ভারতের সংবিধান প্রণয়ন | Constitution of India
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- ভারতের সংবিধানের ব্যাখ্যা-কর্তা কাকে বলা হয়?
উত্তর: সুপ্রিমকোর্টকে ভারতীয় সংবিধানের ব্যাখ্যা-কর্তা বলা হয়। - ভারতীয় সংবিধান রচনার দায়িত্ব কোন সংস্থার উপর দেওয়া হয়েছিল?
উত্তর: গণপরিষদের উপর ভারতীয় সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। - বর্তমানে ভারতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সংখ্যা কটি?
উত্তর: বর্তমানে ভারতে ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আছে। - ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে ভারত কীরূপ রাষ্ট্র?
উত্তর: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে ভারত হ’ল সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। - কোন দেশের সংবিধান পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান ?
উত্তর: ভারতীয় সংবিধান হল পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। - পৃথিবীর কোন দেশে অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য পৃথক সংবিধান আছে?
উত্তর: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য পৃথক সংবিধান আছে। - ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
উত্তর: ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। - কবে গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশন বসে?
উত্তর: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি গণ-পরিষদের সর্বশেষ অধিবেশন বসে। - কে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাকে ‘Testament of his old age’ বলেছেন?
উত্তর: আর্নেস্ট বার্বার ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাকে ‘Testament of his old age’ বলে অভিহিত করেছেন। - কবে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। - কবে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত হয়?
উত্তর: ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত হয়। - কোন সংবিধানকে অনুসরণ করে ভারতের সংবিধানে নির্দেশমূলক নীতি যুক্ত করা হয়?
উত্তর: আয়াৰ্ল্যান্ডের সংবিধানকে অনুসরণ করে ভারতের সংবিধানে নর্দেশমূলক নীতি যুক্ত করা হয়। - ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে কটি অঙ্গরাজ্য আছে?
উত্তর: ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ২৯টি অঙ্গরাজ্য আছে। - ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স কত বছর ছিল?
উত্তর: ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স ছিল ২১ বছর। - বর্তমানে ভারতের সংবিধানে ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স কত বছর?
উত্তর: বর্তমানে ভারতের সংবিধানের ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। - সংবিধানের কততম সংশোধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র’ কথাটি যুক্ত হয়েছে?
উত্তর: সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র’ কথাটি যুক্ত হয়েছে। - এখন পর্যন্ত (January 2019) ভারতের সংবিধান কত বার সংশোধন হয়েছে?
উত্তর: এখন পর্যন্ত (January 2019) ভারতের সংবিধান ১২৪ বার সংশোধন হয়েছে। - ভারতের সংবিধানে বর্তমানে কটি ধারা আছে?
উত্তর: ভারতের সংবিধানে বর্তমানে ৪৪৮টি ধারা আছে। - ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিকে কটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়?
উত্তর: ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিকে ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। - সংবিধানের প্রকৃতি কীরূপ হওয়া কাম্য?
উত্তর: সংবিধান লিখিত ও সুস্পষ্ট হওয়াই কাম্য। - ভারতের সংবিধানকে কী ধরনের সংবিধান বলা যেতে পারে?
উত্তর: ভারতের সংবিধানকে আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান বলা যেতে পারে। - “Commentaries on the Constitution of India” গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: “Commentaries on the Constitution of India” গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন ভেঙ্কটেশ সুব্বারাও। - বর্তমানে ভারতের সংবিধানে তপশিল-এর সংখ্যা কটি?
উত্তর: বর্তমানে ভারতের সংবিধানে তপশিলের সংখ্যা ১২টি। - ভারতীয় সংবিধানের জনক কাকে বলা হয়?
উত্তর: ড. বি. আর. আম্বেদকরকে ভারতীয় ‘সংবিধানের জনক’ বলা হয়। - ভারতের সংবিধান রচনায় কত সময় লাগে?
উত্তর: ভারতের সংবিধান রচনায় সময় লাগে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন। - কবে ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়?
উত্তর: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়। - কবে ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়?
উত্তর: ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়। - গণপরিষদের সভাপতি কে ছিলেন?
উত্তর: ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন। - “ভারতের জনগণ সংবিধান রচনা করেননি, সংবিধান রচনা করেছে সমাজের উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়”— উক্তিটি কার?
উত্তর: “ভারতের জনগণ সংবিধান রচনা করেননি, সংবিধান রচনা করেছে সমাজের উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত সম্প্রদায় ”—উক্তিটি করেছেন কে. ভি. রাও । - কবে ভারতের গণপরিষদ গঠিত হয়?
