আন্তজাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক ধারণা

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক ধারণা | International Relations

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

১। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বােঝ?
উত্তর : পৃথিবীর বিভিন্ন বারে মধ্যে পারস্পরিক কুটনৈতিক, সামরিক প্রভৃতি বিষয়ে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, তাকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে।

২। আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?
উত্তর : আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন যেগুলির দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয় সেই নিয়মকানুনকেই বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন।

৩। ‘Power’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে?
উত্তর : ফরাসি শব্দ ‘Pouvour এবং লাতিন শব্দ ‘POTESTAS’ থেকে ইংরেজি ‘Power’ শব্দের উৎপত্তি হয়। এর অর্থ হল ক্ষমতা।

৪। কে বলেছেন—’আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হল ক্ষমতা বা শক্তি’?
উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হল ক্ষমতা বা শক্তি, এ কথা বলেছেন অধ্যাপক মরগেনথউ।

৫। ক্ষমতা বলতে কী বােঝ ?
উত্তর : সাধারণভাবে ক্ষমতা হল নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতা বলতে জাতীয় ক্ষমতা বা জাতীয় শক্তিকেই বােঝায়।

৬। লাসওয়েল ও কাপলান রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন ?
উত্তর : লাসওয়েল ও কাপলান এর মতে, “রাজনৈতিক ক্ষমতা হল কোনাে কিছু মঞ্জুর করা বা না করার ভয় দেখিয়ে ওপরের আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য।”

৭। ক্ষমতা সম্পর্কে রবার্ট ডালের বক্তব্য কী?
উত্তর : রবার্ট ডালের মতে, ক্ষমতা হল বলপ্রয়ােগের দ্বারা অর্জিত প্রভাব।

৮। ক্ষমতার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর : ক্ষমতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক আচরণ ও সম্পর্কের বিচার।

৯। ক্ষমতার উপাদানগুলি কী কী?
উত্তর : ক্ষমতার উপাদানগুলি হল ভৌগােলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক শক্তি, সামরিক শক্তি, মনস্তাত্ত্বিক উপাদান, আন্তর্জাতিক অবস্থান প্রভৃতি।

১০। রাজনীতিকে শক্তি নির্ভর বলেছেন কে?
উত্তর : ই. এইচ. কার বলেছেন রাজনীতি শক্তি নির্ভর।

১১। ফ্রাঙ্কলের মতে শক্তি বা ক্ষমতা কী ?
উত্তর : ফ্রাঙ্কলের মতে, অন্যের মন ও কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং কাঙ্ক্ষিত ফল সৃষ্টির সামর্থ্যই হল শক্তি বা ক্ষমতা।

১২। মরগেনথাউ-এর মতে শক্তি কী ?
উত্তর : মরগেনথাউ-এর মতে, শক্তি হল অন্যের মন এবং কাজের উপর প্রয়ােগযােগ্য ক্ষমতা।

১৩। রাসেলের ভাষায় ক্ষমতা কী?
উত্তর : রাসেলের ভাষায় ক্ষমতা হল ‘The Pro- duction of intended effects’ .

১৪। রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে অধ্যাপক অ্যালান বল কী বােঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর : অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক।

১৫। “ক্ষমতা হল রাজনীতিচর্চার প্রধান বিষয় কার উক্তি ?
উত্তর : “ক্ষমতা হল রাজনীতিচর্চার প্রধান বিষয়, এই উক্তিটি হল অধ্যাপক অ্যালান বলের।

১৬। ‘Modern Politics and Govern- ment’ গ্রন্থটির লেখক কে?
উত্তর : ‘Modern Politics and Govern- ment’ গ্রন্থটির লেখক হলেন অধ্যাপক অ্যালান বল।

১৭। ‘ভূরাজনীতি’ তত্ত্বটির প্রবক্তা কে?
উত্তর : ‘ভূরাজনীতি’ তত্ত্বটির প্রবক্তা হলেন হ্যালফোর্ড ম্যাকাইভার।

১৮। ‘National Interest’ গ্রন্থটির প্রণেতা কে?
উত্তর : ‘National Interest’ গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন ফ্রাকেল।

১৯। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কাকে বলে?
উত্তর : যে ব্যবস্থায় দেশের আর্থিক নীতি পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সেই ব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বলে।

২০। উন্নয়নশীল দেশ কাকে বলে ?
উত্তর : যে-সকল দেশ খুব উন্নত নয় আবার খুব অনুন্নতও নয় অর্থাৎ উন্নয়নের পথে সেই সকল দেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হয়।

২১। এলিট বলতে কাদের বােঝানাে হয় ?
উত্তর : যে-সকল মানুষ জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি ও সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠ তাদের এলিট বলা হয়।

২২। ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ বলতে বােঝায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা সােভিয়েত ইউনিয়ন, এর কোনােটিতে যােগদান না করে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করা।

২৩। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের জনক কে?
উত্তর : ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু হলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের জনক।

২৪। ‘জাতীয় স্বার্থ’ বলতে কী বােঝায় ?
উত্তর : জাতীয় স্বার্থ’ বলতে বােঝায় একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি।

২৫। জনসমষ্টির সঙ্গে জাতীয় শক্তির সম্পর্ক।
উত্তর :  জাতীয় শক্তির একটি উপাদান হল জনসমষ্টি।

২৬। সামরিক শক্তির সঙ্গে জাতীয় শক্তির সম্পর্ক কী?
উত্তর : জাতীয় শক্তির একটি উপাদান হল ‘সামরিক শক্তি।

২৭। কূটনীতির সঙ্গে জাতীয় শক্তির সম্পর্ক কী ?
উত্তর জাতীয় শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ‘কূটনীতি’।

২৮। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন কবে, কোথায় প্রথম সূচনা হয় ?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে আফ্রো-এশিয়ার রাষ্ট্র সম্মেলনে প্রথম সূচনা হয়।

২৯। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে (১-৬ সেপ্টেম্বর) বেলগ্রেডে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩০। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে (৫-১০ অক্টোবর) কায়রােতে দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩১। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে (৮-১০ সেপ্টেম্বর) জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকাতে তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩২। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে (৫-৯ সেপ্টেম্বর) আলজিয়ার্সে চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৩। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় পঞ্চম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে (১৬-১৯ আগস্ট) শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বােতে পঞ্চম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৪। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় যষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে (৩-৯ সেপ্টেম্বর) হাভানায় যষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৫। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় সপ্তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে (৭-১১ মার্চ) নতুন দিল্লিতে সপ্তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৬। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় অষ্টম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে (১-৭ সেপ্টেম্বর) হারারেতে অষ্টম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৭। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় নবম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৮৯ খ্রিস্টব্দে (১-৭ সেপ্টেম্বর) বেলগ্রেডে (দ্বিতীয় বার) নবম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৮। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কবে, কোথায় দশম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে (১-৬ সেপ্টেম্বর) জাকার্তায় দশম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩৯। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কোথায় ত্রয়ােদশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?
উতর জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির কুয়ালালামপুরে ত্রয়ােদশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৪০। প্রথম নিজোট শীর্ষ সম্মেলনে কতগুলি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যােগদান করেছিলেন?
উত্তর : প্রথম নির্জোট শীর্ষ সম্মেলনে ২৫টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যােগদান করেছিলেন।

৪১। কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত নির্জোট শীর্ষ সম্মেলনে কতগুলি রাষ্ট্র অংশ গ্রহণ করেছিল?
উত্তর : কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত নির্জোট শীর্ষ সম্মেলনে ১১৩টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যােগদান করেছিলেন।

৪২। জাতীয় স্বার্থকে জাতীয় মূল্যবােধের সমষ্টি বলেছেন কে ?
উত্তর : জাতীয় স্বার্থকে জাতীয় মূল্যবােধের সমষ্টি বলেছেন অধ্যাপক ফ্রাঙ্কেল।

৪৩। নির্জোট শীর্ষ সম্মেলন কত বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় ?
উত্তর : নির্জোট শীর্ষ সম্মেলন তিন বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়।

৪৪। বিশ্বায়ন’ বলতে কী বােঝ?
উত্তর সাধারণ অর্থে বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও প্রযুক্তির বিস্তার বােঝায়।

৪৫। প্রথম নির্জোট শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত বিশিষ্ট রাষ্ট্রনেতাদের নাম উল্লেখ করাে।
উত্তর : প্রথম নির্জোট শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত বিশিষ্ট রাষ্ট্র নেতাগণ হলেন ভারতের শ্রী জওহরলাল নেহরু, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের নাসের, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, যুগােশ্লাভিয়ার টিটো এবং ঘানার নকুমা। I

৪৬। পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন বলতে কী বােঝ?
উত্তর : পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যার ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশই একে অপরের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

৪৭। CTBT-এর পুরাে নাম কী? 
উত্তর : Comprehensive Test Ban Treaty [সামগ্রিক (পরমাণু) পরীক্ষা নিষিদ্ধ চুক্তি]।

৪৮। রােডি পররাষ্ট্রনীতি বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর : রােডির মতে পররাষ্ট্রনীতি হল জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং অন্য রাষ্ট্রের ব্যবহার পরিবর্তনের জন্য গৃহীত একগুচ্ছ নীতি।

৪৯। “ঠান্ডা লড়াইয়ের পরবর্তীকালে নির্জোট আন্দোলন বেশি প্রাসঙ্গিক”—এই উক্তি কাদের?
উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ড. ওয়ান | (Dr. Wan) এবং ড, সিয়াও (Dr.Xiao)- | এর উক্তিটি হল—“ঠান্ডা লড়াইয়ের পরবর্তীকালে নির্জোট আন্দোলন বেশি | প্রাসঙ্গিক।

৫০। W.T.O.-এর পুরো নাম কী?
উত্তর : W.T.O.- এর পুরাে নাম World Trade Organization (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা)।

৫১। ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও কাজকে জাতীয় স্বার্থের নামে চালানাের চেষ্টা করেছেন কারা?
উত্তর : নেপােলিয়ন, হিটলার, মুসােলিনি, জর্জ বুশ প্রভৃতি রাষ্ট্রনায়কগণ ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও কাজকে জাতীয় স্বার্থের নামে চালানাের চেষ্টা করেছেন।

৫২। হার্টম্যান ‘জাতীয় স্বার্থ’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর : হার্টম্যান বলেছেন, “অপরাপর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি যা সংরক্ষণ বা অর্জন করতে চায়, তাই হল জাতীয় স্বার্থ।”

