১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ | Sepoy Mutiny in 1857

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ (Sepoy Mutiny in 1857)

সিপাহী বিদ্রোহের কারণ : লর্ড ডালহৌসী স্বত্ববিলােপ নীতি অনুসারে দখল করেন সাতারা (১৮৪৮), জয়িতপুর (১৮৪৯), সম্বলপুর (১৮৪৯), বাঘােট (১৮৫০), পাঞ্জাব (১৮৪৯),ভরতপুর (১৮৫০), উদয়পুর (১৮৫২), সিকিম (১৮৫০), পেগু (১৮৫৩), নাগপুর (১৮৫৪), কিন্তু বাঘােট ও উদয়পুরের রাজ্য তাঁকে ফেরত দিতে হয়। যখন ডালহৌসী রাজপুতানার কারাউলী রাজ্যটির উপর স্বত্ববিলােপ নীতি প্রয়ােগ করতে যান তখন কোর্ট অফ ডাইরেক্টর তাঁকে বিরত করেন। ডালহৌসী অযােধ্যা রাজ্যটি দখল করেন কুশাসনের অজুহাতে। স্যার জেমস আউট্রামকে ১৮৫৪ থেকে অযােধ্যার ব্রিটিশ রেসিডেন্ট করে রাখা হয় ও ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মুখ্য কমিশনার নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু ১ মাসের মধ্যে তাকে সরিয়ে স্যার হেনরি লরেন্সকে মুখ্য কমিশনার নিয়ােগ করা হয়। ডালহৌসী কর্ণাটকের নবাব ও তাঞ্জোরের রাজার পেনশান ও উপাধি এবং নানাসাহেবের ভাতা বন্ধ করেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ডালহৌসী ঘােষণা করেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের উত্তরাধিকারীকে লালকেল্লা ত্যাগ করতে হবে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং ঘােষণা করেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের উত্তরাধিকারীকে মােগল সম্রাটরূপে মানা হবে না।
দেশীয় সিপাহীদের বেতন ও প্রােমােশনের ব্যবস্থা খারাপ ছিল। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং জেনারেল সার্ভিস এনলিস্টমেন্ট আইন পাশ করেন। তাতে বলা হয় সিপাহীদের দেশের মধ্যে ও বাহিরে যে কোনাে জায়গায় যেতে হবে। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইন, পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি আইন পাশের ফলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় ও ইউরােপীয়দের সংখ্যার অনুপাত ছিল ৬ : ১। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারী মাসে সেনাবাহিনীতে নতুন এনফিল্ড রাইফেল প্রবর্তন হয়। এর টোটা দাঁতে কেটে বন্দুকে ভরতে হত। প্রচার হয় যে এই টোটাতে গােরু ও শূকরের চর্বি মেশানাে থাকে। ১৯ নম্বর নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সেনারা বেরহামপুর স্টেশনে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৬ ফেব্রুয়ারি এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ নিতে অস্বীকার করেন। তারা তাদের কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল মিশেলের বিরােধিতা করে। ৩৪ নম্বর নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি সেনাবাহিনীর সেনা মঙ্গল পান্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে লেফট্যান্যান্ট বাগ এবং জেনারেল হেয়ার শে কে আহত করেন এবং নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মঙ্গল পান্ডে ও ঈশ্বর পান্ডের ফাসি হয়। এরপর তৃতীয় ক্যাভালরীর সেনারা মীরাটে এই কার্তুজ নিতে অস্বীকার করলে ৮৫ জনকে বন্দী করা হয় ও তাদের কোর্ট মার্শাল হয়। ৭নং অযােধ্যা রেজিমেন্টের সেনারা লক্ষ্ণৌতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২ মে টোটা নিতে অস্বীকার করে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ১০ মে তৃতীয় ক্যাভালরীর সেনারা মীরাটে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বন্দী কয়েদিদের নামে শপথ নিয়ে। তারা ১১নং ও ২০নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সাথে যােগ দেয়। তারা ইংরেজ অফিসার ফিনিশকে হত্যা করে। এরপর তারা দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। জেনারেল হিউইট সিপাহীদের বাধা দিতে ব্যর্থ হন। ১১ মে দিল্লি পৌছে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘােষণা করেন।
সিপাহী বিদ্রোহের বিস্তার : দিল্লিতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ও জেনারেল বখত খান। বখত খান ছিলেন বেরিলির একজন ব্রিটিশ সুবেদার। কানপুরে নেতৃত্ব দেন নানাসাহেব, রাওসাহেব (নানার ভাইপাে), তাতিয়া টোপি এবং আজিমুল্লা খান (নানার উপদেষ্টা)। লক্ষ্ণৌতে নেতৃত্ব দেন বেগম হজরত মহল ও আহমদুল্লা। ঝাঁসিতে নেতৃত্ব দেন রানি লক্ষ্মীবাঈ। বেরিলিতে নেতৃত্ব দেন খান বাহাদুর খান। বিহারের আরাতে নেতৃত্ব দেন কুওর সিং ও অমর সিং। ফৈজাবাদে নেতৃত্ব দেন মৌলবি আহমদুল্লা ও ফিরােজ শাহ। ফারুকাবাদে নেতৃত্ব দেন তুপজল হাসান খান। বিজনৌর এ নেতৃত্ব দেন মহবৃত মহম্মদ খান। মােরাবাদ-এ নেতৃত্ব দেন আবদুল আলি খান। এলাহাবাদ ও বারানসীতে নেতৃত্ব দেন লিয়াকত আলি।
সিপাহী বিদ্রোহ দমন :
1. দিল্লিতে বিদ্রোহ দমন করেন জেনারেল জন নিকলসন সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি যুদ্ধের সময় মর্টার ফেটে মারা যান। লেফট্যান্যান্ট হডসন বাহাদুর শাহের পুত্র ও নাতিদের হত্যা করেন। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে হুমায়ুনের সমাধি থেকে ধরে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়।
2. কানপুরে স্যার হাগ হুইলার নানা সাহেবের সেনাবাহিনীকে অবরােধ করেন এবং তিনি নানার কাছে বশ্যতাস্বীকার করেন। নানার সেনাবাহিনী সমস্ত ইংরেজদের হত্যা করেন। মেজর জেনারেল হ্যাঙলক নানাকে পরাস্ত করেন ও জেনারেল নীল বহু ভারতীয় হত্যা করেন। কানপুর ছিল তাঁতিয়া টোপির নেতৃত্বে গােয়ালিয়রের অধীনে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্যার কলিন ক্যাম্পবেল কানপুর পুনরুদ্ধার করেন।
3. লক্ষ্ণৌতে স্যার হেনরি লরেন্স ব্রিটিশদের নেতৃত্ব দেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর হ্যাভলক আউট্রাম এবং নীল লরেন্সের সাথে যােগ দেন। নীল ও হ্যাভলকের মৃত্যু হয়। তাঁতিয়া টোপি লক্ষৌ অধিকার করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ স্যার কলিন ক্যাম্পবেল লক্ষৌ পুনরুদ্ধার করেন।
4. ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন হিউরােজ গােয়ালিয়র পুনরুদ্ধার করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের কাছ থেকে ঝাঁসি পুনরুদ্ধার করেন।
5. ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্যার কলিন ক্যাম্পবেল বেরিলি পুনরুদ্ধার করেন।
6. উইলিয়াম টেলর ও ভিনসেন্ট আয়ার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সাময়িকভাবে কুঁওর সিংকে পরাস্ত করে আরা দখল করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে কুঁওর সিংয়ের মৃত্যু হয়।
7. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে কর্ণেল নীল বারানসী ও এলাহাবাদ পুনরুদ্ধার করেন।
• নেতৃমন্ডলের পরিণতির তালিকা :

