রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি | Definition and Origin of State
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১। লক বর্ণিত ‘প্রাকৃতিক অবস্থা’ কীরূপ ছিল?
উত্তর: লকের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক-রাষ্টীয়, প্রাক-সামাজিক নয়। এই অবস্থা ছিল শান্তি, শুভেচ্ছা ও পারস্পরিক সহযােগিতার রাজ্য। মানুষ সাধারণভাবে সুখেই ছিল। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ছিল। ন্যায়, বিবেক ও যুক্তির অনুশাসন ছিল।
প্রশ্ন ২। রুশাে বর্ণিত ‘প্রাকৃতিক অবস্থা’ কীরূপ ছিল ?
উত্তর: রুশাের মতে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল সহজ, সরল ও সুন্দর। মানুষের মধ্যে হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ বা দ্বন্দ্ব ছিল না। পরস্পরের মধ্যে ছিল সহযােগিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব। মানুষেরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। তার মতে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল স্বর্গরাজ্য।
প্রশ্ন ৩। লক ও রুশাের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ?
উত্তর: (১) লকের মতে চুক্তি হয়েছিল দুটি। কিন্তু রশাের মতে চুক্তি হয়েছিল একটি।
(২) লক রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন, কিন্তু রুশাে জনগণের সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন।
প্রশ্ন ৪। রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিষয়ক কাল্পনিক মতবাদগুলি কী কী?
উত্তর: রাষ্ট্রের উৎপত্তি-বিষয়ক কাল্পনিক মতবাদগলি হল ঐশ্বরিক মতবাদ, বলপ্রয়ােগ মতবাদ এবং সামাজিক চুক্তি মতবাদ।
প্রশ্ন ৫। সমাজ কাকে বলে?
উত্তর: সমাজতাত্ত্বিক ম্যাকাইভার ও পেজের মতে, “সমাজ হল প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রক্রিয়া, কর্তৃত্ব ও পারস্পরিক সহযােগিতা, বিভিন্ন গােষ্ঠী ও বিভিন্ন দল, মানব- আচরণ ও স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গড়ে ওঠা ব্যবস্থা।”
প্রশ্ন ৬। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: (১) রাষ্ট্রের বহু পূর্বেই সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। (২) রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আছে, কিন্তু সমাজের নেই। (৩) রাষ্ট্রের পরিধি সমাজের পরিধির তুলনায় অনেক সীমিত।
প্রশ্ন ৭। ‘State’ বা ‘স্টেট’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি কীভাবে হয়েছে?
উত্তর: টিউটন যুগে রাষ্ট্র অর্থে ‘স্ট্যাটাস’ শব্দের ব্যবহার করা হত। এই শব্দটি একটি ল্যাটিন শব্দ। অর্থাৎ ল্যাটিন শব্দ ‘স্ট্যাটাস’ (Status) থেকেই ইংরেজি শব্দ ‘State’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।
প্রশ্ন ৮। রাষ্ট্রের উৎপত্তি-বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ কোনগুলি?
উত্তর: বিবর্তনবাদ ও মার্কসবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি-বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ।
প্রশ্ন ৯। ঐশ্বরিক মতবাদের কোনাে গুরুত্ব আছে কী?
উত্তর: আদিম ও অসভ্য বর্বর যুগে ঐশ্বরিক বন্ধনই মানুষকে প্রথম ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে আনুগত্য বােধের শিক্ষা দিয়েছিল। তাই গেটেল বলেছেন “মানুষ যখন স্বায়ত্তশাসনের জন্য উপযুক্ত ছিল না তখন এই মতবাদ মানুষকে আনুগত্যের শিক্ষা দান করেছিল।”
প্রশ্ন ১০। ঐশ্বরিক মতবাদের প্রধান সীমাবদ্ধতা কী?
উত্তর: (১) ঐশ্বরিক মতবাদ অনৈতিহাসিক, অযৌক্তিক এবং অবিশ্বাস্য। (২) ঐশ্বরিক মতবাদ রাজনীতিতে চরম স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। (৩) লৌকিক বিষয়ে ঈশ্বরের ধারণা ভ্রান্ত।
প্রশ্ন ১১। “সাধারণ ইচ্ছা” কী?
উত্তর: রুশাের চুক্তিবাদের মূল স্তম্ভ হল ‘সাধারণ ইচ্ছা’। রুশাের মতে, সমষ্টিগত স্বার্থ বা সাধারণের কল্যাণ যে ইচ্ছার মধ্যে বর্তমান তারই সমন্বয়ে সাধারণ ইচ্ছার সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দুই ধরনের ইচ্ছা থাকে—প্রকৃত ইচ্ছা এবং অপ্রকৃত ইচ্ছা। সাধারণের স্বার্থ বা কল্যাণ সম্পর্কিত ইচ্ছাটি হল প্রকৃত ইচ্ছা। প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়েই সৃষ্টি হয় সাধারণের ইচ্ছা।
প্রশ্ন ১২। রুশাের মতবাদের সীমাবদ্ধতা কী?
উত্তর: (১) রুশাের চুক্তিবাদের মূল স্তম্ভ অর্থাৎ সাধারণ ইচ্ছার ধারণাটি অস্পষ্ট।
(২) রুশাে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সাধারণ ইচ্ছার কাছে বলি দিয়েছেন। (৩) রুশাের তত্ত্ব আদর্শবান প্রতিষ্ঠার সহায়ক হলেও বাস্তবে এর গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে।
প্রশ্ন ১৩। বলপ্রয়োেগ মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী?
উত্তর: (১) বলপ্রয়ােগের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। (২) কর্তৃত্ব কায়েম করার জন্যই বলবান ব্যক্তি বা গােষ্ঠী রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে। (৩) কেবল রাষ্ট্রের সৃষ্টি নয়, বলপ্রয়ােগ হল রাষ্ট্রপরিচালনা ও সংরক্ষণের মূল শক্তি।
প্রশ্ন ১৪। বলপ্রয়ােগ মতবাদের কয়েকজন প্রবক্তার নাম উল্লেখ করাে।
উত্তর: সােফিস্ট দার্শনিক থ্রেসি মেকাস, লিকক, ওপেনহাইমার, জেকস্ ট্রিটস্কে, নিৎসে, বার্নহার্ডি প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিকরা বলপ্রয়ােগ মতবাদের প্রবক্তা।
প্রশ্ন ১৫। বলপ্রয়ােগ মতবাদের গুরুত্ব কী?
উত্তর: (১) পাশবিক শক্তি রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিবর্তনের অন্যতম উপাদান হিসাবে স্বীকৃত।
(২) রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
(৩) ল্যাস্কির মতে, সামরিক শক্তির মধ্যেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মূল নিহিত আছে।
প্রশ্ন ১৬। বলপ্রয়ােগ মতবাদের সীমাবদ্ধতাগুলি কী কী?
উত্তর: (১) পাশবিক বলই রাষ্ট্রের একমাত্র ভিত্তি হতে পারে না। তাই গ্রিন বলেছেন, “Will, not Force, is the basis of the State.”
(২) এই মতবাদ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পরিপন্থী।
(৩) বলপ্রয়ােগ মতবাদ বিশ্বশান্তির পরিপন্থী।
(৪) এই মতবাদ ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি অনৈতিক।
প্রশ্ন ১৭৷ চুক্তিবাদে লকের অবদান কী?
(১) আধুনিক গণতন্ত্রের মৌলিক অর্থ তিনিই প্রথম উপলদ্ধি করেন।
(২) জনগণের সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করেন।
(৩) স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
(৪) লক সসীম সার্বভৌমের প্রবক্তা।
প্রশ্ন ১৮। চুক্তিবাদী লকের সীমাবদ্ধতা কোথায়?
উত্তর: (১) লক আইনগত সার্বভৌমিকতাকে উপেক্ষা করেছেন।
(২) লকের স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব কল্পিত।
(৩) লক মূলত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বা ধনতন্ত্রের জয়গান করেছেন।
প্রশ্ন ১৯। চুক্তিবাদী হবস লক ও রুশাের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়?
উত্তর: (১) সকলেই বলেছেন, চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
(২) রাষ্ট্রগঠনের পূর্বে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় বসবাস করত।
(৩) জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থা পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রগঠনের জন্য উদ্যোগী হয়েছে।
প্রশ্ন ২০। গার্নার প্রদত্ত রাষ্ট্রের সংজ্ঞাটি কী?
উত্তর: অধ্যাপক গার্নার যে সংজ্ঞাটি দিয়েছেন সেটি হল—“রাষ্ট্র হল বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন একটি জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পণ বা প্রায় সম্পূর্ণ মুক্ত এবং যার একটি সুগঠিত শাসনব্যবস্থা আছে—যে শাসনব্যবস্থার প্রতি অধিবাসীদের অধিকাংশই স্বাভাবিকভাবে আনুগত্য দেখায়।”
প্রশ্ন ২১। রাষ্ট্র সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের সংজ্ঞাটি লেখাে।
উত্তর: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক’ অ্যারিস্টটলের মতে, “রাষ্ট্র হল স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি।”
প্রশ্ন ২২। রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিনের বিখ্যাত উক্তিটি কী?
উত্তর: লেনিনের মতে, “রাষ্ট্র হল শ্রেণি শাসনের যন্ত্র, রাষ্ট্রের মাধ্যমে এক শ্রেণি অপর শ্রেণিকে শােষণ করে।”
প্রশ্ন ২৩। সরকার বলতে কী বােঝ?
উত্তর: সরকার হল এমন একটি সংগঠন বা যন্ত্র যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেয়। প্রকৃত অর্থে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সমষ্টিকে বলে সরকার।
প্রশ্ন ২৪। সরকারকে কেন রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক বলা হয়?
উত্তর: সরকার হল রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্র। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। মস্তিষ্ক যেমন শরীরকে পরিচালিত করে, সরকার তেমনি রাষ্ট্রকে পরিচালিত করে। তাই সরকারকে রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক বলা হয়।
প্রশ্ন ২৫। ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের’ তাত্ত্বিক প্রবক্তা কাকে বলা হয়? তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম কী?
উত্তর: ইংল্যান্ডের ‘গৌরবময় বিপ্লবের’ (১৬৮৮) তাত্ত্বিক প্রবক্তা বলা হয় জন লককে। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম ‘Two Treaties on Civil Government’।
প্রশ্ন ২৬। ফরাসি বিপ্লবের তাত্ত্বিক প্রবক্তা কে? তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম কী?
উত্তর: ফরাসি বিপ্লবের তাত্ত্বিক প্রবক্তা বা প্রধান অনুপ্রেরণাদাতা ছিলেন রুশাে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম ‘Social Contract’।এটি ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন ২৭। সামাজিক চুক্তি মতবাদের মুখ্য প্রবক্তা কারা?
উত্তর: ইংরেজ দার্শনিক হবস, জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক রুশাে সামাজিক চুক্তি মতবাদের মুখ্য প্রবক্তা।
প্রশ্ন ২৮। হবস প্রণীত গ্রন্থটির নাম কী? এটি কত খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: হবস প্রণীত গ্রন্থটির নাম ‘লেভিয়াথান’। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন ২৯। হবসের মতবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর: (১) দুর্বিষহ প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে।
(২) চুক্তি হয়েছিল যে, রাজা চুক্তির উর্ধ্বে।।
(৩) রাজা হলেন সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী।
(৪) রাজার বিরুদ্ধাচরণ করার অধিকার প্রজাদের নেই।
প্রশ্ন ৩০। হবস ও লকের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর: (১) হবস ছিলেন চরম রাজতান্ত্রিক সমর্থক কিন্তু লক নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক।
(২) হবসের মতে চুক্তি হয়েছিল একটি কিন্তু লকের মতে দুটি।
(৩) হবস রাজাকে চুক্তির উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু লক রাজাকে চুক্তির পক্ষভুক্ত করে জনগণের অধিকারকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
প্রশ্ন ৩১। হবস ও রুশাের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর: (১) হবস চরম রাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু রুশাে গণতন্ত্রের পুজারি।
(২) হবস প্রাকৃতিক অবস্থাকে দুর্বিষহ বলেছেন। কিন্তু রুশাে মর্ত্যের স্বর্গ বলেছেন।
(৩) হবস রাজতন্ত্রকে স্থায়িত্ব দিতে চেয়েছেন। কিন্তু রুশাে গণতন্ত্রের জয়গান করেছেন।
প্রশ্ন ৩২। ঐশ্বরিক মতবাদের কয়েকজন তাত্ত্বিক সমর্থকের নাম লেখাে।
উত্তর: সেন্ট অগাস্টাইন, ধর্মযাজক সেন্টপল, টমাস অ্যাকুইনাস্ত, মার্টিন লুথার, স্যার রবার্ট ফিলমার প্রমুখ তাত্ত্বিকরা ঐশ্বরিক মতবাদের তাত্ত্বিক সমর্থক।
প্রশ্ন ৩৩। ‘প্যাট্রিয়ার্কা’ (Patriarcha) গ্রন্থটির প্রণেতা কে?