৫৩। “জোট নিরপেক্ষতাবাদ বলতে সেই সকল দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বােঝায় যারা কমিউনিস্ট বা পশ্চিমি কোনাে শক্তি জোটের সঙ্গে যুক্ত নয়।” —এ কথা কে বলেছেন?
উত্তর : “জোট নিরপেক্ষতাবাদ বলতে সেই সকল দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বােঝায় যারা কমিউনিস্ট পশ্চিমি কোনাে শক্তি জোটের সঙ্গে যুক্ত নয়।” —এ কথা বলেছেন অধ্যাপক বার্টন।

৫৪। “জাতীয় স্বার্থ হল পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে মুখ্য ধারণা” —এ কথা বলেছেন কে?
উত্তর “জাতীয় স্বার্থ হল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মুখ্য ধারণা’” —এ কথা বলেছেন অধ্যাপক ফ্রাঙ্কেল।

৫৫। ‘Non alignment is freedom of action which is part of independence’ কার উক্তি?
উত্তর : ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নির্জোট আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘Non alignment is freedom of action which is part of independence’।

৫৬। কবে, কাদের মধ্যে বান্দুং সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ?
উত্তর : ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বান্দুং শহরে অ্যাফ্রো- এশিয়ান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৫৭। বান্দুং সম্মেলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর : বান্দুং সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযােগিতা এবং উপনিবেশবাদের বিরােধিতা করা।

৫৮। বিশ্বায়ন বিরােধী আন্দোলনের প্রথম শহিদ কে?
উত্তর : ২৩ বছরের তরুণ কালো জিওলানি হলেন বিশ্বায়ন বিরােধী আন্দোলনের প্রথম শহিদ।

৫৯। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বিশ্বায়ন’ বলতে কী বােঝ?
উত্তর : আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বায়ন’ বলতে বােঝায়, মুক্তবাজার-অর্থনীতির পথ নির্দেশ করা।

৬০। জোটনিরপেক্ষতাকে ‘Counter force to the Balance of Power’, কে বলেছেন?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষতাকে ‘Counter force to the Balance of Power’, বলেছেন অধ্যাপক জয়ন্তনুজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

৬১। ‘NATO’-এর পুরাে নাম কী?
উত্তর ‘NATO-এর পুরাে নাম North Atlantic Treaty Organisation (উত্তর আতলান্তিক চুক্তি সংস্থা)।

৬২। ‘Globalisation is not working for many of world’s poor. It is working for stability of the global economy.’- কার উক্তি ?
উত্তর : জোসেফ সিটগনিৎস বিশ্বায়ন বিষয়ে আলােচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘Globalisation is not working for many of world’s poor. It is working for stability of the global economy’.

৬৩। “সংস্কৃতির অন্তরে বিশ্বায়নের অবস্থান, আবার বিশ্বায়নের অন্তরে সংস্কৃতির অবগান ( ” (Globalisation is at the heart of modern Culture, Culture practices lie at the heart of Globalisation) ?
উত্তর : “সংস্কৃতির অন্তরে বিশ্বায়নের অবস্থান, আবার বিশ্বায়নের অন্তরে সংস্কৃতির অবস্থান (“Globalisation is at the heart of modern Culture, Culture practices lie at the heart of Globalisation’) এ কথা বলেছেন জন টমিলসন (John Tamilpori)।

৬৪। ‘বিশ্বায়ন’-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ কী?
উত্তর : ‘বিশ্বায়ন’-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল— ‘Globalisation’ ।

৬৫। ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ বইটির রচয়িতা কে?
উত্তর : ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন জোসেফ সিনিংস।

৬৬। “দ্য পলিটিক্যাল ইমি অব দ্য টুয়েন্টিয়েথ সেপূরি” গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর : “দ্য পলিটিক্যাল ইকনমি অব দ্য টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্জুরি” গ্রন্থটির রচয়িতা সামির আমিন।

৬৭। দ্বিমের রাজনীতির পরিবর্তে একমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতির সূচনা কবে থেকে হয় ?
উত্তর : দ্বিমেরু রাজনীতির পরিবর্তে একমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতির সূচনা হয় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে।

৬৮। কে বিশ্বায়নকে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সংযােগস্থাপন বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর বিশ্বায়নকে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সংযােগস্থাপন বলে অভিহিত করেছেন জোসেফ স্টিগনিৎস।

৬৯। কয়েকটি জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করাে।
উত্তর : কয়েকটি জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাম হল- ভারত, চিন, ইন্দোনেশিয়া, যুগােশ্লাভিয়া, মিশর প্রভৃতি।

৭০। বিশ্বায়নের দুটি নীতি কী কী?
উত্তর : বিশ্বায়নের দুটি নীতি হল—(ক) উদারীকরণ এবং (খ) বেসরকারিকরণ।

৭১। সিবিউরির দৃষ্টিতে জাতীয় স্বার্থ কী?
উত্তর : সিবিউরির মতে, জাতীয় স্বার্থ হল একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি।

৭২। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন্ রাষ্ট্র একমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব করছে?
উত্তর : বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব করছে।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। ক্ষমতা কাকে বলে?
উত্তর : ক্ষমতা বলতে সাধারণত শক্তি সামর্থ্য বা দক্ষতাপ্রসুত এক ধরনের প্রভাবকে বােঝায় যার. দ্বারা মানুষের ব্যবহারকে প্রভাবিত করা যায়। সুতরাং, মানুষের আচার-আচরণকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্যকে ক্ষমতা বলে।

প্রশ্ন ২। ক্ষমতার দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে।
উত্তর : ক্ষমতার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হল- (i) ক্ষমতা হল একটি সম্পর্কমূলক বিষয়, (ii) ক্ষমতা হল একটি আচরণমূলক বিষয়।

প্রশ্ন ৩। ক্ষমতার সমস্যাগুলি উল্লেখ করাে।
উত্তর : ক্ষমতার সমস্যাগুলি হল— (i) ক্ষমতার অভিপ্রায়টি জানা দরকার, (ii) ক্ষমতার কার্যকারিতার প্রশ্নটিও বিবেচ্য, (iii) ক্ষমতার গােপনীয়তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, (iv) ক্ষমতার ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন ৪। ক্ষমতা সম্পর্কে অধ্যাপক অ্যালান বলের বক্তব্য উল্লেখ করাে।
উত্তর : অধ্যাপক অ্যালান বল তাঁর ‘Modern Politics & Government’ গ্রন্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। বলের মতে, রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক, ক্ষমতাকে যিনি ধারণ করে আছেন তিনি বিভিন্ন শক্তির ভয় দেখিয়ে অনিচ্ছুক ব্যক্তির ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজের নির্দেশ পালনে বাধ্য করবে। অ্যালান বল উল্লেখ করেছেন যে, ফ্রাইডে নামক ব্যক্তিটি দ্বীপে না আসা পর্যন্ত রবিনসন ক্রুসাের কোনাে ক্ষমতা ছিল না।

প্রশ্ন ৫। জাতীয় স্বার্থ’ বলতে কী বােঝ?
উত্তর : অধ্যাপক পল সিবিউরি জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে তিনটি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন- (i) জাতীয় স্বার্থ’ বলতে একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টিকে বােঝায়। (ii) বর্ণনাত্মক অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব উদ্দেশ্যের সমন্বয় যা প্রতিটি জাতি তার নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে নিরন্তর অনুসরণ করে। (iii) জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে গােষ্ঠী এবং ব্যক্তির মধ্যে যে বিরােধ সৃষ্টি হতে পারে তার প্রতিও সিবিউরি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

প্রশ্ন ৬। জোটনিরপেক্ষ নীতির মূল বিষয়গুলি বর্ণনা করাে।
উত্তর : ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের সপ্তম শীর্ষ সম্মেলনে আলােচনার ভিত্তিতে জোটনিরপেক্ষ নীতির যে মূল বিষয়বস্তুগুলি স্থির হয়েছিল সেগুলি হল— সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, নয়া ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবিদ্বেষ, অন্যের ভূখণ্ড গ্রাস, বৃহৎশক্তির আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম ঘােষণা করা। ওই সম্মেলনে আরও স্থির করা হয়েছিল যে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন স্বাধীনতা, সাম্য ও সহযােগিতার ভিত্তিতে নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তােলার সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে।

প্রশ্ন ৭। ‘পঞ্চশীল’ নীতি কী?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অগ্রণী পদক্ষেপ হিসাবে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চিন- ভারত সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে গৃহীত নীতিগুলি হল— (1) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, (ii) ‘ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা, (iii) অনাগ্ৰাসন, (iv) অন্যের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করা, (v) সমগত বা পারস্পরিক সুবিধা। এই নীতিগুলি ‘পঞ্চশীল’ নীতি নামে পরিচিত।

প্রশ্ন ৮। ‘বিশ্বায়ন’ বলতে কী বােঝ?
উত্তর : বিশ্বায়ন হল দেশীয় সীমানার উর্ধে শিল্প কর্পোরেশনের প্রসারতা এবং আন্তঃসীমাভিত্তিক অর্থনৈতিক সুবিধা ও সম্পর্কের এক সংযুক্ত প্রক্রিয়া। যা ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এ পরিগতি লাভ করেছে। বিশ্বব্যাপী মতাদর্শ হিসাবে একে গ্রহণযোগ্য করে তােলার প্রচেষ্টার পিছনে মুক্ত বাণিজ্যের দর্শন কাজ করে চলেছে। বর্তমানে বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাণিজ্যের তত্ত্ব দুটিকে নতুন শতাব্দীর অনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক বলে প্রচার করা হয়।

প্রশ্ন ৯। ‘বিশ্বায়ন’-এর তালিকায় কী কী অন্তর্ভুক্ত করা যায় ?
উত্তর : ‘বিশ্বায়নের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি হল—তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি, বিমানপথে মাল পরিবহনের বহুল প্রচলন, টাকার বাজারে ফাটকাবাজি, দেশের সীমানা পেরিয়ে ক্রমবর্ধমান পুঁজি প্রবাহ, কেবল চ্যানেল প্রসার, গণ বিপণন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বহুজাতিক কর্পোরেটরে কি বৃদ্ধি, নতুন আন্তর্জাতিক শ্রম-বিভাজন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমের অবাধ চলাচল, জাতি রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হ্রাস, উত্তর-আধুনিকতা, প্লাস্টিক অর্থ (Plastic Money) প্রভৃতি।