উত্তর: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গণপরিষদ গঠিত হয়। - মোট কত জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়?
উত্তর: মোট ৩৮৯ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। - গণপরিষদ কাকে বলে?
উত্তর: দেশের জনগণের সংবিধান রচনার দায়িত্ব যাঁরা সম্পাদন করেন, সম্মিলিতভাবে তাঁদের গণপরিষদ বলা হয়। - গণপরিষদের ব্রিটিশ অংশের আসনগুলির জন্য কবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর: গণপরিষদের ব্রিটিশ অংশের আসনগুলির জন্য ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। - ভারতীয় গণপরিষদ কি সার্বভৌম সংস্থা?
উত্তর: আইনের দৃষ্টিতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে গণপরিষদ সার্বভৌম ছিল না। - গণপরিষদের খসড়া কমিটির সভাপতি কে ছিলেন?
উত্তর: গণপরিষদের খসড়া কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. বি. আর. আম্বেদকর। - ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদের মোট কটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদের মোট ১১টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। - প্রস্তাবনা কাকে বলে?
উত্তর: সংবিধানের ভূমিকাকে প্রস্তাবনা বলা হয়। - কোন দেশের সংবিধানে সর্বপ্রথম একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত হয়?
উত্তর: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান রচয়িতারা সর্বপ্রথম একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত করেন। - ইংরেজি ‘Constitution ‘ কোন শব্দ থেকে এসেছে?
উত্তর: ইংরেজি ‘Constitution’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Constiture’ থেকে এসেছে। - স্বাধীন ভারতের প্রথম অধ্যক্ষ কে হন?
উত্তর: স্বাধীন ভারতের প্রথম অধ্যক্ষ হন জি. ভি. মভলঙ্কর। - গণপরিষদকে কে ‘আইনজীবীদের স্বৰ্গ’ বলেছেন?
উত্তর: অধ্যাপক আই ভর জেনিংস (Ivor Jennings) গণপরিষদকে ‘আইনজীবীদের স্বৰ্গ’ বলেছেন। - ‘গণপরিষদই ছিল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসই ছিল ভারত’-কার উক্তি?
উত্তর: ‘গণপরিষদই ছিল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসই ছিল ভারত’ -একথা বলেছেন গ্রেনভিল অস্টিন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১। গণপরিষদ কাকে বলে?
উত্তর : জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, যারা দেশের সংবিধান রচনার দায়িত্বে থাকেন, তাদের নিয়ে গঠিত কমিটি বা সংস্থাকে বলা হয় গণপরিষদ।
প্রশ্ন ২। ভারতের গণপরিষদ কী সার্বভৌম সংস্থা?
উত্তর : কংগ্রেস গণপরিষদকে সার্বভৌম সংস্থা হিসাবে গণ্য করেছে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে ১৯৪৬ = খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বরে গঠিত গণপরিষদ সার্বভৌম ছিল না। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দ্বারা গণপরিষদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর গণপরিষদও আইনগতভাবে সার্বভৌম সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রশ্ন ৩। ভারতের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন কবে এবং কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর : ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর নতুন দিল্লির ‘কনস্টিটিউশান হলে’ বেলা ১১টার সময় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়।
প্রশ্ন ৪। ভারতের সংবিধান রচনা করতে কত সময় লাগে ?
উত্তর : ভারতের সংবিধান রচনার কাল হল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ দু-বছর এগারাে মাস আঠারাে দিন। এই সংবিধান রচনার জন্য ১১টি অধিবেশন আহ্বান করা হয়।
প্রশ্ন ৫। ভারতের সংবিধানের ওপর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রভাব উল্লেখ করাে।
উত্তর : ভারতের সংবিধানের মূল ভিত্তি হিসাবে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনকে গণ্য করা হয়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় গঠনব্যবস্থা, শক্তিশালী কেন্দ্র, রাজ্যগুলির কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা, ক্ষমতা বণ্টন ব্যবস্থা, সংসদীয় গণতন্ত্র, রাজ্যপালদের নিয়ােগ, রাজ্যপালদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রভৃতির ওপর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনের ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ করা যায়।
প্রশ্ন ৬। সাংবিধানিক দলিলে গণপরিষদের সকল সদস্য কী সই করেছিলেন?
উত্তর : সাংবিধানিক দলিলে গণপরিষদের সকল সদস্য সই করেননি। যেমন, অকালি ও সােশ্যালিস্টগণ, মুসলিম লিগের একটি অংশ এবং কয়েকজন চরম দক্ষিণপন্থী সদস্য সাংবিধানিক দলিলে স্বাক্ষর করেননি। ৩০৮ জন সদস্যদের মধ্যে (পাঁচটি আসন শূন্য ছিল) ২৭৫ জন স্বাক্ষর করেছিলেন।
প্রশ্ন ৭। ভারতীয় সংবিধান কবে রচিত হয় এবং কবে কার্যকারী হয় ?
