পারে না।

প্রশ্ন ৫। মার্কসবাদের উৎস সম্পর্কে একটি টীকা লেখাে।
উত্তর: কোনাে মতবাদ বা দর্শনই স্বয়ম্ভু নয়। মার্কসবাদ একটি বস্তুবাদী দর্শন। মার্কসবাদের সুনির্দিষ্ট পটভূমি বা উৎস রয়েছে। মার্কস তাঁর পূর্ববর্তী বহু লেখক, তাত্ত্বিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, এবং অর্থনীতিবিদদের রচনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক্ষেত্রে মার্কস-এর ভাবশিষ্য লেনিনের বক্তব্যই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ও গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়।
   লেনিনের ভাষায়, ‘মার্কস-এর দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালার নাম মার্কসবাদ। জার্মান চিরায়ত দর্শন, ইংরেজ চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্র তথা সাধারণভাবে ফরাসি বিপ্লবের মতবাদ মানবজাতির সবচেয়ে অগ্রসর তিনটি দেশে আবির্ভূত উনিশ শতকের এই তিনটি প্রধান ভাবাদর্শগত প্রবাহের ধারাবাহিক ও প্রতিভাধর পূর্ণতা সাধক হলেন মার্কস। লেনিনের আরও অভিমত হল, উনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজ অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্ররূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তার ন্যায়সংগত উত্তরাধিকারই হল মার্কসবাদ। প্রকৃতপক্ষে, মার্কসীয় তত্ত্বের প্রধান প্রধান উপকরণগুলি সংগৃহীত হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর জার্মান, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স থেকে। মার্কস তাঁর ‘উদ্বৃত্তমূল্য সংক্রান্ত তত্ত্ব ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখদের কাছ থেকে শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্র ও বিপ্লবসংক্রান্ত তত্ত্ব ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের থেকে এবং দ্বন্দ্ববাদ ও বস্তুবাদ সংক্রান্ত ধারণা জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেল প্রমুখদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। তাই বলে মার্কসবাদ মৌলিকত্ববিহীন নয়। মার্কস বিভিন্ন উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করেছেন এবং এক নতুন বস্তুবাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছেন।

প্রশ্ন ৬। মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের একটি টীকা লেখাে।
উত্তর: উদারনৈতিক বুর্জোয়া দার্শনিকদের মতে বিপ্লব হল, অভ্যন্তরীণ সংঘাতপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থার হিংসাত্মক ও আকস্মিক পরিবর্তন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শনে বিপ্লবকে একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, একটি শাসকশ্রেণির পতন ঘটিয়ে নতুন এক শাসকশ্রেণির উদ্ভব হয়। মার্কসীয় চিন্তাধারা অনুসারে, যে- কোনাে শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিস্বার্থের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শ্রেণির স্বার্থে সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হল বিপ্লব। অন্যভাবে বলা যায়, বিপ্লব হল পুরাতন একটি শ্রেণির হাত থেকে নতুন একটি শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর অর্থাৎ প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের ধারক শাসক শ্রেণিকে উৎখাত করে নতুন প্রগতিশীল শ্রেণি কর্তৃক, ক্ষমতা দখল এবং নতুন একটি উৎপাদন সম্পর্কের সৃষ্টিই হল বিপ্লব। মার্কস বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসাবে অভিহিত করেছেন। লেনিন বিপ্লবের জন্য দু-ধরনের শর্তের কথা বলেছেন। এই শর্ত দুটি হল—বিষয়ীগত অবস্থা এবং বিষয়গত অবস্থা। বিপ্লবের ‘বিষয়গত অবস্থা’ বলতে জনগণের বিপ্লবী চেতনা, সংগ্রামী মানসিকতা, দৃঢ়তা, উপযুক্ত সংগঠন, নির্ভুল রণনীতি ও রণকৌশল ইত্যাদিকে বুঝিয়েছেন। বিষয়গত এবং বিষয়ীগত উপাদানের সংযুক্ত অবস্থানের মাধ্যমেই বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সফল হয়। মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বটি উদারনৈতিক রাষ্ট্র দার্শনিকদের দ্বারা বিভিন্ন ভাবে সমালােচিত হলেও, মার্কসীয় বিপ্লবতত্ত্ব সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি উদ্দীপক হিসাবে কাজ করেছে—এ কথা সকলেই স্বীকার করেন।

প্রশ্ন ৭। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কাকে বলে ?
উত্তর: কার্ল মার্কস হলেন বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের জনক। তাঁর দর্শন কয়েকটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার মধ্যে একটি হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
   হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ গড়ে উঠেছে। দ্বন্দ্ববাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Dialectics। এই শব্দটি গ্রিক শব্দ Dialego থেকে এসেছে। যার অর্থ হল—বিতর্কের মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো। ব্যাপক অর্থে দ্বান্দ্বিকতার আসল অর্থ হল—দুটি পরস্পর বিরােধী শক্তির সংঘাত।।
   হেগেলের মতে কোনাে কিছু শাশ্বত নয়। সবকিছু পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের মূলে আছে। দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের কারণ ভাব বা Idea । ভাব বা Idea হল বাইরের শক্তি। এই শক্তির প্রভাবে বস্তুজগতের। পরিবর্তন ঘটছে।
   মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বকে মেনে নিলেও সবটা মানেন নি। হেগেলের মতে ভাবজগৎ আসল। বস্তুজগৎ ভাবজগতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মার্কস-এর মতে বস্তুই আসল। মানুষের চেতনা, অনুভূতি এবং কল্পনা বস্তুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। বস্তুর পরিবর্তন হয়। তবে সেই পরিবর্তন বাইরের কোনাে শক্তির দ্বারা ঘটে না। বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বই বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। এই ধারণার নাম। হল-“দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।”
   দ্বন্দ্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস বলেছেন—প্রতিটি বস্তুর মধ্যে দুটি উপাদান আছে— ইতিবাচক ও নেতিবাচক। তাদের মধ্যে সংঘর্ষে পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন অগ্রগতির সূচনা করে—পরিমাণগত ও গুণগত অগ্রগতি। কখনও এই পরিবর্তন ধীরে আসে, কখনও বা দ্রুতগতিতে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তর হয়েছে ধীর গতিতে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সমাজতন্ত্রে উন্নয়ন হয় উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে। এই উল্লম্ফনের প্রক্রিয়া কে বলে বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে নতুন সমাজের জন্ম হয়। এর নাম সমাজতান্ত্রিক সমাজ। |

প্রশ্ন ৮। মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর: সংগ্রামের তত্ত্ব
কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের বিখ্যাত রচনা “Communist Manifesto” গ্রন্থটি শুরু করেছেন এই বাক্যটি দিয়ে,—এ পর্যন্ত যত সমাজব্যবস্থা দেখা গেছে তাদের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এর অর্থ কোনাে সমাজের ইতিহাসকে জানতে হলে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসকে জানতে হবে। শ্রেণিসংগ্রামই সমাজের চালিকা শক্তি। এই শ্রেণিসংগ্রাম তিন ধরনের। যথা—অর্থনৈতিক শ্রেণিসংগ্রাম, রাজনৈতিক শ্রেণিসংগ্রাম এবং আদর্শগত শ্রেণিসংগ্রাম। উপাদানকে কেন্দ্র করে সমাজে দুটি শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। এই দ্বন্দ্ব পরিণতি লাভ করে বাদ, প্রতিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্য দিয়ে। শ্রমিক বুঝতে পারে যে একমাত্র শাসক শ্রেণিকে উৎখাতের মাধ্যমেই নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
পশ্চিমি তাত্ত্বিকরা, যেমন Carew flunt বলেছেন যে, সমাজজীবনে দ্বন্দ্বের একমাত্র উৎস শ্রেণিস্বার্থের সংঘাত নয়। মার্কস শ্রেণি সহযােগিতার কথা উল্লেখ করেনি। ধনতান্ত্রিক সমাজেও মানুষের জীবনযাত্রায় মান উন্নত হয়েছে। মার্কস একে উপেক্ষা করেছেন। রাষ্ট্র সবসময় শ্রেণি শাসনের যন্ত্র নয়। জনকল্যাণ রাষ্ট্র জনগণের অনেক কল্যাণ করছে।

প্রশ্ন ৯। মার্কসবাদকে কোন্ কোন্ দিক থেকে সমালােচনা করা যায় ?
উত্তর: প্রথমত, মার্কস প্রদত্ত ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা ত্রুটিপূর্ণ। সমাজে বস্তুর প্রভাব ছাড়া ধর্ম, স্নেহ, মমতা ইত্যাদির প্রভাব আছে। মাতা ভবিষ্যতে অর্থপ্রাপ্তির আশায় পুত্রকে স্নেহ করে না। তা ছাড়া ক্ষমতার লােভ, মহাপুরুষের আবির্ভাব প্রভৃতি ঘটনা ইতিহাসের ধারাকে প্রভাবিত করে। 
দ্বিতীয়ত, মার্কস বলেছেন, শিল্পোন্নত দেশে শ্রমিকদের অবস্থার চরম অবনতি ঘটবে। তাই সেখানে বিপ্লব হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির ফলে সেখানে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।
তৃতীয়ত, মার্কস রাষ্ট্রকে যন্ত্র বলেছেন। বিশ্বে বর্তমানে রাষ্ট্র মানুষের কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই মার্কস রাষ্ট্রের যে অবলুপ্তির কথা বলেছেন তা সম্ভব হচ্ছে না।
চতুর্থত, মার্কস শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছেন। কিন্তু ম্যাকাইভার প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, শ্রেণিসংগ্রামের পরিবর্তে শ্রেণি সহযােগিতার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।
পঞ্চমত, মার্কসবাদীরা বলেছেন—বিপ্লবের পর সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু ল্যাস্কি বলেছেন—এতে এক ধরনের সুবিধাভােগী শ্রেণি সৃষ্টি হতে পারে। ল্যাস্কির ধারণা বর্তমানে পূর্ব ইউরােপে সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রশ্ন ১০। ফ্যাসিবাদ বলতে কী বােঝ?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান বল মনে করেন, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ একটিমাত্র রাজনৈতিক দল এবং সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় তাকে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থা অথবা ফ্যাসিবাদ বলে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় জনগণের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। মুসােলিনির আমলে ইটালি এবং হিটলারের আমলে জার্মানি ফ্যাসিবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
   অ্যালান বল ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন—
প্রথমত, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি প্রতি বিপ্লবী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রাধান্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় থাকে।
দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত থাকে। এই সমস্ত ব্যক্তির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে একজন নেতা অথবা একটি রাজনৈতিক দল বা পার্টি। ফ্যাসিবাদে পার্টি ও সর্বোচ্চ নেতাকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়।
তৃতীয়ত, এরূপ ব্যবস্থায় বলপ্রয়ােগ অথবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা রক্ষা করা হয়।
চতুর্থত, ফ্যাসিবাদে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে।
পঞ্চমত, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠে বলি দেওয়া হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতা এখানে মূল্যহীন।

