ব্রিটিশ ভারতে কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ (Farmer and Tribal revolts in British India)
ধর্মীয় ও উপজাতি আন্দোলন
ওয়াহাবি আন্দোলন
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদ। রােহিলখণ্ডে এটি শুরু হলেও পরে বিহার, বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও দাক্ষিণাত্যে এটি বিস্তার লাভ করে। বিলায়েত খান, শাহ মহম্মদ হােসেন এবং ফারহাত হােসেনকে সৈয়দ আহম্মদ নিয়ােগ করেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শিখদের বিরুদ্ধে উপজাতিদের সমর্থন করেন। ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ ও শিখদের বিরুদ্ধে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ মারা যান। বিলায়েত আলি নেতৃত্ব গ্রহণ করে মৌলবি নাসিরুদ্দিনকে কমান্ডার ইন-চিফ নিযুক্ত করেন। রঞ্জিত সিং এর মৃত্যুর পর ওয়াহাবিরা শিখদের রাজত্বের কিছু অংশ দখল করে নেন। বিলায়েত আলির মৃত্যুর পর এনায়েত আলি ওয়াহাবি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এনায়েত আলির মৃত্যুর পর মাকশুদ আলি ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। মাকশুদ আলির পর আবদুল্লা সিত্তানে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ব্রিটিশরা ১৬ টি অভিযান পাঠান ১৮৫০-৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে স্যার সিডনি কটন সিত্তানা দখল করেন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহাবিরা সিত্তান পুনর্দখল করেন। ঐ বছর জেনারেল গাভ পুনরায় ওয়াহাবিদের পরাস্ত করেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে আম্বালায় বিচারে ইয়াআলি, আবদুল রহিম ও মহম্মদ জাফর ও অন্যান্য অনেককে দীপান্তর দেওয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাটনায় বিচারে আহমদুল্লাকে পাটনা থেকে স্থানান্তর করা হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মালদায় বিচারে মৌলবী আমিরুদ্দিনকে মালদা থেকে বিতাড়িত করা হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে রাজমহল ট্রায়ালে ইব্রাহিমকে বিতাড়িত করা হয়। ওয়াহাবি কথার অর্থ হল নবজাগরণ।
কুকা আন্দোলন
উনবিংশ শতকে কুকা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ভগত জহরমল। শিয়ান সাহিব নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। জহরমলের শিষ্য বালাক সিং এরপর কুকা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। রাম সিং কুকা আন্দোলনকে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সুবা এবং নায়েব সুবা নিয়ােগ করেন। একদল কুকা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েন। তারা মালুধ এবং কোটলাতে দশজনকে হত্যা করেন। ৬৮ জন কুকাকে ব্রিটিশরা হত্যা করেন। রাম সিংকে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয় ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।
ফরাজি আন্দোলন
ফরাজি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন হাজি শরিয়ত উল্লাহ। তার গুরু ছিলেন মৌলানা মুরাদ। তিনি ভারতকে \’দার উল হারব’ বা বিধর্মীদের দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে ‘দার-উ-ইসলাম’ এ পরিণত করা। ফরাজি আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয় আন্দোলন এবং এর উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইসলাম ধর্মের পূনর্জাগরণ ঘটানাে। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরিয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র মহম্মদ মহসীন বা দুদুমিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ফরাজি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল বাহাদুরপুর এবং বারাসত।
জাতিগত আন্দোলন (Caste Movement)
ন্যায়ের আন্দোলন (Justice Movement)
১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে জাস্টিস আন্দোলন শুরু করেন সি. এন. মুদালিয়ার, টি. এস. নাইয়ার এবং পি. ত্যাগরাজাচেট্টি। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে শিক্ষা, সরকারি চাকরি এবং রাজনীতিতে নিম্নবর্ণের প্রবেশ ও ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কমানাের জন্য। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন যেটি পরিচিত জাস্টিস পার্টি নামে। এই দল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সবরকম সহযােগিতা করে সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় ও আইন সভায় সদস্যপদ লাভের আশায়।