নেতার নাম পরিণতি
1. বাহাদুর শাহ জাফর রেঙ্গুনে নির্বাসন ও সেখানে মৃত্যু ১৮৬২।
2. নানাসাহেব নেপালে পালিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান।
3. বেগম হজরতমহল নেপালে পালান ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।
4. খান বাহাদুর নেপালে পালান ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মারা যান।
5. জেনারেল বখত খান ১৩ মে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে মারা যান।
6. মৌলবি আহমদুল্লা পুয়াইনের রাজা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেন।
77. রানী লক্ষ্মীবাঈ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে মারা যান।
8. কুঁওর সিং ৯ মে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে মারা যান।
9. তাঁতিয়া টোপী সিন্ধিয়ার মান সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেন ব্রিটিশদের। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল তাঁর ফাঁসি হয়।

সিপাহী বিদ্রোহে যাঁরা অংশগ্রহণ করেননি : সিন্ধিয়া এবং তার মন্ত্রী | দিনকর রাই, নিজাম ও তার মন্ত্রী সালার জং, হােলকার, কাশ্মীরের গুলাব সিং, ভােপালের বেগম, নেপালের প্রধানমন্ত্রী জং বাহাদুর, যােধপুরের রাজা, শিখরা। বাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও রাজপুতানার শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এতে যােগ দেয় নি।
• বিদ্রোহ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তালিকা :

বই লেখক
1. হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান মিউটিনি টি. আর হােমস
2. এ হিস্ট্রি অফ দ্য সিপাই ইন ইন্ডিয়া জে ডব্লু. কি
3. ইন্ডিয়ান মিউটিনি অফ ১৮৫৭ জে. বি. ম্যালেসন
4. এইটিন ফিফটি সেভেন সুরেন্দ্রনাথ সেন
5. দি সিপাই রিভােল্ট—ইটস কজেস এ্যান্ড কনসিকুয়েন্স এইচ. মিদ
6. ইন্ডিয়ান ফাস্ট ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেস বীর সাভারকর
7. দ্য সিপাই মিউটিনি এ্যান্ড দ্য রিভােল্ট অফ ১৮৫৭ রমেশচন্দ্র মজুমদার
8. সিভিল ডিসটারবেনসেস্ ডিউরিং দ্য ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া এস. বি. চৌধুরি
9. ভারতের মহাবিদ্রোহ প্রমােদ সেনগুপ্ত।
10. অওধ ইন রিভােল্ট রুদ্রাংশু মুখার্জি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার, ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ভেলােরে, ১৮২৪ এ ব্যারাকপুরের ৪৭নং রেজিমেন্টে, ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৪৪নং রেজিমেন্টে, ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ২২নং রেজিমেন্টে, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ৬৬নং রেজিমেন্টে, ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ৩৭নং রেজিমেন্টে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল।

Leave a Comment

Scroll to Top