প্রশ্ন ১০। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন’ বলতে কী বােঝ?
উত্তর : ‘সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন’ এক অভিনব চিন্তার ফসল। বিশ্বগ্রাসী পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির সংস্কৃতির ওপর সিংহভাগ অধিকার করতে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রথার মাধ্যমে নিজেদের গতি সমৃদ্ধ চকচকে ও রগরগে সাংস্কৃতিকে তৃতীয় বিশ্বের অঙ্গনে প্রবেশ করিয়ে চলেছে। তথাকথিত জনপ্রিয় সংগীত প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে অবরুদ্ধ করে চলেছে। কেবল টিভির মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি সাধারণ মানুষের গৃহকোণে পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রচার অব্যাহত। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের যুবসমাজ নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে তাৎক্ষণিক উরসে নিজেদের অস্তিত্বকে বিলীন করে তুলছে।

প্রশ্ন ১১। বিশ্বব্যাপী লগ্নি পুঁজির সম্প্রসারণের কাজ করছে এমন তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নাম লেখাে।
উত্তর : বিশ্বায়নের উদ্ভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশগুলি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF) বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (W.T.0.) এই তিনটি সংস্থার মাধ্যমে পূজি লগ্নি করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শােষণ করছে।

প্রশ্ন ১২। জাতীয় শক্তি’ বলতে কী বােঝ?
উত্তর : জাতীয় শক্তি বলতে বােঝায় “একটি রাষ্ট্রের সেইসব শক্তি ও সামর্থ্যের সমষ্টি, যা সেই রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থের অগ্রগতির জন্য ও জাতীয় লক্ষ্যপূরণের জন্য কাজে লাগায় ও ব্যবহার করে।

প্রশ্ন ১৩। নির্জোট আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ?
উত্তর : নির্জোট আন্দোলনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—
(ক) জোটনিরপেক্ষতা,
(খ) কোনাে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি,
(গ) বিশ্বশান্তি রক্ষা,
(ঘ) জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন এবং
(ঙ) বৃহৎ শক্তিবর্গের পরস্পর বিরােধিতার প্রেক্ষাপটে গঠিত কোনাে বহুপাক্ষিক সামরিক জোটের সদস্য না হওয়া।

প্রশ্ন ১৪। জোটনিরপেক্ষতার প্রধান প্রবক্তা কে ?
উত্তর : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশীয় দেশগুলির সম্প্রীতি সম্মেলনে জওহরলাল নেহরু জোটনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রচার করেন। তবে জোটনিরপেক্ষতার প্রধান প্রচারক বা সংগঠক হিসাবে নেহরু ছাড়াও ইজিপ্টের নাসের, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, যুগােস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো প্রমুখ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।

প্রশ্ন ১৫। জোটনিরপেক্ষতার অর্থ কী?
উত্তর : জোটনিরপেক্ষতা একটি প্রচলিত ও পরিচিত শব্দ হলেও, এটির নানা ধরনের ব্যাখ্যা আছে। অনেকে জোটনিরপেক্ষতাকে একটি আদর্শ বলে মনে করেন। এদের মতে জোটনিরপেক্ষতা হল বিশ্বরাজনৈতিক পরিবেশ বা বিন্যাসকে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের অনুকূলে নিয়ে আসার এক দার্শনিক তত্ত্ব। আবার অনেকে জোটনিরপেক্ষতাকে একটি আন্দোলন বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, বৃহৎ শক্তি জোট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিরপেক্ষ দেশগুলির আন্দোলনই হল জোটনিরপেক্ষতা।

প্রশ্ন ১৬। বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর : বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি হল— (ক) জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংহতিকরণ, (খ) পরিবেশগত পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, (গ) বিশ্বায়ন ভৌগােলিক ব্যবধান মানে না, (ঘ) বিশ্বায়নের সঙ্গে উদারীকরণের নিবিড় যােগ রয়েছে, (ঙ) সমগ্র বিশ্বে অর্থব্যবস্থার মধ্যে একটি অখণ্ডতা তৈরির প্রচেষ্টা।

প্রশ্ন ১৭। বিশ্বায়নের সুফলগুলি কী কী?
উত্তর : বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া নানা ক্ষেত্রে বহু সুফল এনেছে। যেমন— (ক) পণ্য ও মূলধনের বাজারের প্রসার ঘটেছে, (খ) টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, (গ) তথ্যপ্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতি ঘটেছে, (ঘ) ব্যাংক, বিনিয়ােগ, শিল্প ও বাণিজ্যের অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটেছে, (ঙ) কম্পিউটার, ফ্যাশান ডিজাইন, মডেলিং, মিডিয়া ও প্রিন্টিং, ফোটোগ্রাফি, মাস কমিউনিকেশন, হােটেল ম্যানেজমেন্ট, ইন্টিরিয়র ডেকরেশন, বায়ােটেকনােলজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মােচন করেছে।

প্রশ্ন ১৮। বিশ্বায়নের কুফলগুলি কী কী?
উত্তর : মানুষের জীবনে বিশ্বায়ন আশীর্বাদের পরিবর্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে, যেমন- (ক) পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত সংকট আরও প্রকট হয়েছে, (খ) সুস্থ মূল্যবােধগুলিকে নষ্ট করেছে, (গ) অনুন্নত দেশগুলির উপর উন্নত দেশগুলির নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়েছে। (ঘ) বিশ্বায়ন পরিচালিত হয় বহুজাতিক সংস্থাগুলির স্বার্থে, কাজেই শ্রম স্বার্থ, ক্রেতা সুরক্ষা, মানবাধিকার সবই লম্বিত হচ্ছে, (ঙ) কহিীনতা, গণতন্ত্রের উৎপাটন প্রভৃতি ঘটছে।

প্রশ্ন ১৯। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বােঝায় ?
উত্তর : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যেটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে কুটনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমন উপাদান ও কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাহ্যিক নীতি ও শক্তিকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক।

প্রশ্ন ২০। রাজনৈতিক ক্ষমতা কাকে বলে?
উত্তর : যে ক্ষমতার মাধ্যমে মানুষের রাজনৈতিক আচার-আচরণের পরিবর্তন করা যায় সেই ক্ষমতাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে।

প্রশ্ন ২১। অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাকে বলে?
উত্তর : যে ক্ষমতার মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক আচার-আচরণের পরিবর্তন করা যায় সেই ক্ষমতাকে বলে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। যেমন স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ছিল জাতীয়প্রণ। কিন্তু বর্তমানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয়করণের পরিবর্তে বেসরকারিকরণের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রশ্ন ২২। ব্যাপক অর্থে ‘জাতীয় স্বার্থ’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে কোনাে রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বার্থের সামঞ্জস্যবিধান করাই হল ব্যাপক অর্থে জাতীয় স্বার্থ। এরকম জাতীয় স্বার্থ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করে, ফলে বিরােধের আশঙ্কা হ্রাস পায়।

প্রশ্ন ২৩। আব্দুল আজিজ সৈয়দ-এর দেওয়া জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞাটি লেখাে।
উত্তর : জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে সৈয়দ বলেছেন, রাষ্ট্র অর্জন করতে চায় এমন কতকগুলি দীর্ঘমেয়াদি নিরবচ্ছিন্ন সৎ উদ্দেশ্যকে জাতীয় স্বার্থ বলা হয়। এই উদ্দেশ্যগুলি সৃষ্টি হয় জাতির রাজনৈতিক চেতনা ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা থেকে।

প্রশ্ন ২৪। ক্ষমতা বা শক্তির (Power) উপাদানগুলি লেখাে।
উত্তর : ক্ষমতা বা শক্তির উপাদানগুলি হল— (ক) ভৌগােলিক অবস্থা, (খ) জনসংখ্যা, (গ) অর্থনৈতিক উপাদান, (ঘ) সামরিক শক্তি , (ঙ) জনমত গঠনের ক্ষমতা, (চ) জাতীয় চরিত্র, (ছ) সরকারের প্রকৃতি, (জ) কূটনীতি, (ঝ) প্রযুক্তিবিদ্যা, (ঞ) মতাদর্শ, (ট) আত্মবিশ্বাস প্রভৃতি।

প্রশ্ন ২৫। সংকীর্ণ অর্থে জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : পৃথিবীর কোনাে কোনাে রাষ্ট্র ন্যায়নীতি, আদর্শ, মূল্যবােধের পরােয়া না করে যে-কোনাে উপায়ে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় একেই সংকীর্ণ অর্থে জাতীয় স্বার্থ বলা হয়। এই সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ বিশ্বশান্তির পরিপন্থী।

প্রশ্ন ২৬। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কয়টি শক্তি-জোটের সৃষ্টি হয়েছিল ও কী কী?
উত্তর : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুটি শক্তি-জোটের সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলি হল—ক) গণতন্ত্রের নামে মার্জি নেতৃত্বধীন পশ্চিম ইউরােপীয় রাষ্ট্রজোট (NATO) এবং (খ) সমাজতন্ত্রের নামে সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট ‘ওয়ারশ চুক্তি (Warshaw Pact) )।

বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১ শক্তি বলতে কী বােঝ?
উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে শক্তি (Power) এক প্রাধান্যমূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। অনেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে শক্তি রাজনীতি (Power politics) বলেই উল্লেখ করেছেন। সকল সার্বভৌম রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের জন্য জাতীয় শক্তির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় রাষ্ট্র কী ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করবে তা অনেকাংশে তার জাতীয় শক্তির ওপর নির্ভরশীল। শুম্যান (F. Lschuman) বলেছেন, শক্তির জন্যে বা ক্ষমতার জন্যে লড়াই হল রাজনীতি (All politics is a struggle for power)। অধ্যাপক মরগেনথ্য (Morgenthau) বলেছেন, সকল হতি ক্ষেত্রের মতাে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও হল শক্তির জন্য লড়াই।
   শক্তি বলতে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন বিষয় বােঝান। শক্তির সংজ্ঞা সম্পর্কে তাই ঐকমত্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। হানস মরগেনহা-এর (Hans Morgenthau) মতে, অন্যের মন ও কাজের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা হল শক্তি (Powd of man over the minds and actions of other me)। মানুষের ওপর মানুষের নিয়ণ হল শক্তি। শক্তির সঙ্গে অনেকে বলপ্রয়ােগের পার্থক্য করে থাকেন। বলপ্রয়ােগ বলতে শুধু সামরিক শক্তি বােঝায়, কিন্তু শক্তির ধারণা ব্যাপকতর। বলপ্রয়ােগ বা বলপ্রয়ােগের তত প্রদর্শন ও শক্তির অন্যান্য ইতিবাচক ও অহিংস পদ্ধতিও আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্তববাদী (Realist school) দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ শক্তিকে, উপায় ও লক্ষ্য বলে মনে করেন। কোনাে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল অতি ও নিরাপত্তা রক্ষা। শক্তি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করে। এই অর্থে শক্তি রাষ্ট্রের লক্ষ্য।