উত্তর: প্যাট্রিয়ার্কা’ গ্রন্থটির প্রণেতা রবার্ট ফিলমার। এটি ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন ৩৪। ‘City of God’ গ্রন্থটির প্রণেতা কে?
উত্তর: ‘City of God’ গ্রন্থটির প্রণেতা সেন্ট অগাস্টাইন।
প্রশ্ন ৩৫। ইংল্যান্ডে গৌরবময়বিপ্লব কখন হয়? এর রাজনৈতিক গুরুত্ব কী?
উত্তর: ইংল্যান্ডে গৌরবময়বিপ্লব ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয়।
এই বিপ্লবের রাজনৈতিক তাৎপর্য তথা গুরুত্ব হল এই যে, এর প্রভাবে রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্য অবলুপ্ত হয়। অর্থাৎ ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের সূত্রপাত হয়।
প্রশ্ন ৩৬। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে ক্ষুদ্রায়তন রাষ্ট্রের নাম কী?
উত্তর: পৃথিবীর সর্ববৃহদায়তন রাষ্ট্রটির নাম সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন (৮৭ লক্ষ বর্গমাইল) এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্রায়তন রাষ্ট্রটির নাম স্যানম্যারিনাে (৩৮ বর্গমাইল)।
প্রশ্ন ৩৭। রাষ্ট্রের প্রধান চারটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করাে।
উত্তর: রাষ্ট্রের প্রধান চারটি বৈশিষ্ট্য হল—(ক) জনসমষ্টি, (খ) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, (গ) সরকার এবং (ঘ) সার্বভৌমিকতা।
প্রশ্ন ৩৮। ত্রিপুরাকে কেন রাষ্ট্র বলা হয় না, তার দুটি কারণ লেখাে।
উত্তর: ত্রিপুরা একটি রাষ্ট্র নয়। কারণ—(ক) এর সার্বভৌমিকতা নেই। একে কেন্দ্রের অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। কেন্দ্রের বিরােধী কোনাে আইন করলে তা বাতিল হয়ে যায়। (খ) ত্রিপুরা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনাে চুক্তি বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না।
প্রশ্ন ৩৯। মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর: মার্কসবাদীরা বলেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র হল শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার। লেনিনের মতে, “রাষ্ট্র হল একটি শ্রেণির ওপর অন্য একটি শ্রেণির উৎপীড়নের যন্ত্র, অন্য পদানত শ্রেণিগুলিকে একটি শ্রেণির আয়ত্তে রাখার যন্ত্র। কারণ, যে রাষ্ট্রে জমি ও উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে, সে রাষ্ট্র যতই গণতান্ত্রিক হােক না কেন, তা হল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।
প্রশ্ন ৪০। ‘পােলিশ’ ও ‘সিভিটাস’ শব্দ দুটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘পােলিশ’ (Polis) শব্দটি গ্রিক শব্দ। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগণ ‘রাষ্ট্র’ অর্থে পােলিশ শব্দটি ব্যবহার করতেন।
‘সিভিটাস’ (Civitas) শব্দটি রােমান শব্দ। রােমান দার্শনিকগণ ‘রাষ্ট্র’ বােঝাতেই সিভিটাস শব্দকে ব্যবহার করতেন।
প্রশ্ন ৪১। রাষ্ট্র এবং সংঘ কি একে অপরের পরিপূরক?
উত্তর: রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণসাধন করা। সেই কাজ করতে গেলে সামাজিক সংঘের প্রয়ােজন আছে। কারণ মানুষের বিকাশের জন্যে সামাজিক সংঘগুলি গড়ে ওঠে। ল্যাস্কি বলেন, “রাষ্ট এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সহযােগিতায় সমাজজীবন সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে। তাই বলা যায়, রাষ্ট্র এবং সংঘ একে অপরের পরিপূরক।
প্রশ্ন ৪২। ‘রাষ্ট্র’ শব্দটিকে, কখন এবং কোথায় সর্বপ্রথম কে প্রয়ােগ করেন?
উত্তর: ‘রাষ্ট্র’ বা ‘স্টেট’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ইটালির বিখ্যাত দার্শনিক মেকিয়াভেলি। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মেকিয়াভেলি রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রিন্স’ (Prince)-এ প্রথম রাষ্ট্র (State) শব্দটির প্রয়ােগ দেখা যায়।
প্রশ্ন ৪৩। সামাজিক সংঘ বা প্রতিষ্ঠান বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের ‘সােসাইটি’ (Society) গ্রন্থে সামাজিক সংঘ সম্পর্কে বলেছেন যে, এক বা একাধিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যখন একটি গােষ্ঠী গড়ে ওঠে তখন তাকে ‘সামাজিক সংঘ’ বলে।
প্রশ্ন ৪৪। রাষ্ট্রের কয়েকটি গৌণ উপাদান বা বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
উত্তর: রাষ্ট্রের গৌণ উপাদানগুলি হল—স্থায়িত্ব, কূটনৈতিক বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রসংঘের সদস্যপদ ইত্যাদি।
প্রশ্ন ৪৫। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘ভূখণ্ড’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘ভূখণ্ড’ বলতে শুধুমাত্র ভূপৃষ্ঠকে বােঝায় না। এখানে ‘ভূখণ্ড’ বলতে রাষ্ট্রের অন্তর্গত ভূভাগ, নদনদী, গিরিপর্বত, হ্রদ, ভূগর্ভস্থ সকল সম্পদ, আকাশপথ, উপকূলভাগ ইত্যাদিকে বােঝায়।
প্রশ্ন ৪৬। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কি রাষ্ট্র?
উত্তর: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ একটি আন্তর্জাতিক সংঘ। এখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে স্বেচ্ছামূলক সদস্যপদ গ্রহণ করে। এর নিজস্ব কোনাে সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। এর কোনাে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডও নেই। তাই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ রাষ্ট্র নয়।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
1. ত্রিপুরা কি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র?
উত্তর: না। ত্রিপুরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়।
2. কে বলেছেন ‘নির্দিষ্ট ভূখন্ড রাষ্ট্রের আবিশ্যিক উপাদান নয়’?
উত্তর: সিলি বলেছেন ‘নির্দিষ্ট ভূখন্ড রাষ্ট্রের আবিশ্যিক উপাদান নয়’।
3. ‘আধুনিক সামাজিক সৌধের শীর্ষবিন্দু হল রাষ্ট্র’- কে একথা বলেছেন?
উত্তর: ‘আধুনিক সামাজিক সৌধের শীর্ষবিন্দু হল রাষ্ট্র’- একথা বলেছেন অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি।
4. রাষ্ট্রের কি কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা আছে?
উত্তর: না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকার সার্বভৌমিকতা আছে।
5. ‘রাষ্ট্র শ্রেণিশাসনের যন্ত্র মাত্র’- কার উক্তি?
উত্তর: ‘রাষ্ট্র’ শ্রেণিশাসনের যন্ত্র মাত্র’- উক্তিটি হলো কাল মার্কসের।
6. একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে কয়টি রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারেন?
উত্তর: একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে একটি মাত্র রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারেন।
7. রাষ্ট্র কিরূপ ধারণা?
উত্তর: রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা।
8. সর্বপ্রথম বৃহদায়তন রাষ্ট্রের কথা বলেছেন কারা?
উত্তর: টিউটনেরা সর্বপ্রথম বৃহদায়তন রাষ্ট্রের কথা বলেছেন।
9. ‘আমিই রাষ্ট্র’- কে বলেছিলেন?
উত্তর: চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’।
10. সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কি একটি রাষ্ট্র?
উত্তর: না । সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ হল একটি রাষ্ট্র সমবায়।
11. হবস এর মতে প্রাকৃতিক অবস্থা কিরূপ ছিল?
উত্তর: হবস এর মতে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক্-সামাজিক।
12. পাশবিক বলই রাষ্ট্রের ভিত্তি , কোন্ মতবাদে একথা বলা আছে?
উত্তর: বলপ্রয়োগ মতবাদে বলা আছে, পাশবিক বলি রাষ্ট্রের ভিত্তি।
13. ‘শক্তি নয়, জনগণের ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি’ কে বলেছেন?
উত্তর: ‘শক্তি নয়, জনগণের ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি’- একথা বলেছেন গ্রিন।
14. হবস ও লকের মতবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছেন কে?
উত্তর: হবস ও লকের মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন রুশো।
15. ‘ভাগ্যবান যোদ্ধাই প্রথম রাজপথ অলংকৃত করে’- কার উক্তি?
উত্তর: ‘ভাগ্যবান যোদ্ধাই প্রথম রাজপথ অলংকৃত করে’ একথা বলেছেন ভল্টেয়ার।
16. ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থের প্রণেতা কে?
উত্তর: ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থের প্রণেতা হলেন হবস।
17. রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর: সার্বভৌমিকতা হলো রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
18. ‘জনগণের বাণীই ঈশ্বরের বাণী’ কে বলেছেন?
উত্তর: ‘জনগণের বাণীই ঈশ্বরের বাণী’ বলেছেন রুশো।
19. ‘সামাজিক চুক্তি’ মতবাদে দুটি চুক্তির কথা বলেছেন কে?
উত্তর: ‘সামাজিক চুক্তি’ মতবাদে দুটি চুক্তির কথা বলেছেন জন লক।
20. হবস কীরূপ রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন?
উত্তর: হবস স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন।
21. হবস এর মতে প্রকৃতির রাজ্য কিরূপ ছিল?
উত্তর: হবসের মতে প্রকৃতির রাজ্য ছিল দুর্বিষহ।
22. ‘সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থটির প্রণেতা কে?
উত্তর: ‘সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন রুশো।
23. কার মতে -আদিম মনুষ্য সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে অর্পণ করেছিল?
উত্তর: হবসের মতে -আদিম মনুষ্য সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে অর্পণ করেছিল।
24. কার মতে প্রকৃতির রাজ্য ছিল মর্ত্যের স্বর্গ?
উত্তর: রুশোর মতে প্রকৃতির রাজ্য ছিল মর্ত্যের স্বর্গ।
25. ‘সাধারণ ইচ্ছা’ ধারণাটির প্রবক্তা কে?
উত্তর: সাধারণ ইচ্ছা ধারণাটির প্রবক্তা হলেন রুশো।
26. রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক কাকে বলা হয়?
উত্তর: সরকারকে রাষ্ট্রের মস্তিস্ক বলা হয়।
27. পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা কম জনসংখ্যার দেশটির নাম কি?
উত্তর: ভ্যাটিকান সিটি হল পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা কম জনসংখ্যার দেশ।
28. ‘চুক্তির দ্বারা জনগণ তাদের সমস্ত ক্ষমতা রাজার হাতে অর্পণ করেছিল’ উক্তিটি কার?
উত্তর: ‘চুক্তির দ্বারা জনগণ তাদের সমস্ত ক্ষমতা রাজার হাতে অর্পণ করেছিল’- এ কথা বলেছেন জন লক।
29. কত খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে গৌরবময় বিপ্লব শুরু হয়?
উত্তর: 1688 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে গৌরবময় বিপ্লব শুরু হয়।
30. ‘টু ট্রিটিজ অন সিভিল গভর্মেন্ট’ গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: ‘টু ট্রিটিজ অন সিভিল গভর্মেন্ট’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন জন লক।
31. ‘চুক্তির ধারা তাদের সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করেছিল সাধারণ ইচ্ছার হাতে’ উক্তিটি কার?
উত্তর: চুক্তির ধারা তাদের সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করেছিল সাধারণ ইচ্ছার হাতে’ – একথা বলেছেন রুশো।
32. গৌরবময় বিপ্লব এর তাত্ত্বিক প্রবক্তা কে?
উত্তর: গৌরবময় বিপ্লব এর তাত্ত্বিক প্রবক্তা হলেন জন লক।
33. মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে কিরূপ প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন?
উত্তর: মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে একটি অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন।
34.পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বেশি জনসংখ্যা দেশটির নাম কি?
