আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচার | Law Liberty Equality and Justice
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
১। “আইন হল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ”, উক্তিটি কার?
উত্তর : “আইন হল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ” বলেছেন বোদা।
২। সাম্যের জন্য আবেগ স্বাধীনতার আশাকে নির্মূল করে’—উক্তিটি কার?
উত্তর ‘সাম্যের জন্য আবেগ স্বাধীনতার আশাকে নির্মূল করে’—বলেছেন লর্ড অ্যাক্টন।
৩। সাম্য একটি পরিবর্তনশীল ধারণা’ উক্তিটি কার?
উত্তর ‘সাম্য একটি পরিবর্তনশীল ধারণা’- বলেছেন কার্ল মার্কস।
৪। “সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্বই সম্ভব নয়”-কে বলেছেন?
উত্তর : “সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্বই সম্ভব নয়”—একথা বলেছেন রুশাে।
৫। “রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণনিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মগুলি হল আইন”-কার উক্তি ?
উত্তর : “রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণনিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মগুলি হল আইন” বলেছেন হল্যান্ড।
৬। “সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতিই আইনের রূপ লাভ করে”—উক্তিটি কার ?
উত্তর : “সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতিই আইনের রূপ লাভ করে”-উক্তিটি হল হেনরি মেইনের।
৭। “আইন সার্বভৌমের আদেশ”—একথা বলেছেন কে ?
উত্তর : “আইন সার্বভৌমের আদেশ”—একথা বলেছেন অস্টিন।
৮। “মানুষের যুক্তিহীন শক্তি ও মদমত্ততা আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তব রূপায়ণে প্রধান বাধা”কার উক্তি ?
উত্তর “মানুষের যুক্তিহীন শক্তি ও মদমত্ততা আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তব রূপায়ণে প্রধান বাধা’—একথা বলেছেন রাসেল।
৯। “সাধারণ ইচ্ছা জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছার সমষ্টি এবং সমাজ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী”—এই অভিমত কার ?
উত্তর “সাধারণ ইচ্ছা জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছার সমষ্টি এবং সমাজ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী”—এই উক্তিটি করেছেন রুশাে।
১০। “কেবল রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত, ঘােষিত ও প্রযুক্ত হলেই আইন হয় না’—উক্তিটি কার ?
উত্তর : আর্নেস্ট বার্কার বলেছেন—“কেবল রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত, ঘােষিত ও প্রযুক্ত হলেই আইন হয় না।”
১১। ‘Utopia’ গ্রন্থটির লেখক কে?
উত্তর : টমাস মুর হলেন ‘Utopia’ গ্রন্থটির লেখক।
১২। ‘On Liberty’ গ্রন্থটির লেখক কে ?
উত্তর : জন স্টুয়ার্ট মিল হলেন ‘On Liberty’ গ্রন্থের লেখক।
১৩। “স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরােধী”- কার উক্তি?
উত্তর : “স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরােধী”- এই অভিমতটি হল লর্ড অ্যাক্টন ও আলেক্সির।
১৪। “আইন হল সমাজে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণির ইচ্ছার প্রকাশ”-উক্তিটি কার?
উত্তর : মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন-“আইন হল সমাজে প্রতিক্তিশালী শ্রেণির ইচ্ছার প্রকাশ।
৫। আইনের উৎস সাধারণত কয়টি?
উত্তর : আইনের উৎস সাধারণত ৬টি।
১৬। “আইন হল সমাজের প্রচলিত চিন্তাধারা ও অভ্যাসের সেই অংশ মা সুস্পষ্ট বিধিতে পরিণত”—এই অভিমতটি কার?
উত্তর : “আইন হল সমাজের প্রচলিত চিন্তাধারা ও অভ্যাসের সেই অংশ যা সুস্পষ্ট বিধিতে পরিণত”—এই উক্তিটি করেছেন উড্রো উইলসন।
১৭। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের লেখক কে?
উত্তর : ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের লেখক হলেন প্লেটো ।
১৮। ‘স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বােঝায়’—একথা বলেছেন কে?
উত্তর : ‘স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বােঝায়’—একথা বলেছেন অধ্যাপক ল্যাস্কি।
১৯। স্বাধীনতার শর্ত কী ?
উত্তর আইন হল স্বাধীনতার শর্ত।
২০। আইনের উৎস কী?
উত্তর : আইনের উৎস হল ন্যায়বিচার।
২১। মানুষের কেবলমাত্র বহির্জীবনের আচার- আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে কে ?
উত্তর : আইন মানুষের কেবলমাত্র বহির্জীবনের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২২। ‘আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য উভয়ই থাকা দরকার’—একথা বলেছেন কে ?
উত্তর : অধ্যাপক বার্কার বলেছেন, ‘আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য উভয়ই থাকা দরকার।’
২৩। ‘গণতন্ত্র’ কথাটি সংবিধানের কোথায় স্থান পেয়েছে ?
উত্তর : ‘গণতন্ত্র’ কথাটি সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে।
২৪। “স্বাধীনতার মতাে অন্য কোনাে ধারণা এত বিচিত্র তাৎপর্য বহন করেনি এবং মানবমনে এত বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি’—উক্তিটি কার ?
উত্তর : “স্বাধীনতার মতাে অন্য কোনাে ধারণা এত বিচিত্র তাৎপর্য বহন করেনি এবং মানবমনে এত বিচিত্র প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি করেনি, একথা বলেছেন ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু।
২৫। “রাষ্ট্রের স্বাধীনতা কখনােই প্রত্যেকের অবাধ স্বাধীনতা হতে পারে না; তা হল সব সময় সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতা”—একথা বলেছেন কে ?
উত্তর “রাষ্ট্রের স্বাধীনতা কখনােই প্রত্যেকের অবাধ স্বাধীনতা হতে পারে না; তা হল সব সময় সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতা”—একথা বলেছেন অধ্যাপক বার্কার।
২৬। “মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সে আজ সর্বত্রই শৃঙ্খলাবদ্ধ”—একথা বলেছে কে?
উত্তর “মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সে আজ সর্বত্রই শৃঙ্খলাবদ্ধ”—একথা বলেছেন বুশাে।
২৭। “অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে মানুষের কাছে অন্যান্য স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়”—এই অভিমত কাদের ?
উত্তর “অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে মানুষের কাছে অন্যান্য স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়”—এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন মার্কসবাদী দার্শনিকগণ।
২৮। “শােষক ও শােষিত এবং ভুরিভােজী ও ক্ষুধার্তদের মধ্যে সাম্যকে আমরা কখনােই স্বীকার করি না”—উক্তিটি কার?
উত্তর : “শােষক ও শােষিত এবং ভুরিভােজী ও ক্ষুধার্তদের মধ্যে সাম্যকে আমরা কখনােই স্বীকার করি না”—এই উক্তিটি করেছেন লেনিন।
২৯। “A Grammar of Politics” গ্রন্থের লেখক কে?
উত্তর “A Grammar of Politics” গ্রন্থের লেখক হলেন অধ্যাপক ল্যাস্কি।
৩০। “অর্থনৈতিক সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়”—একথা বলেছেন কে?
উত্তর : “অর্থনৈতিক সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়”—একথা বলেছেন ল্যাস্কি।
৩১। “Principles of Social and Political Theory” গ্রন্থটির লেখক কে ?
উত্তর : “Principles of Social and Political Theory’গ্রন্থটির লেখক হলেন আর্নেস্ট বার্কার।
৩২। “জাস্টিস” (Justice) শব্দটি কোন্ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয় ?
উত্তর “জাস্টিস” শব্দটির উৎপত্তি হয় লাতিন শব্দ ‘জাস্টা’ (Justus) ও ‘জাস্টিসিয়া’ (Justitia) থেকে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১। আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর : আইন হল রাষ্ট্রের দ্বারা সৃষ্ট, স্বীকৃত ও প্রযােজ্য সেই সমস্ত নিয়মকানুন যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন কথাটি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই দিক দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন বলতে সাধারণভাবে সেই সমস্ত নিয়মকানুনকেই বােঝায় যা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এককথায় রাষ্ট্রের নিয়মকানুনই হল আইন।
প্রশ্ন ২। আইনের উৎসসমূহ কী ?
উত্তর : আইনের উৎসগুলি হল—প্রথা, ধর্ম, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত, পণ্ডিত ব্যক্তিগণের আলােচনা, ন্যায়বিচার এবং আইনসভা বা আনুষ্ঠানিক আইন প্রণয়ন।
প্রশ্ন ৩। আইনের বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর : (i) আইন নিয়মের সমষ্টি, এর লক্ষ্য বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা, (ii) আইন মানুষকে অধিকার দেয়, (iii) আইন সার্বজনীন, (iv) আইন সার্বভৌম শক্তির দ্বারা সৃষ্ট, (v) আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়।
প্রশ্ন ৪। আইনের মার্কসীয় সংজ্ঞা কী ?
উত্তর : মার্কস ও মার্কসবাদীরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। মার্কসের মতে, আইন বলতে বােঝায় রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের সমষ্টি যা শাসক শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে। যার দ্বারা বড়ােলােক শ্রেণি উপকৃত হয়।
প্রশ্ন ৫। অস্টিন প্রদত্ত আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর : অস্টিনের মতে, আইন সার্বভৌমের আদেশ। এই আইনের পশ্চাতে সবচেয়ে বড়াে সমর্থন হল রাষ্ট্র কর্তৃত্ব। আইন মান্য না করলে আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি পেতেই হবে।
প্রশ্ন ৬। আইনের অনুশাসন কাকে বলে?