প্রশ্ন ২) ক্ষমতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর : ক্ষমতার মূল বৈশিষ্টাগুলি হল-

ক্ষমতা হল একটি সম্পর্ক
অধ্যাপক ব্যালান বল তাঁর “Modern Politics & Government” গ্রন্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। বলের মতে রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক ক্ষমতাকে যিনি ধারণ করে আছেন তিনি বিভিন্ন শক্তির ভয় দেখিয়ে অনিচ্ছুক ব্যক্তির ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজের নির্দেশ পালনে বাধ্য করবেন। বল উল্লেখ করেছেন যে, ফ্রাইডে নামক ব্যক্তিটি দ্বীপে না আসা পর্যন্ত রবিনসন ক্রুসাের কোনাে ক্ষমতা ছিল না। সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যের উৎস হল শক্তির ভয়। সম্মান ও সম্পদের প্রলােভন রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ সময়েই রাজনৈতিক আধিকারিকগণ আনুগতা আদায়ের জন্য ভীতি প্রদর্শনি বা শাস্তিদানের পদ্ধতি গ্রহণ করেন। অধ্যাপক বল বিষয়টির অন্য একটি দিকের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। বিষয় হল ‘কে’ বা ‘কী ক্ষমতা রয়েছে’? যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতাে কোনাে মন্ত্রী পদত্যাগ করেন এবং এর ফলে মন্ত্রীসভা সকেটে ঋড়ে, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত ক্ষমতাশালী। সুতরাং, ক্ষমতার সম্পর্ক নিরূপণের সমস্যা রয়েছে। বলের মতে, রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক এবং এই সম্পর্ক সব সময় সুস্পষ্ট নয়।

ক্ষমতা হল আচরণমূলক
রাজনৈতিক ক্ষমতাকে একটি সম্পর্ক হিসাবে বিবেচনা করলে, দেখা প্রয়ােজন যে কার ওপর এবং কী সম্পর্কে কোনাে ব্যক্তির ক্ষমতা বর্তমান। ক্ষমতা হল পরিবর্তনশীল। এই কারণে কোনাে রাজনৈতিক পদাধিকারীর ক্ষমতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমকালীন ব্যক্তিবর্গের আচরণকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে তার সামর্থ্যের বিষয়টি আলােচনা করা আবশ্যক। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়ােগপদ্ধতি পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আচরণ ও কাজকর্মের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়ােগপদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়। বল যথার্থই বলেছেন, কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে বন্টিত হয় না। সেই কারণেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে।

প্রশ্ন ৩) জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর : পল সিবিউরি (Pawl Seabory) জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে তিনটি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রথমত, তাঁর মতে, জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টিকে বােঝায়।
দ্বিতীয়ত, বর্ণনাত্মক অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব উদ্দেশ্যের সমন্বয় যা প্রতিটি জাতি তার নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে নিরন্তর অনুসরণ করে।
তৃতীয়ত, জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে গােষ্ঠী এবং ব্যক্তির মধ্যে যে বিরােধ সৃষ্টি হতে পারে তার প্রতিও সিবিউরি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
   জর্জ কেন্নান (Kennan)-এর মতে, বস্তুত, আমরা যা জানতে এবং অনুধাবন করতে পারি তাতেই জাতীয় স্বার্থ নামে অভিহিত করা হবে। হলটির মতে অনেক সময়ে জাতির লক্ষ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমরূপে জাতীয় স্বার্থের ধারণা প্রয়ােগ করা হয়। তিনি মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কোন কোন বিষয় যুক্ত থাকবে এই বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিতে পারে।
   অধ্যাপক মরগেনথাউ রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জাতীয় স্বার্থের বিশ্লেষণে নৈতিক মতাদর্শগত এবং আইনানুগ মানদণ্ড গ্রহনের বিরােধী। তিনি জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে প্রধান চিহ্ন প্রদানকারী স্তকূপে বর্ণনা করেছেন। মরগেনহাউ এর মতে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল বিষয়বস্তু জাতীয় স্বার্থের ধারণার মধ্যেই নিহিত। যে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়, তার ওপরই জাতীয় স্বার্থের ধারণা নির্ভরশীল। মরগেনহাউ-এর মতে জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে অস্তিত্বের বিষয় জড়িত। এই অস্তিত্ব বলতে তিনি কোনাে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের ভৌগােলিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে অন্য রাষ্ট্রের আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষার প্রয়ােজনীয়তা বুঝিয়েছেন।

প্রশ্ন ৪) জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্যগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর : জাতীয় স্বার্থের ধারণা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এই কারণে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যের পরিবর্তনের ফলে জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। সাধারণত জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্যরূপে আত্মরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় কল্যাণ, মর্যাদা, শক্তি সংরক্ষণ, মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ও প্রবণতাকে উল্লেখ করা হয়। জাতীয় স্বাধীনতা এবং ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার মাধ্যমেই কোনাে জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব। জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সংহতি এবং ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার পরেই কোনাে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কল্যাণসাধনে ব্রতী হতে পারে। জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি ও প্রভাব বিস্তার হল পরবর্তী লক্ষ্য। মতাদর্শগত লক্ষ্যও জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। পুঁজিবাদের সঙ্গে সাম্যবাদের বিরােধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে জটিল করে তুলছে। আগ্রাসন পরিহার ও প্রতিরােধ, শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক সহযােগিতার সম্প্রসারণ, বিরােধ দূরীকরণ, কোনাে বিশেষ মতাদর্শের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হল জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য। তবে প্রত্যেক জাতির জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার বিবেচনাই প্রাধান্য অর্জন করে।
   জাতীয় স্বার্থের ধারণার ভিত্তিতেই পারস্পরিক আলাপ-আলােচনা হয়ে থাকে। কোনাে রাষ্ট্রনেতা তখনই অন্য কোনাে রাষ্ট্রকে সুযােগসুবিধা দানের বিষয়ে বিবেচনা করেন যখন তিনি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হন যে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে তাঁর জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
   আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কে জাতীয় স্বার্থের ধারণাই নির্ধারকের ভূমিকা গ্রহণ করে। যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক প্রত্যেকটি বিষয়ই জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যেসব সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়েছিল, তাদেরও মূল লক্ষ্য ছিল নিজ জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত এবং প্রসারিত করা। একইভাবে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ নিজেদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসমাধানের জন্য যথাক্রমে ‘ওয়ারশ চুক্তি’ (Warshaw pact) এবং ‘কোমেকন’ (Comecon) গঠনের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির সামরিক জোট রয়েছে। নিরস্ত্রীকরণ, আণবিক মারণাস্ত্রের প্রসার রােধের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ, মারণাস্ত্রের সীমিতকরণ ইত্যাদি বিষয় জাতীয় স্বার্থের ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ভূখণ্ড-কেন্দ্রিক রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষেই জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন ৫) ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বান্দুং সম্মেলনের ভিত্তিতে জোটনিরপেক্ষতার ধারণাটি বিবৃত করো।
উত্তর : বান্দুং সম্মেলনে মূলত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ‘পঞ্চশীলনীতি’ রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব, অনাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমানাধিকার ও সহাবস্থান প্রবলভাবে সমর্থিত হয়। জোটনিরপেক্ষতার নীতি জোরালােভাবে সমর্থন করেন।
   • জোটনিরপেক্ষতা তথাকথিত নিরপেক্ষতার’, (Neutrality) ধারণা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আন্তর্জাতিক আইনে নিরপেক্ষতার (Neutrality) অর্থ হল যুদ্ধে বিবদমান রাষ্ট্রগুলি থেকে দূরে থাশ। কিন্তু জোটনিরপেক্ষতার অর্থ নির্লিপ্ততা বা ঔদাসীন্য নয়, নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “ঠান্ডা লড়াই’ (Cold war)-এর আবহাওয়ায় আন্তর্জাতিক সমস্যার বিচার করবে প্রতিটি সমস্যার প্রকৃতি বিচার করে, জোটের মুখাপেক্ষী হয়ে নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনা প্রশমনই জোটনিরপেক্ষতার মূল লক্ষ্য।
   • সামরিক জোটগুলি সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বিশেষ নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। তাই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যে কোনাে সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করা চলবে না। জোটনিরপেক্ষতা সতে চুক্তি ও মারণাস্ত্রের বিরােধিতা করে। নিরস্ত্রীকরণের (Disarmarnent) ওপর জোটনিরপেক্ষতা প্রথম অবস্থা থেকেই বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে আসছে।
   • বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযােগিতার পথে বিরাট প্রতিবন্ধক। সাম্রাজানে ও অসামাের বিরুদ্ধে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির নেতৃবৃন্দ প্রথম অবস্থা থেকে কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেন এবং এর অবসানের জন্যে প্রয়াসী হন।
   • সামরিক জোটের বিরােধী হলেও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নিজেরা কোনাে পৃথক জােট গঠন করবে না। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সহযােগিতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ এক বিশ্ব গড়ে তােলার জন্যে এবং লক্ষ্যগুলি পূরণের নিরন্তর প্রয়াস চালাবে। পদাশের দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে জোটনিরপেক্ষতা একটি আন্দোলনের রূপ (NAM) পরিগ্রহ করে এবং আন্দোলন ক্রমশ প্রসার লাভ করে।