প্রশ্ন ১১। ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের কারণ হিসাবে অধ্যাপক কোল-এর অভিমত ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর: অধ্যাপক কোল ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের কারণ হিসাবে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন।
প্রথমত, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনের উপযােগিতা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার প্রচলিত মূল্যবােধের প্রতি অনাস্থা, তার ফলে চরম নৈরাশ্য দেখা দেয়। মানুষ নতুন পথ বা আদর্শের জন্যে আকাশিত হয়।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক অস্থিরতার ফলে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার তীব্র অভাব সম্পর্কিত ভীতি সৃষ্টি হয়।
চতুর্থত, সাম্যবাদী আদর্শ ও ধ্যানধারণা সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও ভীতি সঞ্চারের জন্যে ব্যাপক মিথ্যা প্রচারিত হয়।
পঞ্চমত, রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মনােভাব।
ষষ্ঠত, দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা।
সপ্তমত, এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মনােভাবের পুনর্জাগরণ। এইরকম পরিস্থিতিতে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের প্রতি বিমুখ জনগণ ব্যক্তিগত নেতৃত্বের মােহে সংকটমুক্তির পথ খোঁজে, একনায়কতন্ত্র ফ্যাসিবাদী রূপ পরিগ্রহ করে।

প্রশ্ন ১২। কোন্ কোন্ দিক থেকে ফ্যাসিবাদকে সমালােচনা করা যায় ?
উত্তর: মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ বিভিন্নভাবে জনগণের স্বাধীনতা ও কণ্টকে রােধ করেছে। তাই গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনা করা হয়।
প্রথমত, ফ্যাসিবাদ হল সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক। এখানে জনগণের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অস্বীকৃত। ফ্যাসিস্ট দল ছাড়া অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করা হয়। তাই লয়েড মন্তব্য করেন—Fascism rejects democracy as a system of Government and a creed.
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পর্কে ফ্যাসিবাদী ধারণা ভ্রান্ত। এখানে ব্যক্তির স্বাধীনতার উপলদ্ধির জন্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের উৎসর্গ করা হয়, কিন্তু এই উৎসর্গ হল স্বাধীনতার অস্বীকৃতি। তাই বলা যায় Fascist freedom is the another name of slavery.
তৃতীয়ত, ফ্যাসিবাদ সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী। উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে লঙ্ঘন করে। সুতরাং, এই মতাদর্শ হল মানবসভ্যতার শত্রু।
চতুর্থত, ফ্যাসিবাদী সমাজে রাজনৈতিক সাম্য এবং জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অস্বীকৃত হয়। মানবজীবনের যাবতীয় মূল্যবােধকে উপেক্ষা করা হয়। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে অর্থাৎ শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করা হয়।
পঞ্চমত, মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী প্রতিটি দেশে একচেটিয়া পুঁজিপতির স্বার্থের অনুকূলে এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতিকূলে ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত হয়। প্রকৃত বিচারে ফ্যাসিবাদ হল সেই প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণির মতবাদ।
শােষিত মানুষ পুজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে একচেটিয়া পুঁজিপতি স্বার্থরক্ষার জন্য ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হয়। মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবর্তে ফ্যাসিবাদ সংকটকে স্বাগত জানায়। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী—“Tascism is nothing but nacked dictatorship of firlance capital.”

প্রশ্ন ১৩। গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর: (ক) রাজনীতিতে অহিংসার নীতি প্রয়ােগ
গান্ধিজির দর্শনের মূল আদর্শ হল সত্য ও অহিংসা। কেবল ব্যক্তিজীবনে নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অহিংসা নীতির প্রয়ােগ করেছেন। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে তিনি অহিংসার নীতিকে ব্যবহার করেছেন। তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তন করতে বিপ্লব চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি হবে অহিংস বিপ্লব।
(খ) রাষ্ট্র ক্ষতিকারক প্রতিষ্ঠান
গান্ধিজির মতে রাষ্ট্র ক্ষতিকারক প্রতিষ্ঠান। কারণ তাঁর মতে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল হিংসা ও বলপ্রয়ােগ। এই বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে একশ্রেণি অন্যশ্রেণিকে শােষণ করে। এই শােষণ বন্ধ করার জন্যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত হওয়া উচিত।
(গ) রাষ্ট্রহীন ও দলহীন গণতন্ত্র
রাষ্ট্র যেহেতু হিংসার প্রতীক এবং দল যেহেতু হিংসার পথ গ্রহণ করে, সেহেতু আদর্শ সমাজব্যবস্থা হল রাষ্ট্রহীন ও দলহীন গণতন্ত্র। এই সমাজে প্রত্যেকেই শাসক। সকলের কল্যাণের জন্যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। রাষ্ট্র না থাকলে হিংসা থাকবে না। অহিংসা নীতির উপর সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
(ঘ) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
গান্ধিজি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী তার মতে সকল ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে থাকলে সে স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে। তাই গান্ধিজী পয়েতি ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত বলে মনে করতেন।
(ঙ) সর্বোদয় তত্ত্ব
গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় সর্বোদয় তত্ত্ব অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। সর্বোদয়ের অর্থ হল—সকল মানুষের উদয় বা উন্নতি। কোনাে গােষ্ঠীর উন্নতি নয়, ইংল্যান্ডের হিতবাদীরা বলেছেন, রাষ্ট্রের কাজ হল সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ করা। কিন্তু গান্ধিজি বলেছেন, বেশি মানুষের নয়, সব মানুষের উন্নতি বিধান আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

প্রশ্ন ১৪। রামরাজ্য বলতে গান্ধিজি কী বােঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর: মহাত্মা গান্ধি নতুন ধরনের এক সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই ব্যবস্থায় পরিপূর্ণ ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এই আদর্শ সমাজব্যবস্থায় রাজা ও দেউলিয়ার মধ্যে, ব্যারিস্টার ও ঝাড়ুদারের মধ্যে কোনাে রকম বৈষম্য থাকবে না, এই সমাজ হবে শ্রেণিহীন। এই সমাজে হিংসার প্রতীক রাষ্ট্রের কোনাে স্থান নেই। এক আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা করতে গিয়ে গান্ধিজি রাষ্ট্রবিহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। অহিংস নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থায় শােষণহীন সমাজের সৃষ্টি হবে। কারণ সমাজ থেকে হিংসা দূর। করতে পারলে সবরকম শােষণের অবসান হবে। এরকম অহিংস সমাজে সকলের জন্য সমান সুযােগসুবিধা থাকবে, সাম্যনীতি বাস্তবে রূপায়িত হবে এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মহাত্মা গান্ধি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সাম্যভিত্তিক শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেছেন। প্যারোেল মন্তব্য করেছেন- Gandhiji was a firm believer in a classless, egalitarian society in which there would be no distinction of rich and poor, high and low. গান্ধিজির এই সাম্যভিত্তিক শ্রেণিহীন ও শােষণহীন সমাজ অহিংস নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি শ্রেণিসংগ্রামের পথ পরিহার করে শ্রেণি সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করতে বলেছেন। এই সমাজব্যবস্থায় কোনাে রাষ্ট্র থাকবে না এবং কোনাে রাজনৈতিক ক্ষমতাও থাকবে না। রাষ্ট্রবিহীন এই অহিংস গণতন্ত্রই হল গান্ধিজির ভাষায় রামরাজ্য। গান্ধিজির মতানুসারে, রামরাজ্য হবে পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব। এই রাজত্বে জনগণের নৈতিক কর্তৃত্বের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।   

প্রশ্ন ১৫। রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণার সমালােচনাগুলি কী কী?
উত্তর: গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাধারাকে বিভিন্নভাবে সমালােচনা করা হয়ে থাকে –
(ক) রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র উপেক্ষিত
রাজনৈতিক সমস্যাকে ধর্মীয় ও নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার করে গান্ধিজি তাঁর মত প্রচার করেছিলেন। তার ফলে গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তা বিশেষ অস্পষ্ট বলে সমালােচনা করা যায়। মার্কসীয় লেখকগণের মতে, রাষ্ট্র শ্রেণি শাসন ও শ্রেণিশােষণের যন্ত্র—এই মৌলিক সত্য গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তায় উপেক্ষিত হয়েছে।
(খ) সমাজ পরিবর্তনে অহিংস আন্দোলন সঠিক পন্থা নয়
গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকের অন্যায় ও শােষণের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলন পরিচালনার কথা বলেছেন। বিপ্লবী কর্মপন্থা ও বিপ্লবী আন্দোলনকে গান্ধিজি নিন্দা করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক বিচারে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে সমালােচনা করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, বুর্জোয়া শাসকগণ কোথাও বলপ্রয়ােগ ছাড়া ক্ষমতা ত্যাগ করেনি। অহিংস আন্দোলন বা বিবেকের নিকট আবেদন শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়নি।
(গ) রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র স্ববিরােধী
গান্ধিজির আদর্শ সমাজ রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র ধারণাটির সম্পূর্ণ পরস্পর বিরােধী। গান্ধিজি একদিকে রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, আবার অপরদিকে রাষ্ট্রের ন্যূনতম কার্যাবলি, সমাজ কল্যাণের লক্ষ্য পূরণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
(ঘ) রামরাজ্য কল্পলােকের বিষয়
গান্ধিজির পরিকল্পিত সত্য ও অহিংসা ভিত্তিক আদর্শ সমাজ ও রামরাজ্য বর্তমান জগতে নিতান্তই অবাস্তব। ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরােপ করে গান্ধিজি বাস্তব অবস্থা উপেক্ষা করেছেন। এরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সম্পর্কে গান্ধিজি নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাস্তবে দেখা যায় যে, গান্ধিজির আদর্শ স্বপ্নের ভারত’ আজও সার্থক হয়নি।
(ঙ) সমাজ বা রাষ্ট্র অপেক্ষা ব্যক্তিকে গুরুত্ব আরােপ
গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তায় সমাজ বা রাষ্ট্র অপেক্ষা ব্যক্তির ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। ব্যক্তির নৈতিক স্বাধীনতার উপলব্ধির কথা গান্ধিজি বলেছেন, কিন্তু তা সমাজ বা রাষ্ট্রনিরপেক্ষ হতে পারে না। সমাজের সভ্য হিসাবে এবং রাষ্ট্রের সহায়তায় ব্যক্তিজীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব বলে। অনেকেই বিশ্বাস করেন। এই দৃষ্টিতেও গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তাধারা সমালােচনার উর্ধ্বে নয়।

