বাংলায় স্বাধীন সুলতানী শাসনের ইতিহাস | History of Bengal Sultanate
Short Notes on History of Bengal Sultanate | বাংলায় স্বাধীন সুলতানী শাসনের ইতিহাস
ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন
- সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ইলিয়াস শাহি বংশ নামে পরিচিত। তাঁর সিংহাসন আরোহণের মধ্যে দিয়েই বাংলার ইতিহাসে এক নতুন পর্যায়ের সূচনা হয়ে ছিল। সামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ এর পূর্ব ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট। তবে বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি ষড়যন্ত্র দ্বারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং লক্ষণাবতী র সিংহাসন দখল করার পর তিনি রাজ্য বিস্তারে মন দেন।
- ইলিয়াস শাহ এর সামরিক সাফল্য ও ক্ষমতার দ্রুত প্রসারে ফিরোজ তুঘলক শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশ আক্রমণ করলে ইলিয়াস শাহ সপরিবারে পান্ডুয়ার অনতিদূরে দুর্ভেদ্য “একডালা দুর্গে” আশ্রয় নেন। দীর্ঘ দিন অবরোধ করেও ইলিয়াস শাহ কে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা যায় নি। কিন্তু দুর্গের অভ্যন্তরে ক্রন্দনরত মহিলা, শিশু দের প্রতি করুণাবশত তিনি দুর্গ দখল না করেই দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় এবং ফিরোজ তুঘলক বাংলাতে ইলিয়াসের মর্যাদা স্বীকার করে নেন।
- ইলিয়াস শাহ্ এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকন্দর শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর আমলেও বাংলা আক্রমণ করেন। তিনিও তাঁর পিতার মতই দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। দুর্গ অবরোধ করে রেখেও ফিরোজ তা আবার অধিকার করতে ব্যর্থ হন। দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। এই ঘটনার পরবর্তী দুশো বছর বাংলাতে কোনো দিল্লির শাসক অভিযান করেন নি।
- শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক রূপে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তাঁর উদ্যোগে বহু মসজিদ, মিনার ও প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। পান্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ শিল্প কীর্তি।
- তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ প্রায় কুড়ি বছর বাংলা শাসন করেন। তাঁর আমলে বাংলায় সুখ ও সমৃদ্ধি বিরাজ করত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সৈফুদ্দিন সিংহাসনে বসেন।
- সৈফুদ্দিন এর মৃত্যুহলে ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিন সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলে উত্তরবঙ্গের ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশ সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। রাজা গণেশ ১৪১৫ থেকে ১৪১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি “দনুজমর্দনদেব” উপাধি নিয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র হিন্দু শাসক যিনি গতানুগতিক মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে কিছুদিনের জন্য হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। তাঁর দুটি স্থাপত্য সৃষ্টি হলো গৌড়ে ” ফতে খাঁর সমাধি ভবন ” এবং পান্ডুয়ার ” একলাখী প্রাসাদ”।
- গণেশের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র যদু যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালাল উদ্দিন মহম্মদ নাম ধারণ করেছিলেন তিনি সিংহাসনে বসেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিংহাসনে বসেন কিন্তু তাঁর কুসাশনে অতিষ্ঠ হয়ে অভিজাত গণ ইলিয়াস শাহী বংশের নাসিরউদ্দিন মামুদ কে সিংহাসনে বসান। এইভাবে বাংলায় ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- নাসিরুদ্দিনের পুত্র রুকুনউদ্দিন বারবক শাহ ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক। পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি “অল – ফাজিল” ও “অল – কামিল” উপাধি তে ভূষিত হন। সে যুগের প্রখ্যাত টীকাকার বৃহস্পতি মিশ্র তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ হলো “পদ চন্দ্রিকা”। বারবক শাহ তাঁকে পণ্ডিত সার্বভৌম উপাধি দ্বারা সম্মানিত করেন।