আত্মমর্যাদা আন্দোলন (Self Respect Movement)
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তামিলনাড়ুতে আত্মসম্মান আন্দোলন শুরু করেন ই.ভি রামস্বামীনিক্কার। তিনি পেরিয়ার নামে পরিচিত। এই আন্দোলন ছিল ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে, বিবাহের সময় ব্রাহ্মণ ছাড়া বিবাহ, জোর করে মন্দিরে প্রবেশ, মনুস্মৃতি পুড়িয়ে ফেলা ইত্যাদি। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি খুদিআরশা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
নাদার আন্দোলন
নাদার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তামিলনাড়ুর রামনাথ জেলায়। নাদাররা ছিল কৃষি শ্রমিক। তারা ছিল মূলত শাহনা। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে নাদার মহাজন সঙ্গম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা উচ্চবর্ণের প্রথা ও রীতিনীতি আচার ব্যবহার অনুকরণ করতে থাকে। পলি আন্দোলন ও তামিলনাড়ুর পলিরা ছিল নিম্নবর্ণের লােক। তারা ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা দাবি করে। তারা নিজেদেরকে বলত বানিয়াকুল ক্ষত্রিয়।
ইজহাবা আন্দোলন (Exhaua Movement)
কেরালার অস্পৃশ্য ইজহাবারা নানুআসান বা নারায়ণগুরুর নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন এস.এন. ডি.পি যােগ (SNDP-Shri Narayan Dharma Paripolana Yogam) নামে পরিচিত। এই আন্দোলনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ এবং উচ্চবর্ণে উন্নতিকরণ। কেরালার কমিউনিস্টরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন।
নাইর আন্দোলন
ত্রিবাঙ্কুরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাইররা উচ্চবর্ণের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ ও মালােয়লি ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে নাইর আন্দোলন শুরু করেন। সি.ভি. রামনপিল্লাই মায়েয়ালি মেমােরিয়াল স্থাপন করেন। তিনি ব্রাহ্মণদের সরকারি চাকরির বিরােধিতা করেন। তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘মার্তন্ডবর্মা’ নাইর সামরিক শক্তির লুপ্ত গৌরবের কথা রয়েছে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পরে বিখ্যাত নাইর নেতা কে রামকৃষ্ণপিল্লাই এবং এম. পদ্মনাভ পিল্লাইয়ের আবির্ভাব হয়। কে রামকৃষ্ণপিল্লাই ১৯০৬-১৯ সাল পর্যন্ত স্বদেশ অভিমানী পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পদ্মনাভপিল্লাই নাইর সার্ভিস সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
সত্যশােদক আন্দোলন
জোতিবা ফুলে মহারাষ্ট্রে সত্যশােদক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সত্যশােদক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণদের হাত থেকে নিচুজাতের মানুষদের রক্ষা করা।
মাহার আন্দোলন
মহারাষ্ট্রের অস্পৃশ্য মাহারদের প্রথম নেতৃত্ব দেন। তাদের প্রথম স্নাতক ড.বি.আর. আম্বেদকর। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সর্বসাধারণের জন্য জলের কল ব্যবহার, মন্দির প্রবেশ, এবং আইন সভায় মাহারদের প্রতিনিধিত্ব। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে মাহাররা মনুস্মৃতি পুড়িয়ে এই আন্দোলনকে আরাে জনপ্রিয় করেন।
ড. বি. আর আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬)