প্রশ্ন ১৬। রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস ও গান্ধির মতের পার্থক্য কোথায় ?
উত্তর: প্রথমত, গান্ধির রাষ্ট্রচিন্তা স্ববিরােধী। একদিকে তিনি রাষ্ট্রবিহীন সমাজের কথা কল্পনা করেন, অন্যদিকে তিনি রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করেননি। কিন্তু মার্কস রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণভাবে শ্রেণিস্বার্থের সংগঠন রূপে গণ্য করেন।
দ্বিতীয়ত, গান্ধি ব্যক্তিসত্তার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ব্যক্তিকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু মার্কস সামগ্রিক স্বার্থের উপর গুরুত্ব দেন।
তৃতীয়ত, মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রকে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের উপায় হিসাবে গণ্য করেন, কিন্তু মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শ্রেণির শােষণের যন্ত্র।
চতুর্থত, রাষ্ট্রের বিরােধিতা সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধি অহিংস আন্দোলন এবং সত্যাগ্রহীর সমর্থক ছিলেন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী বিপ্লব ও শ্রেণিসংগ্রামী ছাড়া রাষ্ট্রের বিরােধিতা সম্ভব নয়।
পঞ্চমত, গান্ধি ধর্মকে রাজনীতির প্রাণ হিসাবে গণ্য করেন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন ধর্মকে মানুষের আফিং হিসাবে গণ্য করে এবং ধর্মের ভূমিকা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।

রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১) উদারনীতিবাদ বলতে কী বােঝ? এর মূলনীতিগুলিকে ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর :
উদারনীতিবাদ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় মতবাদ। ল্যাস্কি (Laski) বলেছেন,—ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলন উদারনীতিবাদের জন্মলগ্ন। বিশ শতকের প্রথম দিকে এর গুরুত্ব কিছুটা কমে গেলেও বর্তমানে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে একটা বড়াে চ্যালেঞ্জ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
সংজ্ঞা
উদারনীতিবাদ বা Liberalism – শব্দটি লাতিন শব্দ Liber থেকে এসেছে। ‘Liber’ কথাটির অর্থ হল স্বাধীন। সুতরাং, যে মতবাদ ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশে গুরুত্ব আরােপ করে, স্বাধীনতার অধিকার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে, তাকে বলা হয় উদারনীতিবাদ।
উদারনীতিবাদের মূলনীতি
উদারনীতিবাদকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায়। সনাতন উদারনীতিবাদ এবং আধুনিক উদারনীতিবাদ। এই উভয়ের সমন্বয়ে উদারনীতিবাদের নীতিগুলি বর্ণনা করা যায়—
(ক) ব্যক্তিস্বাধীনতা
ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্ব আরােপ করে থাকে উদারনীতিবাদ। উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল ব্যক্তিস্বাধীনতা। ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে বাক্‌, মুদ্রাযন্ত্র, চিন্তা ও বিশ্বাসের পূর্ণ স্বাধীনতা বােঝায়। কারণ, নিয়ন্ত্রণ থাকলে ব্যক্তির বিকাশ হবে না।
(খ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি
উদারনীতিবাদ নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। কারণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলে নাগরিক কাজকর্মে উৎসাহ পায়। ফলে দেশে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে। কিন্তু আধুনিক উদারনীতিবাদ সম্পত্তির অধিকারের ওপর কিছুটা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত প্রকাশ করে।
(গ) রাজনৈতিক সাম্য
উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যনীতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকলে সমান অধিকার পাবে। এই সাম্যনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারের লক্ষ্য হবে সব মানুষের কল্যাণ-সাধন করে।
(ঘ) নিরপেক্ষ আদালত
উদারনীতিবাদ ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ আদালত রাখার পক্ষপাতী। এই আদালত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা করে।
(ঙ) বহুদলীয় ব্যবস্থা
উদারনীতিবাদীরা গণতন্ত্রে একাধিক দল রাখার পক্ষপাতী। একাধিক দল থাকলে জনগণ স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। বিরােধী দল সরকারের সমালােচনা করে তার স্বৈরাচারী কার্যকলাপে বাধা দেন করে।
(চ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
উদারনীতিবাদীরা অর্থনৈতিক কাজকর্মের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বিরােধী। তারা মনে করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্য নীতি থাকলে প্রতিযােগিতা থাকবে। এর ফলে উৎপাদনের মান বাড়বে এবং দ্রব্যের দাম কমবে।
(ছ) শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তন
উদারনীতিবাদ বিপ্লবের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজের পরিবর্তন চায়। তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন করার পক্ষপাতী।
(জ) ধর্মনিরপেক্ষতা
উদারনীতিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল, ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল, প্রত্যেকে তার নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা সুযােগ-সুবিধা প্রদান করবে না।
(ঝ) সার্বিক ভােটাধিকার
উদারনীতিবাদে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের নীতি স্বীকৃত হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই স্বাধীনভাবে ভােট দিতে পারে।
(ঞ) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
উদারনীতিবাদ সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতি গণ সংযােগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা স্বীকার করে। এই স্বাধীনতার ফলে তারা সরকারের কাজের সমালােচনা করতে পারে। তাতে সরকার সংযত হয়ে চলতে চেষ্টা করবে। ফলে জনগণ সরকারের কাছ থেকে সঠিক সেবা পায়।
সমালােচনা
মার্কসবাদীরা বিভিন্নদিক দিয়ে উদারনীতিবাদের সমালােচনা করেছেন।
প্রথমত, উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যের কথা বলেছেন, কিন্তু অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলেনি। ল্যাস্কি বলেছেন, অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্য ও অধিকার অর্থহীন।
দ্বিতীয়ত,
ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে স্বীকার করার ফলে বিত্তশালীরাই জনমত গঠনের মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। সেজন্য এখানে প্রকৃত জনমত গড়ে উঠতে পারে না।
তৃতীয়ত, এখানে বিচারকেরা উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আসে। তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। কারণ, নিজের জীবনে দারিদ্র্য না থাকলে দারিদ্র্যের জ্বালা বােঝা কষ্টকর।
চতুর্থত, উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত করতে চায়। অথচ ব্যক্তির বিকাশের জন্য যে পরিবেশ দরকার, রাষ্ট্র তা সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
পঞ্চমত, উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সমাজে বৈষম্য থাকলে সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ রূপায়িত হতে পারে না।
মূল্যায়ন
সমালোচিত হলেও উদারনীতিবাদ ব্যাক্তিস্বাধীনাতার পক্ষে মতপ্রকাশ করে মানুষের মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির পথ সুগম করেছে। বিশেষ করে বর্তমানে মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রে যেভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার কণ্ঠরােধ করা হয়েছে, তার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য উদারনীতিবাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রশ্ন ২) আধুনিক বা ইতিবাচক উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে বর্ণনা করাে।