উত্তর : ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় এবং সর্বশেষ অধিবেশন বসে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি। ভারতীয় সংবিধান রচিত হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর এবং কার্যকারী হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি।
প্রশ্ন ৮। গণপরিষদের মূল লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর :গণপরিষদের সদস্যদের মূল লক্ষ্য ছিল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শের ভিত্তিতে ভারতবাসীর জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা প্রস্তুত করা।
প্রশ্ন ৯। ভারতের সংবিধানের কটি ধারা এবং কটি তালিকা আছে?
উত্তর : মােট ৩৯৫টি ধারা, বহু উপধারা এবং ৮টি তালিকা নিয়ে ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছিল। বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানে প্রায় ৪৫০টি ধারা, বহু উপধারা এবং ১২টি তালিকা আছে।
প্রশ্ন ১০। ভারতীয় সংবিধান সংশোধন সুপরিবর্তনীয় না দুষ্পরিবর্তনীয় ?
উত্তর : ভারতের সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি ব্রিটেনের মতাে সুপরিবর্তনীয় বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে দুম্পরিবর্তনীয় নয়। এই সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি সুপরিবর্তনীয়তা ও দুম্পরিবর্তনীয়তার সংমিশ্রণ।
প্রশ্ন ১১। ভারতের সংবিধান কীভাবে সংশােধন করা যায় ?
উত্তর : ভারতের সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি আছে- (১) কিছু বিষয় আছে যা পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই সংশােধন করা যায়। (২) সংবিধানের অধিকাংশ বিষয় পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সংশােধন করা যায়। (৩) আবার কিছুকিছু বিষয় আছে যা সংশােধন করার জন্য পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ এবং অর্ধেক রাজ্য আইনসভার সম্মতি দরকার হয়।
প্রশ্ন ১২। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি কীরূপ?
উত্তর : ভারতের শাসনব্যবস্থা কাঠামােগত বিচারে যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও প্রকৃতিগত বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক হােয়ারের মতে, ভারতীয় সংবিধান কতক পরিমাণে যুক্তরাষ্ট্রীয়’ বা ‘আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয়’।
প্রশ্ন ১৩। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গরাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য কী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুসারে সংবিধানের অনেকগুলি বিধান জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সরাসরি বলবৎ হয় না। কাশ্মীর সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতিকে এ ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ জারি করতে হয়। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের নিজ সংবিধান রচনা করার ক্ষমতা ভারতের সংবিধানে স্বীকার করা হয়েছে।
প্রশ্ন ১৪। প্রস্তাবনা বলতে কী বােঝ?
উত্তর : সংবিধানের ভূমিকা বা মুখবন্ধকে বলা হয় প্রস্তাবনা। আল্লাদি কৃয়স্বামী আয়ার-এর ভাষায়, প্রস্তাবনা হল আইনের এক ধরনের ভূমিকা এবং অনেকক্ষেত্রে তা আইনের নীতি ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে আমাদের সাহায্য করে। বস্তুত প্রস্তাবনা হল সংবিধানের দর্শন।
প্রশ্ন ১৫। ভারতবর্ষ কি সার্বভৌম রাষ্ট্র?
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলা হয়েছে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, ভারতের কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ সার্বভৌম চরিত্রের মূলে আঘাত হানে। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ বা বর্জন স্বেচ্ছাধীন। তাই ভারত সার্বভৌম রাষ্ট্র।
প্রশ্ন ১৬। ভারতের সংবিধানে কী ধরনের শাসনব্যবস্থা বলবৎ করা হয়েছে ?
উত্তর ভারতের সংবিধান ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর রচিত হয় এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি তা কার্যকারী হয়। এই সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলবৎ করার কথা বলা হয়।
প্রশ্ন ১৭। ক্যাবিনেট মিশন কত খ্রিস্টাব্দে এবং কাদের নিয়ে গঠিত হয় ?
উত্তর : ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাবিনেট মিশন গঠিত হয়। ভারত-সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস এবং এ. ভি. আলেকজান্ডারকে নিয়ে ক্যাবিনেট মিশন গঠিত হয়।
প্রশ্ন ১৮। সংবিধান কাকে বলে?