উত্তর: গণপ্রজাতন্ত্রী চিন হল পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বেশি জনসংখ্যা দেশ।
35. রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে সনাতন মতবাদগুলির মধ্যে কোন মতবাদটি শ্রেষ্ঠ?
উত্তর: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে সনাতন মতবাদগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক মতবাদটি শ্রেষ্ঠ।
36. ‘লেকচাস অন জুরিসপ্রুডেন্স’ গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: ‘লেকচাস অন জুরিসপ্রুডেন্স’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন জন অস্টিন।
37. রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক মতবাদটি কিরূপ মতবাদ?
উত্তর: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক মতবাদটি একটি অবৈজ্ঞানিক মতবাদ।
38. ‘রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রন্ত্র রাষ্ট্রের পাপের প্রতীক’- কার উক্তি?
উত্তর: ‘রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রন্ত্র রাষ্ট্রের পাপের প্রতীক’- একথা বলেছেন ট্রিটস্কে।
39. কে রাষ্ট্রের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন?
উত্তর: অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন।
40. সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়া ব্যক্তির পক্ষে কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়।
41. মেকিয়াভেলি কোন গ্রন্থে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহার করেন?
উত্তর: ‘ম্যাকিয়াভেলি‘ দ্য প্রিন্স’ নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহার করেন।
42. ‘প্যাট্রিয়ার্কা’ (Patriarcha) গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: অধ্যাপক ফিলমার ‘প্যাট্রিয়ার্কা’ (Patriarcha) গ্রন্থটি রচনা করেন।
43. ‘জনগণের ইচ্ছাই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা’ কে কথা বলেছেন?
উত্তর: ‘জনগণের ইচ্ছায় হল ঈশ্বরের ইচ্ছা’ একথা বলেছেন জাঁ জ্যাক রুশো।
বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১) হবস বর্ণিত “প্রাকৃতিক অবস্থা” বর্ণনা করাে।
উত্তর: ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের গৃহশিক্ষক টমাস হবস তাঁর ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan) গ্রন্থে চুক্তিবাদের আলােচনা করে রাজনৈতিক চিন্তাজগতে আলােড়ন সৃষ্টি করেন। হবস হলেন চুক্তিবাদের আধুনিক ভাষ্যকার।
‘প্রাকৃতিক অবস্থা’-র বর্ণনা থেকেই হবস তার চুক্তিবাদী আলােচনা শুরু করেন। হবসের মতে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক-সামাজিক। অর্থাৎ প্রাকৃতিক অবস্থায় কোনাে সমাজজীবন ছিল না। মানবচরিত্র সম্পর্কে তাঁর সম্পূর্ণ স্বকীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমে হবস প্রাক-সামাজিক প্রাকৃতিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন। হবসের মতে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর, কলহপ্রিয়, লােভী, ধূর্ত, শঠ, নির্দয় ও আক্রমণমুখী। এই কারণে প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের শত্রু। হবস এই অবস্থাকে ‘সকলের সঙ্গে সকলের যুদ্ধ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাভাবিক আইন বলতে ‘জোর যার মুল্লুক তার’-কে বােঝাত। স্বার্থসাধনের জন্য অন্যকে হত্যা করতেও কেউ দ্বিধাবােধ করত না। একে অন্যকে শত্রু ভাবত। প্রত্যেকে প্রত্যেককে এড়িয়ে চলত। প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন হয়ে উঠল নিঃসঙ্গ। ফলে প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য মানুষ উদ্যোগী হয়ে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন ২) অ্যারিস্টটল কেন মানুষকে রাজনৈতিক জীব হিসাবে চিহ্নিত করেন?
উত্তর: অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব (“Man is by nature Social Animal”)। গ্রিক দর্শন অনুযায়ী অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র ও সমাজকে অভিন্ন মনে করতেন। অর্থাৎ মানুষ একইসঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। কারণ একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্য দিয়েই মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব। তিনি রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করেছেন। রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তিনি বলেন—“The State is prior to the individual,”অর্থাৎ রাষ্ট্র হল একটি সার্বিক সত্তা। ব্যক্তি তার অংশমাত্র; সমগ্র ছাড়া অংশের সৃষ্টি ও বিকাশ আজও সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রকে তিনি অপরিহার্য মনে করেন।
প্রশ্ন ৩) রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করাে।
উত্তর: রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে পার্থক্য বর্তমান। নিম্নে সেগুলি উল্লেখ করা হল-
প্রথমত, রাষ্ট্র প্রধানত চারটি উপাদান নিয়ে গঠিত। এগুলি হল—নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমিকতা। তাই সরকার রাষ্ট্রের একটি অংশমাত্র। অংশ কখনও সমগ্রের সমান হতে পারে না। প্রাণীর সারাদেহ আর মাথা এক জিনিস নয়। মাথা দেহের অংশমাত্র। তেমনি সরকার ও রাষ্ট্র এক জিনিস নয়।
দ্বিতীয়ত, রাষ্টের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সব মানুষকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু সরকার গঠিত হয় দেশ শাসনের কাজে নিযুক্ত মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার অস্থায়ী। এক সরকারের পরিবর্তে অন্য সরকার আসে। কিন্তু রাষ্ট্র একইভাবে থেকে যায়।
চতুর্থত, ব্যক্তি সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে। সরকারের নীতিকে সমালােচনা করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার কোনাে অভিযােগ থাকতে পারে না।
পঞ্চমত, রাষ্ট্র বলতে সাধারণত নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের কথা মনে পড়ে। যেমন, ভারত রাষ্ট্র বলতে ভারতের ভৌগােলিক সীমানার কথা মনে আসে। কিন্তু সরকার বলতে যারা শাসন করে তাদের বােঝায়।
ষষ্ঠত, সব রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এক। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমিকতা অবশ্যই আছে। কিন্তু সব সরকার এক ধরনের নয়। যেমন, কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও গণতন্ত্র আছে; কোথাও এককেন্দ্রিক, আবার কোথাও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা আছে।
সপ্তমত, রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সরকার সেই ক্ষমতা প্রয়ােগ করে মাত্র। তাই সরকার সরে গেলে সে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকারী হারায়। অন্য সরকার এসে রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা প্রয়ােগ করে।।
অষ্টমত, রাষ্ট্রকে দেখা যায় না। তার সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযােজ্য। কিন্তু সরকার হল বাস্তব রূপ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এর অস্তিত্ব বুঝতে পারি।
প্রশ্ন ৪) রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদের উপাদান হিসাবে ধর্মের গুরুত্ব আলােচনা করাে।
উত্তর: গােষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে রক্তের বন্ধন দীর্ঘস্থায়ী হল না। তার প্রভাব ধীরে ধীরে কমে গেল। এই অবস্থায় গােষ্ঠীজীবনের সংহতি বজায় রাখল ধর্ম। ধর্ম বলতে মানুষ প্রকৃতি পূজা এবং পূর্বপুরুষদের পূজা বুঝত। তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দেবতার কোপ বলে মনে করত। দুঃখদুর্দশাকে পূর্বপুরুষদের অভিশাপের ফল বলে গােষ্ঠীপ্রধানের মাধ্যমে দেবতা ও পূর্বপুরুষদের পূজা দিত। ফলে গােষ্ঠীপ্রধান নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই কর্তৃত্ব থেকে জন্ম নিল রাষ্ট্র। অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, রাষ্ট্রনৈতিক বিবর্তনের প্রথম দিকে ও সবথেকে সংকটময় যুগে ধর্ম বর্বরােচিত অরাজকতা দমন করেছিল এবং শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছিল। এই আনুগত্যের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কিছু চতুর লােক সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযােগ নিয়ে নিজেরা অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলে প্রচার করল। এদের বলা হত জাদুকর। এরা এই সুযােগে নিজেদের নেতা হিসাবে ঘােষণা করল। এদের কারচুপি ধরা পড়ায় এদের মধ্যে কেউ কেউ পরে পুরােহিত সেজে আনুগত্য লাভ করে রাজায় পরিণত হয়। বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ফ্রেজার তাই বলেছেন—“জাদুকরেরা অবশেষে পুরােহিত রাজায় পরিণত হল।”
প্রশ্ন ৫) ঐশ্বরিক মতবাদকে কোন কোন দিক থেকে সমালােচনা করা যায়?
উত্তর: ঐশ্বরিক মতবাদ বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে। যেমন—
• (ক) কাল্পনিক মতবাদ
বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত যে, এই মতবাদ নিছক কাল্পনিক। ইতিহাসে এর সন্ধান পাওয়া যায় না। ঈশ্বর একের পর এক রাষ্ট্র তৈরি করে এক-একজনকে তার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ ধারণা বিশ্বাসযােগ্য নয়।
• (খ) ধর্ম ও রাজনীতি এক নয়
ধর্মযাজকরাই বলেছেন, ধর্ম ও রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক। জিশুখ্রিস্ট নিজেই বলেছেন—“সিজারের যা কিছু প্রাপ্য সিজারকে দাও। ঈশ্বরের যা কিছু প্রাপ্য, তা ঈশ্বরকে দাও।” বিখ্যাত ধর্মযাজক হকার বলেছেন—“ধর্মের ব্যাপারে ঈশ্বরের কথা স্বীকার করা যায়, কিন্তু লৌকিক ব্যাপারে নয়।” সুতরাং রাষ্ট্রের ব্যাপারে ঈশ্বরকে টেনে আনা ঠিক নয়।
• (গ) বিপজ্জনক মতবাদ
এই মতবাদ বিপজ্জনক। কারণ, অতীতে এই মতবাদের অজুহাতে রাজারা নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতাকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলে প্রচার করেছিল। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারকে পদানত করা হয়েছিল।
• (ঘ) অযৌক্তিক মতবাদ
ঈশ্বর মানুষের মঙ্গল করে। তাই যে রাজা মানুষের কল্যাণ করে, তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে মনে করলেও যে অত্যাচারী রাজা তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে মনে করার কোনাে যুক্তি মহাভারতে বলা হয়েছে, কল্যাণকামী রাজাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করা হয়। কিন্তু যে রাজা প্রজা রক্ষা করতে পারে না, তাকে ক্ষিপ্ত কুকুরের মতাে বিনষ্ট করা উচিত।
• (ঙ) অসম্পূর্ণ মতবাদ
যেখানে রাজতন্ত্র আছে, সেখানে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে কল্পনা করা গেলেও যেখানে রাজতন্ত্র নেই, রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, সেই রাষ্ট্রে ঈশ্বরের প্রতিনিধি কে তার উত্তর এই মতবাদে নেই।
প্রশ্ন ৬) রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করাে।
উত্তর : রাষ্ট্র ও সমাজের রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক বা পার্থক্য দেখাতে গেলে প্রথমে উভয়ের সংজ্ঞা সংক্ষেপে দেওয়া প্রয়ােজন। সমাজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন- সাধারণভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং সম্পর্ক বিষয়ে সচেতন মানবগােষ্ঠীকে সমাজ বলে। অন্যদিকে রাষ্ট্র বলতে বােঝায় বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত এক আবশ্যিক রাজনৈতিক সংগঠন।
প্রাচীনকালে গ্রিক দার্শনিকরা রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কোনাে পার্থক্য আছে বলে মনে করতেন না। অ্যারিস্টটল বলেছেন—“মানুষের পূর্ণ বিকাশ রাষ্ট্রেই সম্ভব।” এখানে রাষ্ট্রের মধ্যে সমাজ কথাটি নিহিত আছে। কারণ তিনি বলেছেন–“মানুষ সমাজবদ্ধ জীব।” অর্থাৎ সমাজের মধ্যে মানুষের প্রকৃত বিকাশ ঘটে। তবে রাষ্ট্র ও সমাজ এক নয়। কারণ-
প্রথমত, সমাজের জন্ম অনেক আগে হয়েছে। আদিম মানুষ যখন গােষ্ঠীগত জীবন শুরু করে, তখন থেকে সমাজের উৎপত্তি। এর অনেক পরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র এসেছে।
দ্বিতীয়ত, সমাজের কাজ হল মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক, যেমন—নৈতিক দিক, ধর্মীয় দিক প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলােচনা করে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতা ছাড়া রাষ্ট্র বাঁচতে পারে না। কিন্তু সার্বভৌমিকতা ছাড়া সমাজ গড়ে উঠতে পারে।