উত্তর :
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে সনাতন উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের স্রোতধারা এবং সমাজজীবনে শ্রমিক আন্দোলনের ধারার সম্মুখে উদারনীতিবাদ নতুন রূপে পরিগ্রহ করতে বাধ্য হয়। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য
রক্ষা করে আধুনিক বা ইতিবাচক নয়া উদারনীতিবাদের উদ্ভব হয়। বিংশ শতাব্দীতে ধনতন্ত্রের ব্যাপক সংকট জনগণের কল্যাণসাধনে সঠিক কর্মসূচি গ্রহণে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র প্রমাণ করে যে, শ্রমিক, কৃষক ও ব্যাপক জনগণের কল্যাণসাধন সমাজতন্ত্রে সম্ভব । এই পরিস্থিতিতে উদারনীতিবাদের সমর্থকগণ জনকল্যাণে রাষ্ট্রের ইতিবাচক তথা জনকল্যাণ রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রচার করেছেন। উদারনীতিবাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই আধুনিক বা ইতিবাচক বা নয়া উদারনীতিবাদ বলা হয়।
আধুনিক বা ইতিবাচক উদারনীতিবাদের মৌল বৈশিষ্ট্য :
আধুনিক বা ইতিবাচক উদারনীতিবাদের মৌল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে আলােচিত হল—
(ক) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য
আধুনিক বা ইতিবাচক উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে থাকে। সাম্য ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া স্বাধীনতার কল্পনা করা অসম্ভব। আধুনিক যুগে প্রতিটি মানুষের সমান ভােটাধিকার স্বীকার করে গণতন্ত্রকে বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব।
(খ) অধিকারের গুরুত্ব
আধুনিক উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে যে, ব্যক্তির অন্তনিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের সুযােগ থাকলে জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সার্থক হয়ে উঠবে। সুতরাং নাগরিকের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারগুলির সমর্থনের সপক্ষে আধুনিক উদারনীতিবাদ মত প্রকাশ করে। মত প্রকাশের অধিকার, জীবনের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের অধিকার, ধর্মের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, ভােটদানের অধিকার ও নির্বাচিত হবার অধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়।
(গ) সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার
জনগণের সার্বভৌমত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। গণতন্ত্রকে জনগণ পরিচালিত শাসনব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার হবে আর অপরিহার্য অঙ্গ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ সকলের সমান ভভাটাধিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একান্ত কাম্য।
(ঘ) একাধিক রাজনৈতিক দল স্বীকার
আধুনিক উদারনীতিবাদের সমর্থকগণ সমাজের বহুত্ববাদী প্রকৃতি স্বীকার করেন। বিভিন্ন স্বার্থের যথাযথ প্রকাশের জন্য তথা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য তারা একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন।
(ঙ) সাংবিধানিক ও সংসদীয় পদ্ধতিতে পরিবর্তন
নয়া উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে যে জনগণের নির্বাচিত সরকারকে জনগণ আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার অধিকারী। এর জন্য কোনাে বৈপ্লবিক পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রয়ােজন নেই। ব্যালট বাক্সের মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণভাবে কাম্য পরিবর্তন সম্ভব।
(চ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার
আধুনিক উদারনীতিবাদ আইনের অনুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত বলে মনে করে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত ও শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের স্বৈরাচার হতে জনগণের অধিকার রক্ষায় সমর্থ। সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিশেষভাবে প্রয়ােজন।
(ছ) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার
বৈষয়িক প্রয়ােজন পূরণ, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা উৎপাদনের অগ্রগতির সহায়ক বলে আধুনিক উদারনীতিবাদের সমর্থকগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করেন। সম্পত্তির অধিকারের বিলােপসাধনের পরিবর্তে এঁরা কিছু নিয়ন্ত্রণ আরােপ করবার পক্ষপাতী।
(জ) সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ
সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারে পরিণত না হয় এবং সংখ্যালঘুর স্বার্থ যাতে সংরক্ষিত হয় তার জন্য উদারনীতিবাদ সংখ্যালঘুর যথাযথ প্রতিনিধিত্বের সপক্ষে মত প্রকাশ করে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, সীমাবদ্ধ ভােটদান পদ্ধতি প্রভৃতির মাধ্যমে সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
(ঝ) সমাজকল্যাণ রাষ্ট্রের আদর্শ
আধুনিক উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা স্বীকার করে সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করে। সমাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে যে, বিভিন্ন সামাজিক সংস্কার এবং জনকল্যাণকর কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে পারে। সামগ্রিক স্বার্থে পরিকল্পনা গ্রহণ, শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়ােজনীয় জাতীয়করণ, সেবামূলক কর্মসূচি গ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের দূরীকরণ সম্ভব। ধনতন্ত্রের সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ হিসাবেই উদারনীতিবাদ জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রচার করেছে।
মূল্যায়ন
রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তত্ত্ব সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর একটা বিশাল অংশ এই তত্ত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছে। শুধু তাই নয় এই তত্ত্বের মধ্য দিয়েই বর্তমানের পশ্চিমি গণতন্ত্রের রূপটি প্রতিফলিত হয়েছে। এই মতবাদের একটা উল্লেখযােগ্য দিক হল পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে এই মতবাদ বিবর্তিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের গতিপ্রকৃতির একটা প্রতিচ্ছবিও এই মতবাদের মধ্য দিয়ে লক্ষ করা গেছে। ফলে এই তত্ত্ব আধুনিক তত্ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

প্রশ্ন ৩) উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে সমালােচনাগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করাে।

উত্তর :
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তত্ত্ব। পৃথিবীর একটা বড়াে অংশের মানুষ এই তত্ত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছে। তা ছাড়া এই তত্ত্বের মধ্য দিয়েই বর্তমানের পশ্চিমি গণতন্ত্রের রূপটি প্রতিফলিত হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও উদারনীতিবাদ বর্তমানে তীব্র সমালােচনার সম্মুখীন। কারণ—
(ক) পৌর ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলা হলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উদারনীতিবাদে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হওয়ায় পৌর ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা এখানে অর্থহীন।
(খ) উদারনীতিবাদে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে আর্থিক ক্ষেত্রে অসাম্যকে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে।
(গ) একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার ফলে উদারনীতিবাদ সমাজের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকেই কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে।
(ঘ) বৈপ্লবিক পন্থা পদ্ধতিকে উদারনীতিবাদ সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের পক্ষপাতী হলেও ইতিহাস এই শিক্ষা দেয় যে, ব্যালটের মাধ্যমে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
(ঙ) বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার এবং প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের ধারণা আসলে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
(চ) উদারনীতিবাদে সকলেই আইনের চোখে সমান এই জাতীয় বক্তব্যকে তুলে ধরলেও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আইন কখনােই সকলের স্বার্থরক্ষা করতে পারে না।
(ছ) উদারনীতিবাদে সম্পত্তির অধিকারকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্যতম মাধ্যম বলে মনে করা হলেও ব্যক্তিগত সম্পত্তিই যে-সমস্ত রকমের শােষণের উৎস সে ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই।
(জ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে এই মতবাদ নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণে সন্তুষ্ট হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আধা-অলীক কল্পনা।(ঝ) উদারনৈতিক সমাজে শাসক সম্প্রদায় আসলে সংখ্যালঘু শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে বলে এই তত্ত্ব সংখ্যালঘু শ্রেণির প্রতিনিধিত্বের আড়ালে ক্ষমতাসীন শ্রেণির স্বার্থকেই রক্ষা করতে চায়।
(ঞ) বৃহত্তর সামাজিক পটভূমিকায় ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্পর্কে উদারনীতিবাদীরা আস্থাশীল হলেও এই ব্যবস্থায় সমস্ত ব্যক্তির পক্ষে যথােচিত মর্যাদা লাভ করা সম্ভব হয় না।
(ট) উদারনীতিবাদে গণ-সংযােগের মাধ্যমগুলিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও এই মাধ্যমগুলি যখন শাসক সম্প্রদায়ের স্বার্থের বিরােধিতা করে তখন তার কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়।
(ঠ) উদারনীতিবাদে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও যেখানে উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেখানে জনকল্যাণের আদর্শ বাস্তবায়িত হতে পারে না।
(ড) ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা উদারনীতিবাদে বলা হলেও বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা যায় যে ধর্ম আজও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
(ঢ) পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সমান মর্যাদার কথা উদারনীতিবাদে বলা হলেও উভয়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া তা কখনােই বাস্তবায়িত হতে পারে না।
(ণ) শ্রেণিবিভক্ত সমাজে স্বার্থবাহী গােষ্ঠীর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে সমাজ সমাধানহীন দ্বন্দ্বে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে, আপসহীন বিরােধে নিজেকে বিভক্ত করেছে।
(ত) ফ্যাসিবাদ, নাতসিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরােধিতার মধ্যে দিয়ে উদারনীতিবাদ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইলেও এ কথা বলা যায় যে, এইসব মতবাদের কিছু উপযােগিতা আছে।
মূল্যায়ন
উদারনৈতিক দর্শন সমাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায়। মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক ও বিপ্লবী দর্শনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখে এটি আপন অস্তিত্ব সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলােপসাধন করে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পুঁজিবাদী পথে উন্নয়নের জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উদারনীতিবাদের এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকার করতে হয়। বিগত চারশাে বছরের ইতিহাসে আধুনিক পশ্চিমি গণতান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতিতে উদারনীতিবাদ অনেক মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার জন্ম দিয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শােষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদারনীতিবাদ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করে। নির্দিষ্ট যুগের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে উদারনীতিবাদকে সে যুগের প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে স্বীকার করতে হয়।

