ভারতীয় বিচারব্যবস্থা

ভারতীয় বিচারব্যবস্থা | Judiciary In India

রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১) ভারতের সুপ্রিমকোর্টের কার্যাবলি আলােচনা করাে।
উত্তর : ভারতের ‘অখণ্ড বিচারব্যবস্থার শীর্ষ আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্ট হল একদিকে দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত, অপরদিকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত। এই দ্বৈত ভূমিকার সমন্বয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের বিশিষ্ট চরিত্র।

কার্যাবলি
সুপ্রিমকোর্টের কার্যক্ষেত্রকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(এক) মূল এলাকা, (দুই) আপিল এলাকা, (তিন) পরামর্শদান এলাকা, (চার) নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারির এলাকা।
(এক) মূল এলাকা
ভারতীয় সংবিধানের ১৩১ নং ধারা অনুযায়ী যে-সকল মামলা কেবলমাত্র সুপ্রিমকোর্টেই দায়ের করা যায় এবং সুপ্রিমকোর্ট যে-সকল’ মামলার বিরােধ নিষ্পত্তি করে সেইসব ক্ষেত্রগুলি সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকার মধ্যে পড়ে—
(ক) কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে এক বা একাধিক অঙ্গরাজ্য সরকারের মধ্যে বিরােধ।
(খ) কেন্দ্র সরকার এবং এক বা একাধিক অঙ্গরাজ্যের সরকারের সঙ্গে অপর কয়েকটি বা একটি অঙ্গরাজ্যের সরকারের বিরােধ।
(গ) দুই বা তার বেশি অঙ্গরাজ্যের সরকারের মধ্যে বিরােধ, আবার রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন নিয়ে কোনাে বিরােধ উপস্থিত হলে তার নিষ্পত্তি করে সুপ্রিমকোর্ট—এটিও মূল এলাকার মধ্যে পড়ে। তবে সংবিধান গ্রহণের পূর্বে যেসব সন্ধি, চুক্তি, অঙ্গীকারপত্র, সনদ সম্পাদিত হয়েছিল এবং যা এখনও বলবৎ আছে সেগুলিকে কেন্দ্র করে কোনাে বিরােধ দেখা দিলে তার নিষ্পত্তি করতে পারে না সুপ্রিমকোর্ট।
(দুই) আপিল এলাকা
ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট। আপিল এলাকা বলতে বােঝায় যে-কোনাে অধস্তন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল গ্রহণ করার ক্ষমতা। সুপ্রিমকোর্টে যে চার ধরনের আপিল করা যায় তা হল—
(অ) সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল : ভারতীয় সংবিধানের ১৩২ নং ধারা অনুযায়ী কোনাে দেওয়ানি, ফৌজদারি বা অন্য যে-কোনাে মামলার বিষয়ে হাইকোর্ট যদি সার্টিফিকেট দেয় যে, সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িয়ে আছে তাহলে তা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যাবে। আবার হাইকোর্ট সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকার করলে এবং সুপ্রিমকোর্ট যদি নিজে মনে করে যে মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনাে প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। তাহলে সেক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট আপিলের ‘বিশেষ অনুমতি দিতে পারেন।
(আ) দেওয়ানি আপিল : ভারতীয় সংবিধানের ১৩৩ নং ধারা অনুসারে কোনাে দেওয়ানি মামলার সঙ্গে আইনের গুরুত্বপূর্ণ যে-কোনাে প্রশ্ন জড়িত আছে অথবা হাইকোর্ট যদি মনে করেন যে-কোনাে দেওয়ানি মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টে হওয়া উচিত তাহলে সেই মামলার সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যাবে।
(ই) ফৌজদারি আপিল : ভারতীয় সংবিধানের ১৩৪ নং ধারা অনুসারে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে –
(i) নিম্ন বিচারালয়ে নির্দোষ বলে প্রমাণিত কোনাে ব্যক্তিকে হাইকোর্ট যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়ে থাকে।
(ii) হাইকোর্ট নিম্ন বিচারালয় থেকে কোনাে মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দিলে।
(ii) মামলাটি সুপ্রিমকোর্টে আবেদনযােগ্য—এই মর্মে হাইকোর্ট সার্টিফিকেট দিলে প্রভৃতি বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।
(ঈ) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল : ভারতীয় সংবিধানের ১৩৬ নং ধারা অনুসারে সুপ্রিমকোর্ট ভারতের যে-কোনাে আদালতের যে-কোনাে রায়, আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য বিশেষ অনুমতি (Special Leave) দিতে পারে তবে সামরিক আদালতের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতা নেই।
(তিন) পরামর্শদান এলাকা
ভারতীয় সংবিধানের ১৪৩ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন আইন বা তথ্যসংক্রান্ত বিষয়ে কোনাে সার্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে বা উদ্ভব হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাহলে সেক্ষেত্রে তিনি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টকে পরামর্শ দানে বাধ্য করা যায় না। এছাড়াও সংবিধান চালু হওয়ার আগে যেসব সন্ধি, চুক্তি, অঙ্গীকারপত্র, সনদ ইত্যাদি সম্পাদিত হয়েছিল এবং যেগুলি সংবিধান চালু হওয়ার পরেও কার্যকর আছে সেইসব বিষয়ে কোনাে বিরােধ উপস্থিত হলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ চাইতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিমকোর্ট পরামর্শ দিতে বাধ্য থাকেন। তবে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কাজ করতে বাধ্য নন।
(চার) নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করার এলাকা 
ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে সযত্নে সংরক্ষণের দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। তাই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে সেগুলিকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সুপ্রিমকোর্ট বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকারপৃচ্ছা, উৎপ্রেষণ প্রভৃতি নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করতে পারে। তবে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি করে সুপ্রিমকোর্টের এই লেখ জারির ক্ষমতা অকেজো করে দিতে পারে।
উপরিউক্ত ক্ষমতা ছাড়াও সুপ্রিমকোর্টের আরও কিছু ক্ষমতা আছে। যেমন-
(i) সুপ্রিমকোর্ট হল সর্বোচ্চ অভিলেখ আদালত বা ‘Court of Records’ সুপ্রিমকোর্টে যে সমস্ত নথিপত্র সংরক্ষিত থাকে ভারতের যে-কোনাে বিচারালয় সেগুলিকে প্রামাণ্য এবং যথার্থ হিসাবে গ্রহণ করে থাকে।
(ii) সংসদ বিশেষ আইন প্রণয়ন করে বা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বােঝা পড়ার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের এলাকা বৃদ্ধি করতে পারে।
(i) সুপ্রিমকোর্ট নিজের আদেশ বা রায় পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
(iv) সুপ্রিমকোর্টকে অবমাননার জন্য অবমাননাকারীর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা সুপ্রিমকোর্ট নিজেই গ্রহণ করতে পারে।
(v) ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোনাে মামলা প্রত্যাহার এবং হাইকোর্টে পাঠাতে পারে সুপ্রিমকোর্টকে।
(vi) ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুপ্রিমকোর্ট যে-কোনাে ডিক্রি বা আদেশ জারি করতে পারে। এইরকম ডিক্রি বা আদেশ ভারতের সমস্ত ভৌগােলিক এলাকার মধ্যে বলবৎ হবে।
(vii) নিজের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়ােজনীয় কর্মচারী নিয়ােগের ক্ষমতাও সুপ্রিমকোর্টের হাতে অর্পণ করা হয়েছে।