উত্তর : আইনের অনুশাসন ব্যক্তিস্বাধীনতাকে রক্ষা করে। এর অর্থ হল, ‘আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের অনুশাসনের রূপকার অধ্যাপক ডাইসির মতে, কোনাে অবস্থাতেই আইনের প্রয়ােগে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গভেদে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে তারতম্য করা যাবে না। সকলের ক্ষেত্রে আইন একইভাবে প্রযােজ্য হবে।
প্রশ্ন ৭। অর্পিত আইন বলতে কী বােঝ?
উত্তর : আইনসভা মুলত আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু যখন আইনসভা আইনের মূল লক্ষ করে আইনটিকে সম্পূর্ণ করবার দায়িত্ব শাসন বিভাগের ওপর অর্পণ করে এবং শাসন বিভাগ এই ক্ষমতাবলে যে আইন প্রণয়ন করে তাকেই অর্পিত আইন (Delegated Legislation) বলে। একে আবার অধস্তন আইন প্রণয়ন (Subordinate Legislation) বলা হয়।
প্রশ্ন ৮। আইনকে কোন অর্থে ‘সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ’ বলা হয় ?
উত্তর : সাধারণ ইচ্ছা সমাজের সকল জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছার (Real Will) সমষ্টি। বুশাের মতে সাধারণ ইচ্ছাই সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে প্রণীত আইনকে সেই কারণেই সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ’ বলে রুশাে অভিহিত করেছেন। সমাজে কোনাে ব্যক্তি আইন অমান্য করলে মনে করতে হবে যে সেই ব্যক্তি অপ্রকৃত ইচ্ছার (Unreal Will) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে সাধারণ ইচ্ছার অনুগামী হতে অর্থাৎ আইন মান্য করে চলতে বাধ্য করা হবে।
প্রশ্ন ৯। আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?
উত্তর : লরেন্সের (S. T. Lawrence) মতে, যে-সকল নিয়মকানুন দ্বারা সভ্য রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত এবং পারস্পরিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়, তাকেই আন্তর্জাতিক আইন বলে। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে স্বীকার করতে চান না।
প্রশ্ন ১০। আন্তর্জাতিক আইনের উৎস কী?
উত্তর : প্রথা ও চুক্তিকেই সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস বলে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালতের বিধির ৩৮ ধারায় (Article 38,Statute of International Court of Justice) আন্তর্জাতিক আইনের যে উৎসগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল—(ক) সাধারণ বা বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা সৃষ্ট নিয়মাবলি যা বিবদমান রাষ্ট্রগুলি স্বীকার করে নেয়, (খ) আইনের মতাে বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রথাসমূহ, (গ) সভ্য রাষ্ট্রগুলির দ্বারা স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মাবলি এবং (ঘ) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত ও খ্যাতনামা আইনবিদগণের প্রকাশিত রচনাসমূহ।
প্রশ্ন ১১। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না কেন?
উত্তর : আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ—(ক) আন্তর্জাতিক আইনগুলি সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট নয়। (খ) আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের শাস্তি দেবার ক্ষমতা নেই। (গ) প্রতিটি রাষ্ট্র সার্বভৌম বলে তাদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে আইনকে চাপানাে যায় না। (ঘ) আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করার জন্য কোনাে বিশ্ব আইনসভা নেই।
প্রশ্ন ১২। আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
উত্তর : প্রথমত, আইন মানুষের বাহ্যিক আচার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু নৈতিক বিধি বাহ্যিক আচার-আচরণ, চিন্তা সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। দ্বিতীয়ত, আইন রচিত হয়। কিন্তু নৈতিক বিধি নিয়ম মেনে রচনা করা হয় না। তৃতীয়ত, আইন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, কিন্তু নৈতিক বিধি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। চতুর্থত, আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন থাকে, আইন ভঙ্গ করলে দৈহিক শাস্তি ভােগ করতে হয়। নৈতিক বিধি ভঙ্গের জন্য কোনাে দৈহিক শাস্তির সুযােগ থাকে না। নীতিহীন কাজের শাস্তি হল সামাজিক নিন্দা ও বিবেকের দংশন।
প্রশ্ন ১৩। স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : স্বাধীনতা নেতিবাচক অর্থে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বােঝায়। কিন্তু ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা বলতে আত্মবিকাশের সুযােগ বােঝায়। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা বলতে সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ বােঝায়, যেখানে মানুষ জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ খুঁজে পায়।
প্রশ্ন ১৪। ব্যক্তিস্বাধীনতা বা পৌরস্বাধীনতা কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর : যে-সকল অধিকার ভােগ দ্বারা মানুষ তার ব্যক্তিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধন করতে পারে, তাকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বা পৌরস্বাধীনতা বলে। সম্পত্তির অধিকার, ধর্মের অধিকার, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার উল্লেখযােগ্য উদাহরণ।
প্রশ্ন ১৫। স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা কী?
উত্তর : স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটলে স্বাধীনতা ভােগ করা সম্ভব বলে এই তত্ত্বের সমর্থকরা বিশ্বাস করে। বুর্জোয়া ধারণায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অপেক্ষা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অধিক গুরুত্ব পায়। বুর্জোয়া তত্ত্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র বলে গণ্য করে। আর্থিক অসাম্য, স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং মুষ্টিমেয় বাছাই লােকের শাসন বুর্জোয়া স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন ১৬। স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা কী?
উত্তর : মার্কসীয় দৃষ্টিতে স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণবিহীনতা নয়। ইতিবাচক অর্থে সকল প্রকার শােষণের অবসানে মানুষের সামাজিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করার কথা বলা হয়। স্বাধীনতা হল মানুষের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযােগ যা শােষণভিত্তিক ব্যবস্থার অবসান ঘটলে সম্ভব হতে পারে। সুসংহত দৃষ্টিতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন ১৭। রাজনৈতিক স্বাধীনতা কাকে বলে ?
উত্তর : জনগণ যাতে দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার সুযােগসুবিধা লাভ করে, সেই ব্যবস্থা থাকাই হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। যথা—ভােটদানের অধিকার, সরকারের গঠনমূলক সমালােচনার অধিকার প্রভৃতি।
প্রশ্ন ১৮। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে দারিদ্র বা ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি বােঝায়। দৈনন্দিনের অন্নসংস্থানে যুক্তিসংগত অর্থ খুঁজে পাওয়ার সুযােগ ও নিরাপত্তা হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। কর্মের অধিকার, অবকাশের অধিকার, বেকার-বার্ধক্য ভাতা পাওয়ার অধিকার, অক্ষমতার রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি এর উদাহরণ।
প্রশ্ন ১৯। জাতীয় স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর জাতীয় স্বাধীনতা বলতে বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ততা বােঝায়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট ইংরেজ শাসনমুক্ত হয়ে ভারত জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করে।
প্রশ্ন ২০। আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কী?
উত্তর : আপাতদৃষ্টিতে আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরােধী মনে হয়। মিল, স্পেন্সার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, আইন রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন বা খর্ব করে। কিন্তু একথা সত্য বলে গ্রহণ রা যায় না। স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত না হলে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অধ্যাপক বার্কার বলেন যে, প্রত্যেরে স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা সকলের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীনতা সমাজের সকলের। সুতরাং, সকলের স্বাধীনতা সম্ভব করতে প্রত্যেরে অনিয়ন্ত্রণ স্বীকার করা যায় না। সুতরাং, রাষ্ট্রের আইন দ্বারা অনুমােদিত স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। আইনই স্বাধীনতার শর্ত বলা যায়।
প্রশ্ন ২১। সাম্য কাকে বলে?
উত্তর : সাধারণভাবে সাম্য বলতে সকলে সমান বােঝায়। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শারীরিক ও মানসিক গঠনের দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। সুতরাং, সাম্য বলত ব্যবহারের অভিন্নতা বােঝায়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সাম্য বলতে সুযােগের সমতা বােঝায়। মার্কসীয় দৃষ্টিতে সাম্য বলতে সমাজের শ্রেণিবিভাগ বিলােপের কথা বলা হয়। সকলের সমান সুযােগ এবং বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি—এই দুটিই হল সাম্যের মূলকথা।
প্রশ্ন ২২। সাম্য কয় প্রকার ও কী কী?
উত্তর : সাধারণ দৃষ্টিতে বিচার করলে সাম্যকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল—(ক) সামাজিক সাম্য, (খ) আইনগত সাম্য এবং (গ) স্বাভাবিক সাম্য। এই আইনগত সাম্যের আবার তিনটি রূপ আছে-(i) অর্থনৈতিক সাম্য, (ii) রাজনৈতিক সাম্য এবং (iii) ব্যক্তিগত সাম্য।
প্রশ্ন ২৩। ল্যাস্কির মতে সাম্যের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে।
উত্তর : (ক) কোনাে বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি এবং (খ) সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযােগসুবিধা।
প্রশ্ন ২৪। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করে একথা বলা যায় যে, প্রকৃত অর্থে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণগুলিকে উৎপাটিত করতে হবে এবং সেইসঙ্গে এমন এক পরিবেশের সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করতে হবে যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি তার যােগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযােগ পায়। মার্কসবাদীদের মতে, বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত সাম্য কখনােই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
প্রশ্ন ২৫। পুঁজিবাদী সমাজে সাম্যের প্রকৃতি পর্যালােচনা করাে।
উত্তর : সামন্তসমাজের গর্ভ থেকে উদ্ভূত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণি সাম্যের দাবিতে সােচ্চার হলেও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে সাম্যের আদর্শের কথা ঘােষণা করা হয় তার প্রকৃতি ছিল মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য অর্থহীন হয়ে যায়। যদিও পুঁজিবাদী সমাজই হল প্রথম সমাজ যেখানে আইনের চোখে সাম্যের দাবি প্রথম উথিত হয় এবং সাম্যের অধিকারের আইনগত স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম শুরু হয়।
প্রশ্ন ২৬। সামাজিক সাম্য কাকে বলে?
