ভারতের সংবিধান প্রণয়নের পটভূমি | Historical Background of Indian Constitution

ভারতের সংবিধান প্রণয়নের পটভূমি | Historical Background of Indian Constitution)

ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন আইনের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

1.ভারতশাসন আইন, ১৮৫৮ : (The Government of India Act, 1858)
(a) ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক অধিকৃত ভারতের ভূখণ্ড ইংল্যাণ্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে ন্যস্ত হয়। ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাণী। উক্ত আইনের মাধ্যমে ঘােষণা করা হয় রাণীর নামেই শাসনকার্য পরিচালিত হবে।
(b) কোম্পানীর অধীন স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীর উপর অধিকার ও কর্তৃত্ব ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রাণীর উপর ন্যস্ত হয়।
(c) এই আইনে একজন ভারতসচিব (Secretary of State for India) পদের সৃষ্টি করা হয়। উক্ত সচিব ভারতের শাসনকার্য সম্পর্কিত যাবতীয় কাজকর্মের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়িত্বশীল থাকবেন।

2. ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৬১ : (The Indian Councils Act, 1861)
(a) এই আইনের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতবাসীর অংশ গ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি করা হয়।
(b) এই আইনে সমগ্র দেশের বিচারব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যবস্থা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে কলিকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের এই আইনের মাধ্যমে ভারতে বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসাধন করা হয়।
(c) এই আইনের মাধ্যমে সীমিতভাবে হলেও, প্রাদেশিক আইনসভাগুলিকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

3. ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৯২ : (The Indian Councils Act, 1892)
(a) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চাপে ব্রিটিশ সরকার কার্যনির্বাহী পরিষদে বেসরকারী সদস্য নিযুক্তির ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাকে মেনে নেয়।
(b) প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলিতেও পরােক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
(c) এই আইনে সীমিতভাবে প্রাদেশিক আইন পরিষদের ক্ষমতা বাড়ানাে হয়।

4. ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৯০৯ : (The Indian Councils Act, 1909)
(a) এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বাড়ানাে হয়।
(b) এই আইনে নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করা হয়। এই উদ্দেশ্যে পৃথক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
(c) এই আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমকালীন ভারতসচিব লর্ড মর্লি (Lord Morley) এবং ভাইসরয় লর্ড মিন্টো (Lord Minto) উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এই কারণে এই আইনটি ‘মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন’ (The Morley-Minto Reforms Act) নামে পরিচিত।

5. ভারতশাসন আইন, ১৯১৯ : (The Government of India Act, 1919)
(a) এই আইনের মাধ্যমে ভারতের শাসনকার্যের সঙ্গে ভারতীয়দের ক্রমশ অধিক যুক্ত করা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা চালু করার কথা ঘােষণা করা হয়।
(b) ভারতে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার জন্য প্রাদেশিক সরকারগুলিকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলা হয়।
(c) এই আইনে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অপেক্ষাকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক করা হয়।

6. ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ : (The Government of India Act, 1935)
(a) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনই হল ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের ইতিহাসে ব্রিটিশ সরকারের শেষ পদক্ষেপ। অধ্যাপক জে. সি. জোহারী বলেছেন, “It should be treated as the last political gift of the British Imperialism”. এই আইনটি স্বাধীন ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিকাশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ভারতের বর্তমান সংবিধানের রূপরেখা বহুলাংশে এই আইনটির পটভূমিতে রচিত হয়েছে।
(b) এই আইনে কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়। এর উচ্চকক্ষের নাম রাজ্য পরিষদ (Council of States) এবং নিম্নকক্ষের নাম যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা (Federal Assembly)।
(c) এই আইনটির মাধ্যমে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। উক্ত আইনে বিভক্তিকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ (decentralization) পদ্ধতিতে এদেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
(d) এই আইনের সপ্তম তালিকায় তিনটি তালিকার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। এই তিনটি তালিকা হল—(i) কেন্দ্রীয় তালিকা (Central List), (ii) প্রাদেশিক তালিকা (Provincial List) এবং (iii) যুগ্ম তালিকা (Concurrent List)।
(e) এই আইনে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত (Federal Court) এর ব্যবস্থা করা হয়।

4. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা : (Mountbatten Plan)
(a) ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
(b) ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রকেই ডােমিনিয়ন মর্যাদা দেওয়া।
(c) উভয় রাষ্ট্রেরই কমনওয়েলথ পরিত্যাগ করার অধিকার থাকবে।
(d) ভারতে ও পাকিস্তানে যােগদানে অনিচ্ছুক অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা হয়।

5. ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ : (Indian Independence Act, 1947)
(a) এই আইনের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।
(b) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলিকে বিধিবদ্ধ রূপ দেওয়ার জন্য এই আইনটি প্রণীত হয়।
(c) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই রাজার সম্মতির পর বিলটি আইনে পরিণত হয়।
(d) এই আইনের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হয় এবং সৃষ্টি হয় ভারতীয় ইউনিয়ন ও পাকিস্তান।
(e) এই আইনের মাধ্যমে স্থির হয় নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত উভয় ডােমিনিয়ন এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলির শাসনকার্য ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন অনুসারে পরিচালিত হবে।

গণপরিষদের গঠন (Composition of the Constituent Assembly)

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় গণপরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে। মিশনের প্রস্তাবক্রমে গণপরিষদ গঠনের জন্য ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মােট ২৯৬ জন সদস্য নির্বাচনের জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভারতের গণপরিষদে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ড. বি. আর. আম্বেদকর, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সি. রাজাগােপালাচারী, কে, এম, মুন্সী, আল্লাদী কৃয়স্বামী প্রমুখ।

গণপরিষদ সম্পর্কিত সাধারণ তথ্যাদি :
1. প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত একটি গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠনের প্রস্তাব জাতীয় কংগ্রেস গ্রহণ করেছিল—১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে।
2. ব্রিটিশ সরকারীভাবে প্রথম ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠনের বিষয়টি স্বীকার করে—১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট।
3. ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ক্রিপস্ মিশন আসে—-গণপরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে।
4. ব্রিটিশ সরকার কুপল্যান্ড (Coupland)-কে ভারতে পাঠান ভারতের গণপরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে।
5. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের শ্রমিক সরকার ভারতে ক্যাবিনেট মিশন পাঠায় ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে।
6. ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে গণপরিষদের মােট সদস্যসংখ্যা স্থির হয় ৩৮৯ জন।
7. ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে গণপরিষদের সমস্ত আসন—সাধারণ (অ-মুসলমান ও অ-শিখ) মুসলমান ও শিখ—এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভক্ত হবে।
৪. ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবক্রমে গণপরিষদে আসনসংখ্যা নির্ধারিত হয়—সাধারণের জন্য ২১০টি আসন, মুসলমানদের জন্য ৭৮টি আসন ও শিখদের জন্য ৪টি আসন।
9. ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবক্রমে গণপরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়—১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে।
10. গণপরিষদে ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এইচ. সি. মুখার্জী।
11. গণপরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়—১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে।
12. দিল্লীর কনস্টিটিউশন হলে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে—১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর।
13. গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে যােগদান করেন—২০৭ জন সদস্য।
14. গণপরিষদের অস্থায়ী সভাপতি হন—ড. সচ্চিদানন্দ সিংহ।
15. গণপরিষদের স্থায়ী সভাপতি হন—ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ।
16. গণপরিষদে ভারতকে স্বাধীন সার্বভৌম সাধারণতন্ত্র হিসাবে ঘােষণা করার প্রস্তাব দেন—জওহরলাল নেহরু।
17. গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়—২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
18. গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়—২০শে জানুয়ারি, ১৯৪৭।
19. গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয়—১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২২শে এপ্রিল।
20. গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে গঠিত কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত কমিটি’র (Union Constitutional Committee) সভাপতি হন-পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
21. গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে গঠিত ‘প্রাদেশিক শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত কমিটি’র (Provincial Constitutional Committee) সভাপতি হন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
22. ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি ঘােষণা করেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
23. ভারতের গণপরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে পঞ্চম অধিবেশনের সময় থেকে।
24. ভারতের স্বাধীনতা আইন’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই।
25. গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট।
26. গণপরিষদের খসড়া কমিটির (Drafting Committee) সভাপতি হন ড. বি. আর. আম্বেদকর।
27. খসড়া কমিটি প্রাথমিক পর্বে সংবিধানে যুক্ত করেছিল ৩১৫টি ধারা ও ১৩টি তফশিল (Schedule)।
28. চূড়ান্ত পর্বে খসড়া কমিটি সংবিধানে রাখে ৩৯৫টি ধারা ও ৮টি তফশিল।
29. ভারতীয় সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল ২৬শে নভেম্বর, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে।
30. ভারতীয় সংবিধান রচনা করতে মােট সময় লাগে ২ বছর ১১ মাস ১৭ দিন।
31. গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি।
32. ভারতের সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক কার্যকর হয় ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০।
33. গণপরিষদে বিশেষভাবে যাঁরা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন তারা হলেন আইনজীবী।
34. মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে।
35. মুসলীম লীগ স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তােলে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লীগের লাহাের অধিবেশনে।
36. ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারত বিভাজনের প্রস্তাবটি মেনে নেয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (Mountbatten Plan, 1947) গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
37. ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারত একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে (Sovereign Democratic Republic) পরিণত হয়।
38. \’India: Two Political Cultures\’—এই বইটি লেখেন অধ্যাপক মাইনর ইউনার (Mynor Weiner)।
39. Mynor Weiner-এর মতে, ভারত স্বাধীন হবার পর এদেশে দুটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Political culture) ছিল। যথা—এলিট রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণরাজনৈতিক সংস্কৃতি।

ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ (Salient Features of the Indian Constitution)

1. বিশ্বের সর্বাপেক্ষা লিখিত বৃহৎ ও জটিল সংবিধান : ভারতীয় সংবিধানে বর্তমানে ১২টি তফশিল (Schedule), ২২টি অংশ (Part) ও ৪৫০টির বেশী ধারা (Article) রয়েছে। এর ফলে ভারতীয় সংবিধান এক বিশাল আকার ধারণ করেছে।

2. প্রস্তাবনার সংযুক্তিকরণ : ভারতীয় সংবিধানের প্রথমেই একটি প্রস্তাবনাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবনাকে সংবিধানের ‘মুখবন্ধ (Preface) বলে। প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম (Sovereign), সমাজতান্ত্রিক (Socialist), ধর্মনিরপেক্ষ (Secular), গণতান্ত্রিক (Democratic), সাধারণতন্ত্র (Republic) বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

3. সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মিশ্রণ : প্রকৃতিগতভাবে ভারতীয় সংবিধান একদিকে যেমন সুপরিবর্তনীয়, অন্যদিকে তেমনি দুম্পরিবর্তনীয়। নতুন রাজ্যের সৃষ্টি, কোনাে রাজ্যের সীমানার পরিবর্তন, রাজ্যের নামের পরিবর্তন, বিধানসভার সৃষ্টি বা বিলােপ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান সুপরিবর্তনীয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন, সংবিধান সংশােধন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান হল দুষ্পরিবর্তনীয়। সুপরিবর্তনীয়তা বলতে বােঝায়, যখন সংবিধানের কোনাে অংশের পরিবর্তন করা যায় সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে। আর দুষ্পরিবর্তনীয় বলতে বােঝায় যখন সংবিধানের কোনাে অংশের পরিবর্তনের জন্য ‘জটিল’ বা ‘বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়।

4. ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি : ভারতীয় সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শটি গৃহীত হয়েছে। ফলে এখানে ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি কার্যকর হয়নি। উল্লেখ্য, ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি মার্কিন সংবিধানের বৈশিষ্ট্য যা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। তবে সংবিধানের ৫০ নং ধারায় বিচারবিভাগকে শাসনবিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রপতি সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টগুলির বিচারপতিদের নিযুক্ত করতে পারলেও, পদচ্যুত করতে পারেন না।

5. মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি : ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অংশে (Part III) বর্তমানে ৬টি (Six Fundamental Rights) মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। যেমন—
(i) ১৪-১৮ ধারা – সাম্যের অধিকার।
(ii) ১৯-২২ ধারা – স্বাধীনতার অধিকার।
(iii) ২৩-২৪ ধারা – শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার।
(iv) ২৫-২৮ ধারা – ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার।
(v) ২৯-৩০ ধারা – সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার।
(vi) ৩২-৩৫ ধারা – শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।
   এখানে ৩১ নং ধারাটি বাদ গেছে। কারণ উক্ত ধারাটিতে ‘সম্পত্তির অধিকারটি’ (Right to Property) ছিল। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে 44তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে বর্তমানে সম্পত্তির অধিকারকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

6. রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিসমূহের অন্তর্ভুক্তিকরণ : ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশে (Part-IV) ৩৬ থেকে ৫১ নং ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলি (Directive Principles of State Policy) বর্ণিত হয়েছে। নির্দেশমূলক নীতিগুলিও একপ্রকার অধিকার হিসাবেই গণ্য হয়। তবে এগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ ভারতকে একটি জনকল্যাণকর ও ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদী রাষ্ট্রে (Democratic Socialism) পরিণত করতেই এই নীতিগুলিকে সংবিধানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন।

7. মৌলিক কর্তব্য : বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের \’চতুর্থ ক’ অংশে (Part IVA) ১১টি মৌলিক কর্তব্যকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এই ১১টি মৌলিক কর্তব্যকে সংবিধানের ‘৫১ ক’ ধারায় (51A) লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

8. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ : ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ ভারতকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেশের বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে রচনা করেছিলেন। সে কারণে ভারতীয় সংবিধানে বিশেষ কতকগুলি ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। যেমন, কেবলমাত্র প্রমাণিত অসদাচরণ ও অক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনাে কারণে বিচারপতিদের পদচ্যুত করা যায় না। এছাড়া বিচারপতিদের পদচ্যুতির পদ্ধতিটি অত্যন্ত জটিল করা হয়েছে।

9. একনাগরিকত্বের ব্যবস্থা গ্রহণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় ভারতীয় সংবিধানে দ্বি-নাগরিকত্বের নীতিটি স্বীকৃত হয়নি। এখানে ব্রিটেনের ন্যায় একনাগরিকত্বের নীতিটি স্বীকৃত হয়েছে।

10. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার স্বীকৃতি : ভারতীয় সংবিধানের ১নং ধারায় ভারতকে ‘রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন’ (A Union of States) বলা হলেও সাধারণভাবে ভারতের শাসনব্যবস্থার কাঠামােটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের অনুরূপ। কারণ এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
(a) দু-প্রকার সরকার। যেমন, একটি কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি ২৮টি রাজ্যসরকার রয়েছে।
(b) লিখিত ও মূলত দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান।
(c) যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্টের ভূমিকা।
(d) দেশের কেন্দ্রীয় আইনসভা অর্থাৎ পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট।
(e) সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন।

11. আধা-যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য : ভারতীয় সংবিধানে একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য গৃহীত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য সংবিধানে যুক্ত হয়েছে, যেগুলি ‘আদর্শ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা’র (Ideal Federal System) বিরােধী এবং এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার (Unitary system) অনুরূপ। সেই কারণেই অধ্যাপক কে. সি. হােয়ার (Prof K. C. Wheare) ভারতকে একটি ‘আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ’ (Quasi-Federal State) বলে উল্লেখ করেছিলেন। আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থাৎ, \’যুক্তরাষ্ট্রবিরােধী\’ সেই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(a) রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান না থাকা।
(b) রাজ্যের নিজস্ব সুপ্রীমকোর্ট না থাকা। অর্থাৎ, দ্বৈত বিচারব্যবস্থার নীতিটি গৃহীত না হওয়া।
(c) অবশিষ্ট ক্ষমতা’গুলি (The Residuary Powers) রাজ্যের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকার বা পার্লামেন্টকে অর্পণ করা।
(d) পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ গঠনে (রাজ্যসভা) সমপ্রতিনিধিত্বের নীতিটিকে গ্রহণ না করা।
(e) রাজ্যপালকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা’ (Discretionary powers) প্রদান।
(f) রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ঘােষণা।
(g) রাজ্যের নাম, সীমানা ইত্যাদির পরিবর্তন অথবা নতুন রাজ্যের সূচনা বা রাজ্য পুনর্গঠন প্রভৃতি বিষয়ে পার্লামেন্টের একক ক্ষমতাভোেগ।
(h) এক নাগরিকত্বের নীতি গ্রহণ প্রভৃতি।