প্রশ্ন ৪) মার্কসবাদ কাকে বলে? মার্কসবাদের মূলনীতিগুলি বর্ণনা করাে।

উত্তর :
কার্ল মার্কস হলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক। তিনি ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সমাজের পরিবর্তনের মূল সূত্র বের করে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তােলার বিজ্ঞানসম্মত পথ দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার নাম মার্কসবাদ। লেনিনের ভাষায়, “মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষার নামই হল মার্কসবাদ।”
   মার্কস ও এঙ্গেলস মানবজাতির উৎপত্তি ও বিকাশ প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, সমাজের পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট নিয়মে হয়। এই নিয়ম অনুসারে বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণি পুঁজিবাদের অবসান ঘটাবে এবং শােষণহীন সমাজ গড়ে তুলবে। তাই বলা যায়— মার্কসবাদ হল একটি বৈপ্লবিক মতবাদ যা সর্বহারা শ্রেণিকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করে এবং শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তুলতে একটি মতাদর্শ হিসাবে কাজ করে। মার্কসীয় দর্শন কতকগুলি মূলনীতি ওপর প্রতিষ্ঠিত—
(ক) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উদ্ভব হয়েছে। মার্কস-এর মতে আমরা যে জগৎকে দেখি তা একান্তভাবে বস্তুজগৎ। মানুষের চেতনা, অনুভূতি এবং কল্পনা বস্তুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। বস্তুর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তন বাইরের কোনাে শক্তির দ্বারা হয় না। বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব থাকে। এই দ্বন্দ্ব বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। এই ধারণা থেকে উদ্ভব হয়েছে দ্বন্দ্বমূলকবস্তুবাদ।
(খ) ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা
মার্কস তার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে প্রয়ােগ করে যে তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন, তাকে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। তাঁর মতে ইতিহাস কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিবরণ নয় বা কোনাে রাজার উত্থান পতনের কাহিনি নয়। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামাের ওপর ইতিহাসের ঘটনা গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক কাঠামাে বলতে সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি বােঝায়। এর দুটি দিক আছে— উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক
(গ) উদ্বৃত্ত মূল্য
মার্কস-এর মতে পুঁজিবাদী সমাজে শােষণের চূড়ান্ত রূপ হল, মালিক শ্রেণি কর্তৃক উদ্বৃত্ত মূল্যের আত্মসাৎ করা। শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে যতটুকু মূলধন তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করে মালিকশ্রেণি যে অর্থ পায় এবং শ্রমিককে যতটুকু মজুরি দেয় তার পার্থক্যকে বলে উত্তমূল্য।(ঘ) শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বদাস সমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভব হয়। এই সমাজে শ্রেণিশােষণ শুরু হয়। ফলে দেখা দেয় শ্রেণিতে শ্রেণিতে সংগ্রাম। পরে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি হলে এক শ্রেণির মানুষ প্রচুর জমিজমার মালিক হয়ে সামন্ত প্রভু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে গড়ে ওঠে ভূমিদাস শ্রেণি। শোষক সামন্ত প্রভুদের সঙ্গে শােষিত ভূমিদাসদের সংগ্রাম শুরু হয়। পরে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটার ফলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠল। সমাজ দুটি শ্রেণিতে ভাগ হল—বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি। এদের মধ্যে সংগ্রাম তীব্রতর হয়।
(ঙ) বিপ্লব তত্ত্ব
বিপ্লব বলতে বােঝায়, শােষক শ্রেণিকে হঠিয়ে দিয়ে শােষিত শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রেণিহীন ও শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। মার্কসের মতে বিপ্লবের কারণ হল—উৎপাদনের সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের বিরােধ। প্রাচীন সমাজে এই বিরােধ ছিল না। কারণ যে মালিক, সেই ছিল শ্রমিক। তাই শ্রমিকে-মালিকে দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় উৎপাদন শক্তির মালিকানা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে যায়। ফলে মালিক শ্রেণির সৃষ্টি হল। অন্যদিকে গড়ে উঠল সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণি। এই সময়ে শােষণ শুরু হল। শােষণ থেকে অসন্তোষ এবং তার ফলশ্রুতি হল বিপ্লব।
(চ) রাষ্ট্র সম্পর্কে তত্ত্ব
মার্কস বলেছেন, রাষ্ট্র শাশ্বত নয়, মঙ্গলকামীও নয়। রাষ্ট্র শ্রেণি শশাষণের যন্ত্র। দাস সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি হয়। শশাষণের যন্ত্র হিসাবে আবির্ভাব ঘটে রাষ্ট্রের। পুঁজিবাদী সমাজে শােষণ তীব্র আকার ধারণ করে। যার ফলশ্রুতি হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লবের পর সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে নির্মূল করবে। সমাজ থেকে শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটবে। শােষণ যখন থাকবে না, তখন রাষ্ট্রের প্রয়ােজন ফুরিয়ে যাবে। গড়ে উঠবে শ্রেণিহীন, শােষণহীন, সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। যার মূল নীতি হল, প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়ােজন মতাে ভােগ করবে।
সমালােচনা
মার্কসবাদী নীতি ও তত্ত্ব সমালােচনা মুক্ত নয়। নানা দিক থেকে এই নীতি ও তত্ত্বের সমালােচনা করা হয়েছে ।
প্রথমত, মার্কস সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, মার্কস বলেছেন, অর্থনীতি ইতিহাসের ঘটনাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু ক্ষমতার প্রতি লােভ, মহাপুরুষের আবির্ভাব, ধর্ম প্রভৃতি ইতিহাসকে অনেক সময় প্রভাবিত করে।
তৃতীয়ত, মার্কস বলেছেন, শিল্পোন্নত দেশে শ্রমিকরা চরমভাবে শােষিত হবে। তাই সেখানে বিপ্লব প্রথম দেখা দেবে। কিন্তু বিপ্লব প্রথম ইংল্যান্ড বা জার্মানিতে না হয়ে কৃষিপ্রধান দেশ রাশিয়া ও চিনে হয়।
চতুর্থত, মার্কস রাষ্ট্রকে শ্রেণিশােষণের যন্ত্র বলেছেন। বর্তমানে রাষ্ট্র কল্যাণকর রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের অবলুপ্ত হবার সম্ভাবনা খুব কম।

মূল্যায়নমার্কসবাদী তত্ত্ব ও নীতির বিরুদ্ধে সমালােচনার যুক্তিগুলিকে একেবারে অস্বীকার করা গেলেও, রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে মার্কসবাদের বিরাট ব্যাপক প্রভাব বিরােধ-বিতর্কের উর্ধ্বে। তাই অধ্যাপক ল্যাস্কি যথার্থই বলেছেন, “শ্রমজীবী মানুষ যখন নিজেদের অবস্থায় উন্নতি ঘটাতে আন্দোলন করেছে, তখন এই তত্ত্ব তাদের প্রেরণা দিয়েছে।”

প্রশ্ন ৫) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলতে কী বােঝায়? এর মূলনীতিগুলি ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর :
কার্ল মার্কস হলেন বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের জনক। তার দর্শন কয়েকটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার মধ্যে একটি হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।   হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ গড়ে উঠেছে। দ্বন্দ্ববাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Dialectics। এই শব্দটি গ্রিক শব্দ Dialego থেকে এসেছে। যার অর্থ হল—বিতর্কের মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছােনাে। ব্যাপক অর্থে দ্বান্দ্বিকতার আসল অর্থ হল—দুটি পরস্পর বিরােধী শক্তির সংঘাত।   হেগেলের মতে কোনাে কিছু শাশ্বত নয়। সবকিছু পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের মূলে আছে দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের কারণ ভাব বা Idea। ভাব বা Idea হল বাইরের শক্তি। এই শক্তির প্রভাবে বস্তুজগতের পরিবর্তন ঘটছে।
   মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বকে মেনে নিলেও সবটা মানেননি। হেগেলের মতে ভাবজগৎ অসত্য, বস্তুজগৎ ভাবজগতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মার্কস-এর মতে বস্তুই আসল। মানুষের চেতনা, অনুসূতি এবং কল্পনা বস্তুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। বস্তুর পরিবর্তন হয়। তবে সেই পরিবর্তন বাইরের কোনাে শক্তির দ্বারা ঘটে না। বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বই বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। এই ধারণার নাম হল—“দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ”।
   দ্বন্দ্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস বলেছেন—প্রতিটি বস্তুর মধ্যে দুটি উপাদান আছে— ইতিবাচক ও নেতিবাচক। তাদের মধ্যে সংঘর্ষে পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন অগ্রগতির সূচনা করে—পরিমাণগত ও গুণগত অগ্রগতি। কখনও এই পরিবর্তন ধীরে আসে, কখনও বা দ্রুতগতিতে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তর হয়েছে ধীর গতিতে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর হয় উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে। এই উল্লম্ফনের প্রক্রিয়াকে বলে বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে নতুন সমাজের জন্ম হয়। এর নাম সমাজতান্ত্রিক সমাজ।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূলসূত্র বা নীতি
বস্তুজগৎ ও মানবসমাজের গতিময়তা ও পরিবর্তনের ধারাকে বিশ্লেষণ করবার জন্য মার্কসবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পদ্ধতি অনুসরণ করে। এই পদ্ধতির কয়েকটি মূলনীতি নিম্নে আলােচিত হল :(ক) পার্থিব জগতের কোনাে ঘটনাকে পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।(খ) সকল বস্তুই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। সুতরাং, বস্তুর উদ্ভব ও বিকাশের আলােচনা গতিশীলতার মানদণ্ডে করতে হবে। মাকর্সবাদ ঘােষণা করে যে, কোনাে কিছুই শাশ্বত বা চিরন্তন নয়, সমাজের পরিবর্তন স্বাভাবিক ধারায় দেখা দেবে। বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তু ঘটনার বিকাশের কারণ তাঁর অন্তর্নিহিত স্ববিরােধী। দুই বিপরীতের দ্বন্দ্বই ক্রমবিকাশের ধারার সারবস্তু।(গ) এই পদ্ধতি অনুসারে যে-কোনাে পরিবর্তন এবং বিকাশ বলতে এক উন্নত স্তর হতে উন্নততর স্তরে পৌঁছানাে বােঝায়। বস্তুর অন্তর্নিহিত গতিশীলতার পরিমাণগত পরিবর্তন উন্নততর গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়। যেমন ক্রমাগত উত্তাপ বাড়তে থাকলে এক সময় জল বাষ্পে পরিণত হয়, আবার উত্তাপ হ্রাসের ফলে এক সময় জল বরফে পরিণত হয়। বাষ্প ও বরফের ধর্ম জল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।(ঘ) দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যায় সকল বস্তু বা ঘটনার মধ্যে পরস্পর বিরােধী ধর্ম বর্তমান এবং এই স্ববিরােধিতার জন্যই দ্বন্দ্ব। সুতরাং, বৈপরীত্যের মিলন ও দ্বন্দ্ব এক স্তর হতে অন্য উন্নত স্তরে রূপান্তরের মূল কারণ। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এ শিক্ষা দেয় যে, কোনাে বস্তুর মধ্যে একই ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকে। এই সংঘর্ষের মাধ্যমে বিকাশ সম্ভব হয়।(ঙ) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল অস্বীকৃতির বা নেতির নেতিকরণ। এই নীতি অনুযায়ী পুরাতন অবস্থা অস্বীকার না করে নতুনের জন্ম হতে পারে না। ক্রমবিকাশের পথে দ্রুত লম্ফনের মাধ্যমে অর্থাৎ বৈপ্লবিক পন্থায় পুরাতনকে অস্বীকার করে নতুনের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থাতেই অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং নতুনকে অস্বীকার করে নতুনতর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই নেতিকরণ বা অস্বীকৃতিকে বিশুদ্ধি ‘না’ বলে গ্রহণ করা যায় না, এটি এক নতুন অবস্থায় ইতিবাচক অগ্রগতি। অর্থাৎ বিপ্লব ধ্বংস নয়, উন্নততর বিকাশ মাত্র।

মূল্যায়ন

মার্কসবাদী তত্ত্ব ও নীতির বিরুদ্ধে সমালােচনার যুক্তিগুলিকে একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতে মার্কসবাদের বিপর্যয়ের ফলে এটি এখন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। তথাপি মার্কসবাদী তত্ত্বের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কি যথার্থই বলেছেন, “শ্রমজীবী মানুষ যখন নিজেদের অবস্থায় উন্নতি ঘটাতে আন্দোলন করেছে, তখন এই তত্ত্ব তাদের প্রেরণা দিয়েছে।”

প্রশ্ন ৬) রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসবাদী তত্ত্ব সমালােচনাসহ আলােচনা করাে।