মূল্যায়ন
ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত, সর্বোচ্চ আপিল আদালত, সংবিধানের রক্ষক এবং অভিভাবক, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা এবং রাষ্ট্রপতির আইনগত পরামর্শদাতা হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বিচার বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগীয় অতিসক্রিয়তা (Judicial activism) কথাটি সংযুক্ত হওয়ার ফলে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে তাঁর ভূমিকা অনবদ্য। এসব থাকা সত্ত্বেও সুপ্রিমকোর্টকে নানা রকম সীমাবদ্ধতা থেকেইবিচারকার্য সম্পাদন করতে হয়। কারণ সুপ্রিমকোর্ট যখনই কোনাে ভালাে রায় দিয়েছে সংসদ সংবিধান সংশােধন করে তার রায়কে অকার্যকর করে দিয়েছে। পরিশেষে বলা যায় যে, বিচারপতিদের দৃঢ়তা, যােগ্যতা এবং নিষ্ঠার জোরে সুপ্রিমকোর্ট আগামীদিনে ভারতীয় জনগণের আশা পূর্ণ করবে।

প্রশ্ন ২) ভারতের যেকোনাে অঙ্গরাজ্যের হাইকোর্টের কার্যাবলি আলােচনা করাে।
উত্তর : ভারতের সর্বোচ্চ আদালত হল হাইকোর্ট। ভারতীয় সংবিধানের ২১৫ নং ধারা অনুসারে প্রতিটি রাজ্যের জন্য একটি করে হাইকোর্ট থাকবে। তবে সংসদ আইন প্রণয়ন করে দুই বা ততােধিক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য একটি অভিন্ন হাইকোর্ট স্থাপন করতে পারে। যেমন—কলকাতা হাইকোর্টের মধ্যে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। বর্তমানে ২৮টি অঙ্গরাজ্যের জন্য ২১টি হাইকোর্ট রয়েছে।