উত্তর : জাতি, ধর্ম, বংশ, বর্ণ বা অর্থ কৌলিন্যের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে প্রভেদ করা হলে সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে না। কিন্তু যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ প্রভৃতির ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য করা হয় না, সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতকায় ও কৃয়কায় মানুষের মধ্যে সামাজিক দিক থেকে বৈষম্য করা হয়, তাই সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে না।
প্রশ্ন ২৭। রাজনৈতিক সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভােগের সুযােগকেই রাজনৈতিক সাম্য বলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে, সুস্থ মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্কের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযােগ থাকলে রাজনৈতিক সাম্য বর্তমান বলা যায়। নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযোগকে রাজনৈতিক সাম্য বলা যায়।
প্রশ্ন ২৮। স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক কী ?
উত্তর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যাক্টন, টকভিল প্রমুখ মনে করেন যে, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরােধী। সাম্যের জন্যে আবেগ স্বাধীনতাকে নির্মূল করে। বাস্তবে সাম্য স্বাধীনতার বিরােধী নয়, পরিপূরক। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সমাজে বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব থাকলে ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্ভব হয় না। আর. এইচ. টনি বলেন, স্বাধীনতা বলতে যদি মানবাত্মার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার বােঝায়, তাহলে একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজেই সেই স্বাধীনতা সম্ভব। সুতরাং সাম্য কখনই স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না।
প্রশ্ন ২৯। স্বাভাবিক সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর স্বাভাবিক সাম্য বলতে বােঝায় যে, মানুষ জন্মগত ভাবে সমান সুযােগসুবিধার অধিকারী। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণায় স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব স্বীকৃত হয়। কিন্তু জন্মগতভাবে দেহ মনে সব মানুষ সমান হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানুষের স্বাভাবিক বৈষম্যকে স্বীকার করেই সাম্য তত্ত্বে প্রচার করা হয়। বর্তমানে স্বাভাবিক সাম্য তত্ত্ব অবাস্তব বলে মনে করা হয়।
প্রশ্ন ৩০। সাম্যের মূলকথা কী ?
উত্তর বাস্তবক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মানসিক পার্থক্য থাকে। তাই সাম্য বললে ব্যবহারের অভিন্নতা বােঝায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির মত অনুসারে সাম্য বলতে মূলত দুটি বিষয় বােঝায়—ক) বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি ও (খ) সকলের জন্য উপযুক্ত সুযােগসুবিধার ব্যবস্থা করা।
প্রশ্ন ৩১। সকল আইনই কি স্বাধীনতার সহায়ক?
উত্তর : সমাজবদ্ধ মানুষ কখনও অবাধ স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন বা নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সকলের স্বাধীনতা ভােগ সম্ভব হয়। কিন্তু আইন সৃষ্টি হয় সরকারের দ্বারা। সরকার মুষ্টিমেয় ব্যক্তি নিয়ে গঠিত। সুতরাং, সরকারের আইন সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সহায়ক হতে পারেনা। ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী আইন মান্য করার অর্থ ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা। তাই আইন সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতার সহায়ক হয় না।
প্রশ্ন ৩২। ন্যায়ের ধারণাকে কটি দিক দিয়ে বিচার করা যায় ও কী কী?
উত্তর : ন্যায়ের ধারণাকে ৪টি দিক দিয়ে বিচার করা যায়। যেমন—(ক) আইনগত, (খ) রাজনৈতিক, (গ) সামাজিক ও (ঘ) অর্থনৈতিক।
প্রশ্ন ৩৩। ন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণে অসুবিধা কী?
উত্তর : ন্যায়ের ধারণা কোনাে স্বতন্ত্র ধারণা নয়, সমাজব্যবস্থার আচার-আচরণ ও মূল্যবােধের সঙ্গে ন্যায়ের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১) আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর : সাধারণভাবে আইন বলতে কোনাে নির্দিষ্ট নীতি-নিয়ম বােঝায় যা স্বাভাবিকভাবে সকলে মান্য করে চলে। প্রাকৃতিক জগতের ঘটনাবলির মধ্যে যে কার্যকরণ সম্পর্ক দেখা যায় তার পেছনেও নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। তা বৈজ্ঞানিক বিধি (Scientific Laws) বলে পরিচিত। সামাজিক মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও নিয়মকানুন রয়েছে। মনের চিন্তা, ধ্যানধারণা, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নিয়মকে নৈতিক বিধি (Moral Laws) বলে অভিহিত করা যায়। সমাজবদ্ধ মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবার নিয়মকানুন সামাজিক আইন বা রাজনৈতিক আইন বলে অভিহিত করা হয়। সামাজিক প্রথা, ঐতিহ্য, ফ্যাশন, আচার-ব্যবহারের মধ্যে সামাজিক আইনের (Social Laws) প্রকাশ হয়। সামাজিক আইনের পিছনে জনমতের সমর্থন থাকে এবং সামাজিক আইন অমান্য করলে নিন্দাভাজন হবার ও সামাজিক ধিক্কার বা সমাজচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক আইন রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট ও বলবৎ হয়ে থাকে; এটি মান্য করলে নির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থাও থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের সৃষ্ট এই আইনই প্রধান আলােচ্য বিষয়।
আইনের সংজ্ঞা সম্পর্কেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অস্টিন একে ‘সার্বভৌমের আদেশ’ বলেছেন। ঐতিহাসিক মতবাদে বিশ্বাসী স্যাভিনী (Savigny), হেনরি মেইনের (Henry Maine) মতে, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতিই আইনের রূপ লাভ করে থাকে। আইনানুগ সার্বভৌমের রচিত আইন ছাড়া প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে গঠিত আইনও সমাজে স্বীকৃত। পাউন্ড এর মতে, সাধারণ ও নিয়মিত বিচার বিভাগীয় সংস্থা বিচারকার্য সম্পাদনে যে নিয়মগুলি স্বীকার ও প্রয়ােগ করে তাই আইন। জারস্কিনের মতে, প্রজাদের পক্ষে বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলবার জন্য সার্বভৌমের আদেশই আইন। হল্যান্ড (Holland) বলেন, “রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মগুলি হল আইন।”
রাষ্ট্রপতি উইলসন আইন সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় করে বলেছে, আইন হল মানুষের স্থায়ী আচার ব্যবহার ও চিন্তার সেই অংশ যা রাষ্ট্র কর্তৃক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং যার পিছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে। সহজভাবে বলা যায় যে, আইন হল মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী এমন কতকগুলি নিয়ম যা অমান্য করলে রাষ্ট্রীয় শক্তি শাস্তিবিধান করে থাকে।
প্রশ্ন ২) আইনের যে-কোনাে চারটি উৎস লেখাে।
উত্তর : আইনের চারটি উৎস হল
• (ক) প্রথা প্রথাকেই আইনের প্রাচীনতম উৎস বলে গণ্য করা যেতে পারে। সমাজজীবনে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি প্রথায় পরিণত হয়। প্রথাগুলি আইন না হলেও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের দ্বারা স্বীকৃত হয়ে আইনের মর্যাদা লাভ করে।
• (খ) ধর্ম
প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। ধর্মীয় অনুশাসনকে লােকে অমােঘ বলে মনে করত। আইন ও ধর্মের মধ্যে সে যুগে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। সামাজিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়ােজনীয় বিধিনিষেধগুলি ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং ধর্ম প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে আইনের বিবর্তনে সহায়তা করেছিল।
• (গ) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত
নতুন নতুন পরিবেশ, মানুষের জীবনযাত্রার পার্থক্য, জটিলতা প্রভৃতি কারণে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার নানা সমস্যার উদ্ভব হয়। সমাজজীবনের জটিলতার জন্য প্রথা ও ধর্ম পূর্ব উপযােগিতা হারিয়ে ফেলে, সমাজের দ্বন্দ্ব মীমাংসার দায়িত্ব এসে পড়ল রাজা বা দলপতির উপর। প্রথা ও ধর্মের অসম্পূর্ণতার ক্ষেত্রে দলপতি বা রাজা আপন বিচারবুদ্ধির প্রয়ােগ করে বিরােধের মীমাংসা করতেন। এই বিচারের রায় ভবিষ্যতে আইন বলে গণ্য হল।
• (ঘ) বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা
কোনাে দেশের আইনব্যবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা আইনের উৎস বলে গণ্য হয়। আইনের নানা অর্থ হতে পারে, সুতরাং আইনের সঠিক অর্থ ব্যাখ্যার বিশেষ প্রয়ােজন। পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয় এবং সমকালীন সমাজে তার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। আইনজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিগণের মতামত সরাসরি আইন বলে গণ্য হয় না; কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও আলােচনা দ্বারা আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। বিচারকগণ বিচারের ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ স্বীকার করে রায় দান করেন।
প্রশ্ন ৩) আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর : আইনের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায় সেগুলি (ক) আইন কতকগুলি বিধিবদ্ধ নিয়ম যা সকলে মান্য করে চলে। (খ) আইন মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ; মানুষের চিন্তা ও অনুভূতির সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই। (গ) আইন নির্দিষ্ট ও সর্বজনীন; সমাজের সকল ব্যক্তির ওপর সমানভাবে প্রযােজ্য। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। (ঘ) আইনের বাধ্যতামূলক রূপ রয়েছে ; রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি আইন বলবৎ করে থাকে। আইন অমান্য করলে দৈহিক শান্তি লাভ করতে হয়। (ঙ) আইনের প্রাধান্যমূলক ভূমিকা শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় এর প্রয়ােজনীয়তা সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। সভ্য সমাজ জীবনযাপনের জন্য আইন একান্ত প্রয়ােজন তা অস্বীকার করা যায় না।
প্রশ্ন ৪) আইনের অনুশাসনের অর্থ কী?