উত্তর : রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা
রাষ্ট্র সম্পর্কে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা থেকে মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব স্বতন্ত্র। রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত্তি হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। রাষ্ট্র সম্পর্কে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কয়েকটি ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
সমাজ সম্পর্কে ধারণার ওপর ভিত্তিশীল
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিতে সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক কাঠামাে হল বুনিয়াদ (Base) এবং সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, ধর্ম, কলা, নৈতিকতা, আইন, রাষ্ট্র প্রভৃতি হল উপরি-সৌধ (Super-structure) যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিক বুনিয়াদেরপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উপরি সৌধেরও পরিবর্তন হয়। উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে সামাজিক বিপ্লব দেখা দেয়। সুতরাং, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নতুন অবস্থায় আইন, রীতিনীতি এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তন ঘটে। বুনিয়াদ ও উপরি-সৌধ পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ উপরি-সৌধের পরিবর্তনও আর্থিক কাঠামাের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
সমাজের শ্রেণিদ্বন্দ্বের মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্ভব
সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতেই মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে উৎপাদনের উপকরণের ওপর যে শ্রেণির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই শ্রেণি সম্পত্তির মালিকানার শক্তিতে অন্য শ্রেণিকে শােষণ করে। সুতরাং, সমাজ যখন সম্পত্তিবান ও সম্পত্তিহীন, শােষক ও শােষিতের মধ্যে বিভক্ত হল, তখন রাষ্ট্রের উদ্ভব হল।
রাষ্ট্র
 শ্রেণির শােষণের যন্ত্র
দেখা যায় যে সমাজে আর্থিক দিক হতে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে প্রচলিত সামাজিক সম্পর্ককে অক্ষুণ্ণ রাখবার চেষ্টা করে। এই শ্রেণি আপন স্বার্থরক্ষার জন্য বলপ্রয়ােগমূলক সংগঠনের সাহায্যে শােষণ অব্যাহত রাখে। রাষ্ট্র শ্রেণিশশাষণের যন্ত্র বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে একটি শ্রেণিকে শােষণ করবার জন্য অপর শ্রেণির শ্রেণিস্বার্থ অক্ষুন্ন রাখা এবং শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য জেলখানা, পুলিশ, বিশেষ বাহিনী, সৈন্যদল, আইন প্রভৃতির প্রয়ােজন হয়। লেনিনের মতে, মীমাংসাতীত শ্রেণিস্বার্থের বলেই রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং শ্রেণিশােষণ অক্ষুন্ন রাখার জন্য রাষ্ট্র অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
সমাজ বিকাশের বিভিন্ন ধারায়
মার্কস সমাজ বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বলেছেন, আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শােষণের কোনাে সুযােগ ছিল না। সমাজে শ্রেণিবিভাজন না থাকায় রাষ্ট্রেরও প্রয়ােজন হয় না। দাস সমাজব্যবস্থায় ক্রীতদাস ও দাস-মালিকের মধ্যে প্রথম সামাজিক শ্রেণিবিভাগ দেখা দেয়। দাসদের শাসন ও শােষণের জন্য দাস মালিকরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে থাকে। সামন্ত সমাজে সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসদের মধ্যে সমাজ বিভক্ত হল এবং সামন্তপ্রভুই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে লাগল। আবার বুর্জোয়া সমাজে রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণিকে শােষণ করবার জন্য মালিক শ্রেণির হাতিয়ারে পরিণত হল।
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সর্বহারার একনায়কত্ব
ধনতান্ত্রিক সমাজে শশাষণের অবসান ঘটে না এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বও তীব্র আকার ধারণ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বহারা শ্রেণির জনগণের ব্যাপক অংশের সহযােগিতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকার করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, কোনাে শােষক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে না।
রাষ্ট্রের বিলুপ্তির সম্ভাবনা
মার্কসবাদ বলে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ক্রমপর্যায়ে সাম্যবাদীসমাজে রূপলাভ করবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ব্যাপক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বলপ্রয়ােগমূলক প্রতিষ্ঠানের কোনাে প্রয়ােজন থাকবে না। শ্রেণিসংঘাত থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব; দ্বন্দ্ব-শােষণের অবসান ঘটলে রাষ্ট্রের প্রয়ােজনও নিঃশেষিত হবে। সুতরাং, রাষ্ট্রকে বর্জন করা বা পরিত্যাগ করা নয়, প্রয়ােজনের অভাবে রাষ্ট্র ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যাবে।মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের সমালােচনা
সমগ্র পৃথিবীতে মার্কসবাদ একই সময়ে সমাদৃত ও সমালােচিত হয়েছে। মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযােগগুলি হল নিম্নরূপ-(ক) মার্কস অর্থনৈতিক ঘটনাবলির ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরােপ করে মানুষের জীবনে আদর্শ, ধর্ম, নৈতিকতা প্রভৃতির গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন।(খ) সমালােচকগণ মনে করেন, মার্কস শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণিসংঘর্ষের ওপর বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষের সমাজে সহযােগিতা, ভ্রাতৃত্ব, প্রীতি-ভালােবাসার বন্ধন সমাজকে সম্মুখের দিকে পরিচালিত করে, এই বিষয়টি মার্কসীয় তত্ত্বে উপেক্ষিত।(গ) মার্কসবাদ রাষ্ট্রকে শ্রেণিশােষণের যন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করে বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করেছে; আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণকর রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সম্প্রসারণে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধনতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণির কল্যাণসাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।(ঘ) সর্বহারা শ্রেণির জয়লাভের মধ্য দিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা মার্কসবাদ বলে থাকে। এক্ষেত্রেও সমালােচকগণ বলেন যে, সর্বহারা শ্রেণির জয়লাভের পর নতুন সমাজব্যবস্থায় এক নতুন ধরনের সুবিধাভােগী শ্রেণির আবির্ভাব হতে পারে।(ঙ) ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে মার্কসের বক্তব্যও সমালােচকগণ সঠিক বলে মনে করেন না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীতে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটেনি। অপরদিকে বর্তমান যুগে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতি অস্বীকার করার উপায় নেই।
(চ) মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্বের বিলুপ্তি সম্পর্কে ধারণাটিরও সমালােচনা করা হয়। রাষ্ট্রের বিলুপ্তি অপেক্ষা বর্তমান দিনে রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূল্যায়ন
মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরুদ্ধে সমালােচনা অনেক ক্ষেত্রে অসার ও উদ্দেশ্যপ্রণােদিত বলে প্রমাণ হয়েছে। মার্কসবাদের বিরুদ্ধে সমালােচনা সত্ত্বেও পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানুষের ব্যাপক কল্যাণ সম্ভব করে তুলেছে। পৃথিবীর কোটি কোটি শােষিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের কাছে মার্কসবাদ আলাের পথের দিশারি। মার্কসবাদ প্রমাণ করেছে যে, শােষণমূলক ব্যবস্থার অবসানে মানুষের জন্য এক নতুন মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা একান্ত বাস্তব। সম্প্রতি পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে মার্কসবাদ বিমুখতা এবং সােভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারসংকটকে মার্কসবাদের ব্যর্থতা বলে অনেকে সমালােচনা করেছেন। কিন্তু শােষণমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মার্কসবাদ লেনিনবাদে বিকল্প কোনাে মতাদর্শের কথা আজও কেউ বলতে পারেননি। 

প্রশ্ন ৭) ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা দাও। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর :
ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের বিপরীত অবস্থা। যে শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাধীনতা থাকে না, রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না তাকে বলে ফ্যাসীবাদী শাসনব্যবস্থা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লন্ডেল স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কর্তৃত্বমূলকঅসমতাবাদী শাসনব্যবস্থা’ বলেছেন। আধুনিক কালে বিভিন্ন রূপে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। ফ্যাসিবাদ একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা। এখানে বিরােধিতা বা সমালােচনার কোনাে স্থান নেই। মার্কসবাদীরা ফ্যাসীবাদকে “একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বৃহৎ জমিদার গােষ্ঠীর সম্মিলিত মরণকামড় বলে বর্ণনা করেছেন।” ফ্যাসিবাদী নেতা মুসােলিনির ভাষায়, “All within the State none against the State.” অর্থাৎ সব কিছু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনাে কিছু করা চলবে না। সেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে একটি দল। তার নেতা থাকবে একজন। তার নির্দেশ হবে চূড়ান্ত। তাই এর মূল কথা হল,—“এক দল, এক নেতা, এক রাষ্ট্র।”
বৈশিষ্ট্য
অধ্যাপক অ্যালান বল (Alan Ball) রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদের ছয়টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। তা ছাড়া, এর আরও কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত,
ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের ব্যাপক প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এই দল প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে পারে। যেমন, ইটালিতে ফ্যাসিস্ট দল এই ক্ষমতার অধিকারী ছিল ও রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে পারত।
দ্বিতীয়ত, এই দলের পিছনে একটি রাজনৈতিক আদর্শ থাকে। যেমন, ফ্যাসিবাদী দলের একটি রাজনৈতিক আদর্শ ছিল। অভিজ্ঞতা ও বাস্তব প্রয়ােজনের ভিত্তিতে ফ্যাসিবাদের আদর্শ তৈরি হয়েছে। মুসােলিনি নিজেই বলেছেন,—“আমার কর্মসূচি হল কাজ করা, কথা বলা নয়।” কাজের সুবিধার জন্য যেটা করা প্রয়ােজন, সেই কাজ করাই আদর্শ।
তৃতীয়ত, ফ্যাসিবাদ সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের তত্ত্বে বিশ্বাসী। হেগেলের আদর্শবাদী তত্ত্বের দ্বারা ফ্যাসিবাদ প্রভাবিত হয়েছে। হেগেলের মতাে মুসােলিনি রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক সত্তা রূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র শুধু মানুষের নিরাপত্তা রক্ষা করবে না, সেইসঙ্গে জনগণের আধ্যাত্মিক জীবনের বিকাশ ঘটাবে। এই বিরাট ভূমিকা পালনের জন্যে রাষ্ট্রের প্রয়ােজনে নিজেকে
উৎসর্গ করতে হবে। মুসােলিনির ভাষায়,—“Hence everything for the State”
চতুর্থত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। তারা মনে করে, উৎপাদনের উপকরণ জাতীয়করণ হলে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা কমে যাবে ও উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
পঞ্চমত, ফ্যাসিবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, শ্রেষ্ঠ জাতির অধিকার আছে অন্য জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করা। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে হিটলার জাতির রক্তের বিশুদ্ধতা প্রচার করে অপবিত্র রক্তের মানুষ ইহুদিদের নিধন যজ্ঞ শুরু করেছিলেন।ষষ্ঠত, ফ্যাসিবাদ যুদ্ধের জয়গান করে। এদের শ্লোগান হল—শান্তি নয়, যুদ্ধ চাই। কারণ, যুদ্ধ জাতির গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে। শান্তির পূজারি হলে জাতি দুর্বল হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক মর্যাদা কমে যায়। তাই মুসােলিনি বলেছিলেন,—“মহিলাদের কাছে মাতৃত্ব যেমন, পুরুষদের কাছে যুদ্ধও তেমনি অপরিহার্য।
সপ্তমত, ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রকে ঘৃণা করে। কারণ, গণতন্ত্র হল নির্বোধের শাসন। এটি একটি ধীর গতির শাসন। অযােগ্য ও অপদার্থ ব্যক্তিদের শাসন।
অষ্টমত, ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরােধী। তাদের মতে স্বাধীনতা কোনাে অধিকার নয়। রাষ্ট্রই স্থির করবে নাগরিককে কোন্ কোন্ স্বাধীনতা দেওয়া হবে। রাষ্ট্রের প্রয়ােজনের দিকে তাকিয়ে স্বাধীনতার প্রকৃতি নির্ধারিত হবে।
নবমত, ফ্যাসিবাদী নেতারা মহত্বে বিশ্বাসী। যেমন মুসােলিনিকে অতিমানব বলে মনে করা হয়েছিল। মনে করা হত,—নেতার সিদ্ধান্তে কোনাে ভুল হয় না। তাই তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখানাে নৈতিক কর্তব্য।
সমালােচনা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ হল,—দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। এই মতবাদ শান্তি ও আন্তর্জাতিকতার শত্রু। একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন। সন্ত্রাসের জনক। সমস্ত রকম প্রগতির পথে অন্তরায়।
মূল্যায়ন
সমালােচিত হলেও একা অনস্বীকার্য, ফ্যাসিবাদী শাসনে যােগ্য নেতৃত্বের নিয়মশৃঙ্খলার মাধ্যমে দুর্নীতি ও শৈথিল্যের অবসান ঘটানাে যায়। স্বল্প সময়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হতে পারে। উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় হয়। তা সত্ত্বেও এই মতবাদ কাম্য নয়। কারণ এই মতবাদ বিশ্বকে যুদ্ধে ঠেলে দেয় ও মানবজাতির ধ্বংসকে নিশ্চিত করে। তাই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই মতবাদ ত্যাগ করা উচিত। কারণ মানুষ শান্তি চায়, যুদ্ধ চায় না।