ক্ষমতা ও কার্যাবলি
ভারতীয় সংবিধানে হাইকোর্টের ক্ষমতা এবং কার্যাবলি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে যে, সংবিধান চালু হওয়ার আগে হাইকোর্ট যে-সকল ক্ষমতা ভােগ করত বর্তমানেও সেই সকল ক্ষমতা ভােগ করবে। তবে সংবিধান এবং আইনের গণ্ডির মধ্যে হাইকোর্টকে তার ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রত্যেক হাইকোর্টের এলাকা তার ভৌগােলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও সংসদ আইন প্রণয়ন করে তার এলাকাকে সম্প্রসারিত করতে পারে। হাইকোর্টের এলাকাগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে-
(এক) মূল এলাকা : হাইকোর্টের মূল এলাকা বলতে রাজস্ব সংক্রান্ত সকল বিষয়কেই বােঝায়। এছাড়াও কলকাতা, মুম্বই এবং চেন্নাই-এই তিনটি মহানগরের হাইকোর্টের দেওয়ানি মামলা সংক্রান্ত মূল এলাকা আছে, অন্য হাইকোর্টের এরকম মূল এলাকা নেই।
(দুই) আপিল এলাকা : দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে রাজ্যের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হল হাইকোর্ট। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে জেলা জজ এবং সহকারী জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়। কোনাে অধস্তন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোনাে অধস্তন আদালত যে রায় দেয়, তার বিরুদ্ধেও হাইকোর্টে আপিল করা যায়। এছাড়াও হাইকোর্টের কোনাে বিচারপতির একক রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়। ফৌজদারি মামলায় দায়রা জজ এবং অতিরিক্ত দায়রা জজ কোনাে ব্যক্তিকে সাত বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়।
(তিন) মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত এলাকা : ভারতীয় সংবিধানের ২২৬ নং ধারা অনুসারে হাইকোর্ট তার নিজ ভৌগােলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ, পরদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা এবং উৎপ্রেষণ প্রভৃতি লেখ জারি করতে পারে। এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, সুপ্রিমকোর্ট কেবল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য লেখ জারি করতে পারে, কিন্তু হাইকোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং অন্যান্য আইনগত অধিকার কার্যকারী করার জন্য লেখ জারি করতে পারে।
(চার) আইনের বৈধতা বিচারের এলাকা : কেন্দ্রীয় আইন এবং রাজ্য আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা ভােগ করে হাইকোর্ট। ১৯৭৯ সালে ৪২তম সংবিধান সংশােধন করে হাইকোর্টের এই ক্ষমতার বিলােপসাধন করা হলেও ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ৪৩তম সংবিধান সংশােধন করে তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
(পাঁচ) অধস্তন আদালতগুলিকে তত্ত্বাবধান করা : রাজ্যের অধস্তন আদালতগুলিকে তত্ত্বাবধান করতে পারে হাইকোর্ট। সংবিধানের ২২৭ নং ধারা অনুসারে সকল আদালত এবং ট্রাইবিউনালগুলির ওপর পর্যবেক্ষণের ভূমিকা পালন করে থাকে হাইকোর্ট।
(ছয়) অন্যান্য কাজ : উপরিউক্ত ক্ষমতা ছাড়াও হাইকোর্ট যে-সকল ক্ষমতা ভােগ করে তা হল-(ক) রাজ্যের অধস্তন আদালতগুলিকে খাতাপত্র এবং হিসাবপত্র রক্ষা করার নির্দেশ দিতে পারে।(খ) আদালত অবমাননার জন্য অবমাননাকারীকে শাস্তি দিতে পারে।(গ) নিম্ন আদালতে বিচারাধীন কোনাে মামলার সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত কোনাে প্রশ্ন জড়িত থাকলে হাইকোর্ট সেই মামলাটি নিজের হাতে নিতে পারে।(ঘ) হাইকোর্ট বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়ােজনীয় বিধি প্রণয়ন করতে পারে।(ঙ) অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের নিয়ােগ, পদোন্নতি, বদলি প্রভৃতি বিষয়ে হাইকোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(চ) সর্বোপরি হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্টের ন্যায় অভিলেখ আদালত হিসাবে কাজ করে।