চতুর্থত, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছাড়া রাষ্ট হয় না। কিন্তু নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছাড়া সমাজ গড়ে উঠতে পারে। তাই লিকক বলেছেন- “সমাজ শব্দটির সঙ্গে ভূখণ্ডের ধারণা যুক্ত নয়।”
পঞ্চমত, রাষ্ট্রের জন্য একটি সুগঠিত সরকার থাকা একান্ত প্রয়ােজন। কারণ, সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা পূরণ হয়। কিন্তু সমাজের ক্ষেত্রে এমন কোনাে সরকারের প্রয়ােজন হয় না।
প্রশ্ন ৭) রুশাের সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব আলােচনা করাে।
উত্তর : ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশাে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “সামাজিক চুক্তি” (Social Contract) গ্রন্থে এই মতবাদ প্রচার করেন। রুশাে বলেছেন—“মানুষ পুর্বে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। সেই পরিবেশ ছিল স্বর্গরাজ্য। সেখানে মানুষে-মানুষে কোনাে হানাহানি ছিল। ছিল না কোনাে হিংসা। এক সময়ে মানুষের জীবনে দেখা দিল সমস্যা। প্রকৃতির রাজ্য ভরে উঠল হিংসা ও অরাজকতায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ সামাজিক চুক্তি করল।”
রুশাের মতে চুক্তি হয়েছিল একটি। এই চুক্তির দ্বারা কোনাে ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সমাজের হাতে। রুশাে তার নামকরণ করেছেন—“সাধারণের ইচ্ছা” বা ‘General Will’। ‘সাধারণের ইচ্ছা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—সকলের ইচ্ছার যােগফল হল সাধারণ ইচ্ছা এবং অপ্রকৃত ইচ্ছা। সর্বমানুষের প্রকৃত ইচ্ছার যােগফল হল “সাধারণের ইচ্ছা”। প্রকৃত ইচ্ছা কোনাে ভুল করে না বলে সাধারণের ইচ্ছা” ভুল করে না। এই ইচ্ছা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তাই এর নির্দেশ সবাই মানতে বাধ্য। রুশাের বিশেষ অবদান হল—তিনি গণ-সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করেছেন। “Voice of the People is the voice of God”——অর্থাৎ জনগণের কণ্ঠস্বর হল ঈশ্বরের কণ্ঠস্বররুশাের এই বাণী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অমূল্য সম্পদ।
প্রশ্ন ৮) রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়ােগ মতবাদের মূলকথা বর্ণনা করাে।
উত্তর : বলপ্রয়ােগ মতবাদের প্রবক্তাগণ বলেন, মানুষ কলহপ্রিয় ও ক্ষমতালােভী। সৃষ্টির আদিম কাল থেকে দেখা যাচ্ছে মানুষে-মানুষে বিরােধ। শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির উপর বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে গােষ্ঠী তৈরি করছে। পরে শক্তিশালী গােষ্ঠী গােষ্ঠীপতির নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দুর্বল গােষ্ঠীকে পরাজিত করেছে এবং তাদের উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে উপজাতিতে পরিণত হয়েছে। তারপর বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিলে সবথেকে শক্তিশালী উপজাতি বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারা রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সুতরাং এই মতবাদের মূলকথা হল, একমাত্র বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে।
বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমর্থকগণ আরও বলেন যে, শুধু রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে বলপ্রয়ােগ ঘটেনি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পরও তার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বলপ্রয়ােগ প্রয়ােজন। অর্থাৎ এই মতবাদ শুধুমাত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে না, রাষ্ট্রের প্রকৃতিও ব্যাখ্যা করে।
প্রশ্ন ৯) রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বা সংঘের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
উত্তর : রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বর্তমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের মধ্যে বেশ কিছুপার্থক্য দেখা যায়—
প্রথমত, রাষ্ট্র নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যেমন, রামকৃয় মিশন, রেডক্রস সােসাইটি প্রভৃতি সংঘের কার্যকলাপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাই সে নাগরিকদের যে-কোনাে শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। সেই কারণে সে কাউকে কঠোর শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে না।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সামাজিক সংঘের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। নিজের ইচ্ছার উপর তা নির্ভর করে।
চতুর্থত, একজন ব্যক্তি কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে। কিন্তু কোনাে ব্যক্তি একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে পারে। যেমন, কেউ একইসঙ্গে ভারত ও চিনের নাগরিক হতে পারে না। কিন্তু কেউ একইসঙ্গে ফুটবল ক্লাবের এবং কোনাে পূজা কমিটির সদস্য হতে পারে।
পঞ্চমত, স্থায়িত্বের দিক থেকে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। রাষ্ট্র সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু সামাজিক সংগঠনগুলি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক সংঘ গড়ে ওঠে এবং অনেকের পতনও ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্র স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে টিকে থাকে।
ষষ্ঠত, সামাজিক সংঘ সাধারণত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। যেমন, মােহনবাগান ক্লাব খেলাধুলার উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু রাষ্ট্র নানারকম উদ্দেশ্য সাধন করে।
সপ্তমত, রাষ্ট্র যে-কোনাে সংঘ তৈরি করতে পারে। কিন্তু কোনাে সামাজিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না।
অষ্টমত, গঠনের দিক থেকে রাষ্ট্র অনেক বড়াে হতে পারে। যেমন, চিনের লােকসংখ্যা ১৪৩ কোটি। কিন্তু কোনাে একটি সামাজিক সংঘের এত সদস্য নেই।
নবমত, রাষ্ট্র সামাজিক সংগঠনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রয়ােজন দেখা দিলে সংগঠনকে ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু কোনাে সংগঠন রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ বা ভেঙে দিতে পারে না।
প্রশ্ন ১০ জাতিপুঞ্জও কি একটি রাষ্ট্র?
উত্তর : জাতিপুঞ্জ রাষ্ট্র নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহযােগিতায় এটি গড়ে উঠেছে। অনেকে একে Super State বা মহান রাষ্ট্ররূপে বর্ণনা করেছেন। কারণ—
প্রথমত, রাষ্ট্রের যেমন একটি সংবিধান থাকে, জাতিপুঞ্জের তেমনি একটি সংবিধান আছে যাকে বলা হয় সনদ।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের একটি সরকার থাকে এবং সরকারের তিনটি বিভাগ থাকে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। জাতিপুঞ্জের তেমনি সরকার আছে। এর শাসন বিভাগ হল নিরাপত্তা পরিষদ, আইন বিভাগ হল সাধারণ সভা এবং বিচার বিভাগ হল আন্তর্জাতিক আদালত।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্র যেমন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে, তেমনি জাতিপুঞ্জও অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যায় না। কারণ-
প্রথমত, জাতিপুঞ্জের নিজস্ব কোনাে ভূখণ্ড নেই। নির্দিষ্ট কোনাে নিজস্ব জনসমষ্টি নেই।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের সদস্য হওয়া নাগরিকদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। কিন্তু জাতিপুঞ্জের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলি স্বেচ্ছায় এতে যােগ দিয়েছে, ইচ্ছা করলে যে-কোনাে সময় থেকেই এরা সদস্যপদ ত্যাগ করতে পারে। কেউ সদস্য নাও হতে পারে।
তৃতীয়ত, জাতিপুঞ্জের সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্র এই ক্ষমতা ভােগ করে বলে তার আইন নাগরিকরা মানতে বাধ্য, না মানলে রাষ্ট্র শাস্তি দেবে। কিন্তু জাতিপুঞ্জের কোনাে নির্দেশ মান্য করা রাষ্ট্রের পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়। তাই জাতিপুঞ্জ সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারে না।
চতুর্থত, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে ভাগ করা যায় না। তাই রাষ্ট্রের সদস্য নাগরিকদের সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। কিন্তু জাতিপুঞ্জে সদস্য রাষ্ট্রদের সার্বভৌম ক্ষমতা আছে।
সুতরাং জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা চলে না। এটি হল কতকগুলি সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি
আন্তর্জাতিক সংস্থা।
প্রশ্ন ১১) রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসাবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের গুরুত্ব বর্ণনা করাে।
উত্তর : নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। শুন্যে রাষ্ট্র হয় না। কোনাে রাষ্ট্রের ভূখণ্ড বলতে শুধুমাত্র মাটির উপরিভাগ বােঝায় না। তার মধ্যে নদীনালা, পাহাড়-পর্বত এমনকি মাটির নীচের সম্পদ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। ভূখণ্ডের উপরের আকাশ রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে পড়ে। তাই কোনাে দেশের বিমান অন্য দেশের আকাশপথ ব্যবহার করলে তার অনুমতি নিতে হয়। উপকূল সংলগ্ন সমুদ্রের কিছু অংশও ভূখণ্ডের মধ্যে পড়ে। এতদিন নিয়ম ছিল উপকুলের নিম্নতম জলরেখা থেকে সমুদ্রের তিন মাইল পর্যন্ত ওই ভূখণ্ডের মধ্যে পড়ে। ওই সীমানা এখন বারাে মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তবে ভূখণ্ডের নিয়মের কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। আন্তর্জাতিক নিয়মের ফলে বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাস, বিদেশের পতাকাধারী জাহাজ বা বিমান তাদের রাষ্ট্রের ভূখণ্ড বলে গণ্য করা হবে।
ভূখণ্ডের আয়তন কত হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ বলেছেন, ক্ষুদ্র রাষ্ট ভালাে, শাসনকার্যে সুবিধা হয়। সরকারের সঙ্গে জনগণের যােগাযােগ সহজ হয়। কিন্তু ট্রিটস্কে প্রভৃতি দার্শনিকরা বলেছেন,—“ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হওয়া পাপ”। কারণ, তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়। কিন্তু একথা ঠিক নয়। জাপান ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী।
রাষ্ট্র ছােটো হবে, না বড়াে হবে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য আলােচনার ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল কথা হল রাষ্ট্র হতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকা চাই।
প্রশ্ন ১২) রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসাবে সার্বভৌমিকতার গুরুত্ব বর্ণনা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতা বলতে বােঝায় চূড়ান্ত ক্ষমতা। রাষ্ট্র এই ক্ষমতা ভােগ করে। এই ক্ষমতার বলে রাষ্ট্র তার এলাকার সব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস বলেছেন—“ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর আরােপিত মৌলিক, চরম ও অসীম ক্ষমতার নাম হল সার্বভৌমিকতা।” অন্য কোনাে প্রতিষ্ঠানের এই ক্ষমতা থাকে না। তাই অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন—“এই সার্বভৌমিকতাই রাষ্ট্রকে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক করে।”
সার্বভৌমিকতার দুটি দিক আছে, অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা ও বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা বলতে বােঝায় রাষ্ট্র বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আর বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা বলতে বােঝায়—এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন মতামত দিতে সক্ষম।
সমালােচকরা বলেছেন, রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। কারণ রাষ্ট্র প্রথা, সামাজিক রীতিনীতি ও জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না। বাহ্যিক ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না।
সমালােচিত হলেও একথা মানতেই হবে যে, সার্বভৌমিকতা ছাড়া কোনাে রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। এই ক্ষমতার জোরে সে তার মধ্যেকার সব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের প্রাণ। প্রাণ ছাড়া জীব দেহের সচল অস্তিত্ব থাকে না। তেমনি সার্বভৌমিকতা ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন ১৩) লক কোন অর্থে উদারনীতিবাদের জনক?