প্রশ্ন ৮) গান্ধিজির রাজনৈতিক মতবাদ বা চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর :
অ্যারিস্টটল, হেগেল, রুশাে, মার্কস প্রভৃতি দার্শনিকরা যেভাবে রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন, গান্ধিজি তা করতে পারেননি। তাই গান্ধিবাদ বলে কিছু নেই। গান্ধিজি বলেছেন-“গান্ধিবাদ বলে কিছু নেই…….নতুন কোনাে মতবাদের স্রষ্টা হিসাবে আমি কিছু দাবি করি না।”

গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার স্বরূপ
(ক) রাজনীতিতে অহিংসা নীতির প্রয়ােগ
গান্ধিজির জীবন দর্শনের মূল আদর্শ হল সত্য ও অহিংসা। ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি সত্য ও অহিংসা নীতির প্রয়ােগ করেন। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে তিনি অহিংস নীতিকে ব্যবহার করেছেন। তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তন করতে বিপ্লব চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি হবে অহিংস বিপ্লব।
(খ) রাষ্ট্র ক্ষতিকারক প্রতিষ্ঠানগান্ধিজির মতে রাষ্ট্র ক্ষতিকারক প্রতিষ্ঠান। কারণ তাঁর মতে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল হিংসা ও বলপ্রয়ােগ। এই বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে শােষণ করে। এই শােষণ বন্ধ করার জন্যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত হওয়া উচিত।
(গ) রাষ্ট্রহীন ও দলহীন গণতন্ত্র
রাষ্ট্র যেহেতু হিংসার প্রতীক এবং দল যেহেতু হিংসার পথ গ্রহণ করে, সেহেতু আদর্শ সমাজব্যবস্থা হল রাষ্ট্রহীন ও দলহীন গণতন্ত্র। এই সমাজে প্রত্যেকেই শাসক। সকলের কল্যাণের জন্যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। রাষ্ট্র না থাকলে হিংসা থাকবে না। অহিংসা নীতির ওপর সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
(ঘ) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
গান্ধিজি রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী। সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকলে সে স্বৈরাচারী হবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হবে। তাই সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে না রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমবন্টন করা উচিত। এই লক্ষ্যে তিনি পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি বলে মনে হতেন।
(ঙ) সর্বোদয় তত্ত্বগান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় সর্বোদয় তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। সর্বোদয়ের অর্থ হল,—সকল মানুষের উদয় বা উন্নতি। কোনাে গােষ্ঠীর উন্নতি নয়। কিন্তু গান্ধিজি বলেছেন, বেশি মানুষের নয়, সব মানুষের উন্নতিবিধান আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে এই উন্নতি শুধু অর্থনৈতিক নয়। তার সঙ্গে আছে নৈতিক উন্নতি। মানুষের সব দিকের উন্নতি ঘটলেই সে পূর্ণতা পাবে।
সমালােচনা
প্রথমত, গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে স্ববিরােধিতা আছে। একদিকে তিনি রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, অন্যদিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত করার কথা বলেছেন।
দ্বিতীয়ত, গান্ধিজি বলেছেন,—একমাত্র অহিংসার মাধ্যমে সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভব। কিন্তু মার্কসবাদীরা বলেছেন, অহিংসার দ্বারা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ধ্বংস করা যাবে না। বিপ্লব হল একমাত্র পথ।
তৃতীয়ত, গান্ধিজি হিংসার প্রতীক হিসাবে রাষ্ট্রের অবলুপ্তি তার ক্ষমতাকে সীমিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র হল জনকল্যাণকর রাষ্ট্র।
মূল্যায়ন
সমালােচিত হলেও গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে একটা শাশ্বত মূল্য আছে। তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা ও অহিংসানীতির প্রয়ােগ করেছেন। রাজনীতি থেকে যদি সত্যবাদিতাকে দূরে রাখা হয় তাহলে রাজনীতি কলুষিত হবে। আবার যদি হিংসাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহলে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হবে।
গান্ধিজি বলেছেন, মানুষ যদি ভালাে হয়, তবেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ভালাে হবে। এ কথা সর্বকালে সত্য। মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করে। তাই তারা যদি ভালাে হয়, তবেই রাষ্ট্রব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চলবে। কেউ কেউ গান্ধিজির চিন্তাভাবনাকে অবাস্তব বলেছেন। এ কথা ঠিক নয়। কারণ গান্ধিজির আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা চালু হয়েছে। পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সব থেকে বড়াে কথা—গান্ধিজির অহিংসার নীতি বর্তমানে বিশ্বের রাজনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

প্রশ্ন ৯) গান্ধিজির সর্বোদয়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর :
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। তাঁর জীবন এত বিচিত্র ঘটনায় পূর্ণ, তার বক্তৃতা ও লেখা এত বিশাল ও মানবীয়, বিভিন্ন স্তরে তাঁর কাজকর্ম এত চমকপ্রদ যে, তাঁর জীবন ও শিক্ষার ব্যাপারে নিযুক্ত যে-কোনােঅধ্যয়নকারীর পক্ষে গান্ধি ও গান্ধিবাদ সম্পর্কে ব্যক্তিগত প্রিয়তত্ত্ব প্রমাণ করা সহজ কাজ।
গান্ধির দার্শনিক ভাবনা
গান্ধিজি ছিলেন একজন আদর্শবাদী। যে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা তিনি পরিচালিত তা দার্শনিক বস্তুবাদের বিরােধী—শুধু এই অর্থেই আদর্শবাদী নয়, বরং এই অর্থেও যে, তিনি কতকগুলি ধারণা পােষণ করতেন, বা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আঁকড়ে ছিলেন। নৈতিক মূল্যবােধ, অহিংসা, সত্যাগ্রহ, সর্বোদয় এ ছিল তারই প্রতিফলন। এগুলির অন্যতমটি ছিল সর্বোদয় সম্পর্কিত তাঁর ধারণা।
সর্বোদয়
গান্ধিজির জীবনবেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সর্বোদয় দর্শন। এ বিষয়ে রাস্কিনের ‘Unto this Last’ গ্রন্থটিকে তিনি অনুবাদ করে তার নাম দিয়েছিলেন সর্বোদয়”। ‘Unto this Last’ বইটির অনুসরণে সর্বোদয়ের তিনটি সিদ্ধান্তের উল্লেখ করেছেন—(ক) সমষ্টির কল্যাণের মধ্যেই ব্যক্তি কল্যাণ নিহিত। (খ) জীবিকা অর্জনের অধিকার সবার সমান। তাই সমাজে শ্রমের মূল্য সমান। (গ) শ্রমভিত্তিক জীবনই হল সার্থক জীবন, কেননা সমাজে শ্রমের গুরুত্বই সর্বাধিক।
সকলের কল্যাণ
গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন যে, মানবজাতির জন্য ভবিষ্যতের সুখী সমাজ সর্বোদয় পদ্ধতিতেই গড়ে তােলা যায়। আক্ষরিক অর্থে সর্বোদয় হল সকলের কল্যাণ’, যা এসেছে ‘সর্ব’ এবং ‘উদয়’ কথা দুটি থেকে। সর্বোদয়’ বলতে তিনি এক শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেছেন, যা সমষ্টিগতভাবে সব মানুষকে ঐক্য ও সংহতির সূত্রে আবদ্ধ রাখবে। গান্ধিজির সর্বোদয় তত্ত্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর হিতবাদী দর্শনের ‘সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণের’ ধারণা অস্বীকৃত হয়েছে। গান্ধিজি সৰ্বাধিক মানুষের পরিবর্তে সকলের কল্যাণের কথা বলেছেন।
সর্বোদয়ের আদর্শ
সর্বোদয়ের মূল আদর্শ হল আত্মত্যাগ। তিনি মনে করতেন, আত্মসুখের পরিবর্তে অপরের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিধানই হবে সর্বোদয় সমাজের ব্যক্তিবর্গের আদর্শ।
সর্বোদয়ের অর্থনৈতিক দর্শন
সর্বোদয়ের কাঠামাে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গান্ধিজি যে অর্থনৈতিক আদর্শ উত্থাপন করেছেন তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এই তত্ত্বে সম্পত্তির জাতীয়করণের পরিবর্তে সম্পত্তির অছি ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সর্বোদয় সমাজে প্রত্যেককেই তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং সমাজ থেকে সে প্রয়ােজন অনুযায়ী পাবে। এখানে কৃষি ও শিল্প হবে পরস্পরের পরিপূরক।
সর্বোদয়ের নীতি
গান্ধিজি মনে করতেন সর্বোদয় সমাজে ব্যক্তির অর্থনৈতিক বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়। বস্তুত গান্ধিজির সর্বোদয়ের লক্ষ্য ছিল এক উন্নত নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি। তিনি বিশ্বাস করতেন সত্য, অহিংস ও সৎ উপায়ের মাধ্যমে সর্বোদয় সমাজে এই নৈতিক পরিবেশ গড়ে উঠবে। তাই তিনি সত্য এবং অহিংসাকে মৌলিক নীতি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
রাষ্ট্রক্ষমতাকে ন্যূনতম করা
গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতার ওপর সর্বোদয় তত্ত্বে গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। এই তত্ত্ব মূলত সনাতন গ্রামীণ সভ্যতা, সংস্কৃতি পরিপােষণের কথা বলে। গান্ধিজি মনে করতেন সর্বোদয় গণতন্ত্রে অগণিত গ্রামকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বৃহত্তর গণ্ডির সৃষ্টি হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, প্রথমে গ্রাম স্বরাজ এবং তারপর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। রামরাজ্যের স্তরে রাষ্ট্র থাকলেও তার প্রকৃতি বদলাবে তারপর শাসনহীন ও কর্তৃত্বহীন রামরাজ্য গড়ে উঠবে। একেই গান্ধিজি সর্বোদয় সমাজ বা স্বর্গরাজ্য বা বৈকুণ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বোদয় তত্ত্বে শহর জীবনের পরিবর্তে গ্রাম জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে।
সর্বোদয়ের রাজনৈতিক দর্শন
অর্থনৈতিক আদর্শ ও নৈতিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া সর্বোদয়ের রাজনৈতিক দর্শনও যথেষ্ট কৌতূহলকর। সর্বোদয় দর্শনে রাজনৈতিক দলহীন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। গান্ধিজি মনে করতেন দলব্যবস্থা একদিকে জনগণকে ক্ষমতালােভী করে এবং বিভিন্ন গােষ্ঠীতে বিভক্ত করে। দলীয় গণতন্ত্র স্বার্থান্ধ রাজনীতিবিদ তৈরি করে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে। এ ছাড়াও সর্বোদয় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এবং বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। এখানে কতিপয় বা অধিকাংশের পরিবর্তে সকলের শাসন কায়েম হবে। স্বভাবতই সর্বোদয় সমাজে রাষ্ট্র গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। গান্ধিজি উল্লেখ করেছেন যে, গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এই ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এখানে পঞ্চায়েতগুলি নির্বাচিত হবে সর্বসাধারণের দ্বারা।