মূল্যায়ন 
হাইকোর্টের উপরিউক্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত হিসাবে হাইকোর্ট প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। এতদসত্ত্বেও হাইকোর্টকে বিশেষ কতকগুলি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়। হাইকোর্ট রাজ্যের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসাবে স্বীকৃত হলেও তাকে ভারতের অখণ্ড বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ আপিল আদালত সুপ্রিমকোর্টের অধীনে থেকেই কাজ করতে হয় এবং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। এছাড়াও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়ােগ, বদলি এমনকি অপসারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সর্বব্যাপী প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। ভারতে জাতীয় জরুরি অবস্থা কার্যকর হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে মৌলিক অধিকার কার্যকর করার জন্য হাইকোর্টের কাছে আবেদন করার অধিকার নাকচ করে দিতে পারেন। সর্বোপরি অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং সেই মতাে বিচারপতির অভাব উভয়বিধ কারণে হাইকোর্টের ন্যায়বিচার বিলম্বিত এবং ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। এই সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যে হাইকোর্টকে চলতে হয় বলে রাজ্যেও সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসাবে যে মর্যাদা পাবার কথা তা পায় না।

বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১) ভারতীয় বিচারব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
উত্তর : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল বিচার বিভাগ। তাই ভারতের সংবিধান রচয়িতাগণ প্রচলিত গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী বিচার বিভাগের ভূমিকা স্থির করেন। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(এক) ভারতের যুক্তরাষ্টীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও এখানে দ্বৈত বিচারব্যবস্থার পরিবর্তে অখণ্ড বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে।
(দুই) ভারতবর্ষের সর্বত্র একই দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধি প্রচলিত আছে।
(তিন) নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায় হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টের উপর।
(চার) যে সমস্ত দরিদ্র ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৫০০০০ টাকার কম তাদের কোনাে মামলা থাকলে সরকার কর্তৃক আইনগত সাহায্য দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(পাঁচ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিচার বিভাগকে শাসন ও আইন বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়াও এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলির দ্বারা বিচার বিভাগের ত্রুটিই প্রকাশ পায়। যেমন—আইনের দৃষ্টিতে অসাম্য, দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয়বহুল শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়ােগ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অনুপস্থিতি ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।

প্রশ্ন ২) ভারতের সুপ্রিমকোর্টের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য সংবিধানে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
উত্তর : ভারতের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপর নির্ভর করছে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যটিকে সফল করার জন্য সংবিধানে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যথা—
(এক) বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য গুণগত যােগ্যতাকেই প্রধান মাপকাঠি হিসাবে রাখা হয়েছে।
(দুই) শুধুমাত্র অসদাচরণ অথবা অক্ষমতা ছাড়া অপর কোনাে কারণে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করা যায় না।
(তিন) সংসদে বিচারপতিদের রায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তােলা যাবে না।
(চার) সুপ্রিমকোর্টের কোনাে বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর ভারতের কোনাে আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে পারবে না।
(পাঁচ) বিচারপতি থাকাকালে তাদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি কমানাে যায় না।
(ছয়) সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন, ভাতা বাবদ যে খরচ হবে তা ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে নির্বাহ করা হবে।

প্রশ্ন ৩) ভারতের সুপ্রিমকোর্টের আপিল এলাকা সংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তর : ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট। এর আপিল এলাকাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল : ভারতীয় সংবিধানের ১৩২ নং ধারা অনুযায়ী কোনাে দেওয়ানি, ফৌজদারি বা অন্য যে-কোনাে মামলার বিষয়ে হাইকোর্ট যদি সার্টিফিকেট দেয় যে, সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত আছে, তাহলে তা সুপ্রিমকোটে আপিল করা যাবে।
(খ) দেওয়ানি আপিল : সংবিধানের ১৩৩ নং ধারা অনুসারে কোনাে দেওয়ানি মামলার সঙ্গে আইনের গুরত্বপূর্ণ যে-কোনাে প্রশ্ন জড়িত আছে অথবা হাইকোর্ট যদি মনে করে যে কোনাে দেওয়ানি মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টে হওয়া উচিত তাহলে সেই মামলার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যাবে।
(গ) ফৌজদারি আপিল : সংবিধানের ১৩৪ নং ধারা অনুসারে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে-
(অ) নিম্ন আদালতে নির্দোষ বলে প্রমাণিত কোনাে ব্যক্তিকে হাইকোর্ট যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘােষণা করে,
(আ) হাইকোর্ট নিম্নতর আদালত থেকে কোনাে মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দিলে,
(ই) মামলাটি সুপ্রিমকোর্টে আবেদনযােগ্য—এই মর্মে হাইকোর্ট সার্টিফিকেট দিলে ইত্যাদি বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।
(ঘ) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল ও সংবিধানের ১৩৬ নং ধারা অনুসারে সুপ্রিমকোর্ট ভারতের যে-কোনাে আদালতের যে-কোনাে রায়, আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ‘বিশেষ অনুমতি’ (Special Leave) দিতে পারে। তবে সামরিক আদালত বা ট্রাইবিউনলের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতা নেই।