ভিমরাও রামােজি ছিলেন মাহার সম্প্রদায়ের লােক। তিনি মধ্যপ্রদেশের মাে (Mhow) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার নিজের গ্রামের নামে আম্বেদকর উপাধি নেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগ দিয়ে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে অর্থনীতিতে M.A. পাশ করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে যােগ দিয়ে আইন পড়েন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি M. Sc ও ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে D.Sc ডিগ্রি পান। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বম্বে হাইকোর্টে কাজ শুরু করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বােম্বাইয়ে বহিষ্কৃত হিতকারিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি ডিপ্রেসড ক্লাসের সংগঠন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারাঠী পাক্ষিক বহিস্কৃত ভারত’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জনতা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমাজসমতা সঙঘ স্থাপন করেন এবং অস্পৃশ্যদের অধিকারের জন্য সত্যাগ্রহ শুরু করেন। তার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ফলে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাহার সম্প্রদায় নাসিকের বিখ্যাত কালরাম মন্দিরে প্রবেশের সুযােগ পায়। ডিপ্রেসড ক্লাসের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বােম্বাই আইন পরিষদের মনােনীত সদস্য ছিলেন ১৯২৬-৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তিনি তিনটি গােলটেবিল বৈঠকেই \’যােগ দেন। ব্রিটিশরা কমিউনাল এওয়ার্ড ঘােষণা করলে তিনি গান্ধীর সঙ্গে পুনা চুক্তি করেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট লেবার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাই প্রেসিডেন্সির সাধারণ নির্বাচনে তপশিলি জাতির সকল আসন দখল করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সারাভারত তপশিলি জাতি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিউপিলস এডুকেশান সােসাইটি স্থাপন করেন। ১৯৪২-৪৬ পর্যন্ত তিনি গভর্নর জেনারেলের এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন আইনমন্ত্রী এবং সংবিধান সভার খসড়া কমিটির তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান। হিন্দু কোড বিলের খসড়া তিনি করেন। এজন্য তাকে বলা হয় আধুনিক মনু। তার গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল কাস্টস্ ইন ইণ্ডিয়া, পাকিস্তান অথবা ভারত বিভাজন। মাহার আন্দোলনকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নেতৃত্ব দেন গােপাল বাবা অলঙ্কার। তিনি সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরিতে মাহারদের বেশি পদের দাবি করেন।
কৈবর্ত আন্দোলন
পশ্চিম বাংলায় মেদিনীপুরে কৈবর্তরা ছিল নিচু জাতের লােক। কিন্তু তারা ছিল অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত। তারা নিজেদের মাহিষ্য বলত। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে যতি নির্ধারনী সভা এবং ১৯০১ মাহিষ্য সমিতি গঠিত হয়। পরবর্তীকালে এরা ভারতের জাতীয় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
নমঃশূদ্র আন্দোলন
এরা ছিল বাংলার ফরিদপুরের লােক। এরা অস্পৃশ্য দরিদ্র কৃষক। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের পর কিছু শিক্ষিত অভিজাত ব্যক্তি এবং মিশনারীরা তাদের উৎসাহিত করলে নমঃশূদ্র আন্দোলন শুরু হয়।
কায়স্থ আন্দোলন
উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতের কায়স্থরা অল ইণ্ডিয়া কায়স্থ অ্যাসােসিয়েশান স্থাপন করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কায়স্থ সমাচার পত্রিকা প্রকাশিত হয় এলাহাবাদ থেকে।
বৈকম আন্দোলন
১৯২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন শুরু হয় ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যে। মন্দিরে প্রবেশ ছিল বৈকম আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। বৈকমরা ছিল নিচু জাতের। তাদের নেতা ছিলেন টি. কে. মাধবন।
কৃষক আন্দোলন
নীলবিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০)