উত্তর : লকের রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি প্রাক্-রাষ্ট্রীয় জীবনকে মানুষের সরল ও স্বাভাবিক জীবন হিসেবে গণ্য করেন। প্রাকৃতিক জীবনে মানুষের সম্পত্তি, জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার ছিল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য মানুষ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের হাতে আংশিক দায়িত্ব অর্পণ করলেও সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত। লকের রাষ্ট্রদর্শনে রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বোচ্চ ব্যক্তির পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট সংস্থাকে অর্পণ করা হয়। এই সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে জনগণ তার বিরােধিতা করতে পারে। লকের মতে, জনগণের স্বাধীনতাই হল রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের প্রধান শর্ত। উদারনৈতিক দর্শনের মূল আদর্শ হল ব্যক্তিস্বাধীনতা। ব্রিটেনে পুঁজিবাদের বিকাশের পর্যায়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করার জন্য বলা হয়—“লক হলেন উদারনীতিবাদের জনক” (“Lock was the Forerunner of Liberal Political Philosophy”)। লকের উদারনীতিবাদ সমালােচনামুক্ত নয়। সমালােচকরা বলেন, লকের উদারনৈতিক দর্শন হল তৎকালীন পুঁজিপতি শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার হাতিয়ার।
প্রশ্ন ১৪) রাষ্ট্রের অবলুপ্তি সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা লেখাে।
উত্তর : মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের শেষ সিদ্ধান্ত হল রাষ্ট্রের অবলুপ্তি। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Communist Manifesto) গ্রন্থে মার্কস ও এঙ্গেলস ঘােষণা করেন যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উন্নততর সমাজ গঠিত হবে। পুঁজির স্বাধীন সত্তা, মজুরি ও শ্রমের পার্থক্য বিলুপ্ত হবে। শ্রেণি ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। এন্টিভুরিং রচনায় এঙ্গেলস ঘােষণা করেন যে, সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ বিলুপ্ত হবে। বিশেষ শ্রেণির আধিপত্য থাকবে না। শ্রেণিশােষণের যন্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রের প্রয়ােজন থাকবে না। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অপ্রয়ােজন হবে (“The State will wither away”)। লেনিনের মতে রাষ্ট্রের বিলুপ্তির অর্থ নৈরাজ্যবাদ নয়।
রাষ্ট্রের বিলুপ্তি সম্পর্কিত তত্ত্বটি সমালােচনার ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্র সম্পর্কে সাম্প্রতিক ব্যাখ্যায় মিলিব্যান্ড, পলসুইজি প্রমুখ বলেছেন—পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মার্কসীয় দর্শন এক নতুন দিক সংযােজন করেছে। সমালােচকদের মতে, বিশ্বের একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিফলিত হলেও রাষ্ট্র ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে।
প্রশ্ন ১৫) রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসাবে জনসমষ্টির গুরুত্ব বর্ণনা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্র মানুষের তৈরি। মানুষ ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড (Holland) তাই বলেছেন—“রাষ্ট্র হল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী বহুসংখ্যক লােকের সমষ্টি।” রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী জনসমষ্টিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—নাগরিক ও বিদেশি নাগরিকরা রাষ্ট্রের সভ্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখায়। বিদেশিরা অন্য রাষ্ট্রের সদস্য এবং তাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। রাষ্ট্রের জনসমষ্টি কত হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। প্লেটো বলেছেন—আদর্শ রাষ্ট্রের জনসংখ্যা হবে ৫০৪০। রুশাে বলেছেন—এই জন্যসংখ্যা হবে ১০,০০০। কিন্তু বাস্তবে দেখি ১৪৩ কোটি মানুষের চিন দেশ যেমন আছে, তেমনি ১৫,০০০ লােকের মােনাকা দেশও আছে।
আধুনিক চিন্তাবিদরা জনসংখ্যাকে নির্দিষ্ট করে বলার পক্ষপাতী নন। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, জনসংখ্যা যদি খুব কম হয়, তাহলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানাে যাবে না। রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে না। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল হবে। আবার জনসংখ্যা যদি খুব বেশি হয়, তাহলে খাদ্যের অভাব ও বেকার সমস্যা দেখা দেবে। সুতরাং জনসংখ্যা ও সম্পদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়ােজন।
প্রশ্ন ১৬) পশ্চিমবঙ্গ কি একটি রাষ্ট্র? তােমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর : পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, (ক) একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, (খ) জনসমষ্টি এবং (গ) একটি সরকার আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গকে রাষ্ট্র বলা যাবে না। কারণ-
প্রথমত, এর সার্বভৌমিকতা নেই। একে কেন্দ্রের অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। কেন্দ্রের বিরােধী কোনাে আইন করলে তা বাতিল হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনাে চুক্তি বা কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের শাসক প্রধান হলেন রাজ্যপাল। অথচ তিনি কেন্দ্রের মনােনীত ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র হলে কেন্দ্র তার প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যপালকে মনােনীত করে পাঠাতে পারত না।
চতুর্থত, কেন্দ্র ইচ্ছা করলে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পরিবর্তন করতে পারে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের সম্মতি নাও নিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ সার্বভৌম হলে কেন্দ্র এভাবে সীমানা পরিবর্তন করতে পারত না।
পঞ্চমত, কেন্দ্র প্রয়ােজন মনে করলে কেন্দ্রের শাসন রাজ্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। সংবিধানে তার বিধিব্যবস্থার উল্লেখ আছে। পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র হলে কেন্দ্র তার শাসনভার রাজ্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারত না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের কোনাে সার্বভৌমিকতা নেই। তাই পশ্চিমবঙ্গকে রাষ্ট্র বলা যায় না। একে অঙ্গরাজ্য বলা হয়।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১) রাষ্ট্র কাকে বলে?
উত্তর : গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle) বলেছেন, ‘Man is a social animal’—অর্থাৎ মানুষ একটি সামাজিক প্রাণী। তাই সে নিজের বিকাশের জন্যে সমাজ গঠন করেছে। এই সমাজের মধ্যে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র হল সমাজের শ্রেষ্ঠ সংগঠন। অধ্যাপক ল্যাস্কির (Laski) ভাষায়—রাষ্ট্র হল সমাজের সৌধের চূড়া। কারণ, রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। সেই আইন সবাইকে মেনে চলতে হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলােচ্য বিষয় হল রাষ্ট্র। অথচ রাষ্ট্র বা State কথাটি বেশিদিন আগে জন্ম নেয়নি। ইতালীয় দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি ষােড়শ শতকে তাঁর ‘The Prince’গ্রন্থে সর্বপ্রথম State কথাটি ব্যবহার করেন। তার পূর্বে অবশ্য রাষ্ট্র ছিল। তবে অন্য নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে রাষ্ট্র কথাটি শুধু সর্বজন পরিচিত নয়, সমাজজীবনে এটি অপরিহার্য। এই অপরিহার্যতা সত্ত্বেও এর সংজ্ঞা সম্পর্কে ঐক্যমত্য গড়ে ওঠেনি।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা (Definition of State)
অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দেওয়া সংজ্ঞার মধ্যে মিল নেই। অ্যারিস্টটল বলেছেন—“স্বাবলম্বী এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের জন্য যখন কতকগুলি পরিবার বা গ্রাম একসঙ্গে মিলিত হয়, তখন তাকে বলে রাষ্ট্র।
কিন্তু অ্যারিস্টটলের সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ। বর্তমানে পরিবার ও গ্রাম ছাড়া রাষ্ট্রের মধ্যে শহরও থাকে। এই সংজ্ঞার মধ্যে তার কোনাে উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রপতি উইলসন (Wilson) বলেছেন—“নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইন অনুসারে সংঘবদ্ধ জনসমষ্টির নাম রাষ্ট্র।” কিন্তু একমাত্র আইনের মাপকাঠি দিয়ে রাষ্ট্রকে বিচার করা যায় না বা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দেওয়া সঠিক নয়। তাই এই সংজ্ঞাও গ্রহণযােগ্য নয়। জার্মান দার্শনিক বুন্টসলি (Bluntschli) রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—“রাষ্ট্র হল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমাজ।” কিন্তু এই সংজ্ঞার মধ্যে সার্বভৌমিকতার উল্লেখ নেই। অন্যদিকে, লেনিন (Lenin) বলেছেন—“রাষ্ট্র হল শ্রেণিশাসনের একটি যন্ত্র, যে যন্ত্র দিয়ে এক শ্রেণি অপর শ্রেণিকে শােষণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রের এই সংজ্ঞা এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেগুলির কোনােটিও এককভাবে সম্পূর্ণ নয়। অধ্যাপক গার্নার (Garner) বিভিন্ন সংজ্ঞার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা গ্রহণযােগ্য। তাঁর ভাষায় বলা যায়—“রাষ্ট্র হল বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন একটি জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ মুক্ত এবং যার একটি সুগঠিত শাসনব্যবস্থা আছে—যে শাসনব্যবস্থার প্রতি অধিবাসীদের অধিকাংশই স্বাভাবিকভাবে আনুগত্য দেখায়।”
প্রশ্ন ২) রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, সেগুলির কোনােটি এককভাবে সম্পূর্ণ নয়। অধ্যাপক গার্নার (Garner) বিভিন্ন সংজ্ঞার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা গ্রহণযােগ্য। গার্নারের সংজ্ঞার মধ্যে আমরা রাষ্ট্র গঠনের চারটি উপাদান দেখতে পাই। এগুলি হল—জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার এবং সার্বভৌমিকতা। এছাড়া আরও দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়। এই দুটি হল—স্থায়িত্ব ও স্বীকৃতি।
- (ক) জনসমষ্টি
রাষ্ট্র মানুষের তৈরি। মানুষ ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্র হল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী বহুসংখ্যক মানুষের সমষ্টি। রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনসমষ্টিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, নাগরিক ও বিদেশি নাগরিকরা রাষ্ট্রের সভ্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখায়। বিদেশিরা অন্য রাষ্ট্রের সদস্য এবং তারা তাদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। রাষ্ট্রের জনসমষ্টি কত হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, জনসংখ্যা যদি খুব কম হয়, তাহলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানাে যাবে না। রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে না। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল হবে। আবার জনসংখ্যা যদি খুব বেশি হয়, তাহলে খাদ্যের অভাব ও বেকার সমস্যা দেখা দেবে। তাই জনসংখ্যা ও সম্পদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়ােজন।
- (খ) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড
নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রাষ্ট্রের একটি বৈশিষ্ট্য। শূন্যে রাষ্ট্র হয় না। কোনাে রাষ্ট্রের ভূখণ্ড বলতে শুধুমাত্র মাটির উপরিভাগকে বােঝায় না। তার মধ্যে নদীনালা, পাহাড়-পর্বত এমনকি মাটির নীচের সম্পদ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। ভূখণ্ডের উপরের আকাশ রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে পড়ে। আবার উপকূল সংলগ্ন সমুদ্রের কিছু অংশও ভূখণ্ডের মধ্যে পড়ে।
ভূখণ্ডের আয়তন কত হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ বলেছেন—ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভালাে, শাসনকার্যে সুবিধা হয়। সরকারের সঙ্গে জনগণের যােগাযােগ সহজ হয়। আবার ট্রিটস্কে বলেছেন-
“ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হওয়া পাপ। কারণ, তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়।” কিন্তু রাষ্ট্র ছােট, না বড়াে হবে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল কথা হল রাষ্ট্র হতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকা চাই।
- (গ) সরকার
রাষ্ট্রের আর একটি উপাদান হল সরকার। অধ্যাপক গেটেলের ভাষায়—সরকার হল রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্র। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। সরকার মানুষের মস্তিষ্কের মতাে। মস্তিষ্ক যেমন শরীরকে পরিচালিত করে, সরকার তেমনি রাষ্ট্রকে পরিচালিত করে। সরকার বলতে বােঝায়—যারা শাসনকার্যে নিযুক্ত থাকে। তার অর্থ এই নয় যে, যারা শাসন বিভাগে আছে তারাই সরকার। প্রকৃত অর্থে, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সমষ্টিকে বলে সরকার। সরকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কোনাে রাষ্ট্রে থাকে রাষ্ট্রতন্ত্র, কোথাও গণতন্ত্র আবার কোথাও থাকে যুক্তরাষ্ট্র, কোথাও বা এককেন্দ্রিক সরকার। রাষ্ট্র হতে গেলে যে-কোনাে ধরনের সরকার থাকতেই হবে।
- (ঘ) সার্বভৌমিকতা
রাষ্ট্রের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতা বলতে বােঝায় চূড়ান্ত ক্ষমতা। রাষ্ট্র এই ক্ষমতা ভােগ করে। এই ক্ষমতার বলে রাষ্ট্র তার এলাকার সব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বার্জেস বলেছেন—“ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর আরােপিত মৌলিক, চরম ও অসীম ক্ষমতার নাম হল সার্বভৌমিকতা।” অন্য প্রতিষ্ঠানের এই ক্ষমতা নেই। তাই ল্যাস্কি বলেছেন- “এই সার্বভৌমিকতাই রাষ্ট্রকে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক করে।”