প্রশ্ন ৪) ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক এবং ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা কী তা সংক্ষেপে উল্লেখ করাে।
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক এবং চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হল ভারতের সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের কোনাে অংশের বিশ্লেষণ যেভাবে দেয় সেই ভাবেই তার অর্থ নির্ধারিত হয়। ভারতের কোনাে বিচারালয়—এমনকি পার্লামেন্টও সেই বিশ্লেষণকে উপেক্ষা করতে পারে না। আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতার সাহায্যে সুপ্রিমকোর্ট এই রকম ভূমিকা পালন করে থাকে। তা ছাড়া সংবিধান দেশের মৌলিক আইন হওয়ায় এর বিরােধী যে-কোনাে আইন ও সরকারি সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিকতার দায়ে সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করে দিতে পারে। তবে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এটি মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের মতাে যেমন শক্তিশালী নয়, আবার গ্রেট ব্রিটেনের আদালতের মতাে দুর্বলও নয়। অর্থাৎ ব্রিটেনে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রণীত সকল আইনই আদালতের কাছে বৈধ। এখানে আদালত আইন ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু বৈধতা বিচার করতে পারে না। অপরদিকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট যে-কোনাে আইন বিধিসম্মত পদ্ধতি অনুসারে প্রণীত হয়েছে কি না তা যেমন বিচার করে দেখে, সেই সঙ্গে আহনটি স্বাভাবিক ন্যায়নীতিবােধের বিরােধী কি না তাও বিচার করে দেখে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট যে-কোনো অযৌক্তিক আইনকে বাতিল করে দিতে পারে। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের এ ক্ষমতা নেই। এখানে সুপ্রিমকোর্ট দেখে যে, আইনটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথ পদ্ধতি অনুসারে প্রণীত হয়েছে। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট আইনের গুণাগুণ বিচার করতে পারে না। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মতাে ভারতীয় সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় নয় বলে পার্লামেন্ট সংবিধান সংশােধন করে খুব সহজেই সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ অথবা রায়কে অকেজো করে দিতে পারে। তাই বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক এবং ব্যাখ্যাকর্তা হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট তার ভূমিকা পালন করতে পারে সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসার চিহ্ন থেকেই যায়।

প্রশ্ন ৫) ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা কী?
উত্তর : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল নাগরিকদের লিখিত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ। ভারতের ন্যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই অধিকারগুলিকে সযত্নে সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের উপর। তাই সুপ্রিমকোর্ট মৌলিক অধিকার বিরােধী যে-কোনাে আইন বা সরকারি নির্দেশ অসাংবিধানিকতার দায়ে বাতিল করে দিতে পারে। সংবিধানের ১৩ নং ধারায় মৌলিক অধিকারগুলিকে আইনসভার স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় সংবিধানে সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার লিপিবদ্ধ হওয়ায় মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের উপর বর্তায়। সুপ্রিমকোর্ট এই দায়িত্ব পালনে পাঁচ ধরনের, যথা বন্দি-প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা এবং উৎপ্রেষণ ইত্যাদি লেখ (Writ) জারি করে, সুতরাং বলা যায় যে, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষক এবং অভিভাবক হিসাবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ঘােষণা করে এবং পার্লামেন্টে সংবিধান সংশােধন করে খুব সহজেই মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা যায়। মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্ট কতটা কার্যকারী ভূমিকা পালন করতে পারবে—তা ভবিষ্যৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিই দিক নির্দেশ করে দেবে।