প্রশ্ন ৬) বিশ্বায়ন বলতে কী বােঝ?
উত্তর : বর্তমানে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন কথাগুলি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ৮০ দশক থেকেই অত্যন্ত পরিচিত। অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচি বলেছেন, বিশ্বরন’ (Globalisation) কথাটা এত বিভিন্ন অর্থে এবং এত বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয় যে তার কোনাে সর্বজনগ্রাহা অভিধা তৈরি করার চেষ্টা এখনও পর্যন্ত বৃথাশ্রম বলেই মনে হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান সমত ক্ষেত্রেই বিশ্বায়নের প্রভাব বিভিন্ন বক্তা ও লেখক লক্ষ করেছেন। ‘বৈষয়িক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন’ কথাটি অন্তত দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এত হয়ে বিশ্বায়ন একটি সুগব্যাপী প্রক্রিয়া বা প্রক্রিয়া সমষ্টির সংজ্ঞা। সেই অর্থে বিশ্বায়ন বহিঃপ্রকৃতির বা আর্থিকহারে অন্য যে-কোনাে প্রক্রিয়া সৃষ্টির মত বর্ণনা বা বিশ্লেষণের ব্যাপার-বিশ্লেষক সেখানে নির্লিপ্ত গবেষক বা দর্শকমাত্র। বিশ্বায়নের দ্বিতীয় সংজ্ঞা—কতকগুলি নির্দিষ্ট আর্থিক বা বৈষয়িক নীতির সমাহার, যে নীতিগুলি গ্রহণ করলে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া তরান্বিত হতে পারে।”

প্রশ্ন ৭ | বিশ্বায়নের আড়ালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আর্থিক সংস্কারের নামে যেসব কঠিন শর্ত চাপানাে হয়েছে তা আলােচনা করাে।
উত্তর : তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আর্থিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার ঋণ মঞ্জুরের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি কঠিন শর্ত আরােপ করে। এই শর্তগুলি নিম্নরূপ-
• ব্যাপকভাবে সরকারি ব্যয়সংকোচ এবং সরকারি খরচ কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্যান্য সরকারি ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করে ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে চালাতে হবে।
• রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ভেঙে দিয়ে বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হবে—ব্যাক, বিমা, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সবকিছুই। • সরকারি কর্মচারী সংখ্যা হ্রাস করতে হবে এবং সরকারি বিভাগও বেসরকারি করতে হবে।
• রুণশিল্প বন্ধ করে দিতে হবে এবং সব শিল্পে ব্যাপকহারে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে।
• শিল্প, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব সামাজিক কাজকর্ম হবে মুনাফাভিত্তিক।
• দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হবে।
• আমদানির ওপর বিধিনিষেধ সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে পশ্চিমি দেশগুলির উৎপাদিত সামগ্রী আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
• বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ওইসব দেশে ব্যাপকভাবে প্রবেশের সুযােগ করে দিতে হবে।
• বহুজাতিক কর্পোরেশনের শােষণে যাতে কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেজন্যে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করতে হবে। এই মারাত্মক শর্তগুলির জন্যে তৃতীয় বিশ্বের জনগণ চরমভাবে শােষিত হচ্ছে এবং ওইসব দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা শুধু নয় রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হচ্ছে।

প্রশ্ন ৮) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার গুরুত্ব বর্ণনা করাে।
উত্তর : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শক্তি ছাড়া। কোনাে রাষ্ট্র তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বহুলাংশে এই ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রমাত্রই কতকগুলি বিষয় বা মূল্যবােধ বজায় রাখতে ও বিস্তৃত করতে চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সম্মান, শান্তি, ন্যায়নীতি, নিরাপত্তা, মর্যাদা প্রভৃতির কথা বলা যায়। ক্ষমতা ব্যতিরেকে এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা যায় না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত। ক্ষমতা হল একটি উপায় বা মাধ্যম বিশেষ ; এর সাহায্যে রাষ্ট্র তার স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতি প্রয়ােগ করে। রাষ্ট্রে স্বাধীনতা নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য শক্তির প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এর মধ্যেই নিহিত আছে জাতীয় শক্তির নৈতিক ভিত্তি। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মূল হল এই ক্ষমতা বা শক্তি।

প্রশ্ন ৯) জোটনিরপেক্ষতার গুরুত্ব আলােচনা করাে।
উত্তর : জোটনিরপেক্ষতা তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া স্বাধীন দেশগুলিকে কোনাে আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে মাথা নত না করে জগৎসভায় নিজেদের স্বাধীন, সার্বভৌম অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সুযােগ করে দিয়েছে। তা ছাড়া জোটনিরপেক্ষতাকে আশ্রয় করেই তারা নিজেদের জাতীয় শক্তির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আরও উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের মতামত অবাধে ব্যক্ত করার জন্য নির্জোট আন্দোলনের সুবাদে তারা একটি স্থায়ী মঞ্চ পেয়েছে। তা ছাড়া সােভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ও পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই কারণেই ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের বেলগ্রেড সম্মেলনে যেখানে মাত্র ২৫টি দেশ যোগদান করেছিল আজ সেই সংখ্যা ৪ গুণেরও বেশি। এইসব কারণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোটনিরপেক্ষতা আজ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্রশ্ন ১০) আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জোট আন্দোলনের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জোট আন্দোলন নানাভাবে অবদান রেখেছে। যেমন—
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষতা এক নতুন মাত্রা এনেছে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় তা এক নতুন আলােচ্য বিষয় হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে।
(খ) নির্জোট আন্দোলনের সুবাদে তৃতীয় বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে এবং একই সঙ্গে বিশ্বরাজনীতিতে এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।
(গ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসানে নির্জোট আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
(ঘ) বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নির্জোট আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম করেছে। বস্তুত, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতির তীব্র বিরােধিতা করে এবং এই বিরােধিতার অনুকূলে বিশ্বজনমত গঠন করে নির্জোট আন্দোলন এমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে, দক্ষিণ আফ্রিশ শেষ পর্যন্ত এই নীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
(ঙ) দুর্বল রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির গায়ের জোরে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নির্জোট আন্দোলন সব সময়েই প্রতিবাদ জানিয়েছে। এতে কোনাে কোনাে সময়ে বিশ্বরাজনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে এবং দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধ সংঘর্ষের সম্ভাবনাও কমেছে।
(চ) এই আন্দোলন গােড়া থেকেই প্রত্যেকটি নয়া উপনিবেশবাদী পদক্ষেপের বিরােধিতা করেছে। একই সঙ্গে নয়া উপনিবেশবাদী শােষণ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য নির্জোট আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানাে হয়।

প্রশ্ন ১১) নির্জোট আন্দোলনের সমস্যাগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তর : নির্জোট আন্দোলনের সমস্যাগুলি প্রধানত এইরকম—
(ক) অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে অনেক সদস্যরাষ্ট্রে এমনই জটিলতার সৃষ্টি করেছে যে, পূর্ণশক্তিতে নির্জোট আন্দোলনে মদত দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
(খ) কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের পারস্পরিক সংঘাতে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। বলাবাহুল্য, এতে নির্জোট আন্দোলনের ঐক্য ও শক্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।
(গ) নানা প্রস্তাব ও পরিকল্পনা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযােগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসতে পারেনি।
(ঘ) জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষের ঘটনাও অনেক ঘটেছে। যেমন—কাম্পুচিয়ার উপর ভিয়েতনামের আক্রমণ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, পাক-ভারত বিবাদ ও সংঘর্য ইত্যাদি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নিজোট আন্দোলনকে দুর্বল করেছে।
(ঙ) এই অনৈক্য ও দুর্বলতার জন্যই সাম্প্রতিককালে বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থা প্রণীত বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে নির্জোট আন্দোলন কোনাে সংঘবদ্ধ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারেনি। একইভাবে পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ চুক্তির বৈষম্যমূলক ও আপত্তিকর ধারাগুলির বিরুদ্ধেও নির্জোট আন্দোলন রুখে দাঁড়াতে পারে নি।

রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১) শক্তি কাকে বলে ? শক্তির উপাদানগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তর : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন্ রাষ্ট্র কতটা প্রভাব বিস্তার করবে তা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তির ওপর। যে রাষ্ট্র বেশি শক্তিশালী সেই রাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিকে বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

শক্তির সংজ্ঞা
শক্তির সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। কারণ, বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শক্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন। সহজভাবে বলা যায়,—অন্যের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে বলে শক্তি। মরগেনথাউ (Morgenthau) বলেছেন,—কোনাে ব্যক্তি যদি অন্য কোনাে ব্যক্তির কাজকর্ম, আচার- আচরণ ও মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তখন, বলা যায় যে, সেই ব্যক্তির শক্তি বা ক্ষমতা আছে। আবার কোনাে রাষ্ট্র বা জাতি যদি অন্য রাষ্ট্রের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে, তবে সেই ক্ষমতার নাম জাতীয় শক্তি।
   কোনাে কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন,—মনের ওপর প্রভাব বিস্তার নয়, আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তারের নাম হল শক্তি। কারণ, মনের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ সব সময় পাওয়া যায় না। আবার, অধ্যাপক ফ্রাঙ্কেল (Frankel) বলেছেন,—অপরের মন ও কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য হল শক্তি। তাই বলা যায়, যদি কোনাে রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়, তখন সেই ক্ষমতাকে জাতীয় শক্তি বলা যায়।
   এক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে বল প্রয়ােগ থাকবে কি না। অধ্যাপক পামার ও পারকিন্স তাদের লেখা ‘International Relations’ গ্রন্থে বলেছেন,—স্বাভাবিকভাবে যদি অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে প্রয়ােজনে বলপ্রয়ােগ করতে হবে। তবে শক্তি মানেই বলপ্রয়ােগ বােঝায় । কারণ বলপ্রয়ােগ ছাড়া বিভিন্ন পদ্ধতি বা মতাদর্শ দিয়ে অন্যকে প্রভাবিত করা যায়।