কিন্তু এই ক্ষমতা সমালােচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও একথা মানতেই হবে যে, সার্বভৌমিকতা ছাড়া কোনাে রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। এই ক্ষমতার জোরে সে তার মধ্যেকার সব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের প্রাণ। প্রাণ ছাড়া জীবদেহের সচল অস্তিত্ব থাকে না। তেমনি
সার্বভৌমিকতা ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়।
- (ঙ) স্থায়িত্ব
কোনাে জনসমষ্টি স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করলে তবেই তাকে রাষ্ট্র বলা যাবে। রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। এক সরকারের পরিবর্তে অন্য সরকার আসতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের পরিবর্তন হয় না। তাই রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্থায়িত্ব। অবশ্য মার্কসবাদীরা বলেন—রাষ্ট্র স্থায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র ছিল না। ভবিষ্যতে শােষণহীন সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র থাকবে না। তবুও বলা চলে রাষ্ট্র ক্ষণস্থায়ী নয়।
- (চ) স্বীকৃতি
বর্তমানে স্বীকৃতি পাওয়া রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রের মর্যাদা পেতে গেলে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও পেতে হবে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সদস্য পদ দিয়ে তার স্বীকৃতি দিতে পারে। অথবা পৃথক-পৃথকভাবে রাষ্ট্রগুলি স্বীকৃতি দিতে পারে। তবে সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে হবে এমন কোনাে কথা নেই।
মূল্যায়ন সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রের একাধিক বৈশিষ্ট্য আছে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার, জনসমষ্টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল সার্বভৌমিকতা। তবে একে নিয়ে নানা বিতর্ক গড়ে উঠেছে। কারণ, বর্তমানে রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, আন্তর্জাতিক আইন, ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক বােমা প্রভৃতি উপাদান রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে সংকটের মধ্যে ফেলেছে। তাই অধ্যাপক লিন্ডসে (Lindsay) বলেছেন—“সার্বভৌম রাষ্ট্রের তত্ত্ব আজ ভেঙে পড়েছে।”
প্রশ্ন ৩) ত্রিপুরা কি একটি রাষ্ট্র? তােমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর : রাষ্ট্র শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল State| ভারতের সংবিধানের ১(১) নং ধারায় ভারতকে একটি “Union of States” বলা হয়েছে। এখানে ২৮টি State আছে। এদের নিয়ে ভারত রাষ্ট গঠিত। সেদিক থেকে ত্রিপুরাকে একটি State বলতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও অঙ্গরাজ্যকে State বলে।
কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ত্রিপুরাকে রাষ্ট্র বলা যাবে না। কারণ, রাষ্ট্র সম্পর্কে অধ্যাপক গার্নার (Garner) যে সংজ্ঞা দিয়েছেন—তাতে রাষ্ট্রের প্রধান চারটি বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলি হল— (ক) জনসমষ্টি, (খ) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, (গ) সরকার ও (ঘ) সার্বভৌমিকতা।
ত্রিপুরার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন—(ক) একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড আছে, (খ) জনসমষ্টি আছে এবং (গ) একটি সরকার আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ত্রিপুরাকে রাষ্ট্র বলা যাবে না। কারণ-
প্রথমত, এর সার্বভৌমিকতা নেই। একে কেন্দ্রের অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। কেন্দ্রের বিরােধী কোনাে আইন করলে তা বাতিল হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনাে চুক্তি বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না।
তৃতীয়ত, ত্রিপুরার প্রধান শাসক হলেন রাজ্যপাল। অথচ তিনি কেন্দ্রের মনােনীত ব্যক্তি। ত্রিপুরা স্বাধীন রাষ্ট্র হলে কেন্দ্র তার প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যপালকে মনােনীত করে পাঠাতে পারত না।
চতুর্থত, কেন্দ্র ইচ্ছা করলে ত্রিপুরার সীমানা পরিবর্তন করতে পারে। এ ব্যাপারে ত্রিপুরার সম্মতি নাও দিতে পারে। ত্রিপুরা সার্বভৌম হলে কেন্দ্র এভাবে সীমানা পরিবর্তন করতে পারত না।
পঞ্চমত, কেন্দ্র প্রয়ােজন মনে করলে কেন্দ্রের শাসন রাজ্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। সংবিধানে তার বিধিব্যবস্থার উল্লেখ আছে। ত্রিপুরা স্বাধীন রাষ্ট্র হলে কেন্দ্র তার শাসনভার রাজ্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারত না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার কোনাে সার্বভৌমিকতা নেই। তাই ত্রিপুরাকে রাষ্ট্র বলা যায় না। একে অঙ্গরাজ্য বলা হয়।
প্রশ্ন ৪) রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করাে।
উত্তর : রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে গেলে প্রথমে উভয়ের সংজ্ঞা সংক্ষেপে দেওয়া প্রয়ােজন। অধ্যাপক গার্নারকে (Garner) অনুসরণ করে বলা যায়—“রাষ্ট্র হল বহুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে গঠিত এমন এক জনসমষ্টি যারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যারা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সুগঠিত শাসনব্যবস্থা আছে।”
অন্যদিকে, সরকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলােবি বলেছেন—“সরকার হল এমন একটি সংগঠন বা যন্ত্র যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেয়।”
এই দুই সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক আছে। এই সুবাদে অতীতে রাষ্ট্র ও সরকারকে একই অর্থে ব্যবহার করা হত। যেমন, ফরাসি দেশের রাজা চতুর্দশ লুই বলতেন—“আমিই রাষ্ট্র” (“I am the state” )। কিন্তু বাস্তবে দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে।
উভয়ের মধ্যে পার্থক্য
প্রথমত, রাষ্ট্র প্রধানত চারটি উপাদান নিয়ে গঠিত—নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমিকতা। তাই সরকার রাষ্ট্রের একটি অংশমাত্র। অংশ কখনও সমগ্রের সমান হতে পারে না। প্রাণীর সারাদেহ আর মাথা এক জিনিস নয়। মাথা দেহের অংশমাত্র। তেমনি সরকার ও রাষ্ট্র এক জিনিস নয়।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সব মানুষকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু সরকার গঠিত হয় দেশ শাসনের কাজে নিযুক্ত মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার অস্থায়ী। এক সরকারের পরিবর্তে অন্য সরকার আসে। কিন্তু রাষ্ট্র একইভাবে থেকে যায়।
চতুর্থত, ব্যক্তি সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে। সরকারের নীতিকে সমালােচনা করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার কোনাে অভিযােগ থাকতে পারে না।
পঞ্চমত, রাষ্ট্র বলতে সাধারণত নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের কথা মনে পড়ে। যেমন, ভারত রাষ্ট্র বলতে ভারতের ভৌগােলিক সীমানার কথা মনে আসে। কিন্তু সরকার বলতে যারা শাসন করে তাদের বােঝায়।
ষষ্ঠত, সব রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এক। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমিকতা অবশ্যই আছে। কিন্তু সব সরকার এক ধরনের নয়। যেমন, কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও গণতন্ত্র আছে; কোথাও এককেন্দ্রিক, আবার কোথাও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা আছে।
সপ্তমত, রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সরকার সেই ক্ষমতা প্রয়ােগ করে মাত্র। তাই সরকার সরে গেলে সে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকার হারায়। অন্য সরকার এসে রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা প্রয়ােগ করে।
অষ্টমত, রাষ্ট্রকে দেখা যায় না। তার সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযােজ্য। কিন্তু সরকার হল বাস্তব রূপ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এর অস্তিত্ব বুঝতে পারি।
মূল্যায়ন
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র ও সরকার এক জিনিস নয়। তথাপি উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে। রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমে রূপায়িত হয়। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে সরকার কার্যকর করে। তাই অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন—“কার্যক্ষেত্রে সরকারই রাষ্ট্র।”
প্রশ্ন ৫) রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বা সংঘের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
উত্তর : রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে গেলে প্রথমে উভয়ের সংজ্ঞা সংক্ষেপে দেওয়া প্রয়ােজন। রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়ে গিয়ে অধ্যাপক গার্নার (Garner) বলেছেন—
“রাষ্ট্র হল বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন একটি জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যাদের একটি শাসনব্যবস্থা আছে এবং যারা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।”
অন্যদিকে, সামাজিক সংঘের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন-
“সামাজিক সংঘ হল সেই ধরনের গােষ্ঠী যা এক বা একাধিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গড়ে ওঠে।”
যেমন—ধর্মীয় সংঘ, ক্রীড়া সংঘ প্রভৃতি। এই দুই সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে কতকগুলি সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দেখা যায়।
সাদৃশ্য
প্রথমত, রাষ্ট্র ও সামাজিক সংঘ উভয়েই সমাজ থেকে জন্ম নিয়েছে। তাই উভয়ের জন্মগত উৎস এক।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের যেমন জনসমষ্টির প্রয়ােজন, অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও তেমনি জনসমষ্টির বা সদস্যবর্গের প্রয়ােজন আছে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে যেমন সরকার আছে, তেমনি সামাজিক সংঘের পরিচালনার জন্য কার্যকরী সমিতি থাকে।
চতুর্থত, রাষ্ট্র যেমন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তেমনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠে। সে উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণ করা। মানুষের মধ্যে নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটানাে। সেদিক থেকে উভয়ের মধ্যে মিল আছে। আর এই মিল থাকার জন্য অধ্যাপক ম্যাকাইভার বলেছেন—“State is an association.”
বৈসাদৃশ্য
উভয়ের মধ্যে উপরিউক্ত সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যের সংখ্যাই বেশি। সেগুলি নীচে আলােচিত হল :
প্রথমত, রাষ্ট্র নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যেমন, রামকৃয় মিশন, রেডক্রস সােসাইটি প্রভৃতি সংঘের কার্যকলাপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাই সে নাগরিকদের যে-কোনাে অপরাধের জন্য শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। সেই কারণে সে কাউকে কঠোর শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে না।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সামাজিক সংঘের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। নিজের ইচ্ছার উপর তা নির্ভর করে।
চতুর্থত, একজন ব্যক্তি কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে। কিন্তু কোনাে ব্যক্তি একই সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে পারে। যেমন—কেউ একইসঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে না। কিন্তু কেউ একইসঙ্গে ফুটবল ক্লাবের এবং কোনাে পাঠাগারের সদস্য হতে পারে।
পঞ্চমত, স্থায়িত্বের দিক থেকে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। রাষ্ট্র সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু সামাজিক সংগঠনগুলি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক সংঘ গড়ে ওঠে। অনেকের পতনও ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্র স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকে।
ষষ্ঠত, সামাজিক সংঘ সাধারণত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। যেমন—মােহনবাগান ক্লাব খেলাধুলার উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু রাষ্ট্র নানারকম উদ্দেশ্য সাধন করে।
সপ্তমত, রাষ্ট্র যে-কোনাে সংঘ তৈরি করতে পারে। কিন্তু কোনাে সামাজিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না।
অষ্টমত, গঠনের দিক থেকে রাষ্ট্র অনেক বড়াে হতে পারে। যেমন, চিনের লােকসংখ্যা ১২০ কোটি। কিন্তু কোনাে একটি সামাজিক সংঘের এত সদস্য নেই।
নবমত, রাষ্ট্র সামাজিক সংগঠনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রয়ােজন দেখা দিলে সংগঠনকে ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু কোনাে সংগঠন রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ বা ভেঙে দিতে পারে না।
মূল্যায়ন
রাষ্ট্র ও সামাজিহতিগুলের মুল-পার্থক্য থাকলেও করে সমাজ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণসাধন করা। সেই কাজ করতে গেলে সামাজিক সংঘের প্রয়ােজন আছে। কারণ, মানুষের বিকাশের জন্যে সামাজিক সংঘগুলি গড়ে ওঠে। অধ্যাপক ল্যাস্কি যথার্থই বলেছেন—“রাষ্ট্র এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সহযােগিতায় সমাজজীবন সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে। তাই উভয়েই পরস্পরের পরিপূরক।”
প্রশ্ন ৬) রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক মতবাদ আলােচনা করাে।
অথবা, “রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি”—এই মতবাদটি কতদূর গ্রহণযােগ্য?