উত্তর : ঊনবিংশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ধারণার সম্প্রসারণের ফলে অধ্যাপক এ. ভি. ডাইসি আইনের অনুশাসন সম্পর্কিত তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত ‘An Introduction to the Law of the Constitution’ নামক গ্রন্থে এই ধারণা প্রকাশ করেন।
ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্বটি তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত :
প্রথমত, আইনের অনুশাসন অনুযায়ী আইনের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যতীত কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এই নীতি অনুযায়ী দেশের মধ্যে আইন হল চরম।
দ্বিতীয়ত, আইনের অনুশাসন অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। কোনাে ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সামাজিক পদমর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক সাধারণ আইনের অধীন।
তৃতীয়ত, ডাইসির ব্যাখ্যানুযায়ী ব্রিটেনে নাগরিকের অধিকার সাংবিধানিক ঘােষণার ফলশ্রুতি নয়। অন্যদিকে নাগরিকের অধিকার সমষ্টি প্রথাগত আইন দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।
অধ্যাপক ডাইসির আইনের অনুশাসন সম্পর্কিত ধারণাটি নিঃসন্দেহে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। তথাপি দেশের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য বাস্তব রূপ গ্রহণ করতে পারে না।
প্রশ্ন ৫) আইনের বাধ্যবাধকতা বলতে কী বােঝ?
উত্তর : প্রতিটি রাজনৈতিক সমাজে মানুষ নির্দ্বিধায় আইন মান্য করে। প্রাচীনযুগে আইনের ভিত্তি ছিল ধর্মবােধ। মানুষ আইনকে ঐশ্বরিক বিধানরূপে গণ্য করত। বর্তমানে আইনের ভিত্তি সম্পর্কে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। হবস, বেন্থাম, অস্টিন প্রমুখ মনে করেন যে, আইন হল সার্বভৌমের আদেশ, আইনের পশ্চাতে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন বর্তমান। সুতরাং, সার্বভৌম শক্তির ভয়ে মানুষ আইনকে মান্য করে। কিন্তু রুশাে এবং অন্যান্য আদর্শবাদীগণ আইনকে সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ মনে করেন। সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে সর্বসাধারণের কল্যাণ নিহিত আছে। সুতরাং আইন জনগণের কল্যাণসাধন করে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, আইনের অনুমােদন জনগণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। জনগণের সম্মতি বা ইচ্ছাই হল আইনের বাধ্যবাধকতার ভিত্তি।
হেনরি মেইন প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ হবস এবং রুশাের ধারণার সমন্বয়সাধন করেন। তাঁর মতে, আইনের অনুমােদন জনগণের সম্মতি এবং সার্বভৌম শক্তি উভয়ের উপর নির্ভরশীল। সার্বভৌম শক্তির ভয় আইনের বাধ্যবাধকতার আংশিক কারণরূপে গণ্য করা যায়। কিন্তু জনমত আইনকে শক্তিশালী করে। ম্যাকাইভারের মতে, জনগণের ইচ্ছা বা সম্মতি আইনের অনুমােদনের ভিত্তি হলেও আইন বাধ্যতামূলকভাবে চালিত হয়। তাঁর মতে—The root of obedience to law is not coercion but the will to obey. অধ্যাপক বার্কার মনে করেন যে, আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য উভয়ের সমন্বয় ঘটানাে উচিত। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী বৈষম্যমূলক সমাজে আইনের পশ্চাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থন থাকে। প্রশ্ন ৬ আন্তর্জাতিক আইনকে কী প্রকৃত আইন বলা যায় ? আইনের সংকীর্ণ সংজ্ঞা পরিহার করে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে আন্তর্জাতিক আইনকে নিঃসন্দেহে আইন বলে গণ্য করা যায়। হল (Hall), লরেন্স (Lawrence), পােলক (Fredrick Pollock), ওপেনহেইম (Oppenheim) প্রমুখ আধুনিক লেখকগণ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলার পক্ষপাতী। কারণ—
প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইনও রাষ্ট্রীয় আইনের ন্যায় সাধারণভাবে স্বীকৃত। যে-কোনাে রাষ্ট্রনৈতিক সম্প্রদায়ের সদস্যগণের জীবনযাত্রা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্যে তাদের দ্বারা স্বীকৃত এবং তাদের ওপর বলবৎযােগ্য নিয়মকানুনের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক আইন এই শর্ত যথার্থভাবে পূরণ করে।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক আইনও জাতীয় আইনের ন্যায় নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, সন্ধি, চুক্তি, খ্যাতনামা আইনবিদগণের আলােচনা, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত প্রভৃতি জাতীয় আইনের ন্যায় আন্তর্জাতিক আইনের উৎস বলে বিবেচিত।।
তৃতীয়ত, পিট-কবেট (Pit-Cobbet) ও অন্যান্য আইনবিদগণের মতে, আন্তর্জাতিক আইনও বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মান্য করে চলে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন কার্যকরী করবার নির্দিষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। আইন অমান্যকারী রাষ্ট্রকে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও বলিষ্ঠ আন্তর্জাতিক জনমতের বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয়। এ সম্ভাবনাই সকল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলতে বাধ্য করে।
প্রশ্ন ৭) স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক আইন বলতে কী বােঝ?
উত্তর : প্রাচীন গ্রিসের সময় থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় প্রাকৃতিক আইন বা স্বাভাবিক আইনের দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলােচনায় বিশেষ স্থান লাভ করেছে। উইলােবি (Willoughby) স্বাভাবিক আইনকে তিনটি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন—
প্রথমত, প্রাকৃতিক ঘটনাবলির কার্যকারণ (Cause and Effect) সম্পর্ককে স্বাভাবিক আইন বলা যায়।
দ্বিতীয়ত, জীবজন্তুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে; যেমন, অপত্য স্নেহকে স্বাভাবিক আইন বলা যায়। আবার ধর্মীয় অনুশাসনকে স্বাভাবিক আইন বলে গণ্য করা যায়।
তৃতীয়ত, সমাজের সাধারণ ন্যায়বােধ ও বিচারবুদ্ধির ওপর ভিত্তিশীল কতকগুলি সার্বজনীন নিয়মকে স্বাভাবিক আইন বলা যায়। বাস্তব জগতে যে আইন দ্বারা সমাজ শাসিত তার উর্ধ্বে আইনের স্বাভাবিক ন্যায়ভিত্তিক একটি শ্রেষ্ঠ মান আছে, তাকেও স্বাভাবিক আইন বলা হয়।
প্রাচীন গ্রিসের প্লেটো (Plato), অ্যারিস্টটল (Aristotle), সােফিস্ট (Sophist) দার্শনিকগণ এবং রােমান স্টয়িক (Stoics) পণ্ডিতগণের রচনায় স্বাভাবিক আইনের ধারণা বিশেষ স্থান লাভ করে। মধ্যযুগে অনেকে স্বাভাবিক আইনকে ঈশ্বরের আইন (Divine Law) বলে ঘােষণা করেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে হবস (Hobbes), লক (Locke) ও রুশাের (Rousseau) রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রাকৃতিক পরিবেশে (State of Nature) মানুষ যে প্রাকৃতিক আইনের দ্বারাই পরিচালিত হতেন তা প্রচার করেন। আইনবিদ হুগাে গ্রোটিয়াস (Hugo Grotius) এবং হেনরি মেইনও (Henry Maine) স্বাভাবিক আইনের গুরুত্ব স্বীকার করেন। বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক আইন নানাভাবে ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থান লাভ করেছে।
স্বাভাবিক আইনের সুস্পষ্ট রূপ লক্ষ করা যায় না। স্বাভাবিক আইন বলবৎ করার কোনাে মাধ্যম নেই। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নির্দিষ্ট আইন উপেক্ষা করে স্বাভাবিক আইনের অনুশাসনকে মান্য করা যায় । স্বাভাবিক আইন আদর্শবাদীর কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃত আইন সর্বদাই কার্যকর হবে এবং রাষ্ট্র সংরক্ষণ করবে। তা ছাড়া, চিরন্তন, শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় নীতি বলে কিছু থাকতে পারে না। মানুষের ধ্যান-ধারণা স্থান-কাল ও সামাজিক অবস্থার আপেক্ষিক, সুতরাং পরিবর্তনশীল। তাই আইনও পরিবর্তনশীল।
প্রশ্ন ৮) মার্কসীয় দৃষ্টিতে স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : মার্কসীয় দৃষ্টিতে অধিকার, স্বাধীনতা প্রভৃতি সকল ধারণাই সামাজিক কাঠামাে এবং সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতার দ্বারাই মানুষ পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে। কিন্তু স্বাধীন সমাজব্যবস্থা ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব হতে পারে না। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য থাকে না। প্রকৃত স্বাধীন সমাজেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য, সামাজিক বিকাশের সুযােগ এবং ব্যক্তিত্বের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের সুযােগ যথার্থ স্বাধীনতা বলে গণ্য হতে পারে। প্রত্যেকের পূর্ণ বিকাশের দ্বারাই স্বাধীন সমাজ গড়ে উঠবে। জন লুইস (John Lewis) মার্কসের স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, মার্কসের মতে স্বাধীনতা হল মানবজীবনের মঙ্গলকর বিষয়ের সামগ্রিকতার উপলদ্ধি এবং ব্যক্তিগত ও আত্মিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সামর্থ্য। এর জন্য অপরিহার্যভাবে প্রয়ােজন হল মানবজীবনের ব্যক্তিগত বিষয়ের উৎপাদন পদ্ধতির ওপর যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (Friedrich Engels) স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণাটি ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ স্বাধীনতা বলতে প্রাকৃতিক নিয়ম থেকে মুক্ত হওয়া বােঝায় না ; প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং তাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কার্যকর করবার সম্ভাবনাই হল স্বাধীনতা। প্রাকৃতিক অবস্থা প্রয়ােজনীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যক্তিজীবন ও বহিঃপ্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হল স্বাধীনতা।
প্রশ্ন ৯) আইন ও স্বাধীনতার শর্ত আলােচনা করাে।