শক্তির উপাদান
অপরকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাই হল শক্তি। এই শক্তি স্বাভাবিক নিয়মে কোনাে রাষ্ট্র অর্জন করতে পারে না। কতকগুলি উপাদানের ওপর নির্ভর করে কোনাে দেশের জাতীয় শক্তি। নিম্নে জাতীয় শক্তির প্রধান উপাদানগুলি আলােচিত হল—
• ভৌগােলিক উপাদান
জাতীয় শক্তির উপাদান হিসাবে ভৌগোলিক অবস্থানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের ভৌগােলিক অবস্থান সেই দেশের ক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। ভৌগােলিক অবস্থান জাতীয় অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, প্রতিরক্ষা, কূটনীতি ও রণকৌশলকে প্রভাবিত করে। কোনাে দেশের ভৌগােলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে সেই দেশ একটি সামুদ্রিক শক্তি বা প্ৰলশক্তি হিসাবে আন্তর্জাতিক জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। গ্রেট ব্রিটেন ও জাপানের অবস্থান তাদের সামুদ্রিক শক্তিতে পরিণত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তাকে বিরাট স্থলভাগ এবং সমুদ্র উপকূলের সমীপবর্তী করে তুলেছে। এর ফলে স্থল ও সামুদ্রিক শক্তি উভয়েতেই সে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। পূর্বতন সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম জার্মানির অবস্থান তাদের বিশেষভাবে গুলশক্তিতে পরিণত করেছে।
   অবস্থান কোনাে দেশের সামরিক এবং নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরােপ এবং রাশিয়া থেকে জলভাগ দ্বারা বিচ্ছিন্ন। তার পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বিশাল জলভাগ থাকায় ইউরােপ বা এশিয়া থেকে কোনাে স্থলবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। এই অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ইংলিশ চ্যানেল গ্রেট ব্রিটেনকে বহু আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
• জনসংখ্যা
কোনাে দেশের জাতীয় শক্তির উপাদান হিসাবে মানবসম্পদের অপরিসীম গুরুত্ব আছে। জনসংখ্যার পরিমাণগত ও গুণগত দিক বিচার করা প্রয়ােজন। দেশের সম্পদ উপযুক্তভাবে ব্যবহারের জন্যে এবং নিরাপত্তার জন্যে সামরিক বাহিনীতে জনসংখ্যার প্রয়ােজন। জনসংখ্যা কম হলে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হয় না। আবার জনসংখ্যা খুব বেশি হলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জনবহুল দেশে দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অশিক্ষা, বাসস্থানের অভাব, বেকারত্ব এবং অন্যান্য সমস্যা সমাজে অভিশাপ হিসাবে দেখা দেয়। চিন, ভারতবর্য প্রভৃতি দেশ মাত্রাধিক জনসংখ্যার চাপে বিপর্যন্ত। জনসংখ্যার গুণগত দিকটি বিচার করতে গেলে বয়সের বণ্টন, জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাগত যােগ্যতা, উপাদানশীলতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রভৃতি বিষয় বিচার্য। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়ঃসীমা পর্যন্ত জনগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
• মতাদর্শ
কোনাে কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মতাদর্শকে জাতীয় শক্তির আর একটি উপাদান হিসাবে মনে করেন। কোনাে বিশেষ মতাদর্শ জনগণের মধ্যে প্রেরণা জোগায়। দেশ গঠনের কাজে নিজেকে আত্মনিয়ােগ করে। তাতে দেশ শক্তিশালী হয়। যেমন মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদ চিনের মানুষদের কাজের প্রেরণা দিয়েছে। চিন আজ অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
• সামরিক ক্ষমতা
কোনাে রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষমতা জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করে। সামরিক বাহিনী যদি শক্তিশালী হয় তাহলে সে সহজেই বিদেশি আক্রমণ প্রতিরােধ করতে পারে এবং সামরিক শক্তি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে। তবে সামরিক বাহিনীর আয়তনটা সব কথা নয়। দেখতে হবে, সেনাবাহিনী কতটা দক্ষ এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র কতটা আধুনিক ও উন্নতমানের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্রে বলীয়ান হওয়ার জন্য সে মেগাশক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে।
• প্রাকৃতিক সম্পদ
কোনাে দেশের শক্তি ও সামর্থ্য, সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে খনিজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী, মৃত্তিকার উর্বরতা প্রভৃতিকে বােঝায়।
   রাষ্ট্রের বলপ্রয়ােগের ক্ষমতাকে কার্যকর করার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়ােজন হয়। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য যেসব অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত করা দরকার তার জন্য কেবল উচ্চমানের ইস্পাত ছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম, খনিজ তেল, রবার, ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রয়ােজন। ও দেশপ্রেম রাষ্ট্রের প্রতি ভালােবাসা বা জাতীয়তাবােধ জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। দেশবাসীর দেশপ্রেম যত গভীর হবে, রাষ্ট্র তত শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও জাপান বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাতীয়তাবােধের ফলে তারা আবার শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
• অর্থনৈতিক উন্নতি
কোনাে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নত হলে তার জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটলে রাষ্ট্র নিজের প্রয়ােজন মিটিয়ে বাড়তি বহু জিনিস বিক্রি করে শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে। অন্যান্য রাষ্ট্রকে সাহায্য দিয়ে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারে।
মূল্যায়ন
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, জাতীয় শক্তির বিভিন্ন্য উপাদান আছে।  কিন্তু কোনো একটির ওপর জাতীয় শক্তি পুরােপুরি নির্ভর করে না। জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে অনেকগুলি উপাদান এক সঙ্গে কাজ করে। যেমন, কোনাে রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি থাকতে পারে। কিন্তু এই শক্তির ব্যবহারের জন্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা থাকা একান্ত প্রয়ােজন। তা না হলে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে কোনাে লাভ হবে না। তাই অধ্যাপক হার্টম্যান (Hartman) বলেছেন,—জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

প্রশ্ন ২) জাতীয় স্বার্থ’ বলতে কী বােঝায়? বিদেশনীতিতে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা আলােচনা করাে।
উত্তর : বর্তমান পৃথিবীতে কোনাে রাষ্ট্রই দ্বীপের মতাে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে পারে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। প্রত্যেক রাষ্ট্রই তার জাতীয় স্বার্থ ও লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট থাকে। সেই উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাষ্ট্র বিদেশনীতি নির্ধারণ করে। প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজের জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশনীতি তৈরি করতে পারে না। তাই অধ্যাপক ফ্রাকেল (Frankel) —National interest is the key concept in foreign policy, wefs, fromaaifos জাতীয় স্বার্থ হল প্রধান বিষয়বস্তু।

জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা
ফ্রাকেল জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, জাতীয় মূল্যবােধের সমষ্টিই হল জাতীয় স্বার্থ। সহজভাবে বলা যায়, একটি রাষ্ট্র যখন সাধারণ ও ধারাবাহিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কাজ করে, তাকে জাতীয় স্বার্থ বলা হয়। হার্টম্যান (Hartman) জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার বিভিন্ন চাহিদাগুলি পূর্ণ করতে চায়, এই চাহিদা বা ইচ্ছাই জাতীয় স্বার্থ। আবার পল সিবিউরি (Paul Seabury) জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে তিনটি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন।
• জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টিকে বােঝায়।
• বর্ণনাত্মক অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল, সেইসব উদ্দেশ্যের সমন্বয় যা প্রতিটি জাতি তার নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে নিরন্তর অনুসরণ করে।
• জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে গােষ্ঠী এবং ব্যক্তির মধ্যে যে বিরােধ সৃষ্টি হতে পারে তার প্রতিও সিবিউরি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সাধারণভাবে কোনাে দেশের জাতীয় স্বার্থ বলতে বােঝায়,—তার নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষা, আর্থিক উন্নতি, জাতীয় শক্তিবৃদ্ধি ও জাতীয় মূল্যবােধের সংরক্ষণ ।

বিদেশ নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা
অধ্যাপক মরগেনথাউ (Morgenthau) ‘Politics Among Nations’ গ্রন্থে বলেছেন, জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে কোনাে রাষ্ট্র বিদেশ নীতি প্রণয়ন করতে পারে না। কারণ, জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিলে জনগণ তা সহজে মেনে নেয় না। ফলে সরকার বিপাকে পড়ে। আবার কোনাে কোনাে রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে জাতীয় মূল্যবােধকে গুরুত্ব দেয় এবং এই মূল্যবােধের ভিত্তিতে বিদেশ নীতি প্রণয়ন করে। যেমন, ভারতের জাতীয় মূল্যবােধ হল অহিংসা ও অনাক্রমণ। ভারত এই মূল্যবােধকে বিসর্জন দিয়ে জাতীয় স্বার্থ পূরণ করতে চায় না। সেজন্য বিদেশ নীতিতে এগুলির ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
   তবে অধ্যাপক মরগেনথাউ বলেছেন,—প্রতিটি রাষ্ট্র যদি হিংসাত্মক উপায়ে জাতীয় স্বার্থ পূরণের ক্ষেত্রে বিদেশ নীতি প্রণয়ন করে তাহলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে। কারণ, কোনাে দেশের বিদেশ নীতি যদি অন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হয় বা অন্য রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করে তখন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেবে। যেমন, জার্মানি হিংসাত্মক উপায়ে জাতীয় স্বার্থপূরণের জন্য বিদেশ নীতি প্রণয়ন করায় নিজের দেশের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। অধ্যাপক হার্টম্যান (Hartman) বলেছেন,—বিদেশ নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থ নিশ্চয় দেখা হবে। তবে সেক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের একটা সীমা থাকা দরকার। সীমা ছাড়িয়ে গেলে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত নাও হতে পারে। যেমন, জার্মানি জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকিয়ে বিদেশ নীতির অঙ্গ হিসাবে রাশিয়া আক্রমণ করেছিল। কিন্তু আক্রমণ চালাতে গেলে যে শক্তি থাকা দরকার তা ছিল না । তাই ভুলের মাশুল দিতে হয়েছিল।
মূল্যায়ন
বিদেশ নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থাতীয় স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সমালােচকরা বলেছেন জাতীয় স্বার্থ বলতে নির্দিষ্ট কোনাে বিষয়কে বােঝায় না। বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ বিভিন্ন রকমের। তাই জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে বিদেশ নীতির সুসম্পর্ক নির্ধারণ করা যায় না। তা সত্ত্বেও, বিদেশ নীতি ও জাতীয় স্বার্থ পৃথকভাবে ভাবা যায় না। প্রত্যেক দেশের বিশেষ জাতীয় স্বার্থ থাকে। সরকার বদলালেও জাতীয় স্বার্থ পুরােপুরি বদলায় না। তাই সে সেই জাতীয় স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে বিদেশ নীতি স্থির করে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী জাতীয় স্বার্থ পূরণ করতে বিদেশ নীতি নির্ধারণ করে। ভারত বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্যবােধকে গুরুত্ব দেয়। কারণ, মূল্যবােধ ভারতের জাতীয় স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত।

প্রশ্ন ৩) ‘জোটনিরপেক্ষতা’র (Non-alignment) সংজ্ঞা দাও। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা আলােচনা করাে।
উত্তর : জোটনিরপেক্ষতার দর্শনের উৎস সন্ধানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পরে উপনিবেশবাদ বিরােধী সংগ্রামের শেষ পর্বের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধােত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলা যায়। দ্বিমেরু প্রবণতা এবং ঠান্ডা যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির শেষ অধ্যায়ে এই আন্দোলন এক সুসংগঠিত রূপ লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে বহু দেশের মুক্তি, জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রয়ােজনীয়তা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (Non-Aligned Movement, NAM) প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।

জোটনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জোটনিরপেক্ষতার ধারণা। সাধারণভাবে বলা যায়, কোনাে শক্তি জোটে যােগদান না করে স্বাধীনভাবে বিদেশনীতি প্রণয়ন করার নাম জোটনিরপেক্ষতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দুটি শিবির গড়ে উঠল। একদিকে গড়ে উঠল পুঁজিবাদী গােষ্ঠীর শিবির। অন্যদিকে সমাজবাদী গােষ্ঠী। এই দুটি জোটের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার নাম জোটনিরপেক্ষতার নীতি।
   কেউ কেউ জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বলার পক্ষপাতী। কারণ, জোটনিরপেক্ষতা নেতিবাচক নয়; এটি ইতিবাচক। অর্থাৎ, কোনাে শিবিরে যােগ না দেওয়া এর একমাত্র লক্ষ্য নয়। বিশ্বশান্তি ও সহযােগিতার পথ প্রশস্ত করতেই এই আন্দোলন। সুতরাং বলা যায়, জোটনিরপেক্ষতা বলতে বােঝায়,—কোনাে সামরিক জোটে যােগ না দেওয়া, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়া, শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরােধের মীমাংসা করা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলা।

ভারত ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন
ভারত হল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অগ্রদূত। তবে ভারতের কাছে এটি নতুন কোনাে বিষয় নয়। এটি তার ঐতিহ্যের স্বাভাবিক ফলশ্রতি। ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা নেওয়ার কারণগুলি হল :
• ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য
ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সম্রাট অশােকের অনুসৃত অহিংসা ও শান্তির আদর্শ। অহিংসার পূজারি মহাত্মা গান্ধি এই নীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতি হল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। কারণ, বিশ্বে আক্রমণের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে অহিংসার নীতিকে বিসর্জন দিতে হবে। ভারত এই নীতিতে বিশ্বাসী নয়।
• অর্থনৈতিক উন্নয়ন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর রাজনীতি দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায় রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী গােষ্ঠীর শিবির এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী গােষ্ঠীর শিবির। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র এই দুটি শিবিরে যােগদান করলেও ভারত নিজেকে এই দুটি গােষ্ঠীর শিবির থেকে দূরে রাখ। কারণ, ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যে মূলধনের বিশেষ প্রয়ােজন। অর্থ বা প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়ােজন হলে দুটি শিবিরের সাহায্য নিতে হবে। একটা জোটের মধ্যে গেলে অন্য জোটের বিরাগভাজন হতে হবে। তাই ভারত জোটনিরপেক্ষতার গ্রহণ করেছে।
• অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা
এশিয়া ও আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলি বহু মানুষের প্রাণে ও সম্পত্তির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে জোটনিরপেক্ষতার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছে। কারণ, সামরিক গােষ্ঠীতে যােগ দিলে, তাদের শর্ত পালন করতে গিয়ে স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে হবে। তাই ভারতসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বহু রাষ্ট্র জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে।
• অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষা
ভারতে বহু জাতীয় ও আঞ্চলিক দল আছে এবং তাদের কর্মসূচি বিভিন্ন রকম। ভারত সােভিয়েত গােষ্ঠীতে যোগ দিলে বামপন্থীরা খুশি হবে। কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা অখুশি হবে। আবার মার্কিন গােষ্ঠীতে যােগ দিলে বামপন্থীরা অসন্তুষ্ট হবে। তাই ভারত দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে ঐক্যসাধন করতে জোটনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছে।
• ভৌগােলিক কারণ
ভৌগােলিক অবস্থানের জন্যে ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি নিয়েছে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিলনক্ষেত্ররূপে ভারতের ভৌগােলিক অবস্থান গড়ে উঠেছে। সকলের সঙ্গে হাত মেলাতে ভারত জোটনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছে।

মূল্যায়ন
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ১২৫টি। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি রাষ্ট্রসংঘকে সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছে। উন্নত দেশগুলির বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি সরব হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি নির্জোট গােষ্ঠীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ কথা আজ সত্য সমাজবাদী দুর্গের পতনের পর নির্জোট আন্দোলন কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। তথাপি এর গুরুত্ব কমে যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ডারবান সম্মেলনে মার্কিন প্রতিনিধির উপস্থিতি এ কথাই প্রমাণ করে। এই আন্দোলনের পুরােধা ভারতের মতামতকে সবাই গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঠান্ডা লড়াই (cold war) বিশ্বের রাজনীতিকে দুষিত করছে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব কমেছে। তাই অধ্যাপক বার্টন (Burton) বলেছেন,—জোটনিরপেক্ষতার পরিধি যতই বাড়তে থাকবে, ঠান্ডা লড়াইয়ের (cold war) সুযােগ ততই কমতে থাকবে। 

প্রশ্ন ৪) বিশ্বায়নের (Clobalization) সংজ্ঞা দাও। বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে ভারতের পদক্ষেপ ওতার ফলাফল আলোচনা করাে।
উত্তর : বিশ্বায়ন শব্দটি সাম্প্রতিককালে বহুচৰ্চিত শব্দগুলির অন্যতম। বিজ্ঞজনের আলােচনা চক্রে যেমন, তেমনি আবার সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেও বিশ্বায়নের প্রসঙ্গ প্রতিনিয়ত উত্থাপিত হয়।
   ১৯৮০-এর দশকেই বস্তুত বিশ্বায়ন শব্দটিতে এক বিশেষ মাত্রা সংযােজিত হয়। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা। কারণ বিশ্বায়নের প্রভাবে যেমন আন্দোলিত হতে পারে ব্যাবসাবাণিজ্যের জগৎ, তেমনি প্রযুক্তিবিদ্যা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগৎ আন্দোলিত হবে। বিশ্বায়নে প্রভাবিত হয় রাজনীতি ও অর্থনীতি। বাস্তবে বিশ্বায়নের সূচনা হয় মানবসভ্যতার বিকাশের প্রারম্ভিঙ্ক স্তরেই, যখন মানুষ উপলব্ধি করল যে, বিচ্ছিন্নভাবে যেমন কোনাে ব্যক্তি বাঁচতে পারে না, তেমনি কোনাে সমাজ বা জাতিও বিশ্ব সম্পর্কে নিরাসক্ত বা উদাসীন থেকে নিজের অস্তিত্ব ও অগ্রগতি সুনিশ্চিত করতে পারবে না।

বিশ্বায়নের সংজ্ঞা
বিশ্বায়ন বলতে বােঝায় এমন এক সামাজিক প্রক্রিয়া (Social Process) যার মাধ্যমে বা যার সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তারা অনুভব করতে অভ্যস্ত হয় যে, বিশ্বের সকল অংশ বা সমাজের মানুষ শেষ পর্যন্ত এক অখও পরিবারের সদস্য। নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে ও নানাবিধ অভিজ্ঞতার অভিঘাতে এই বােধ বা বিশ্বচেতনা তৈরি হয় এবং ক্রমশ তা বিকশিত হয়।

বিশ্বায়ন ও ভারত
১৯৮০ দশকে ভারতের বাণিজ্য থেকে আয় খুব কমে যায়। ফলে দেশে বিদেশি মুদ্রার অভাব দেখা দেয়। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার পূর্ণ করতে ভারত বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। এই সুযােগে বিশ্বব্যাংক ভারতের ওপর বিভিন্ন অপ্রীতিকর শর্ত চাপিয়ে দেয়া এবং ভারত বাধ্য হয়ে এই শর্ত মেনে নেয় এবং বিশ্বায়নের পক্ষে মতপ্রকাশ করে।
   প্রথমত, বিশ্বায়নের প্রয়ােজনে বিদেশিরা যাতে ভারতবর্ষে সহজে মূলধন বিনিয়ােগ করতে পারে সেই ব্যবস্থার উদার শর্ত দিয়েছে। তারা যাতে তাদের দেশে মুনাফা পাঠাতে পারে তার ব্যবস্থা করেছে। অনাবাসী ভারতীয়রা ১০০ শতাংশ মালিকানার ভিত্তিতে রূণ শিল্প, হাসপাতাল, হােটেল প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ করতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়নের শর্ত মেনে ভারত বিভিন্ন দ্রব্যের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে।
তৃতীয়ত, বিশ্বায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল,–গ্যাট (GATT – Ceneral Agreement on Tariffs and Trade) চুক্তির স্বাক্ষর করতে হবে। এর অপর এক নাম তাকেল প্রস্তাব। এই চুক্তি অনুসারে WTO বা World Trade Organisation নামে একটি বাণিজ্যিক সংগঠন তৈরি হয়। ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাচেছ।

ফলাফল
প্রথম দিকে আমাদের মনে হয়েছিল বিশ্বায়নের ফলে আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে সেরূপ কোনাে ঘটনা ঘটেনি।
প্রথমত, আমাদের বিদেশি মুদ্রার মজুত ভাণ্ডার বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ছিল ১০০ কোটি ডলার। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে হয় ২০০ কোটি ডলার। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী বিদেশি মুদ্রার মজুত ভাণ্ডার হয় ১৪,১৫৪ কোটি ডলার।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়নের ফলে শিল্পের ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে শিন্সেন্নয়নের হার দাঁড়িয়েছে ৭.৪ শতাংশ। আগের বছর এই সময়ে ছিল ৪.১ শতাংশ। বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তৃতীয়ত, বিশ্বায়নের ফলে রপ্তানির ক্ষেত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি মূলধনের আগমন উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, অনাবাসী ভারতীয়রা বিশ্বায়নের ফলে ভারতে মূলধন বিনিয়ােগে উৎসাহী হচ্ছে। তাই বর্তমানে ভারতে শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

মূল্যায়ন
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সফল হলেও বিশ্বায়নের ফলে দেশি ও কুটিরশিজের ক্ষেত্রে সংকটের শিল্পগুলি অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছে। বিদেশি শিল্পপতিদের মূলধন বেশি। তাদের হাতে উন্নত প্রযুক্তি আছে। তাই দেশি শিল্পগুলির নাভিশ্বাস উঠেছে। পেটেন্ট আইনের ফলে কৃষি ব্যবস্থাও সকেটের মধ্যে পড়বে। এমনকি ব্যাংকিং ও বিমা ব্যবস্থায় বিদেশি মূলধন আসায় দেশীয় পরিসেবা বাবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