কুইজ সেট>>

1. প্রথম উদারনীতিবাদের উদ্ভব হয়-
(A) প্রাচীন রােমে
(B) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
(C) সপ্তদশ শতাব্দীতে


2. উদারনীতিবাদের মূল উপাদান হল—
(A) অর্থনৈতিক সাম্য
(B) ব্যক্তিস্বাধীনতা
(C) রাষ্ট্র কর্তৃত্ব

3. ‘উদারনীতিবাদ’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন-
(A) মার্কস
(B) মিল
(C) ল্যাস্কি
(D) হবহাউস

4. বিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিবাদ- __________ রাষ্ট্রের কথা প্রচার করে।
(A) জনকল্যাণকর
(B) সমাজতান্ত্রিক
(C) সর্বাত্মক
(D) ফ্যাসিবাদী

5. সনাতন উদারনীতিবাদ __________ সমর্থন করেন।
(A) অবাধ বাণিজ্যনীতি
(B) রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যনীতি

6. বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হলেন—
(A) রবার্ট আওয়েন
(B) মার্কস
(C) বার্নস্টাইন
(D) হেগেল

7. মার্কস __________ -এর দ্বন্দ্ববাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
(A) হেগেল
(B) কান্ট
(C) ফয়েরবাখ

8. শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব রচনায় মার্কস ও এঙ্গেলস __________ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
(A) ফরাসি সমাজতন্ত্রী
(B) ইংরেজ অর্থনীতিবিদ
(C) জার্মান দার্শনিকদের

9. মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক নীতি হল—
(A) ভাববাদ
(B) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
(C) উদারবাদ

10. মার্কসবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে __________ -এর অবদান সর্বাধিক।
(A) ল্যাস্কি
(B) বার্নস্টাইন
(C) লেনিন

11. বিপ্লব হল—
(A) রাজনৈতিক পরিবর্তন
(B) শাসকের পরিবর্তন
(C) অর্থনৈতিক পরিবর্তন
(D) সমাজের গুণগত পরিবর্তন

12. প্রথম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়—
(A) আদিম সাম্যবাদী সমাজে
(B) দাস সমাজে
(C) সামন্ত সমাজে
(D) পুঁজিবাদী সমাজে

13. __________ মত প্রকাশ করে যে সর্বহারা বিপ্লবের পর রাষ্ট্রের কোনাে অস্তিত্ব থাকবে না।
(A) উদারনীতিবাদ
(B) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ
(C) মার্কসবাদ
(D) আচরণবাদ

14. রাষ্ট্রক্ষমতা সর্বহারা শ্রেণি দখল করলে __________ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
(A) সর্বহারা শ্রেণির
(B) বুর্জোয়া শ্রেণির

15. __________ বিশ্বাস করে যে, শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
(A) উদারনীতিবাদ
(B) মার্কসবাদ
(C) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ

16. লিবারেলিজম্ (Liberalism) গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন—
(A) রুশো
(B) মার্কস
(C) হবহাউস
(C) মেকিয়াভেলি

17. গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থক ছিলেন—
(A) ভি.আই.লেনিন
(B) বার্কার
(C) বার্নস্টাইন
(D) অরবিন্দ

18. উদারনীতিবাদ ব্যক্তিগত সম্পত্তির
(A) বিলােপসাধন চায়
(B) বিলােপসাধন চায় না

19. উদারনৈতিক চিন্তাধারার সূত্রপাত হয়—
(A) মধ্যযুগে
(B) নবজাগরণের সময়
(C) সপ্তদশ শতকে
(D) অষ্টাদশ শতকে

20. উদারনীতিবাদের অপর নাম-
(A) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ
(B) সাম্যবাদ
(C) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ

21. শান্তিপূর্ণ পথে ও সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের পক্ষপাতী হল—
(A) মার্কসবাদ
(B) উদারনীতিবাদ
(C) সাম্যবাদ

22. অবাধ বাণিজ্যের স্বাধীনতা দাবি করে—
(A) সনাতনী উদারনীতিবাদ
(B) মার্কসবাদ

23. “সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুখ” নীতির প্রবক্তা হলেন—
(A) বেত্থাম
(B) মিল
(C) ল্যাস্কি
(D) বার্কার

24. মার্কসের প্রধান সহযােগী হলেন
(A) এঙ্গেলস
(B) ট্রটস্কি
(C) বার্নস্টাইন
(D) হেগেল

25. কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশিত হয় __________ খ্রিস্টাব্দে।
(A) ১৯৪৮
(B) ১৮১৮
(C) ১৮৪৮
(D) ১৯৫১

26. রাষ্ট্রের বিলুপ্তি চায়—
(A) মার্কসবাদ
(B) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ

27. ‘দাস ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের রচয়িতা
(A) মার্কস
(B) ল্যাস্কি
(C) গ্রিন
(D) বার্কার

28. ভারতের গণতান্ত্রিক সমাজবাদের অন্যতম প্রবক্তা
(A) মহাত্মা গান্ধি
(B) নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু
(C) জওহরলাল নেহরু

29. বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রের অপর নাম—
(A) সাম্যবাদ
(B) উদারনীতিবাদ
(C) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ

30. মার্কসের দ্বন্দ্ববাদে __________-এর প্রভাব দেখা যায়।
(A) হেগেল
(B) ল্যাস্কি
(C) গ্রিন

31. মার্কসের বস্তুবাদী দর্শন __________ দ্বারা প্রভাবিত।
(A) হেগেল
(B) ফয়েরবাখ

32. ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রথম উদ্ভব ঘটে—
(A) আদিম সাম্যবাদী সমাজে
(B) সামন্ত সমাজে
(C) দাস সমাজে

33. “রাষ্ট শ্রেণিশােষণের হাতিয়ার” -বলেছেন ___________ তাত্ত্বিকেরা।
(A) উদারনীতিবাদী
(B) মার্কসবাদী
(C) গণতান্ত্রিক সমাজবাদী

34. বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি বলেছেন—
(A) মার্কস
(B) লেনিন
(C) হেগেল
(D) স্তালিন

35. “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” রচনা করেন—
(A) মার্কস
(B) লেনিন
(C) মার্কস-এঙ্গেলস

36. মার্কসবাদের ভিত্তি হল—
(A) উপযোগীতাবাদ
(B) উদারনীতিবাদ
(C) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ

37. __________ বলেছেন যে, রাষ্ট্র শ্রেণিশাসনের যন্ত্র।
(A) হবস
(B) কার্ল মার্কস
(C) বেত্থাম
(D) ল্যাস্কি

38. __________ বলেছিলেন, “ব্যক্তির স্বার্থই হল প্রকৃত স্বার্থ।”
(A) বার্কার
(B) কার্ল মার্কস
(C) বেত্থাম
(D) ল্যাস্কি

39. উদারনীতিবাদের মুখ্যনীতি হল—
(A) অর্থনৈতিক সাম্য
(B) ব্যক্তিস্বাধীনতা

40. আধুনিক উদারনীতিবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন—
(A) জে. এস. মিল
(B) গ্রিন
(C) হেগেল
(D) রুশাে

41. উপযোগীতাবাদের মূল প্রবক্তা হলেন-
(A) বেত্থাম
(B) জে. এস. মিল
(C) গ্রিন
(D) হেগেল

Leave a Comment

Scroll to Top