উত্তর : স্বাধীনতা সকলের জন্য। তাই সকলের স্বাধীনতা সম্ভব করতে হলে ব্যক্তিকে কতকগুলি নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হয়। বার্কারের মতে, সমাজে প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা আবশ্যিকভাবে সকলের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যথার্থ স্বাধীনতা ভােগ করা যায় না। আইনের দ্বারাই রাষ্ট্র এই নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে। যেমন, নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অন্য নাগরিকের দুর্নাম রটনা করলে বা সমাজের চোখে তাকে হেয় করবার চেষ্টা করলে আইন হস্তক্ষেপ করবে। বস্তুত নিয়ন্ত্রণবিহীন বা অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। আইন না থাকলে সবল দুর্বলের ওপর, ধনী-নির্ধনের ওপর, মালিক শ্রমিকের ওপর অত্যাচার শোষণ চালাবে। অবাধ স্বাধীনতার নামে সমাজে মুষ্টিমেয় মানুষ স্বাধীনতা ভােগের সুযােগ লাভ করবে। জোর যার, মুল্লুক তার’—এই হবে সামাজিক নীতি। সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সমাজের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হবে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল সমাজের প্রতিটি নাগরিকের সত্তা বিকাশের সুযােগসুবিধা নিশ্চিত করা, স্বাধীনতা ভােগের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে নাগরিকের কাছে আনুগত্য দাবি করতে পারে না। নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে থাকে।
সুতরাং, স্বাধীনতা ও আইন পরস্পরবিরােধী নয়, একে অন্যের পরিপূরক। স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বােঝায় না, অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ আরােপ বােঝায়। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্ভব করে। তাই আইনই স্বাধীনতার শর্ত (Law is the condition of liberty”)।
প্রশ্ন ১০) সাম্যের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বর্ণনা করাে।
উত্তর : স্বাধীনতার মতাে সাম্যের ধারণাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সংগ্রামে সাম্যের আদর্শকেও মূল্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্যের প্রকৃতি ও সুস্পষ্ট অর্থ সম্বন্ধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গভীর মতপার্থক্যের সুযােগ ঘটেছে। সাম্য বলতে সকল মানুষ সমান বােঝায়, কিন্তু কোন্ অর্থে মানুষের সঙ্গে মানুষের সমানাবস্থা থাকতে পারে? সাম্যের ধারণা চূড়ান্ত বা স্বতঃসিদ্ধ নয়, এটা আপেক্ষিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মানসিক গঠন, নৈতিক যােগ্যতার পার্থক্য রয়েছে। স্বাভাবিক বা প্রকৃতিগতভাবে মানুষে মানুষে এই পার্থক্য অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং সাম্য বলতে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে সকলের অভিন্নতা বােঝাতে পারে । দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য স্বীকার করতেই হয়। অ্যারিস্টটল বলেছেন যে “অনেক রাষ্ট্রে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের পিছনে আছে অসাম্য (Inequality)। সমাজ মানুষের প্রতি সাম্যের দৃষ্টিতে দেখা এবং অসমান মানুষের প্রতি অসাম্যমূলক ব্যবহার। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রচলিত সামাজিক চেতনার মানদণ্ডে স্বীকৃত অসাম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতিবিধান বােঝায়।” অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, মানুষের অভাব ও যােগ্যতার ক্ষেত্রে যতদিন পার্থক্য থাকবে, তত দিন চূড়ান্তভাবে অভিন্ন ব্যবহার সমাজে থাকতে পারে না। একজন দার্শনিক ও একজন শ্রমিকের প্রয়ােজন ও যােগ্যতা সমপর্যায়ের হতে পারে না। একজন বিজ্ঞানী ও একজন সাধারণ শ্রমিকের সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি দান করা হলে সমাজের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। মানুষের যােগ্যতা ও কর্মশক্তির পার্থক্য যেহেতু রয়েছে, সেহেতু সকলে রাষ্ট্রের নিকট সমান ব্যবহার দাবি করতে পারে না। তাহলে সাম্য বলতে প্রকৃত অর্থে কি বােঝায় ? এর সর্বসম্মত উত্তর এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, সাম্য বলতে প্রাথমিকভাবে বােঝায় “বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি।”
প্রশ্ন ১১) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলােচনা করাে।
উত্তর : বর্তমানে বহু দার্শনিক সাম্য ও স্বাধীনতার পরস্পরবিরােধীরূপ স্বীকার করেন না। মেইটল্যান্ড (Maitland), গডউইন (Godwin), রুশাে (Rousseau), টনি (R.H. Tawney), বার্কার (Barker), ল্যাস্কি (Laski) এবং মার্কসবাদীগণ (Marxists) সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে স্বীকার করেন। টনি বলেছেন, “সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, স্বাধীনতার পক্ষে একান্ত প্রয়ােজন।” স্বাধীনতার ধারণাকে কার্যকর করতে সাম্যের প্রয়ােজন অপরিহার্য। সমাজজীবনে পৌর বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা তখনই সার্থক হতে পারে যখন আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার স্বীকৃত হয় এবং প্রত্যেক নাগরিক শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সমান সুযােগ লাভ করে। অর্থনৈতিক প্রয়ােজন পূরণের পর উপযুক্ত অবসর মিললেই স্বাধীন চিন্তার বিকাশ সম্ভব হতে পারে। বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে না। ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা হল এমন এক সামাজিক পরিবেশ যার মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি পূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে। এই পরিবেশ একমাত্র সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে সৃষ্টি হতে পারে। স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ বােঝায়, তাহলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া অন্যত্র সেই স্বাধীনতা সম্ভব নয়। রুশাের ভাষায় সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্বই সম্ভব নয়। এই অভিমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বাধীনতা সম্ভব করবার জন্যই রাষ্ট্রকে এমন পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করতে হয় যেখানে বিশেষ সুযােগসুবিধার কোনাে অস্তিত্ব থাকবে না। শ্রেণিবৈষম্য বা সম্পদ বৈষম্য স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
প্রশ্ন ১২) সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতার অস্তিত্ব কি সম্ভব?
উত্তর : সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের দাবি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে, তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনৈতিক দার্শনিকগণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যকে স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করতেন। লর্ড অ্যাক্টন, টকভিল, লেকি, বেজহট প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরােধী বলে। অভিহিত করেন। লর্ড অ্যাক্টনের মতে, সাম্যের জন্যে আবেগ স্বাধীনতার আশাকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে। কিন্তু সাম্য ও স্বাধীনতার পরস্পর বিরােধিতার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক দার্শনিক স্বীকার করেন না। মেটল্যান্ড, গডউইন, রুশশা, বার্কার, ল্যাস্কি এবং মার্কসবাদীগণ সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে স্বীকার করেন। টনি বলেছেন, ‘সাম্য স্বাধীনতার’ পরিপন্থী নয়, স্বাধীনতার পক্ষে একান্ত প্রয়ােজন। অধ্যাপক ল্যাস্কি মনে করেন যে, সমাজের মধ্যে বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব থাকলে জনগণের কোনাে স্বাধীনতার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই অভিমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। তাই সাম্য কখনও স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি সম্ভব নয়।
প্রশ্ন ১৩) ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা দাও। ন্যায়বিচারের প্রকৃতি আলােচনা করো।
উত্তর : গ্রিস রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পদ। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রচিন্তা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, ন্যায়বিচার ইত্যাদি সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল যে-সমস্ত কথা বলে গিয়েছেন তা আজও সমাজ-বিজ্ঞানের এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে গভীর চিন্তার বিষয়। রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো ন্যায়বিচারের পক্ষে জোর সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তি ও ন্যায়বিচার সমাজের ভিত। আইন যখন রচনা করা হবে তখন আইন প্রণেতারা লক্ষ রাখবেন তা যেন ন্যায়বিচারের ধারণাকে লঙ্ঘন না করে।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের কতকগুলি অপরিহার্য গুণাবলির উল্লেখ করেছেন। যেমন—সহনশীলতা, সাহস, প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচার। আদর্শ রাষ্ট্রের চতুর্থ গুণ হল ন্যায়বিচার। এটি কোনাে বিশেষ শ্রেণির এককগুণ নয়। এর যদি সম্পূর্ণ বিকাশ না ঘটে তাহলে রাষ্ট্র কখনােই আদর্শ রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হতে পারে না। প্রতিটি ব্যক্তির যা প্রাপ্য তাকে তা দেবার নাম ন্যায়বিচার। প্রত্যেক ব্যক্তির কতকগুলি সহজাত গুণাবলি আছে। এই গুণাবলির সাহায্যেই ব্যক্তি কোনাে কাজ করার শক্তি বা সামর্থ্য অর্জন করে থাকে। ব্যক্তির কাজ এমন হওয়া দরকার যার ফলে রাষ্ট্রের উন্নতি বৃদ্ধি পায়। এই কাজ করার জন্য ব্যক্তি অবশ্যই কিছু প্রাপ্য দাবি করতে পারে। এই প্রাপ্য থেকে যদি তাকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হবে।
প্রতিটি ব্যক্তি বা শ্রেণি যদি নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করে তবেই ন্যায়বিচার বিকশিত হবার সুযােগ পাবে। ড. অমল কুমার মুখােপাধ্যায় তাঁর Western Political Thought গ্রন্থে বলেছেন যে, সমাজের তিনটি শ্রেণি যদি তাদের কাজ ঠিকঠাক করে তবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এক শ্রেণি অন্য শ্রেণির কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। ন্যায়বিচার একটি নির্দেশিকা যা সমাজের অন্যায়, ত্রুটি দূর করে। প্লেটোর ধারণা প্রত্যেকে যদি নির্দিষ্ট কাজ করে এবং তার প্রাপ্য পায় তবে ন্যায়বিচার রক্ষিত হবে। সমাজ বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রেহাই পাবে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে। আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার অপরিহার্য। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সাম্য ও ন্যায় ওতপ্রােতভাবে জড়িত।
প্রশ্ন ১৪ ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ?