প্রশ্ন ৬) ভারতের যে-কোনাে অঙ্গরাজ্যের হাইকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতাগুলি কী কী তা উল্লেখ করাে।
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের ২১৫ নং ধারা অনুসারে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে একটি করে হাইকোর্ট থাকবে। আবার এক বা একাধিক অঙ্গরাজ্যের জন্য একটি করে হাইকোর্ট থাকতে পারে। অঙ্গরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত হিসাবে হাইকোর্টকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতা হল হাইকোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা। মূল এলাকার অর্থ হল সরাসরি মামলা দায়ের করার ক্ষমতা। রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত বিরােধ নিষ্পত্তির বিষয়ই হাইকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত বিষয়ের মধ্যে পড়ে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে হাইকোর্টের এই এলাকা সংক্রান্ত ক্ষমতা বিলােপ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম সংবিধান সংশােধন করে এই ক্ষমতা হাইকোর্টকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি হাইকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতা থেকে বিলােপসাধন করে কলকাতা, মুম্বই এবং চেন্নাই শহরে তা নগর দায়রা আদালতে সম্পাদন করা হয়।

প্রশ্ন ৭) ভারতের লােকআদালত সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা রচনা করাে।
উত্তর : ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে দরিদ্র এবং দুর্বল ভারতবাসী যাতে সহজে যথাযথ ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে তার জন্য ১৯৮৭ সালে ‘আইনগত পরিসেবা কর্তৃপক্ষ নামে’ একটি আইন প্রণয়ন করে সংসদ লােকআদালতকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। বিচারপতি পি.এন ভগবতী ‘লােকআদালত’ গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। লােকআদালত গঠিত হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় আধিকারিক, একজন বিখ্যাত আইনজীবী এবং একজন সমাজসেবী নিয়ে। লােকআদালতের এক্তিয়ারে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি যে-কোনাে মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। আদালতে অনেকদিন ঝুলে আছে কিংবা যে-কোনাে বিষয় যা কোনাে আদালতে উত্থাপিত হয়নি তার বিচার লােকআদালত করতে পারে। এই আদালতে যেহেতু বাদী এবং বিবাদী উভয়পক্ষের সহমতের ভিত্তিতে বিচারকার্য সম্পাদন হয় বলে উভয়পক্ষই এই আদালতের রায় মেনে নিতে বাধ্য। লােকআদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোথাও আপিল করা যায় না। লােকআদালতের এক্তিয়ারকে সম্প্রসারিত করার ফলে পরিবহন, ডাক, যােগাযােগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, হাসপাতাল, বিমা এবং বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ের মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে লােকআদালত উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। লােকআদালতে কোনােরকম খরচ হয় না বলে এবং দ্রুত বিরােধের মীমাংসা করা যায় বলে এর জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