12. সংসদীয় শাসনব্যবস্থার স্বীকৃতি : ভারতীয় সংবিধানে ব্রিটিশ সংবিধানের অনুকরণে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার রীতিটি গৃহীত হয়েছে। সুতরাং, ভারত একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল :-
(a) দুই প্রকার শাসকপ্রধানের উপস্থিতি। যথা—প্রকৃত শাসক ও নামসর্বস্ব শাসক। এখানে প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত শাসকপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব শাসকপ্রধান (Titular or nominal head)।
(b) আইনসভার নিম্নকক্ষের নিকট কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বশীলতা। অর্থাৎ, ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের (লােকসভা) নিকট যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকেন।
(c) আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের মধ্যে সংযােগ বা সম্পর্ক রক্ষা। ফলে মন্ত্রীসভার সদস্যগণ আইনসভার সদস্য হয়ে থাকেন।
(d) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।
(e) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট গঠন ও সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য’ (First among equals) নীতির স্বীকৃতি।

13. পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ও বিচারবিভাগের প্রাধান্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা : ভারতের সংবিধান রচয়িতাগণ পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতার (Sovereign powers) সাথে বিচারবিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার’ উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশ ও আমেরিকার সংবিধানকে অনুসরণ করেছিলেন। ব্রিটিশ সংবিধানকে অনুসরণ করে তারা ভারতের সংসদ বা পার্লামেন্টকে শক্তিশালীভাবে গড়ে তােলেন। অন্যদিকে মার্কিন সংবিধানকে অনুসরণ করে বিচারবিভাগ বা সুপ্রীমকোর্টের প্রাধান্যকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট পার্লামেন্ট প্রণীত যে কোনাে আইনকে ‘সংবিধানবিরােধী’ হবার কারণে বাতিল করতে পারে। অপরদিকে পার্লামেন্ট সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক বাতিল আইনটিকে সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে সাংবিধানিক একটি আইনে পরিবর্তন ও পরিণত করতে পারে। উল্লেখ্য সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট প্রায় একক ক্ষমতা ভােগ করে।

14. জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ঘােষণা : ভারতীয় সংবিধানে দেশের অস্বাভাবিক অবস্থা (extraordinary situation) মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রপতিকে তিন প্রকার জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা (Emergency Powers) প্রদান করা হয়েছে। এই তিন প্রকার জরুরী ক্ষমতাগুলি হল :
(a) জাতীয় জরুরী অবস্থা (National emergency) যা সংবিধানের ৩৫২নং ধারায় যুক্ত হয়েছে।
(b) শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার কারণে (On the ground of failure of constitutional machinery) রাজ্যে রাষ্ট্রপতিশাসন জারী যা সংবিধানের ৩৫৬নং ধারায় বর্ণিত হয়েছে। অথবা, সংবিধানের ৩৬৫ ধারানুসারে রাজ্যগুলি কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে চলতে অক্ষম হলে রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা করা যেতে পারে।
(c) আর্থিক জরুরী অবস্থার (Financial emergency) ঘােষণা, যা সংবিধানের ৩৬০নং ধারায় যুক্ত হয়েছে।

15. সংরক্ষণমূলক বিশেষ ব্যবস্থা : ভারতীয় সংবিধানে তফশিলী জাতি, তফশিলী উপজাতি, অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণী ও ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য বিশেষ সংবিধান সুবিধা ও বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন তফশিলী জাতি ও উপজাতি প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের স্বার্থে সরকারী চাকরীতে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ (১৬ (৪) ধারা], আইনসভায় নিম্নকক্ষে আসন সংরক্ষণ (৩৩০ ও ৩৩২নং ধারা), লােকসভা ও বিধানসভায় ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকে সুনিশ্চিত করতে আসন সংরক্ষণ (৩৩১ ও ৩৩৩) প্রভৃতি।

16. প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার : ভারতীয় সংবিধানে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ভােটদানের অধিকার দেওয়া হয়েছে (৩২৬ ধারা)। উল্লেখ 61তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ভােটদানের ন্যূনতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করা হয়।

17. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার স্বীকৃতি : গণতান্ত্রিক ক্ষমতাকে তৃণমূল স্তরে বিভাজন ও বিস্তৃত করার জন্য 73তম সংবিধান সংশােধনের (১৯৯২) মাধ্যমে গ্রামে ত্রিস্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গঠন করা হয় ও 74তম সংবিধান সংশােধনের (১৯৯২) মাধ্যমে শহরে পৌর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

18. গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র (Democratic and Socialism)—উভয় শব্দ দুটিই যুক্ত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতি অনুসারে রাষ্ট্রের নিকট সকল নাগরিক সমান বলে গণ্য হলেও, রাষ্ট্র দেশের পশ্চাৎপদ শ্রেণীর স্বার্থে ‘বৈষম্যমূলক সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করতে পারবে, যা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে রচিত।

19. নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান : ভারত একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ হবার কারণে এখানে দুপ্রকার শাসকপ্রধানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দেশের সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি ব্রিটেনের রাজা বা রাণীর ন্যায় বংশানুক্রমিকভাবে শাসন করেন না। এখানে রাষ্ট্রপতি জনগণ কর্তৃক পরােক্ষভাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হন, যা সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে। বস্তুত, ভারতে কোনাে সরকারী পদই বংশগত সূত্রে অর্জন করা যায় না। তাই ভারত যেমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেই সঙ্গে একটি প্রজাতান্ত্রিক বা সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (Republic) হিসাবেও গণ্য হয়।

20. সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাম্য : ভারতীয় সংবিধানের ১৪নং ধারায় সাম্যের অধিকারটি বর্ণিত হয়েছে। উক্ত ধারায় বলা হয়েছে যে—(i) আইনের চোখে সকলে সমান (Equality before the law) এবং (ii) আইনসমূহ কর্তৃক সকলে সমানভাবে রক্ষিত হবে (Equal protection of the laws)। কিন্তু এখানে সাম্য কথাটি সার্বজনীনভাবে প্রযােজ্য হবে না। অর্থাৎ ভারতে প্রতিটি মানুয সংরক্ষিত হবেন তার অবস্থান বা মর্যাদা অনুসারে। অর্থাৎ সমপর্যায়ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক সমান আচরণ পাবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনাে বিভেদ করতে পারবে না। তাই ব্যক্তির অবস্থান বা মর্যাদা অনুসারে (Rank or Status) প্রতিটি ব্যক্তি জাতি, ধর্ম, বর্ণ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্র কর্তৃক সমান আচরণ পাবেন। ভারতে সমপর্যায়ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক সমভাবে গণ্য হবেন (The guarantee of equal protection is a guarantee of equal treatment of persons in equal circumstances, permitting differentiation in different circumstances)।

21. বিরােধী দলের গুরুত্ব : সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে বিরােধী দলের যথাযথ ভূমিকার উপর। ব্রিটেনের বিরােধী দলকে ‘রাজা বা রাণীর বিরােধী দল’বলা হয়। ভারতেও বিরােধী দলের ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে পার্লামেন্টের বিরােধী দলের মর্যাদা লাভ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দলটিকে লােকসভার মােট আসনের এক-দশমাংশ (1/10) আসন লাভ করতে হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলেও লােকসভায় এক-দশমাংশের বেশী আসন এককভাবে লাভ করায় প্রথম বিরােধী দলের মর্যাদা লাভ করে এবং লােকসভায় সংবিধান স্বীকৃত বিরােধী দলের উপস্থিতি ঘটে। কারণ ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের আগে কোনাে রাজনৈতিক দলই এককভাবে লােকসভায় এক-দশমাংশ আসন লাভ করতে পারে নি।

সংবিধানে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ শব্দের ব্যাখ্যা

‘সার্বভৌম’ (Sovereign) কথাটির অর্থ : রাষ্ট্রের আইন ও আদেশ বা নির্দেশসমূহ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রতিটি নাগরিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মান্য করতে বাধ্য থাকবে এবং রাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতি স্বাধীনভাবে রচনা করতে পারবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অপর কোনাে রাষ্ট্র অথবা আন্তর্জাতিক সংগঠনের নির্দেশ মানবে না।

সমাজতন্ত্র’ (Socialism) কথাটির অর্থ : ভারতে ‘সমাজতন্ত্র\’ শব্দটির অর্থ মার্কস-এঙ্গেলস্ প্রণীত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের (Scientific Socialism) অনুরূপ হয়। এখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সংবিধান সংশােধন বা শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে। কোনাে বিপ্লব বা সংগঠিত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নয়। তাই ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সমাজতন্ত্র শব্দটিকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’-এর (Democratic Socialism) অনুরূপ বলা যায়।

‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (Secular) কথাটির অর্থ : রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনাে ধর্ম থাকবে না এবং রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সমান বা নিরপেক্ষ আচরণ করবে।