প্রশ্ন ৫) বিশ্বায়ন কাকে বলে? বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য কী? 
উত্তর : ‘বিশ্বায়ন’ বলতে আমরা বুঝি পুঁজির কেন্দ্রীভবন। বিভিন্ন কারণে পুঁজিবাদ আজ সংকটাপন্ন। এই সংকটেরই আর এক নাম বিশ্বায়ন। প্রকৃতপক্ষে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রত্যক্ষ মদতে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। গােটা পৃথিবী জুড়ে চলা অর্থনৈতিক সংস্কার, যার পােশাকি নাম বিশ্বায়ন—এই প্রচেষ্টারই ফসল। বস্তুত গ্লোবালাইজেশনের অর্থই হচ্ছে গুটি কয়েক পশ্চিমি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কবজায় বিশ্বের অর্থনীতিকে আরও বেশি সংহত করা।
   বিশ্বায়ন, উদারীকরণ অথবা নয়া-উদারনীতিবাদ যে-কোনো নামেই অভিহিত করা হােক-না-কেন, এই সংকট পুঁজিবাদ ব্যবস্থারই সংকট। পুঁজিবাদী শ্রেণি তাদের সংকটের মােকাবি উত্তরােত্তর আক্রমণমুখী হয়ে উঠছে। এই ব্যবস্থায় বড়ােরা ছােটোদের গিলে খায়। বিশ্বায়ন ও উদারীকরণ স্লোগান তুলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সমগ্র বিশ্বের বাজারকে বিশেষ করে ভারতের মতাে তৃতীয় বিশ্বের বাজারগুলিকে তাদের পণ্যের বাজারে পরিণত করছে। এর জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলি- বিশ্বব্যাংক, আই, এম, এফ., এবং অধুনাগঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাকে ব্যবহার করছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলির এই প্রক্রিয়ার নামেই বিশ্বায়ন। এর আর এক নাম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন।
   বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ গ্রন্থে লেখেন যে, বিশ্বায়নের অর্থ হল এমন এক সামাজিক অবস্থা যেখানে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহুজাতিক সংস্থাগুলির স্বার্থ রক্ষা হয়’।

বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রধান দুটি অক্ষ হল, উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ। যেসব দেশে এই নীতি প্রয়ােগ করা হয়েছে তার সবগুলিতেই এর কয়েকটি লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। যেমন—
• কর্মী সংকোচন
‘গ্লোবালাইজেশন’ মানে দায়হীন শােষণ আর বঞ্চনার সীমাহীন বিশ্বে, বিশ্বব্যাপী নির্বিকার নির্মমতার অচিন্ত্যনীয় আয়ােজন। উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের নীতির ফলে দেশের শ্রমজীবী মানুষ আজ চরম দুর্দশার মুখে। একদিকে বেপরােয়াভাবে কর্মী সংকোচন চলেছে, অন্যদিকে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রগুলিকে হয় সরাসরি বেসরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, নতুবা বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশের সুযােগ করে দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে অবাধে দ্রব্য আমদানি করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ধ্বংস হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে বিপন্ন ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পেই যেহেতু কর্মসংস্থান বেশি হয়ে থাকে, তাই এই ধরনের সংস্থা বন্ধ হওয়ায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। বিশ্ব কমিশনের মতে, বিশ্বায়ন পৃথিবীতে বৈষম্য নিয়ে এসেছে। বিশ্বায়নের সুবিধাগুলি দেশের মধ্যে বা দুটি দেশের মধ্যে অসমভাবে বন্টিত হয়েছে। জয়ী ও পরাজিতের মধ্যে মেরুকরণ বেড়ে চলছে। ধনী-দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে মেরুকরণ বেড়ে চলেছে। ক্রমবর্ধমান বেকারির ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। শ্রমিক হারাচ্ছে তার ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার। কমে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হচ্ছে।
• শ্রমশক্তির অপচয়
শ্রম খরচ কমাতে শ্রমশক্তিকে ব্যাপকভাবে কমানাে হচ্ছে। ১৪টি রাষ্ট্রে শিশু মৃত্যুর হার বেড়েছে। “রুগ্ণ ও অলাভজনক কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের মােট ৫৪টি দেশ আরও গরিব হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের মন্তব্য, “আর্থিক লাভ মাত্র কয়েকটি দেশকেই উপকৃত করেছে বহু দেশের স্বার্থের বিনিময়ে। উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়ােগের জন্য বহুজাতিক কর্পোরেশনের অবাধ প্রবেশ ঘটছে।
• শ্রম পরিবেশ
এক্সপাের্ট প্রসেসিং জোন (রপ্তানির জন্য উৎপাদনের অঞ্চল) ও ফ্রি-ট্রেড জোন (মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল- এর সৃষ্টি), যেখানে দেশের প্রচলিত শ্রম আইন প্রযােজ্য নয় এবং শ্রমিকদের কাজের পরিবেশও খুবই খারাপ)।
• শ্রমিক ছাঁটাই
স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বায়ন শুরু হবার পর ২১টি দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। শ্রমিকের কাজের ও জীবনধারণের অবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা ও অর্জিত সুযােগসুবিধার ব্যাপক ছাঁটাই চলছে। ক্ষুদ্র ও ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প ধ্বংস করে কারিগরদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে।
• ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ
শ্রম আইন সংশােধনের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকারে আক্রমণ।
• পেটেন্ট আইন প্রবর্তন
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির বাণিজ্যের শর্তের আরও অবনতি ও কঠোরতম পেটেন্ট আইন প্রবর্তন। পরিমাণগত বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজারে বিদেশি পণ্যের প্লাবন ও দেশীয় বাজার থেকে দেশীয় পণ্যের বিতাড়ন।
• মুনাফা বৃদ্ধি
কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা শিকেয় তুলে রাখা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিপ্লবের সুযােগ নিয়ে আধুনিকতম অটোমেটিক মেশিন ও কমপিউটারের সাহায্যে অতি কম সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদন করা। এবং মুনাফার হার আরও বৃদ্ধি করা।

প্রশ্ন ৬) তৃতীয় বিশ্বের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলােচনা করাে।
উত্তর : তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই দীর্ঘকাল কোনাে-না-কোনাে ইউরােপীয় শক্তির অধীনে থাকার ফলে এদের শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ইত্যাদি কোনােক্ষেত্রেই আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি। এ সমস্ত রাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হল ব্যাপক নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য, ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিসেবার অভাব, অপ্রতুল বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব ইত্যাদি এই সমস্ত অনগ্রসর রাষ্ট্রগুলির বিকাশের জন্য প্রয়ােজন প্রচুর পরিমাণে মূলধন এবং প্রযুক্তির কলাকৌশলের হস্তান্তর।
   এই মূলধন এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তার জন্য এইদেশগুলি বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের দ্বারস্থ হল। আর এই ঋণ মঞ্জুরের যে শর্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার (IMF) উপস্থিত করল এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির আর্থনীতিক কাঠামাের পরিবর্তন সাধিত হল।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব
“বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিজয়ী ও বিজিত উভয়েই থাকবেন। বাণিজ্য ও বিনিয়ােগ বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আয়ের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে তাও এই শতাব্দীর নজিরবিহীন—গ্যাটের উরুগুয়ে রাউন্ডের সিদ্ধান্তগুলি কার্যকারী করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যের আয় ১৯৯৫-২০০১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ২১২ থেকে ৫১০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এর সুফল সকলে পায় না। যেমন স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে এই বাণিজ্যিক নীতির কারণে প্রতি বছরে লােকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার থেকে ১২০ কোটি ডলারে। রাষ্ট্রসংঘের নিয়ন্ত্রিত UNDP কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন রিপাের্টে (১৯৯৭) বিশ্বায়ন সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর বিশ্বায়নের কুফল
• বিশ্বায়ন তৃতীয় দুনিয়ার ‘দরিদ্র জনগণের নিকট অভিশাপ রূপে উপস্থিত হয়েছে। বিশ্বায়নের অর্থ অবাধ আমদানি ও রপ্তানি। এর ফলে উন্নত দেশগুলি উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা ও পরিকাঠামাের সাহায্যে সস্তায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজারে নিয়ে আসছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদকরা এই সুযােগ থেকে বঞ্চিত হবার ফলে তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে অর্থাৎ উন্নত রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। ফলে উন্নয়নশীল দেশের ছােটো ও মাঝারি কলকারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ফলে বেকারসমস্যা তীব্রতর হয়ে উঠছে।
• বিশ্বায়ন সরকারি মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানাকে উৎসাহ প্রদান করে থাকে। ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় রাষ্ট্রের মানুষই আজ প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ ব্যক্তিগত মালিকানার ফলে শ্রমিকদের বেতন সংকোচন, ছাঁটাই প্রভৃতি যথেচ্ছভাবে হবার ফলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এর ফলে তৈরি হয়েছে এক বিশাল বেকারবাহিনী।
• বিশ্বায়ন সবসময় তীব্র প্রতিযােগিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিকাশের কথা বলে। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রগুলির উৎপাদকেরা উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে উৎপাদনকে যে স্তরে নিয়ে যেতে পারবে উন্নয়নশীল দেশসমূহ তাদের অনুন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে উৎপাদন সেই স্তরে নিয়ে যেতে পারছে না, তারা অসম প্রতিযােগিতার মধ্যে পড়ে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।
• অনেকে বিশ্বায়নকে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির ওপর নয়া উপনিবেশ স্থাপনের একটি হাতিয়ার বলে মনে করে। বিশ্বায়নের সুযােগ নিয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলি বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের বাজার দখল করতে বিশেষভাবে উদ্যত। সত্তর দশকের শেষে ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বহুজাতিক সংস্থার লগ্নির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫১,০০০; ৩৪,০০০ এবং ১৬,০০০ মিলিয়ন ডলার।
   তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর বিশ্বায়নের এই কুফল পরিলক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আজ তাদের পক্ষে আর বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভবপর নয়। উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলি প্রযুক্তি বিদ্যা ও মূলধনের অধিকারী এবং এগুলি ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলি বিকাশ লাভ করতে পারবে না। আবার এগুলি ধীরে ধীরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় বহুজাতিক সংস্থাগুলি মূলধন ও প্রযুক্তিবিদ্যার অন্যতম জোগানদাতা হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে। তাই উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে আজ আর বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নের নামেও উপস্থিত হওয়া একেবারেই অসম্বব।

Leave a Comment

Scroll to Top