  1. ভারতবর্ষে কী ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত আছে?
    উত্তর: ভারতবর্ষে অখণ্ড বিচারব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
  2. ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের নাম কী?
    উত্তর: ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের নাম সুপ্রিমকোর্ট।
  3. কোনাে রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের নাম কী?
    উত্তর: কোনাে রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের নাম
    হাইকোর্ট বা মহাধর্মাধিকরণ।
  4. ভারতবর্ষে কি দ্বৈত বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে?
    উত্তর: ভারতবর্ষে দ্বৈত-বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি।
  5. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা কত?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা ২৬ জন।
  6. হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা কত?
    উত্তর: হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে সংবিধানে বলা নেই। তবে একজন প্রধান বিচারপতি এবং অপর কয়েকজন বিচারপতি নিয়ে হাইকোর্ট গঠিত হয়।
  7. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হওয়ার একটি যােগ্যতা লেখাে।
    উত্তর: ভারতীয় নাগরিকতার সঙ্গে হাইকোর্টে অন্তত ৫ বছর বিচারপতি হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা প্রয়ােজন।
  8. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কে অপসারণ করতে পারেন?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের রাষ্ট্রপতি অপসারণ করতে পারেন।
  9. সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে কে নিযুক্ত করেন?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন।
  10. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির অবসর গ্রহণের বয়সসীমা কত বছর?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির অবসর গ্রহণের বয়সসীমা হল ৬৫ বছর।
  11. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা কোন্ ধারায় উল্লেখ আছে?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা ১২৫ নং ধারায় উল্লেখ আছে।
  12. ভারতের একজন প্রধান বিচারপতির নাম লেখাে যিনি পরবর্তীকালে উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন?
    উত্তর: ভারতের একজন প্রধান বিচারপতি মােহম্মদ হিদায়েতুল্লা (১৯৬৮–৭০) পরবর্তীকালে উপরাষ্ট্রপতি (১৯৭৯-১৯৮৪) হয়েছিলেন।
  13. অবসর গ্রহণের পর সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিগণ কী কাজ করতে পারেন না?
    উত্তর: অবসর গ্রহণের পর সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিগণ আইনজীবীর কাজ করতে পারেন না।
  14. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা কোন্ তহবিল থেকে দেওয়া হয়?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা সঞ্চিত তহবিল থেকে দেওয়া হয়।
  15. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন কখন হ্রাস করা যায়?
    উত্তর: জরুরি অবস্থার সময় সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন হ্রাস করা যায়।
  16. রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরােধ দেখা দিলে মীমাংসা কে করে?
    উত্তর: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরােধ দেখা দিলে মীমাংসা করে সুপ্রিমকোর্ট।
  17. ভারতীয় সংবিধানের জনক বা অভিভাবক কাকে বলা হয়?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টকে ভারতীয় সংবিধানের জনক বা অভিভাবক বলা হয়।
  18. ভারতের সুপ্রিমকোর্টের কটি অধিকারের এলাকা রয়েছে?
    উত্তর: ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ৪টি অধিকারের এলাকা রয়েছে।
  19. ভারতের অধস্তন আদালতগুলি কয় প্রকার ও কী কী?
    উত্তর: ভারতের অধস্তন আদালতগুলি মূলত দু-প্রকার— (ক) দেওয়ানি ও (খ) ফৌজদারি আদালত।
  20. সংবিধানের কোন ধারায় প্রত্যেক রাজ্যে হাইকোর্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছে?
    উত্তর: সংবিধানের ২১৪ নং ধারায় প্রত্যেক রাজ্যে হাইকোর্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
  21. ভারতের সুপ্রিমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি কে ছিলেন?
    উত্তর: ভারতের সুপ্রিমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন হরিলাল কেনিয়া।
  22. সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে কে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে সেই দায়িত্ব পালন করেন কার্যনির্বাহী প্রধান বিচারপতি।
  23. ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত কোনটি?
    উত্তর: ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত সুপ্রিমকোর্ট।
  24. মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সুপ্রিমকোর্ট কয় ধরনের লেখ জারি করতে পারে ?
    উত্তর: মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সুপ্রিমকোর্ট পাঁচ ধরনের লেখ জারি করতে পারে।
  25. সংবিধানের কত নং ধারায় সুপ্রিমকোর্টকে লেখ জারির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে?
    উত্তর: সংবিধানের ৩২ নং ধারায় সুপ্রিমকোর্টকে লেখ জারির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
  26. সুপ্রিমকোর্টের এক্তিয়ারাধীন লেখগুলি কী কী?
    উত্তর: এ সুপ্রিমকোর্টের এক্তিয়ারাধীন লেখগুলি হল—বন্ধীপ্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা ও উৎপ্রেষণ।