ফরাসী বণিক লুই বােনাে ছিলেন ভারতের প্রথম নীলকর এবং ইংরেজ বণিক কাল ব্ল্যাম ভারতে প্রথম নীলশিল্প গড়ে তােলেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে নীলচাষে কোম্পানীর একচেটিয়া অধিকার লুপ্ত হয়। নীলকর সাহেবরা নিজেদের জমিতে নীল চাষ করলে তাকে বলা হত নিজ আবাদী এবং চাষিকে আগাম টাকা দিয়ে চাষের জমিতে নীল চাষ করার জন্য চুক্তি করলে তাকে বলা হত রায়তি, দাদনী বা বে-এলাকা চাষ। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি প্রকাশিত হয়। রেভারেণ্ড জেমস লঙ-এর উদ্যোগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকটি ইংরাজিতে অনুবাদ করেন। নীলকরেরা জেমস লঙ এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন এবং বিচারে তার একমাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়। জমিদার কালিপ্রসন্ন সিংহ নিজে ঐ টাকা জমা দেন।
লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন দ্বারা নীলকরদের অত্যাচার দমনের চেষ্টা করেন। বাংলার ছােটলাট হ্যালিডে সাহেব, সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফ, বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাঙ্গোলস নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষিদের পক্ষ নেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে কৃষ্ণনগরের কাছে চৌগাছা গ্রামে বিদ্রোহ শুরু হয়।নদীয়ার চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস কৃষকদের সংগঠিত করেন। নীলবিদ্রোহের কারণ নির্ণয় করেন তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্রান্ট। নীলবিদ্রোহ দমনের জন্য একাদশ আইন পাস হয়। নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহের ফরাজি নেতা রফিক মন্ডল, আশাননগরের মেঘাই সর্দার, খুলনার কাদের মােল্লা, সুন্দরবনের রহিমউল্লা, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার, নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়, মল্লিকপুরের পাঁচুশেখ, সাধুহাটির মথুরানাথ আচার্য, রানাঘাটের শ্রীগােপাল পালচৌধুরী, চন্ডীপুরের শ্রীহরি রায় প্রমুখ।
নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়কে বাংলার \’নানা সাহেব’ বলা হত। নদীয়ার বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসকে বলা হত বাংলার ওয়াট টাইলার। বিশ্বনাথ সর্দার বিশে ডাকাত নামে জনপ্রিয় হন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকার নীল কমিশন গঠন করেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম আইন দ্বারা নীলচুক্তি আইন রােধ করা হয়। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদন শুরু হলে ভারতে প্রায় নীলচাষ উঠে যায়। \’হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী নিয়মিত প্রকাশ করতেন। এর ফলে নীলকরেরা তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা আনেন ও তিনি পরাস্ত হন। দ্য ব্লু মিউটনি গ্রন্থটি লেখেন ব্লেয়ার কিং।
পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭২-১৮৭৬)
পূর্ববঙ্গের জমিদারদের বিরুদ্ধে পাবনা কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। সরকার শেষপর্যন্ত অস্ত্রের দ্বারা এই বিদ্রোহ দমন করেন এবং একটি কমিশন বসানাে হয় কৃষকদের দূরবস্থা জানার জন্য। এই বিদ্রোহের প্রধান নেতারা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়, শম্ভু পাল, কে মােল্লা। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন জমিদার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে রমেশচন্দ্র দত্ত লেখেন বাংলার কৃষক বিদ্রোহ।
দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ ১৮৭৫ : দক্ষিণাত্যে বােম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামের প্যাটেল বা মােড়লদের। দাক্ষিণাত্যে কৃষকরা সাউকার বা মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পুনা জেলার কার্দে গ্রামে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। কার্দে গ্রামের কালুরাম নামে জনৈক মারােয়াড়ি ঋণের দায়ে আবদ্ধ বাবাসাহেব দেশমুখ নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির জমিজমা ঘরবাড়ি আদালতের আদেশে দখল করে নিলে কৃষকরা একত্রিত হয়ে মহাজনদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট শুরু করে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে পুনা জেলার সুপা গ্রামে উন্মত্ত জনতা গুজরাটি মহাজনদের ঘরবাড়ি, দোকান, গদি লুট করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়, এবং প্রায় ৬০০০ কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ কমিশন নিয়ােগ করা হয়। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে দাক্ষিণাত্যে কৃষি সাহায্য আইন প্রবর্তিত হয়।