উত্তর : প্লেটোর ন্যায় বিচারতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে আমরা ন্যায়বিচারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। যেমন—
(ক) ন্যায়বিচার সমন্বয়সাধনকারী, সম্প্রীতিতে ভরা একটি বন্ধন। এই বন্ধন সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে।
(খ) ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগুলিও নিজেদের মধ্যে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ে।
(গ) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে অথবা রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচারের রক্ষক হয় তবে সমাজে কোনাে রকম সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে না।
(ঘ) আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল সবরকম শ্রেণি সংঘর্ষকে উৎপাটিত করা। এটি সম্ভব, যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ঙ) প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচারের ভিত্তি হল যুক্তি ও প্রচলিত রীতি। সমাজে যদি কেউ অন্যায় কাজ করে অথবা অন্যের প্রতি অবিচার করে কিংবা অন্যেরা তাকে অনুসরণ করে তাহলে। ন্যায়বিচারের অবলুপ্তি ঘটবে।
(চ) ন্যায়বিচারের ধারণা সামাজিক মানুষকে যুক্তিবাদী করে তােলে। মানুষের এই যুক্তিবাদী মনােভাব ন্যায়বিচারের সহায়ক হয়। মানুষ নীতি বহির্ভূত কোনাে কাজ করতে চাইবে না।
(ছ) ন্যায়বিচার সমাজে প্রীতি, ভালােবাসা-সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করে। এটাই তাে মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
(জ) মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ নিজ প্রয়ােজনে সমাজে বাস করে। পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই পরস্পর নির্ভরশীলতাই হল ন্যায়বিচারের ভিত্তি।
প্রশ্ন ১৫) মার্কসবাদীদের মতে পুঁজিবাদী সমাজে স্বাধীনতা সম্ভব নয় কেন?
উত্তর : মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী পুঁজিবাদ হল একটি শ্রেণিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। পুঁজিবাদী সমাজে সর্বপ্রকার অসাম্য ও বৈষম্যকে প্রশ্রয় দিয়ে সম্পত্তিবান শ্রেণির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এইরূপ সমাজে উৎপাদনের উপকরণের উপর সংখ্যালঘু শ্রেণির মালিকানা থাকার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবনে সর্বপ্রকার সুযােগ থেকে বঞ্চিত থাকে। মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র শুধুমাত্র বণিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার” হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। এইরুপ সমাজে রাষ্ট্রীয় আইন সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার রক্ষক নয়। তাই মার্কসীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আপথেকারের মতে, পুঁজিবাদী সমাজে স্বাধীনতার অর্থ হল বুর্জোয়া শ্রেণির স্বাধীনতা।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১) আইনের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি আলােচনা করাে।
উত্তর : আইনের সংজ্ঞা
আইন বলতে বােঝায় নিয়মকানুন। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে রাষ্ট্র কতকগুলি নিয়মকানুন তৈরি করে। সেইসব নিয়মকানুনকে বলে আইন। সুষ্ঠু শাসনব্যস্থার প্রয়ােজনে মানুষের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। রাষ্ট্র এই আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যেসব নিয়ম তৈরি করে তাকে বলে আইন। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড (Holland) আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে সাধারণ নিয়মগুলি সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ প্রয়ােগ করে সেগুলিকে বলা হয় আইন।
তবে আইনের সংজ্ঞা দেওয়া নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। প্রখ্যাত আইনবিদ অস্টিন (Austin) বলেছেন—আইন হল সার্বভৌমের আদেশ। প্রতিটি রাষ্ট্রে একটি সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ থাকে। তার আদেশ হল আইন। কিন্তু এই সংজ্ঞা সঠিক নয়। ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তা হেনরি মেইন বলেছেন—সমাজে অনেক প্রথা ও রীতি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে রাষ্ট্র স্বীকার করে নেয়। সুতরাং সার্বভৌমের আদেশ আইন নয়। আইন হল—সামাজিক প্রথার স্বীকৃতি।
অস্টিন ও হেনরির সংজ্ঞা দুটিকে সমন্বয় করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলসন (Wilson) আইনের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা গ্রহণযােগ্য। তিনি বলেছেন—আইন হল মানুষের স্থায়ী আচার-ব্যবহার ও চিন্তার সেই অংশ যা সাধারণ নিয়মের আকারে সুস্পষ্ট ও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিলাভ করেছে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট সমর্থন আছে।
আইনের প্রকৃতি
আইনের প্রভাব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের প্রভাব আছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক জীবনে আইনের প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশি। তাই রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার তাই বলেছেন—“আইনের দ্বারা রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে এবং রাষ্ট্রের কাজ হল আইন তৈরি করা।” আইনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে আমরা আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি দেখতে পাই ?