‘গণতান্ত্রিক’ (Democratic) কথাটির অর্থ : এখানে সরকার গঠিত হবে ভারতীয় জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের চোখে সমান হিসাবে গণ্য হবে (To state, all citizens are equal)।

‘প্রজাতান্ত্রিক’ (Republic) কথাটির অর্থ : এখানে দেশের রাষ্ট্র তথা সাংবিধানিক প্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিও জনগণের দ্বারা পরােক্ষভাবে অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হবেন। উল্লেখ্য ভারত হল একটি গণতান্ত্রিক ও সেই সঙ্গে একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বটে। কিন্তু ব্রিটেন বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও এটি একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কারণ ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ রাজা বা রাণী দেশের জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ কোনােভাবেই নির্বাচিত হন না। তারা বংশানুক্রমে শাসন করেন ও নিজ পদে আসীন হন। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, যা দেশের লিখিত সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে।

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি কথাটির অর্থ : যখন সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগ নিজ নিজ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থেকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে এবং কোনাে বিভাগই অপর বিভাগ দুটির উপর হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে না। ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণের নীতিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় প্রযুক্ত হয়েছে।

‘যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত’ কথাটির অর্থ : যখন কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের বিরােধ বা দ্বন্দ্ব বাধে অথবা রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে বিরােধ বাধে, তখন উক্ত বিরােধের মীমাংসা বা সমাধান শুধুমাত্র যে আদালত করে থাকে, তাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত’ (Federal Court) বলে।

‘দ্বি-নাগরিকত্ব’ (Dual citizenship) কথাটির অর্থ : যখন কোনাে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব প্রদানের সাথে সাথে রাজ্য সরকারগুলিও তাদের অধিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে থাকে। উক্ত ব্যবস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন বলে নাগরিকদের কোনাে অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্ব থাকে না।

‘যুক্তরাষ্ট্র’ কথাটির অর্থ : যখন কোনাে দেশে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সাথে কতকগুলি আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকার থাকে, তখন তাকে যুক্তরাষ্ট্র বলে। এইরূপ শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের মাধ্যমে ক্ষমতা বন্টিত হয় এবং সংবিধানের গুরুত্ব বিশেষভাবে স্বীকৃত হয়ে থাকে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার—উভয়কেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সংবিধানের গণ্ডীর মধ্যে থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়।

ভেটো ক্ষমতা : ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের ভেটো ক্ষমতা’ (Veto Power) প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের বিল বাতিল করার ক্ষমতাকে ভেটো ক্ষমতা বলে। তবে ভারতীয় সংবিধানের ১১১ ধারা অনুসারে (Article 111) রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমােদিত কোনাে বিলে অসম্মতি প্রদান করলে অর্থাৎ ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ করলে, বিলটি যদি পুনরায় কোনাে সংশােধন ছাড়াই অনুমােদিত হয়, তখন রাষ্ট্রপতি তার সম্মতি জানাতে বাধ্য থাকেন।

প্রশাসনিক বিচারব্যবস্থা (Administrative Tribunal) : সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর হাতে বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। একেই প্রশাসনিক বিচারব্যবস্থা বলে। এর ফলে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স (Ordinance) : ভারতীয় সংবিধানের ১২৩ ধারাবলে রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকলে অর্ডিন্যান্স বা জরুরী আইন বা অধ্যাদেশ জারী করতে পারেন যা আইনের মতােই কার্যকর হয়। তবে এই জুরুরী আইন ছয় সপ্তাহের মধ্যে পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমােদিত হতে হবে। নচেৎ অর্ডিন্যান্সটি বাতিল বলে গণ্য হবে। রাজ্যের রাজ্যপাল ২১৩ ধারাবলে অর্ডিন্যান্স জারী করতে পারেন।

অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (Deligated Legislation) : প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ সাধারণভাবে আইন প্রণয়ন করে না। কিন্তু প্রয়ােজনে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ যাতে বিধি-নিয়ম প্রণয়ন করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে পার্লামেন্ট প্রশাসনের হাতে আইনানুসারে ক্ষমতা প্রদান করে এবং তা নির্দেশ আকারে জারী করে। শাসনবিভাগ কর্তৃক প্রণীত এই সমস্ত আইন-কানুনকে ‘অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন’ (Delegated Legistation) বলে।