পাঞ্জাবের কৃষক অসন্তোষ (১৮৯০-১৯০০)
পাঞ্জাবের মহাজনদের জমি অধিগ্রহণের জন্য কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। সরকার ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব জমি হস্তান্তর আইন পাশ করান। এই আইনে কৃষকদের থেকে মহাজনদের হাতে জমি হস্তান্তর নিষিদ্ধ হয় এবং ২০ বছরের বেশি জমি মর্টগেজ নিষিদ্ধ হয়।
মােপলা বিদ্রোহ (১৯২১)
কেরলের মালাবার অঞ্চলে মুসলমান মােপলা কৃষকরা হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মােপলা বিদ্রোহ করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পুলিশেরা তিরুরঙ্গদি মসজিদে অস্ত্রখোজার নামে তল্লাশি চালালে পুলিশ, থানা, জমিদার ও মহাজনদের বাড়ি আক্রমণ করে। এরনাথ ও অলুভানাথ অঞ্চল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মােপলারা বিভিন্ন স্থানে রিপাবলিক গঠন করে। মােপলা বিদ্রোহের নেতারা ছিলেন কানহামমত গাজী, কলথিনগল মহম্মদ, আলি মুশালিয়ার, সিথি কয়ামঙ্গল ইত্যাদি। ব্রিটিশরা ২৩৩৭ বিদ্রোহীকে হত্যা করে, ১৬৫০ জনকে আহত করে এবং ৪৫০০০ বেশি লােককে বন্দী করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ৬৬ জনকে পুনুরের রেলের ওয়াগনের মধ্যে বন্দী রাখা হয় এবং শ্বাসকষ্টে তারা মারা যান।
বরদোলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮)
গুজরাটের বরদোলী জেলায় ২২% ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি হলে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নাে রেভিনিউ ক্যাম্পেন শুরু করেন। ব্রিটিশরা সেই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। সরকার একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়ােগ করেন। এই কমিটির সুপারিশে ভূমিরাজস্ব কমানাে হয়। এই সত্যাগ্রহের অনুসন্ধানের জন্য সরকার ম্যাক্সওয়েল ব্লুমফিল্ডকে নিয়ােগ করেন। কানভার্মি মেহেতা ও কল্যানজি মেহেতা, দুই ভাই এই আন্দোলন শুরুর জন্য সর্দার প্যাটেলকে অনুরােধ করেন। তারা জমিদার যুবক মণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেন।
শ্রেণীসচেতন কৃষক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব
১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে বিহারের কৃষকরা দারভাঙ্গার মহারাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। বীরেন্দ্র নাথ শাসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের কৃষক ও সম্পন্ন চাষিরা ইউনিয়ন বাের্ড বর্জন ও চৌকিদারি কর প্রদান বন্ধ করেন। ১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড় রায়বেরিলী, সুলতানপুর ও ফৈজাবাদের কৃষকরা বাবা রামচন্দ্র নামে ব্যক্তির নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে খাজনা ও বয়কট আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে জওহরলাল নেহেরু, বাবা রামচন্দ্র ও গৌরিশঙ্কর মিশ্র অযােধ্যা কিষান সভা স্থাপন করেন, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্দ্রনারায়ণ দ্বিবেদী ও গৌরিশঙ্কর মিশ্র উত্তরপ্রদেশ কিষানসভা প্রতিষ্ঠা করেন লক্ষ্ণৌতে। উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলীতে জিঙ্গারি সিং ও বাবা রামচন্দ্র কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯২২-২৪ খ্রিস্টাব্দে আপ্লুরি সিতারাম রাজুর নেতৃত্বে অন্ধ্রের গােদাবরী জেলার রুম্পা নামক আদিবাসীরা রুম্পা বিদ্রোহ শুরু করে। বাংলায় ফজলুল হক ও আদাম খাঁ কৃষকপ্রজা পার্টি স্থাপন করেন। পাঞ্জাবে ফজলি হােসেনের নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট দল গঠিত হয়। ১৯২৩ এন. জি, রঙ্গা রাইয়ত সভা প্রতিষ্ঠা করেন উত্তর প্রদেশের গুন্টুর জেলায়। তিনি এগ্রিকালচার লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এন. জি, রঙ্গা ও বি.ভি.রত্নম স্থাপন করেন অন্ধ প্রভিনশিয়াল রায়ত অ্যাসােসিয়েশান। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে এন. জি. রঙ্গা এবং ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় সাউথ ইণ্ডিয়ান ফেডারেশন অফ পিজ্যাণ্ট অ্যাণ্ড এগিকালচারাল লেবার। এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন এন. জি. রঙ্গা ও নাম্বুদিরিপাদ ছিলেন যুগ্মসচিব। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সারাভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ্ণৌতে। এর সভাপতি ছিলেন স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী ও জেনারেল সেক্রেটারী হন এন. জি. রঙ্গা। প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর কিষান দিবস পালন করা শুরু হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিহারের গয়া জেলার নিয়ামতপুরে সারাভারত কিষাণ সভার দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে জাতীয় কংগ্রেসের ফৌজপুর অধিবেশনে কিষান কংগ্রেসের ইস্তেহারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের বড়াবাঁকি, সীতাপুর ও বাহরাইচ জেলায় একা আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন শুরু হলেও সরকারি চাপে এটি ব্যর্থ হয়। মাদারি পাসি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশ তাকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেপ্তার করে।
বিজলিয়া আন্দোলন
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন শুরু হয় রাজস্থানের মেওয়াড়ে। সাধু সীতারাম দাস ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এর নেতৃত্ব দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ভুপ সিং ও তাকে সাহায্য করেন মানিকলাল ভার্মা। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তারা নাে রেভিনিউ আন্দোলন চালু করেন উদয়পুরের মহারাজার বিরুদ্ধে।
• উপজাতি আন্দোলনের তালিকা-
বিদ্রোহের নাম | সাল | সময় | নেতা |
1. কোট্টারােম্মান | তিরুনেলভেলি | ১৭৯২-৯৯ | বীরপাণ্ড কোট্টা বােম্মান |
2. পাইক বিদ্রোহ | উড়িষ্যা | ১৮০৪-০৬ | জগবন্ধু এবং খুড়দার রাজা |
3. ভেলুথাম্বি | ত্রিবাঙ্কুর | ১৮০৮-০৯ | দেওয়ান ভেলুথাম্বি |
4. রাওভার্মল | কচ্ছ ও কাথিয়াবাড় | ১৮৬১-৭৯ | রাও ভার্মল |
5. রামােসিস | পুনা | ১৮২২-২৯ | চিত্ত্বর সিং ও উমাজি |
6. কিট্টর বিদ্রোহ | কিটুর (কর্ণাটক) | ১৮২৪-২৯ | চান্নষ্ম ও রায়াপ্পা |
7. সম্বলপুর | সম্বলপুর | ১৮২৭-৪০ | সুরেন্দ্র সাঁই |
৪. সাতারা | সাতারা | ১৮৪০-৪১ | ধররাও পাওয়ার ও নরসিং দত্রেয় পাটকর |
9. বুন্দেল্লা | সাগর ও দামাে | ১৮৪২ | মধুকর শাহ ও জোয়াহির সিং |
10. গােতকারী | কোলাপুর | ১৮৪৪-৪৫ | |
11. শতবান্দি | শতবান্দি | ১৮৩৯-৪৫ | কেঁদে সাবন্ত ও আন্না সাহিব |
12. রাজু | বিশাখাপত্তনম | ১৮২৭-৩৩ | বীরভদ্র রাজু |
13. পালকোন্ডা | পালকোন্ডা | ১৮৩১-৩২ | পালকোন্ডার জমিদার |
14. গুমশুর | গুমশুর (উড়িষ্যা) | ১৮৩৫-৩৭ | ধনঞ্জয় ভাঞ্জা |
15. পাল্লাকিমেদি | পালাকিমেদি (উড়িষ্যা) | ১৮২৯-৩৫ | জগন্নাথ গজপতি নারায়ণ রাও |
16.সন্ন্যাসী | বাংলা | ১৭৭০ | ভবানী পাঠক, মজনু শাহ |
17. পাগলপন্থী | পূর্বাংলা | ১৮২৫ | করম শাহ ও টিপু মিঞা |
18. সুরাট লবণ আন্দোলন | সুরাট | ১৮৪৪ |
• উপজাতি বিদ্রোহের তালিকা-
বিদ্রোহের নাম | সাল | সময় | নেতা |
1. চুয়াড় বিদ্রোহ | মানভূম ও বরাভূম | ১৭৬৮-১৮৩২ | জগন্নাথ সিং, ধাতকর শ্যাম গঞ্জন, অচল সিং |
2, ভীল | খান্দেশ | ১৮১৮-৪৮ | – |
3. হাে | সিংভূম ও ছােটনাগপুর | ১৮২০, ১৮২২, ১৮৩২ | – |
4, কলি | সহ্যাদি পর্বত | ১৮২৪, ১৮২৮, ১৮৩৯, ১৮৪৪-৪৮ | – |
5. খাসি | খাসি পাহাড় | ১৮২৯-৩২ | তিরুত সিং ও মানিক |
6. সিংফো | আসাম | ১৮৩০-৩৯ | – |
7. কোয়া | রুম্পা অঞ্চল | ১৮৪০, ১৮৪৫, ৫৮, ৬১, ৭৯ | – |
৪. খােন্দ | উড়িষ্যা | ১৮৪৬-৪৮, ১৮৫৫, ১৯১৪ | চক্রবিষয় |
9. নাইক দাস | পাঁচমহল (গুজরাট) | ১৮৪২ | রূপ সিং ও জরিয়া ভগত |
10. কাছানাগা | কাছার (আসাম) | ১৮৮২ | শম্ভুদান |
11. ভীল | বানস ওয়ারা ও দুঙ্গাপুর। | ১৯১৩ | গােবিন্দ গুরু |
12. ওঁরাওন | ছােটনাগপুর | ১৯১৪-১৫ | যাত্রা ভগত |
13. কুকি | মনিপুর | ১৯১৭-১৯ | জাড়ােনাংরানি গুইডিলাে |
14. চেঞ্চ | নাল্লামালাহিল | ১৯২১-২২ | হনুমন্তু |
15. অহম | আসাম | ১৮২৮-৩৩ | গমধর কানাডার |
16. খােরােয়ার | পালামৌ | ১৮৭০ | ভগীরথ |
কোল বিদ্রোহ (১৮২০-১৮৩২)