উত্তর : ঐশ্বরিক মতবাদ হল—রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন মতবাদ। মধ্যযুগে ইউরােপে পােপ ও রাজার মধ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে বিরােধ দেখা দেয়। সেই বিরােধকে কেন্দ্র করে ঐশ্বরিক মতবাদের চরম বিকাশ ঘটে। পরে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটলে এই মতবাদের প্রভাব বিলুপ্ত হতে থাকে। তা সত্ত্বেও এর কিছুটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
মতবাদের মূলকথা
এই মতবাদের মূল কথা হল—ঈশ্বর রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্যে তিনি রাজাকে তাঁর প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরের নির্দেশে তিনি বংশানুক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। তাই রাজার আদেশ হল—ঈশ্বরের আদেশ। রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ হল—ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ করা। ঈশ্বর রাজাকে নিয়ােগ করেন, তাই ঈশ্বরই তার বিচার করবেন। রাজাকে বিচার করার ক্ষমতা প্রজাদের নেই।
মতবাদের সমর্থন
হিন্দু পুরাণে রাজাকে দেবতার পুত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতে বলা হয়েছে—ঈশ্বর মনুকে রাজা হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বাইবেলে ঈশ্বরকে রাজার ক্ষমতার উৎস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মধ্যযুগে পােপ ও রাজার মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে উভয়েই ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস্ এই মতবাদের আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন—“রাজা হলেন ঈশ্বরের সজীব প্রতিমূর্তি।” ভারতে মধ্যযুগে মুসলিম শাসকরা নিজেদের আল্লার প্রতিনিধি হিসাবে প্রচার করেছেন।
সমালােচনা
ঐশ্বরিক মতবাদ বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে-
• (ক) কাল্পনিক মতবাদ
বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত যে—এই মতবাদ নিছক কাল্পনিক। ইতিহাসে এর সন্ধান পাওয়া যায় না। ঈশ্বর একের পর এক রাষ্ট্র তৈরি করে এবং এক একজনকে তার দায়িত্ব দিয়েছেন, এ ধারণা বিশ্বাসযােগ্য নয়।
• (খ) ধর্ম ও রাজনীতি এক নয়
ধর্মযাজকরাই বলেছেন—ধর্ম ও রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক। জিশুখ্রিস্ট নিজেই বলেছেন—সিজারের যা কিছু প্রাপ্য তা সিজারকে দাও। ঈশ্বরের যা কিছু প্রাপ্য, তা ঈশ্বরকে দাও।” বিখ্যাত ধর্মযাজক হুকার (Hooker) বলেছেন—“ধর্মের ব্যাপারে ঈশ্বরের কথা স্বীকার করা যায়, কিন্তু লৌকিক ব্যাপারে নয়।” সুতরাং রাষ্ট্রের ব্যাপারে ঈশ্বরকে টেনে আনা ঠিক নয়।
• (গ) বিপজ্জনক মতবাদ
এই মতবাদ বিপজ্জনক। কারণ, অতীতে এই মতবাদের অজুহাতে রাজারা নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতাকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলে প্রচার করেছিলেন। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারকে পদানত করেছিলেন।
• (ঘ) অযৌক্তিক মতবাদ
ঈশ্বর মানুষের মঙ্গল করেন। তাই যে রাজা মানুষের কল্যাণ করে, তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে মনে করলেও যে অত্যাচারী রাজা তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে মনে করার কোনাে যুক্তি নেই। মহাভারতে বলা হয়েছে, কল্যাণকামী রাজাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করা যায়। কিন্তু যে রাজা প্রজাদের রক্ষা করতে পারে না, তাকে ক্ষিপ্ত কুকুরের মতাে বিনষ্ট করা উচিত।
• (ঙ) অসম্পূর্ণ মতবাদ
যেখানে রাজতন্ত্র আছে, সেখানে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি কল্পনা করা গেলেও যেখানে রাজতন্ত্র নেই, রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, সেই রাষ্ট্রে ঈশ্বরের প্রতিনিধি কে তার উত্তর এই মতবাদে নেই।
মূল্যায়ন
বর্তমানে এই মতবাদ পরিত্যক্ত হলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
প্রথমত, আদিম মানুষেরা বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিন কাটাত। তারা একমাত্র ঈশ্বরকে ভয় করত। তাই রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে বর্ণনা করে রাজার আদেশ মান্য করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এতে তারা রাজার প্রতি আনুগত্য দেখাতে শিখেছিল। এই আনুগত্যের শিক্ষার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র সৃষ্টির পথ সহজ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য হল—জনসাধারণের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করা। ঐশ্বরিক মতবাদ এই আধ্যাত্মিকতার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্র গঠনে ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র ধর্মীয় কারণেই গড়ে উঠেছে।
প্রশ্ন ৭) রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়ােগ মতবাদ ব্যাখ্যা করাে। এই মতবাদের অসম্পূর্ণতা কী তা দেখাও।
উত্তর : রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়ােগ মতবাদ প্রাচীন মতবাদগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন হলেও আধুনিককালে এই মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কারণ, মরগেনথাউ বলেছেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হল ক্ষমতা। শুধু জাতীয় রাজনীতিতে নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার লড়াই চলছে। এই ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে শক্তিধর রাষ্ট্র বলপ্রয়ােগ করতে দ্বিধাবােধ করছে না।
মতবাদের মূলকথা
বলপ্রয়ােগ মতবাদের প্রবক্তাগণ বলেন—মানুষ কলহপ্রিয় ও ক্ষমতালােভী। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে দেখা যাচ্ছে মানুষে-মানুষে বিরােধ। শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির উপর বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে গােষ্ঠী তৈরি করেছে। পরে শক্তিশালী গােষ্ঠী গােষ্ঠীপতির নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দুর্বল গােষ্ঠীকে পরাজিত করেছে এবং তাদের উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে উপজাতিতে (Tribe) পরিণত করেছে। তারপর বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিলে সব থেকে শক্তিশালী উপজাতি বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারা রাষ্ট্রব্যবস্থাগড়ে তুলেছে। সুতরাং এই মতবাদের মূলকথা হল—একমাত্র বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে।
বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমর্থকগণ আরও বলেন যে, শুধু রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে বলপ্রয়ােগ ঘটেনি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পরও তার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বলপ্রয়ােগ প্রয়ােজন। অর্থাৎ এই মতবাদ শুধুমাত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে না, রাষ্ট্রের প্রকৃতিও ব্যাখ্যা করে।
সমর্থন
প্রাচীনকাল থেকে এই মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। গীতায় শ্রীকৃয় বলেছিলেন যে, সাধুদের রক্ষা এবং দুর্জনদের ধ্বংস করার জন্য তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে আসেন। আধুনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন—নিৎসে ও ট্রিস্কে। তাদের মতে রাষ্ট্র শক্তির প্রতীক। জাতির সম্মান বৃদ্ধির জন্য বলপ্রয়ােগ চাই। সমাজতন্ত্রবাদীরাও বিশ্বাস করেন রাষ্ট্র পশুশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। শােষক শ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে শােষিত শ্রেণির আন্দোলনকে দমন করতে চেষ্টা করে। আজও সমাজে বলপ্রয়ােগের ধারা অব্যাহত আছে। তাই “জোর যার মুল্লুক তার” (Might is right) প্রবচনটি গড়ে উঠেছে।
সমালােচনা
একথা সত্য যে, সমাজজীবন গঠনের প্রথম দিকে বলপ্রয়ােগের প্রভাব ছিল। যুদ্ধের মাধ্যমে কোনাে কোনাে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় যুদ্ধের কাহিনির উল্লেখ আছে। তা সত্ত্বেও বলপ্রয়ােগ মতবাদে অনেক অসম্পূর্ণতা আছে। সেই কারণে এই মতবাদ নিম্নলিখিত দৃষ্টিকোণ থেকে সমালােচিত হয়েছে-
• (ক) বলপ্রয়ােগ রাষ্ট্রের ভিত্তি নয়
বলপ্রয়ােগ রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না। কারণ, বলপ্রয়ােগের দ্বারা কিছু লােককে কিছু সময়ের জন্য বেঁধে রাখা যায়। কিন্তু সব লােককে সব সময়ের জন্য দমন করে রাখা যায় না। অধ্যাপক গ্রিন (Green) বলেছেন—“Will, not force is the basis of the state।” অর্থাৎ শক্তি নয়, জনসাধারণের সম্মতিই রাষ্ট্রের ভিত্তি। জনসাধারণ যদি রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতে পারে, তবেই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থায়ী হবে।
• (খ) গণতন্ত্র-বিরােধী
এই মতবাদ গণতন্ত্র-বিরােধী। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল—গণসমর্থন ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারের পরিবর্তন। সাম্য এবং স্বাধীনতা এর মূলনীতি। এখানে হিংসা বা বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কোনাে স্থান নেই। কিন্তু বলপ্রয়ােগ মতবাদ “জোর যার মুল্লুক তার” এই নীতিতে বিশ্বাস করে। তাই এই নীতি গণতন্ত্র-বিরােধী।
• (গ) বিশ্বশান্তির বিরােধী
এই মতবাদ যুদ্ধের নীতিকে সমর্থন করে। যুদ্ধের মাধ্যমে কোনাে দেশের সভ্যতাকে জোর করে অন্য দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনাে অন্যায় দেখে না। তাই এই মতবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্মভূমি। এই মতবাদে যুদ্ধংদেহী মনােভাব বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। সেই কারণে এই মতবাদ বিশ্বশান্তির বিরােধী।
• (ঘ) অন্যান্য উপাদানের অস্বীকৃতি
বলপ্রয়ােগ মতবাদ বলপ্রয়ােগকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির একমাত্র উপায় বলে মনে করেছে। কিন্তু বলপ্রয়ােগ ছাড়া অন্যান্য উপাদান আছে—যেমন, রক্তের সম্পর্ক, রাজনৈতিক চেতনা ইত্যাদি।
• (ঙ) সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট
এই মতবাদ মানুষের কুৎসিত দিকটাই বড় করে দেখেছে। মানুষের মধ্যে প্রেম, প্রীতি, ভালােবাসা প্রভৃতি যে সদগুণ আছে সেগুলিকে উপেক্ষা করেছে। মানুষ যদি শুধু হিংস্র লােভী হত, তাহলে মানুষের সভ্যতার এত বিকাশ ঘটত না। তাই লিক একে অসম্পূর্ণ মতবাদ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
মূল্যায়ন
সমালােচিত হলেও বলপ্রয়ােগ মতবাদকে অস্বীকার করা যায় না। একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে অনেক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজন আছে। সামরিক শক্তি না থাকলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এমনকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও শক্তি প্রয়ােগের প্রয়ােজন আছে। কারণ তার অস্তিত্ব ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শক্তি প্রয়ােগকে অস্বীকার করা যাবে না। সামরিক শক্তি না থাকলে সার্বভৌমিকতা বিপর্যস্ত হবে। ল্যাস্কি যথার্থই বলেছেন—“সামরিক শক্তির মধ্যেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা নিহিত আছে।”তবে এই মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
প্রশ্ন ৮) রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ ব্যাখ্যা ও সমালােচনা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্রের উৎপত্তি-বিষয়ক কল্পনাপ্রসূত মতবাদগুলির মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদ নিঃসন্দেহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবাদ কেবল রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে আলােচনা করে না, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কেও আলােকপাত করে। গণতন্ত্রের পটভূমি তৈরির ক্ষেত্রে এই মতবাদের বিশেষ ভূমিকা আছে।
মতবাদের মূলকথা
এই মতবাদের মূল কথা হল রাষ্ট্র চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। আদিম মানুষেরা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। এই মতবাদের প্রবক্তারা বলেছেন—রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। সে যুগের মানুষেরা স্বাভাবিক আইন (Natural Law) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। সেইসঙ্গে তারা স্বাভাবিক অধিকার ভােগ করত। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ কেমন ছিল, সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, এ বিষয়ে সবাই একমত যে, সেই পরিবেশে কিছু অসুবিধা ছিল। সেই অসুবিধা দূর করে উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র গঠন করেছে।
সমর্থন
প্রাচীনকালে দার্শনিকদের চিন্তার মধ্যে এই মতবাদের প্রকাশ ঘটেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল—গ্রিসের সােফিস্ট দার্শনিকরা। মহাভারতের শান্তিপর্বে এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র”-এ এই মতবাদের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে যে তিনজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের লেখায় এই মতবাদ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে তাঁরা হলেন হব্স, লক এবং রুশাে।
হব্সের মতবাদ