• (ক) আইন বহির্জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে
আইন মানুষের বাইরের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার আন্তর্জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যেমন—মানুষের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানুষের যেসব বাহ্যিক আচরণের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক আছে, আইন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তা না হলে সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। তাই হল্যান্ড (Holland) বলেছেন—“আইন হল মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধারণ নিয়ম, যেগুলি রাষ্ট্র প্রয়ােগ করে থাকে।”
• (খ) আইন বাধ্যতামূলক
নাগরিকদের পক্ষে আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। যদি কেউ আইন না মেনে চলে তাহলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেবে। তাই সবাই আইন মেনে চলতে বাধ্য হয়। ম্যাকাইভার যথার্থই বলেছেন- আইনের পিছনে আছে বলপ্রয়ােগের ব্যবস্থা। তাই আইন মেনে চলতে হয়।
• (গ) আইন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট আইন
লিখিত আকারে থাকে বলে সুস্পষ্ট। শুধু তাই নয়, আইনের মধ্যে যদি কিছু অস্পষ্টতা থাকে, তাহলে আদালত তা ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেয়। তাই আইন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয়।
• (ঘ) আইন সার্বজনীন
আইন সার্বজনীন অর্থাৎ সকলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। কেউ আইনকে এড়িয়ে যেতে পারে না। মানুষের মধ্যে বর্ণগত, জন্মগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে। কিছু আইন সকলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য।
• (ঙ) আইন গতিশীল
আইন গতিশীল। ইহা এক জায়গায় থেমে থাকে না। কারণ সমাজের প্রয়ােজনে আইন গড়ে ওঠে। সমাজ পরিবর্তনশীল। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের পরিবর্তন ঘটে। আইনের পরিবর্তন না ঘটলে সমাজের কাছে তা গ্রহণযােগ্য হবে না।
মূল্যায়ন
একথা অনস্বীকার্য আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করা যায়। যেমন- ভারতে সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা হয়েছ। তবে মার্কসবাদীরা বলেছেন—বৈষম্যমূলক সমাজে ধনিকশ্রেণি নিজেদের স্বার্থে আইন তৈরি করে। সেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা উপেক্ষিত হয়। একমাত্র শ্রেণিহীন ও শােষণহীন সমাজে আইন সকলের স্বাধীনতা সংরক্ষিত করতে পারে।
প্রশ্ন ২) স্বাধীনতার (Liberty) সংজ্ঞা ও প্রকৃতি আলােচনা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল (Aristotle) বলেছেন রাষ্ট্র হল শ্রেষ্ঠ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। কারণ রাষ্ট্রের মধ্যেই সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ জীবন সম্ভব। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাজ হল–মানুষের বিকাশ ঘটানাে। এই বিকাশ ঘটাতে গেলে স্বাধীনতার প্রয়ােজন। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি
সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে বােঝায়—নিজের অধীনে নিজে চলা অর্থাৎ নিজের খুশিমতাে কাজ করা। ব্যক্তি নিজে যা ভালাে মনে করবে তাই করবে। একে বলে স্বাধীনতা। কিন্তু এটি স্বাধীনতার সংকীর্ণ অর্থ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এই অর্থ ধরা হয় না। যা খুশি তাই করার নাম যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে শুধু শক্তিমানরাই স্বাধীনতা ভােগ করবে। দুর্বলদের কোনাে স্বাধীনতা থাকে না। তাই দুর্বলরা যাতে স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে তার জন্যে সবল ব্যক্তিদের আচরণের উপর বাধানিষেধ আরােপ করতে হবে। তাই ল্যাস্কি (Laski) বলেছেন—“স্বাধীনতার প্রকৃতির মধ্যে আছে বাধানিষেধ।”
বাধানিষেধের দূরীকরণ
কিন্তু সবসময় বাধা-নিষেধ আরােপ করাকে স্বাধীনতা বলা যাবে না। মানুষের বিকাশের পথে অনেক বাধা আছে। সেই বাধা দূর করতে না পারলে স্বাধীনতা ভােগ করা যাবে না। বিকাশের পথে এই বাধা-নিষেধ দূর করার নাম স্বাধীনতা। অধ্যাপক ল্যাস্কির (Laski) ভাষায় বলা যায়—“স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি বাধা-নিষেধের অনুপস্থিতি।”
উপযুক্ত পরিবেশের সংরক্ষণ
বাধানিষেধ দুর করলেই ব্যক্তির বিকাশ হবে না। তার জন্য সুযােগসুবিধা দিতে হবে। যেমন, একটা চারাগাছের উপর বাধা সরিয়ে দিলেই যে সে বাড়বে এমন নয়। তার জন্যে জল ও সার। দিতে হবে। অর্থাৎ তাকে সুযােগসুবিধা দিতে হবে। তেমনি ব্যক্তির বিকাশের জন্যে সুযােগসুবিধা দিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তােলা দরকার। এই পরিবেশের নাম স্বাধীনতা। অধ্যাপক ল্যাস্কির (Laski) ভাষায় বলা যায়—“স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি। সেই পরিবেশের সংরক্ষণ, যেখানে মানুষ তার সত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারবে।”
এইসব আলােচনা থেকে বলা যায়, ব্যক্তির বিকাশের জন্যে বাধানিষেধের অপসারণ এবং উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির নাম স্বাধীনতা।
মার্কসীয় ধারণা
ব্যক্তির বিকাশের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশের নাম স্বাধীনতা। মার্কসবাদীরাও একথা স্বীকার করেন। কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজে সাধারণ মানুষ এই’সুযােগ পায় না। এখানে বিত্তবান শ্রেণি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করার চেষ্টা করে। তাই বিত্তবানরা সাধারণ মানুষদের বিকাশের জন্য পরিবেশ গড়ে তুলতে চায় না। এজন্য সাধারণ নাগরিক স্বাধীনতা ভােগ করতে পারেন না যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা উৎপাদনের উপাদানগুলি নিজেদের দখলে আনতে পারছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কাঠামাের পরিবর্তন করতে না পারছে, ততদিন স্বাধীনতা ভােগ করতে পারবে না। এই পরিবর্তনের উদ্যোগকে বলে স্বাধীনতা। সমাজবাদে কোনাে বৈষম্য থাকে না বলে সবাই স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে। পুঁজিবাদী সমাজে তা সম্ভব নয়।
মূল্যায়ন
সুতরাং দেখা যাচ্ছে সঙ্গে স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি সম্পর্কে পুঁজিবাদী চিন্তাভাবনার মার্কসীয় চিন্তাভাবনার পার্থক্য আছে। তবে একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। উভয়েই মনে করে ব্যক্তির বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের নাম স্বাধীনতা। তবে মার্কসবাদীরা বলেছেন—পুঁজিবাদী সমাজে সকলের জন্যে এই পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয় বলে সবাই স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে না।
প্রশ্ন ৩) আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলােচনা করাে।
অথবা, “আইন হল স্বাধীনতার শর্ত”—উক্তিটি আলােচনা করাে।
উত্তর : আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক কীরূপ তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ওর মতবিরােধ লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক ল্যাস্কি (Laski), বার্কার (Barker) প্রভৃতি চিন্তাবিদ্রা মনে করেন উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। অপরদিকে, মিল (Mill), স্পেনসার (Spencer) প্রভৃতি চিন্তাবিদরা মনে করেন উভয়ের মধ্যে পরস্পর-বিরােধী সম্পর্ক আছে। তাই আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে প্রথমে উভয়ের সংজ্ঞা সংক্ষেপে জানা প্রয়ােজন।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা
সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে বােঝায় নিজের ইচ্ছামতাে কাজ করা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এই অর্থ ধরা হয় না। এখানে স্বাধীনতা বলতে বােঝায়—ব্যক্তির বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। ল্যাঙ্কি বলেছেন—“স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি, সেই পরিবেশের সংরক্ষণ যেখানে মানুষ তার সত্তাকে পূর্ণভাবে বিকাশ ঘটাতে পারে।”পরিবেশ বলতে নানা ধরনের সুযােগসুবিধা বােঝায়। এই সুযােগসুবিধা ভােগ করাকে বলে স্বাধীনতা।
আইনের সংজ্ঞা
সমাজের স্বার্থে মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে রাষ্ট্র যে সকল নিয়ম- কানুন তৈরি করে সেগুলিকে বলা হয় আইন। এই আইন সকলকে মেনে চলতে হয়। এটি মেনে। চলা বাধ্যতামূলক। তাই আইন ভঙ্গকারীকে রাষ্ট্র শাস্তি দেয়।
উভয়ের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক
উভয়ের সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করলে আমাদের মনে হবে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিপরীতমুখী। ডাইসি (Dicey), মিল (Mill) প্রভৃতি চিন্তাবিদ এই মতই পােষণ করেন। তাদের মতে স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা। অথচ আইন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে মানুষকে কাজ করতে বাধ্য করে। একে স্বাধীনতা বলা যাবে না। তাই আইন স্বাধীনতার পথে বাধার সৃষ্টি করে। যতই আইনের বেড়াজাল থাকবে, ততই স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবে। অধ্যাপক ডাইসির ভাষায়—The more there is of the one, the less there is of the other, অর্থাৎ একটি বেশি হলে অপরটি কমবে। তার মানে আইন বেশি হলে স্বাধীনতা কমবে।
উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়
উভয়ের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক দেখানাে হলেও বাস্তবে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়। সেই সম্পর্ক নিম্নলিখিতভাবে আলােচনা করা যেতে পারে :
প্রথমত, স্বাধীনতা মানে যা খুশি করা নয়। কারণ যা খুশি করার অধিকার দেওয়া হলে সমাজে যারা শক্তিশালী তারা দুর্বল ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করবে। তাই দুর্বলেরা যাতে স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে তার জন্যে আইনের মাধ্যমে শক্তিমানদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তাই আইন স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন—স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তির বিকাশের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ। কতকগুলি সুযােগসুবিধা দিয়ে সেই পরিবেশ তৈরি হয়। সেই সুযােগ-সুবিধাগুলিকে বলে অধিকার। যেমন—শিক্ষার অধিকার, জীবনের অধিকার প্রভৃতি। রাষ্ট্র আইন তৈরি করে এইসব অধিকারকে স্বীকার করে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সুতরাং আইন ছাড়া অধিকার রক্ষিত হয় না। অধিকার না থাকলে স্বাধীনতা থাকে না। তাই আইনের সঙ্গে স্বাধীনতার নিবিড় সম্পর্ক আছে। সেই কারণে বলা যায়—Law is the condition of liberty, অর্থাৎ আইন হল স্বাধীনতার শর্ত।
তৃতীয়ত, আইন স্বাধীনতার প্রসার ঘটায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়—শ্রমিকদের সুযােগসুবিধা দিলে স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। কিন্তু মালিকশ্রেণি দিতে চায় না।.যতটা কম দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবে। রাষ্ট্র আইন করে মালিকশ্রেণিকে সেগুলি দিতে বাধ্য করে। সুতরাং আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরােধী নয়।
মূল্যায়ন
একথা অনস্বীকার্য আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করা যায়। যেমন— ভারতে সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। তবে মার্কসবাদীরা বলেছেন—বৈষম্যমূলক সমাজে ধনিকশ্রেণি নিজেদের স্বার্থে আইন তৈরি করে। সেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা উপেক্ষিত হয়। একমাত্র শ্রেণিহীন ও শােষণহীন সমাজে আইন সকলের স্বাধীনতা সংরক্ষিত হতে পারে।