নিবর্তনমূলক আটক আইন (Preventive Detention Act) : যে আইনে কোনাে ব্যক্তিকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয় তাকে নিবর্তনমূলক আটক আইন বলে। নিবর্তনমূলক আটক আইন হল একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। ভবিষ্যতে অপরাধ করতে পারে—এই সন্দেহের বশেই কোনাে ব্যক্তিকে এই আইনে বিনা বিচারে আটক করা যায়। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে পার্লামেন্ট এবং রাজ্য আইনসভাগুলি নিবর্তনমূলক আটক আইন প্রণয়ন করতে পারে।

কোরাম (Quorum) : কোনাে একটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বৈধ অধিবেশন বা মিটিং-এর জন্য সংস্থাটির মােট সদস্যের একটি ন্যূনতম অংশকে উপস্থিত থাকতে হয়। একেই কোরাম বলে। যেমন, লােকসভার মােট সদস্যের এক-দশমাংশ হল কোরাম। এক-দশমাংশ সদস্যের উপস্থিতি ছাড়া লােকসভার কোনাে বৈধ অধিবেশন বসতে পারে না।

অংশ (Parts) ও ধারা (Articles) অনুসারে ভারতীয় সংবিধানের রূপরেখা

অংশ ধারা বিষয়সমূহ
অংশ I/১-৪ ধারা ভারতীয় ভূখণ্ড, প্রশাসন, নতুন রাজ্যের সূচনা।
অংশ II/৫-১১ ধারা নাগরিকত্ব।
অংশ III/১২-৩৫ ধারা মৌলিক অধিকার।
অংশ IV/৩৬-৫১ ধারা রাষ্ট্রের নির্দেশমূলক নীতিসমূহ।
অংশ IVA/৫১ ক ধারা মৌলিক কর্তব্য।
অংশ V/৫২-১৫১ ধারা কেন্দ্রের শাসনব্যবস্থা ও সরকার।
অংশ VI/১৫২-২৩৭ ধারা রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ও সরকার।
অংশ VII/২৩৮ ধারা সপ্তম সংবিধান সংশােধনের (১৯৫৬) মাধ্যমে এটি বাতিল করা হয়েছে।
অংশ VIII/২৩৯-২৪১ ধারা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
অংশ IX/২৪২-২৪৩ ধারা সপ্তম সংবিধান সংশােধনের (১৯৫৬) মাধ্যমে এটি বাতিল করা হয়েছে।
অংশ X/২৪৪-২৪৪ ক ধারা তফশিলী জাতি ও উপজাতিভুক্ত অঞ্চল।
অংশ XI/২৪৫-২৬৩ ধারা কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে শাসনতান্ত্রিক সম্পর্ক।
অংশ XII/২৬৪-৩০০ ধারা অর্থ, সম্পদ চুক্তি প্রভৃতি।
অংশ XIII/৩০১-৩০৭ ধারা ব্যবসা, বাণিজ্য।
অংশ XIV/৩০৮-৩২৩ ধারা কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারী চাকরী।
অংশ XIVA/৩২৩ ক-৩২৩ খ ধারা বিশেষ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল (Administrative tribunals) গঠন, বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও অভিযােগের সমাধানের জন্য।
অংশ XV/৩২৪-৩২৯ ধারা। নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন।
অংশ XVI/৩৩০-৩৪২ ধারা তফশিলী জাতি ও উপজাতিদের জন্য ও ইঙ্গ-ভারতীয়দের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।
অংশ XVII/৩৪৩-৩৫১ ধারা। সরকারী ভাষাসমূহ।
অংশ XVIII/৩৫২-৩৬০ ধারা জরুরী অবস্থাসংক্রান্ত ব্যবস্থাদি।
অংশ XIX/৩৬১-৩৬৭ ধারা ফৌজদারী মামলা থেকে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের নিষ্কৃতি দেবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাদি।
অংশ XX/৩৬৮ ধারা। সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি।
অংশ XXI/৩৬৯-৩৯২ ধারা অস্থায়ী, বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।
অংশ XXII/৩৯৩-৩৯৫ ধারা সংবিধানের সংক্ষিপ্ত শিরােনাম, সূচনা ও বাতিল সম্পর্কিত বিষয়াদি।

Leave a Comment

Scroll to Top