বিহারের অন্তর্গত ছােটনাগপুরে ওঁরাও, মুণ্ডা, হাে ইত্যাদি কোল সম্প্রদায়ের লােকেরা বাস করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর কোল উপজাতির উপর জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর অত্যাচার বৃদ্ধি পেলে কোলরা বিদ্রোহের পথে যায়। ১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দে পােহাটের জমিদার ও ইংরেজ সেনাপতি বুওসেজ-এর বিরুদ্ধে চাইবাসার যুদ্ধে কোলরা পরাক্ত হয়। ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে কোলরা পুনরায় বিদ্রোহ ঘােষণা করে। বুদ্ধ ভগত, জয়া ভগত, বিন্দ্রাই সাঙ্কি, সুইমুণ্ডা প্রমুখ এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন। মানভূম, সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, ছােটনাগপুর ইত্যাদি স্থান এই বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল। কোলরা বহিরাগতদের ‘দিকু’বলত। লর্ড বেন্টিঙ্কের নির্দেশে ক্যাপ্টেন উইলকিনসন কোলদের পরাস্ত করেন। কোলদের শান্ত করতে সরকার দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করেন। কোল বিদ্রাহের বিস্তৃত বিবরণ জানা যায় জগদীশ চন্দ্র ঝা এর লেখা ‘দ্য কোল রেবেলিয়ান’ গ্রন্থ থেকে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫)
সাঁওতালদের নিজস্ব এলাকাকে দামিন-ই-কোহ বলা হত। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে এক সমীক্ষায় জানা যায় এই এলাকাতে মােট ৪৩৭টি গ্রামে ৪২ হাজার ৭১৫ জন সাঁওতাল বাস করত। অসৎ ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের কাছ থেকে জিনিস কেনার সময় বেশি ওজনের বাটখারা এবং বিক্রির সময় কম ওজনের বাটখারা ব্যবহার করত। এটি ‘কেনারাম বেচারাম নীতি’ নামে পরিচিত। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সিধু, কানু, চাদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে মিলিত হয়ে ফুল বা বিদ্রোহের শপথ নেয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হূলের প্রতীক ছিল শালগাছ। বিদ্রোহের প্রথম দিকে বীর সিং, লিকা মাঝি, কালাে প্রামানিক, ডােমন মাঝি প্রমুখেরা নেতৃত্ব দেন। ডালহৌসীর নির্দেশে ইংরেজ সেনাপতি জারভিস সাঁওতালদের দমন করেন। সাঁওতালরা মহেশ দারােগা ও তার সহকর্মীকে হত্যা করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতালদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনার সৃষ্টি হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফরেস্ট অ্যাক্ট পাশ হয়। সাঁওতাল সমাজে মাঝি ও মুলিয়াদের বিশেষ অধিকারকে সরকার অস্বীকার করলে তারা খেরওয়ার আন্দোলন শুরু করেন।
মুণ্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০)
ছােটনাগপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুণ্ডা আদিবাসীরা বাস করত। মুণ্ডা কথার অর্থ গ্রামপ্রধান। মুণ্ডারা তাদের পূর্বপূরুষদের বলত খুন্দ কটিদার এবং তাদের দখলকরা জমিকে বলত খুদকন্টি। মুণ্ডা নেতা বীরসামুণ্ডা ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। রাঁচির উলিহাতু গ্রামে বীরসা জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন সুগানমুণ্ডা। বীরসা মিশনারী স্কুলে পড়াশুনাে করেন ও খ্রিস্টান ধর্ম নেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক নতুন দর্শনের উদ্ভব করে নিজেকে ধরিত্রীর পিতা বলে ঘােষণা করেন এবং সিংবেঙা বা সূর্যদেবতার উপাসনা প্রবর্তন করেন। বীরসামুণ্ডা মুণ্ডা সম্প্রদায়ের কাছে প্রফেট বা গুরু হয়ে ওঠেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাঁচির পুলিশ অধিকর্তা মিথারেস চলক নামক স্থান থেকে বীরসামুণ্ডাকে গ্রেপ্তার করেন ও তাঁর দুবছর জেল হয়। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ছাড়া পান। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুণ্ডা বিদ্রোহ শুরু হয়। শৈলরাকার পাহাড়ে এক যুদ্ধে মুণ্ডা সেনাপতি গয়ামুণ্ডা মারা যান। মুণ্ডা বিদ্রোহ উলগুলান বা বিপজ্জনক নামে পরিচিত। উলগুলানের নেতা ছিলেন বীরসামুণ্ডা। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন রাঁচির জেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে কলেরায় বীরসামুণ্ডার মৃত্যু হয়।