- বিখ্যাত বাংলা কাব্য “শ্রীকৃষ্ণবিজয়” এর রচয়িতা মালাধর বসু কে তিনি “গুনরাজ খাঁ” উপাধি প্রদান করেন। কৃত্তিবাস যিনি বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন তিনি ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক তা লাভ করেন। বহু মুসলমান পণ্ডিত কেও তিনি সসম্মানে দরবারে স্থান দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল “শরফনামা ” নামক শব্দকোষ এর রচয়িতা ইব্রাহিম করুকি।
- গৌরের বিখ্যাত ও বিশাল তোরণ “দাখিল দরওয়াজা” তিনি নির্মাণ করেন। এই বংশের শেষ শাসক ছিলেন জালাল উদ্দিন ফতে শাহ। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয় তাঁর সময়েই । তাঁর কর্তৃক নিযুক্ত হাবশি রাই পরবর্তীকালে তাঁকে হত্যা করে।
- ফতে শাহ এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলদেশে একশো আঠারো বছর ব্যাপী ইলিয়াস শাহি বংশের শাসনের অবসান ঘটে। এই ভাবে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে যে বংশের শাসন শুরু হয় ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তাঁর সম্পূর্ণ পতন ঘটে।
বাংলায় আবিসিনীয় বা হাবশি শাসন
- ইলিয়াস শাহি বংশের শেষ শাসক জালাল উদ্দিন ফতে শাহ্ কে হত্যা করে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে হাবশি ক্রীতদাসরা। ১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ পর্যন্ত ছয় বছর তাঁরা শাসন ক্ষমতা দখল করে রাখেন। এই শাসনকাল কে পণ্ডিত রা অন্ধকার যুগ বা Dark Age বলে বর্ণনা করেছেন।
হুসেন শাহি বংশ
- আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং তাঁর বংশধরদের শাসন কাল ইতিহাসে হুসেন শাহি বংশের আমল হিসাবে পরিচিত। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় হুসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
- মধ্যযুগের বাংলায় হুসেন শাহ মর্যাদাপূর্ণ ও বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। বহু হিন্দু কর্মচারী উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত ছিল তাঁর সময়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সনাতন গোস্বামী ও রূপ গোস্বামী। এঁরা ছিলেন সহোদর ভাই। সনাতনের উপাধি ছিল “সাকর মল্লিক” বা ছোট রাজা।
- রূপ গোস্বামী “বিদগ্ধ মাধব” ও “ললিত মাধব ” নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁ র আগ্রহে পরমেশ্বর কবীন্দ্র নামক জনৈক কবি সমগ্র মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় মলাধর বসু “শ্রীমদভগবতগীতা” বাংলায় অনুবাদ করে “গুনরাজ খাঁ” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মোটকথা শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক রূপে ও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে গেছেন।
- গৌড়ের ” গুমতি ফটক ” এবং গৌড়ের অনতিদূরে “ছোট সোনা মসজিদ ” তাঁর অনন্য কীর্তি।
- হুসেন শাহ বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে নিকটবর্তী এক ডালায় স্থানান্তরিত করেন।ক্রমাগত লুণ্ঠনের হাত থেকে রাজধানীর নিরাপত্তার জন্যই তিনি সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত নেন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
- তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন পুত্র নসরৎ শাহ। নসরৎ শাহ-এর মোট চৌদ্দ বছরের শাসনকালের প্রথম সাত বছর শিল্পসাহিত্যর উন্নতির প্রতি মন দেন আর বাকি সাত বছর ভারতীয় রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
- তাঁর নির্মাণ শৈলীর অনন্য নিদর্শন হলো “বারদুয়ারী” বা “সোনা মসজিদ”। গৌরের প্রখ্যাত কদম রসুল ভবন-ও তিনি সংস্কার করেন। তাঁর আমলেই মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন শ্রীকর নন্দী।
- ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে জনৈক আততায়ীর হাতে নসরৎ শাহ-এর মৃত্যু হয়।
- নসরৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো শ্রীধর কবিরাজ নামে জনৈক কবি “কলিকামঙ্গল” বা বিদ্যা সুন্দর কাব্য রচনা করেন।
- হুসেন শাহি বংশের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মামুদ শাহ। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অযোগ্য শাসক। শের খাঁ র ভ্রাতা খাওয়াস খাঁ এই সময় গৌড় নগরী দখল করে নেন। তিনি হুমায়ূনের সাহায্য চান কিন্তু হুমায়ূনই চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হলে বাংলা সম্পূর্ণ ভাবে শের খাঁ র হস্তগত হয়।
- ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন মামুদ শাহ নিহত হন। এইভাবে বাংলাদেশে হুসেন শাহি বংশের অবসান ঘটে এবং দুই শতাধিক বছর ব্যাপী বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানী র পরিসমাপ্তি ঘটে।