হব্সের বিখ্যাত গ্রন্থ “লেভিয়াথান”-এ তিনি সামাজিক চুক্তি মতবাদ ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। তাদের মধ্যে ছিল বিরামহীন বিরােধ। প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের শত্রু—“Every man is enemy to every man.”সেখানে কোনাে আইনশৃঙ্খলা ছিল না। তখনকার নীতি ছিল—“জোর যার মুল্লুক তার।” যার ক্ষমতা বেশি ছিল, সেই আধিপত্য বিস্তার করত। হব্সের ভাষায়-“মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, ঘৃণ্য, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী।”
এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে একটিমাত্র চুক্তি করে সব ক্ষমতা বিনা শর্তে এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংসদের হাতে তুলে দিল। এই ব্যক্তি ছিল চুক্তির ঊর্ধ্বে। তার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। তিনি সার্বভৌম। তাঁর আদেশ হল আইন। এইভাবে সার্বভৌম শক্তির উদ্ভবের মধ্য দিয়ে প্রথম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল।
লকের মতবাদ
লক্ ১৬৯০ সালে প্রকাশিত তাঁর “টু ট্রিটিজ অন সিভিল গভর্নমেন্ট” (Two Treaties on Civil Government) গ্রন্থে বলেছেন—রাষ্ট্রগঠনের পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে কতকগুলি অসুবিধা ছিল। যেমন—সেখানে আইন তৈরির, ব্যাখ্যা করার বা আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি দেবার কোনাে সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছিল না। এই অসুবিধা দূর করতে মানুষ দুটি চুক্তি করল। প্রথম চুক্তি হল, জনগণের নিজেদের মধ্যে চুক্তি। একে বলা হয় সামাজিক চুক্তি। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠল। দ্বিতীয় চুক্তি হল, জনগণের সঙ্গে সরকারের। একে বলা হয় সরকারি চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষ তাদের কিছু স্বাভাবিক অধিকার সরকারের হাতে দিয়ে দিল এই শর্তে যে, সরকার তাদের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার ও ধনসম্পত্তির অধিকার রক্ষা করবে। সরকার যদি জনগণের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে ধরে নেওয়া হবে। তখন জনগণ তাকে অপসারিত করতে পারবে।
রুশাের মতবাদ
রুশাের মতে, মানুষ পূর্বে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। সেই পরিবেশ ছিল স্বর্গরাজ্য। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ইত্যাদির ফলে মানুষের জীবনে দেখা দিল সমস্যা। প্রকৃতির রাজ্য ভরে উঠল হিংসা ও অরাজকতায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ সামাজিক চুক্তি করল। রুশাের মতে চুক্তি হয়েছিল একটি। এই চুক্তির দ্বারা কোনাে ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সমাজের হাতে। রুশাে তার নামকরণ করেছেন—“সাধারণ ইচ্ছা” বা “General Will”। “সাধারণের ইচ্ছা”ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—সকলের ইচ্ছার যােগফল “সাধারণের ইচ্ছা” নয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দুটি ইচ্ছা আছে—প্রকৃত ইচ্ছা (Real Will) এবং অপ্রকৃত ইচ্ছা (Unreal Will)।সব মানুষের প্রকৃত ইচ্ছার যােগফল হল “সাধারণের ইচ্ছা।” প্রকৃত ইচ্ছা কোনাে ভুল করে না বলে, “সাধারণের ইচ্ছা” ভুল করে না। এই ইচ্ছা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তাই এর নির্দেশ সবাই মানতে বাধ্য।
সমালােচনা
সমালােচকেরা বিভিন্নভাবে সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনা করেছেন-
প্রথমত, ইতিহাসে এই মতবাদের সন্ধান পাওয়া যায় না। অনেকে উদাহরণ হিসাবে ১৬২০ সালে “মে ফ্লাওয়ার” চুক্তিকে রাষ্ট্র গঠনের ঐতিহাসিক নজির হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু যে ফ্লাওয়ার জাহাজের যাত্রীরা ইংল্যান্ড থেকে এসেছিল তারা প্রকৃতির রাজ্যের আদিম মানুষ ছিলেন না।
দ্বিতীয়ত, এই মতবাদ অবাস্তব। প্রকৃতির পরিবেশে যারা বাস করত, তাদের রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনাে ধারণা ছিল না। হঠাৎ তারা চুক্তি করে রাষ্ট্র গঠন করল, এই চিন্তা নিছক কাল্পনিক। তাই গার্নার বলেছেন—“এটি মানুষের নিছক কল্পনাপ্রসূত একটি মতবাদ।
তৃতীয়ত, এই মতবাদ অযৌক্তিক। কারণ, চুক্তি করতে গেলে আইনের প্রয়ােজন। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশে চুক্তির পূর্বে কোনাে নির্দিষ্ট আইন ছিল না। এই অবস্থায় আইনগত চুক্তি হতে পারে না।
চতুর্থত, এই মতবাদ বিপজ্জনক। রাষ্ট থাকবে, কি না থাকবে, তা যদি মানুষের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে অরাজকতা দেখা দেবে।
পঞ্চমত, এই মতবাদে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ অবাধ স্বাধীনতা ভােগ করত। কিন্তু আইন ছাড়া স্বাধীনতা থাকতে পারে না। প্রাকৃতিক অবস্থায় কোনাে আইন ছিল না। তাই স্বাধীনতাও ছিল না। স্বাধীনতার নামে ছিল স্বেচ্ছাচারিতা।
মুল্যায়ন
সমালােচিত হলেও এই মতবাদের গুরুত্ব আছে। রাষ্ট্র ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি। মানুষের সম্মতিতে এর সৃষ্টি হয়েছে—এই দর্শন প্রথম শুনিয়েছে সামাজিক চুক্তি মতবাদ। প্রকৃতপক্ষে বলপ্রয়ােগ নয়, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি—এই ধ্যানধারণাকে জন্ম দিয়ে সামাজিক চুক্তি মতবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে।
এছাড়া, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমিকতার যে তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছে, তারও জন্ম হয়েছে এই মতবাদের মধ্য দিয়ে। সবচেয়ে বড়াে কথা হল—এই মতবাদ পৃথিবীর বড়াে তিনটি বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রেরণা দিয়েছে। এগুলি হল ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লব। এখানেই এর সার্থকতা।
প্রশ্ন ৯) রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদ বিবৃত করাে। এটি কি গ্রহণযােগ্য মতবাদ?
অথবা, “রাষ্ট্র বিবর্তনের দ্বারা উদ্ভূত হয়েছে।” আলােচনা করাে।
উত্তর : রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসাবে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ, বলপ্রয়ােগ মতবাদ এবং সামাজিক চুক্তি মতবাদের কোনােটিই পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, কোনাে একটি মতবাদকে অবলম্বন করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন করা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সেদিক থেকে গ্রহণযােগ্য মতবাদ।
মতবাদের মূল বক্তব্য
এই মতবাদের মূল কথা হল,—কোনাে নির্দিষ্ট সময়ে বা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মতাে রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘকাল ধরে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস (Burgess)- এর ভাষায় বলা যায়– “The state is a product of continuous development of human society” অর্থাৎ রাষ্ট্র হল মানবসমাজের বিরামহীন ক্রমবিকাশের ফল। নানা কারণে এর জন্ম হয়েছে। কোনাে একস্থানে একটি কারণে, আবার অন্য স্থানে অন্য কারণে রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে, হঠাৎ করে রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। যে উপাদানগুলি রাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করেছে, সেগুলি হল রক্তের সম্পর্ক, ধর্ম, যুদ্ধ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাজনৈতিক চেতনা।
• (ক) রক্তের সম্পর্ক
রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক উপাদান হল রক্তের সম্পর্ক। পরিবার হল প্রাচীনতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারের কর্তা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করত এবং তাদের আনুগত্য পেত। এর মধ্যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দেখা যায়।
পরিবারের সদস্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহকর্তার পক্ষে কর্তৃত্ব বজায় রাখা সম্ভব হল না। রক্তের সম্পর্ক তাদের বন্ধনকে শক্ত করল। পরিবারের সকল সদস্য একই বংশ থেকে এসেছে বলে নিজেদের মনে করে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হল। এই বড়াে পরিবার আরও বড়াে হয়ে গােষ্ঠী এবং উপজাতিতে পরিণত হল। তার মাধ্যমে সৃষ্টি হল রাষ্ট্র।
• (খ) ধর্মের বন্ধন
রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে ধর্মের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। ধর্ম বলতে মানুষ প্রকৃতি পূজা এবং পূর্বপুরুষদের পূজা বুঝত। তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দেবতার কোপ বলে মনে করত। দুঃখদুর্দশাকে পূর্বপুরুষদের অভিশাপের ফল বলে মনে করত। তাই এই অভিশাপের হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা গােষ্ঠীপ্রধানের মাধ্যমে দেবতা ও পূর্বপুরুষদের পূজা দিত। ফলে গােষ্ঠীপ্রধান নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই কর্তৃত্ব থেকে জন্ম নিয়েছিল রাষ্ট্র।
• (গ) যুদ্ধবিগ্রহ
যুদ্ধবিগ্রহ রাষ্ট্র গঠনে বড় রকমের সাহায্য করেছে। আদিম কাল থেকে মানুষ আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে সংগ্রাম করে আসছে। তা ছাড়া ক্ষমতার প্রতি লােভ এবং অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার করার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির বশে আদিম সমাজে এক জনগােষ্ঠী অন্য জনগােষ্ঠীকে আক্রমণ করেছে। তাদের জমির ফসল ও গৃহপালিত পশু অপহরণ করেছে। এগুলি ছিল নিত্যকার ঘটনা।
এছাড়া, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে কেন্দ্র করেও আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ হয়েছে। এইসব যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একজন দলপতির প্রয়ােজন হয়। এই দলপতি যুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিয়ে গােষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করত, গােষ্ঠীর মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে রাখত। এইভাবে দলপতি সহজেই গােষ্ঠীর বা উপজাতির আনুগত্য লাভ করে নিজেকে রাজা বলে ঘােষণা করত। সেই কারণে বলা হয়—যুদ্ধের ফলে রাজার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু উৎপত্তির ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজন। সামরিক শক্তি না থাকলে সার্বভৌমিকতা বিপন্ন হবে।
• (ঘ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি
আদিম মানুষ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে যখন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বাস করতে আরম্ভ করল, তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হল। এই সম্পত্তি রক্ষার জন্য দলপতির প্রয়ােজন হল। দলপতি আইন ও প্রথার সাহায্যে সম্পত্তির বিরােধের মীমাংসা করতে থাকল। এইভাবে মীমাংসার মাধ্যমে জনগণের আনুগত্য পেয়ে দলপতি একদিন নিজেকে রাজা বলে ঘােষণা করল। তাই অধ্যাপক গেটেল বলেছেন- “আদিম মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে অবদান জুগিয়েছে।”
• (ঙ) রাজনৈতিক চেতনা
রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশে রাজনৈতিক চেতনার দান আছে। মানুষ শুধু সামাজিক জীব নয়, রাজনৈতিক জীবও বটে। অ্যারিস্টটলের ভাষায়—“Man is a political animal.” তাই প্রাচীনকাল থেকে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা ধীরে ধীরে মানুষের অবচেতন মনে এসেছে। কিছু কিছু চিন্তাশীল ব্যক্তির প্রেরণায় তারা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়ােজনীয়তা উপলদ্ধি করেছে। এই উপলদ্ধিই পরবর্তীকালে রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করেছে।
সমালোচনা
সমালােচকরা বলেছেনএই মতবাদ সঠিক নয়।
কারণ-
প্রথমত, মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবন কখন শুরু হয়েছে, এই মতবাদ তার উত্তর দিতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, এই মতবাদ রাষ্ট্রের সৃষ্টির ব্যাপারে বিভিন্ন উপাদানের কথা বললেও, কোন্ উপাদানটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার উল্লেখ করেনি।
তৃতীয়ত, কেউ কেউ রক্তের সম্পর্ক এবং ধর্ম, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জন্ম দিয়েছে—একথা মানতে রাজি নন।
মূল্যায়ন
সমালােচিত হলেও এই মতবাদ গ্রহণযােগ্য মতবাদ। কারণ, রাষ্ট্র ক্রমবিকাশের ফলে— এই সত্য ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া, পূর্বে যে মতবাদগুলি গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে যে সত্যটুকু আছে, সেগুলি এখানে স্থান পেয়েছে। যেমন—ধর্মের মধ্যে ঐশ্বরিক মতবাদ, যুদ্ধের মধ্যে বলপ্রয়ােগ মতবাদ এবং রাজনৈতিক চেতনায় সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রতিফলন ঘটেছে। এইভাবে সব মতবাদের সত্যটুকুকে নিয়ে গড়ে ওঠায় বিবর্তনমূলক মতবাদ সর্বাপেক্ষা গ্রহণযােগ্য মতবাদ বলে মনে করা হয়।
See More
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি
- জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র
- আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচার
- গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র
- নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
- ভারতের সংবিধান প্রণয়ন
- ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি
- রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকারের প্রকৃতি
- ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য
- ভারতের দলব্যবস্থা
- নির্বাচন কমিশন : গঠন ও কার্যাবলী নির্বাচন কমিশন : গঠন ও কার্যাবলী