  27. সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়ােগের পূর্বে রাষ্ট্রপতি কার সঙ্গে পরামর্শ করতে বাধ্য?
    উত্তর: সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়ােগের পূর্বে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে বাধ্য।
  28. কী কারণে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করা যায়?
    উত্তর: প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে বিচারপতিদের অপসারণ করা যায়।
  29. বন্ধীপ্রত্যক্ষীকরণের অর্থ কী?
    উত্তর: বন্ধীপ্রত্যক্ষীকরণের অর্থ সশরীরে হাজির করা।
  30. হাইকোর্টের বিচারপতিদের কে নিয়ােগ করেন?
    উত্তর: হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়ােগ করেন রাষ্ট্রপতি।
  31. হাইকোর্টের বিচারপতিরা কত বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন?
    উত্তর: হাইকোর্টের বিচারপতিরা ৬২ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন।
  32. বর্তমানে ভারতে কয়টি হাইকোর্ট রয়েছে?
    উত্তর: বর্তমানে (২০১৯) ভারতে ২৫টি হাইকোর্ট রয়েছে।
  33. হাইকোর্টের দুটি এলাকার উল্লেখ করাে।
    উত্তর: হাইকোর্টের দুটি এলাকা হল মূল এলাকা ও আপিল এলাকা।
  34. হাইকোর্টের অধস্তন আদালতগুলিকে যে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে সেগুলি কী কী?
    উত্তর: হাইকোর্টের অধস্তন আদালতগুলিকে যে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে সেগুলি হল দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত।
  35. ভারতের অখণ্ড বিচারব্যবস্থায় সর্বনিম্ন আদালত (গ্রামস্তরে) কোনটি?
    উত্তর: ভারতের অখণ্ড বিচারব্যবস্থায় সর্বনিম্ন আদালত ন্যায় পঞ্চায়েত।
  36. ন্যায় পঞ্চায়েতের ওপরের স্তরের দেওয়ানি আদালত কোনটি?
    উত্তর: ন্যায় পায়েতের ওপরের স্তরের দেওয়ানি আদালত হল মুনসেফি আদালত।
  37. ন্যায় পঞ্চায়েতের ওপরের ফৌজদারি আদালত কোনটি?
    উত্তর: ন্যায় পঞ্চায়েতের ওপরের ফৌজদারি আদালত হল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত (Magistrate’s Courts)।
  38. জেলার সর্বোচ্চ দেওয়ানি আদালত কোনটি?
    উত্তর: জেলার সর্বোচ্চ দেওয়ানি আদালত হল জেলা জজের আদালত।
  39. জেলাস্তরের সর্বোচ্চ ফৌজদারি আদালত কোনটি?
    উত্তর: জেলাস্তরের সর্বোচ্চ ফৌজদারি আদালত হল দায়রা জজের আদালত (Sessions Judges Court)।
  40. জেলা জজের আদালতের ওপরের স্তরের আদালত কোনটি?
    উত্তর: জেলা জজের আদালতের ওপরের স্তরের আদালত হল হাইকোর্ট।
  41. জেলা জজের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন্ আদালতে আপিল করা যায়?
    উত্তর: জেলা জজের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়।
  42. মহকুমা স্তরে দেওয়ানি আদালত কোনটি?
    উত্তর: মহকুমা স্তরে দেওয়ানি আদালত হল মুনসেফি আদালত।
  43. মুনসেফি আদালতের ওপরের স্তরের দেওয়ানি আদালত কোনটি?
    উত্তর: মুনসেফি আদালতের ওপরের স্তরের দেওয়ানি আদালত হল ‘সাব জজের আদালত’।
  44. মুনসেফি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন্ আদালতে আপিল করা যায়?
    উত্তর: মুনসেফি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সাব জজের আদালতে (Sub-Judges’s Court) আপিল করা যায়।
  45. ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন্ আদালতে আপিল করা যায়?
    উত্তর: ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজের আদালতে আপিল করা যায়।
  46. দায়রা জজের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন্ আদালতে আপিল করা যায়?
    উত্তর: দায়রা জজের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়।
  47. সাব জজের আদালতের ওপরের স্তরের দেওয়ানি আদালত কোনটি?
    উত্তর: সাব জজের আদালতের ওপরের স্তরের দেওয়ানি আদালত হল জেলা জজের আদালত।
  48. সাব জজের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আদালতে আপিল করা যায়?
    উত্তর: সাব জজের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়।
  49. লােকআদালত বলতে কী বােঝ?
    উত্তর: সাধারণ মামলা সহজ পদ্ধতিতে, অল্প সময়ে, অল্প ব্যয়ে মীমাংসা করার জন্য গঠিত আদালতই হল লােকআদালত।
  50. লােকআদালত প্রথম কোথায় গঠিত হয়?
    উত্তর: লােকআদালত প্রথম গঠিত হয় দিল্লিতে। “All India Legal Aid and Advice Board” – এর দিল্লি শাখা প্রথম লােকআদালত গঠন করে।
  51. লােকআদালতের জনক কে?
    উত্তর: লােক আদালতের জনক হলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পি.এন. ভগবতী।
  52. কে, কবে লােকআদালতের সুপারিশ করে?
    উত্তর: ‘ল কমিশন’ (Law Commission) ১৮৮৬
    খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট লােকআদালত গঠনের সুপারিশ করে।
  53. ভারতে কত সালে, কোথায় প্রথম লােকআদালত বসে?
    উত্তর: ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর দিল্লিতে প্রথম লােকআদালত বসে।
  54. হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়ােগের সময় রাষ্ট্রপতি কার সঙ্গে পরামর্শ করতে বাধ্য থাকেন?
    উত্তর: হাইকোর্টের প্রধান বিচাপতি নিয়ােগের সময় রাষ্ট্রপতি ওই রাজ্যের রাজ্যপাল ও ভারতের – সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে বাধ্য থাকেন।
  55. হাইকোর্টের বিচারপতিদের কে পদচ্যুত করেন?
    উত্তর: হাইকোর্টের বিচাপতিদের রাষ্ট্রপতি পদচ্যুত করেন (সংসদের অনুমােদনক্রমে)।
  56. হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা কে স্থির করেন?
    উত্তর: হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা স্থির করেন রাষ্ট্রপতি।

Leave a Comment

Scroll to Top