প্রশ্ন ৪) সাম্য (Equality) বলতে কী বােঝায়? সাম্যের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর : যুগে যুগে দার্শনিকরা সাম্যের জয়গান করেছেন। সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের সম্পদেরও সাম্যনীতি স্বীকৃত হয়েছে। এর কারণ হল—সাম্য ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকলে সমাজে অশান্তি দেখা দেবে। অশান্ত সমাজে ব্যক্তির বিকাশ হবে না। তাই রাষ্ট্রচিন্তার জগতে সাম্যনীতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে উত্তর আছে।
সাম্যের সংজ্ঞা
সাধারণভাবে সাম্য বলতে বােঝায় সকলে সমান। কিন্তু বাস্তবে সকলে সমান হতে পারে না। মানুষদের মধ্যে শক্তি, সামর্থ্য বা বুদ্ধির পার্থক্য থাকবেই। রাষ্ট্রের কাছ থেকে সকুলে সমান সুযােগসুবিধা দাবি করতে পারে না। একজন বিজ্ঞানী যে সুযােগ দাবি করে, একজন কৃষক তা করতে পারে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য কথাটির অর্থ হল—প্রত্যেক ব্যক্তি তার বিকাশের জন্যে প্রয়ােজনীয় সুযােগসুবিধা পাবে। এই সুযোেগর ক্ষেত্রে কোনাে বৈষম্য থাকবে না। কোনাে বিশেষ শ্রেণি রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনাে বিশেষ সুবিধা পাবে না। এই সুযােগের সমতার নাম হল সাম্য। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়— ভারতীয় সংবিধানের ১৪নং ধারায় বলা হয়েছে, আইনের চোখে সকলে সমান। সমান অপরাধে প্রত্যেক ব্যক্তি সমান শাস্তি পাবে। ১৫নং ধারায় বলা হয়েছে—ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতি কারণে রাষ্ট্র কোনাে নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না। এই সমতার নীতিকে বলে সাম্য।
সাম্যের প্রকৃতি
সমাজব্যবস্থার চরিত্রের উপর সাম্যের প্রকৃতি বা স্বরুপ নির্ভর করে। উদারনৈতিক ব্যবস্থায় সাম্যের যে প্রকৃতি, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার থেকে ভিন্ন। তাই উভয় সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সাম্যের প্রকৃতি আলােচনা করা যুক্তিসংগত
• (ক) উদারনৈতিক ব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি
উদারনৈতিক ব্যবস্থা বলতে বােঝায়,—যেখানে বাক্স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। এই ব্যবস্থায় সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য স্বীকৃত। এখানে আইনের চোখে সকলে সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতির ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় না। নির্বাচিত হওয়া বা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও সাম্যনীতি পালিত হয়। সাম্যের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের হাতে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
• (খ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে বােঝায়—শ্রেণিহীন শােষণহীন সমাজব্যবস্থা। এখানে উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কার্ল মার্কস হলেন বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের প্রবক্তা। মার্কসবাদীরা বলেন—উদারনৈতিক গণতন্ত্রে প্রকৃত সাম্য থাকতে পারে না। কারণ, প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে শুধু রাজনৈতিক সাম্য থাকলে চলবে , অর্থনৈতিক সাম্যও থাকা চাই। অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। পূর্ণিমার চাঁদ তখন ঝলসানাে রুটির মতাে মনে হয়।
মার্কসবাদীরা তাই মনে করেন—একমাত্র সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক সাম্যের উপর জোর দেওয়া হয়। এখানে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে না বলে শ্রেণিবৈষম্য থাকে না। এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে শোষণ করার সুযােগ পায় না। ফলে এখানে প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মূল্যায়ন
একথা অনস্বীকার্য যে, অর্থনৈতিক সাম্য থাকলে রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন। এই অবস্থায় প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। উদারনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হলেও অর্থনৈতিক সাম্যনীতি উপেক্ষিত হয়। তাই এখানে প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সেদিক থেকে সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক সাম্য স্বীকৃত হয় বলে প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
অবশ্য উদারনীতিবাদের সমর্থকরা মনে করেন, সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকলেও একদল সুবিধাভােগী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। তারাই সমাজতন্ত্রের সুফল ভােগ করে। পূর্ব ইউরােপের ও রাশিয়ার ঘটনা সে কথাই প্রমাণ করে। সমালােচিত হলেও একথা বলা যায় আদর্শগত দিক থেকে সমাজতন্ত্রে সর্বশ্রেণির মানুষ সাম্য ভােগ করতে পারে। |
প্রশ্ন ৫ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ন্যায়নীতি ( Justice) সম্পর্কে ধারণা (Concept) ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় ন্যায়নীতি সম্পর্কিত ধারণা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। উত্তর শুধু বর্তমানে নয়, প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় ন্যায়নীতি ও মূল্যবােধের ধারণা বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। তার কারণ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলােচ্য বিষয় হল রাষ্ট্র ও সরকার। রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হল—ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে ন্যায়তত্ত্ব প্রচার করেছেন। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সংবিধানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার শপথ নেওয়া হচ্ছে। যেমন, ভারতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার শপথ নেওয়া হয়েছে।
ন্যায় সম্পর্কে ধারণার অর্থ
‘ন্যায়’ বলতে কী বােঝায়, সে ব্যাপারে সর্বজনগ্রাহ্য কোনাে সংজ্ঞা নেই। আমরা সকলে ন্যায়ের কথা বলি। কিন্তু ন্যায়ের ধারণা পরিষ্কার নয়। কারণ মানুষে মানুষে, দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ন্যায় সম্পর্কে ধারণা ভিন্ন হতে পারে। এক দেশে যেটি ন্যায়, অন্য দেশে তা নাও হতে পারে।
সাধারণভাবে বলা যায়—যা করা উচিত আমরা তাকে ন্যায় বলি। যা করা উচিত নয় তাকে অন্যায় বা ন্যায়-বিরােধী বলি। সেদিক থেকে বলা যায়, যা নৈতিক বা আদর্শমূলক সেটাই হল ন্যায়। তবে এখানে বলা প্রয়ােজন, ন্যায়-ধারণা গতিশীল। পূর্বে যেটি ন্যায় ছিল বর্তমানে তা নাও হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়—ক্রীতদাস প্রথা একসময়ে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন এটি ন্যায়- বিরােধী বলে মনে করা হত না। কিন্তু বর্তমানে এটি ন্যায়-বিরােধী এবং নিন্দনীয় অপরাধ হিসাবে মনে করা হয়।
অধ্যাপক বার্কার ন্যায় ধারণার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—Justice কথাটি ল্যাটিন শব্দ ‘Jus’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘Jus’ শব্দের অর্থ হল—সামঞ্জস্যবিধান করা। তাই বলা যায়—যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযােগ সাধন করে বা বিভিন্ন মূল্যবােধের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে তাকে বলে ন্যায়।
অধ্যাপক বার্কার এই প্রসঙ্গে বলেছেন, স্বাধীনতা ও সাম্য হল রাজনৈতিক ন্যায়ের দুটি রূপ। কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্যের বিরােধ দেখা দিতে পারে। ন্যায়নীতি এই বিভিন্ন দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে। সেদিক থেকে বলা যায়, যে ধারণা বিভিন্ন রাজনৈতিক মূল্যবােধের সঙ্গেল সংযােগসাধনের কাজ করে তাকে বলে ন্যায়।
ন্যায় ও সাম্যের সম্পর্ক
ন্যায়ের সঙ্গে সাম্যের সম্পর্ক আছে। ন্যায়ের ধারণার ভিত্তিতে বলা হয়—সব মানুষই সমান। কেউ কারও থেকে ছােটো বা বড়াে নয়। সাম্যনীতির বক্তব্যও তাই। সুতরাং, দুটি ধারণার মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। সাম্যনীতিকে বাদ দিয়ে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই ভারতের সংবিধান রচয়িতারা সামাজিক ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠার জন্যে সাম্যনীতিকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে। প্রথমেই স্থান দিয়েছেন।
তবে অনেকে মনে করেন—উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক সবসময় নিবিড় নাও হতে পারে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে বলে অসাম্য থাকে। অথচ সেই অসাম্যকে অন্যায় বলে মনে করা হয় না। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এরকম অসাম্যকে অন্যায় বলে মনে করা হয়। আধুনিককালের সমাজব্যবস্থায়ও কতকগুলি ক্ষেত্রে অসাম্যকে অন্যায় বলে মনে করা হয় না। বরং তাকে সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে সমর্থন করা হয়। যেমন, তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা ও সুযােগসুবিধা আছে। এতে মনে হতে পারে যে, সাম্য নীতিকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ন্যায় ও আইনের সম্পর্ক
ন্যায়নীতির সঙ্গে আইনের কীরুপ সম্পর্ক সে ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে। প্রাচীনকালে মনে করা হত উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। তাই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ন্যায়নীতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হত। অন্যদিকে বর্তমানে আচরণবাদীরা মনে করেন, আইনের ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি ও মূল্যবােধের কোনাে স্থান নেই।
তবে অধ্যাপক বার্কার বলেছেন—উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা উচিত। প্রকৃত আইনের মধ্যে ন্যায়বিচার ও মূল্যবােধ থাকতে হবে। কোনাে আইন যদি ন্যায়বােধের উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তাকে প্রকৃত অর্থে আইন বলা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, আইনের অন্যতম কাজ হল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা। মানুষের নৈতিকতাবোেধ জাগানাের জন্যে বাহ্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। রাষ্ট্র। আইনের মাধ্যমে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে।
অবশ্য মার্কসবাদীরা বলেছেন—পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থে আইন তৈরি করে। সেই আইন সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সমালােচিত হলেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ককে অস্বীকার করা যাবে না। উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হলে সমাজে অশান্তি দেখা দেবে। এই অশান্তি বেশিদিন চলতে পারে না। তখন বিপ্লবের মাধ্যমে আবার এই সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
See More
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি
- রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
- জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র
- গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র
- নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
- ভারতের সংবিধান প্রণয়ন
- ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি
- রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকারের প্রকৃতি
- ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য
- ভারতের দলব্যবস্থা
- নির্বাচন কমিশন : গঠন ও কার্যাবলী নির্বাচন কমিশন : গঠন ও কার্যাবলী