উত্তর : সংবিধান হল রাষ্ট্রের দলিল। রাষ্ট্রের ন্যায় সংবিধানেরও বিভিন্ন সংজ্ঞা আছে। সংকীর্ণ এবং ব্যাপক অথে সংবিধানের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়। সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান বলতে বােঝায়, রাষ্ট্রের নিয়মকানুন। অপরদিকে ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে বােঝায়, শাসনব্যবস্থার নিয়মকানুনের সংমিশ্রণ।
প্রশ্ন ১৯। সংবিধানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে ব্রাইস এবং ফাইনার অভিমত কী ?
উত্তর : লর্ড ব্রাইসের মতে, “সংবিধান হল সেইসব আইন ও প্রথার সমষ্টি যেগুলিকে অনুসরণ করে রাষ্ট্র চলে।” ফাইনারের মতে, “মৌলিক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবস্থাই সংবিধান।”
প্রশ্ন ২০। সংবিধানের মার্কসীয় সংজ্ঞা কী ?
উত্তর : মার্কসবাদীরা এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের সংজ্ঞা প্রদান করে থাকেন। তাঁদের মতে, “সংবিধানের মধ্য দিয়ে সমাজব্যবস্থার নির্দিষ্ট প্রকৃতিটিকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সমাজে যে শ্রেণি প্রভুত্ব করে তাদের স্বার্থরক্ষা করাই সংবিধানের কাজ।”
প্রশ্ন ২১। লিখিত সংবিধান কাকে বলে?
উত্তর : যখন কোনাে রাষ্ট্রের ও সরকারের গঠন এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি মূলনীতিগুলি কতকগুলি আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয় তখন সেই রাষ্ট্রের সংবিধানকে আমরা লিখিত সংবিধান বলে অভিহিত করে থাকি। যেমন—ভারতের সংবিধান লিখিত সংবিধানের উদাহরণ।
প্রশ্ন ২২। অলিখিত সংবিধান কাকে বলে?
উত্তর : কোনাে রাষ্ট্রে যখন রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলি লিখিত আকারে উপস্থাপিত না করে প্রথা, রীতিনীতি প্রভৃতির দ্বারা মৌলিক নীতিগুলি পরিচালিত হয় এবং রাষ্ট্রের শাসক ও নাগরিকরা সেই প্রথা, রীতিনীতিকে মান্য করে, সেই রাষ্ট্রের সংবিধানকে অলিখিত সংবিধান বলে। যেমন যুক্তরাজ্যের সংবিধান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রশ্ন ২৩। সুপরিবর্তনীয় সংবিধান কাকে বলে?
উত্তর : যে সংবিধান সহজেই পরিবর্তন করা সম্ভব অর্থাৎ সাধারণ আইন যেভাবে প্রণীত হয় সেই পদ্ধতিতে যে সংবিধান সংশােধন করা যায় সেই সংবিধানকে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। যেমন—গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রশ্ন ২৪। দুম্পরিবর্তনীয় সংবিধান কাকে বলে ?
উত্তর : যে সংবিধান সহজে সংশােধন করা যায় না, সংশােধন করতে হলে জটিল পদ্ধতির দ্বারা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, সেই সংবিধানকে দুম্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। যেমন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রশ্ন ২৫। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কাকে বলে?
উত্তর : যে দেশের শাসনব্যবস্থায় একটিমাত্র সরকারের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় অর্থাৎ সারা দেশে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেই দেশের শাসনব্যবস্থাকে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বলে।
প্রশ্ন ২৬। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা কাকে বলে?
উত্তর : যে দেশের শাসনব্যবস্থায় দুই ধরনের সরকারের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়—এক, কেন্দ্রীয় সরকার অপরটি রাজ্য সরকার, সেই দেশের শাসনব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বলে।
প্রশ্ন ২৭। ভারতের সংবিধানকে আইনবিদদের স্বর্গরাজ্য বলা হয় কেন?
উত্তর : ভারতের সংবিধানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসনব্যবস্থার উল্লেখযােগ্য বিভিন্ন বিষয় গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বহু আপাত-বিরােধী আদর্শ সংবিধানে স্থান পেয়েছে। এই সমস্ত আপাত-বিরােধী বক্তব্য ও লিখিত অনুচ্ছেদসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য অহরহ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। তাই ভারতের সংবিধানকে আইনবিদদের স্বর্গরাজ্য বলে অভিহিত করা হয়।
প্রশ্ন ২৮। ভারতের সংবিধান কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও মার্কিন শাসনতন্ত্রকে অনুসরণ করেছে?
উত্তর : ভারতের সংবিধান পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা, পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব, আইনের অনুশাসন, নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করেছে। আবার লিখিত সংবিধান, মৌলিক অধিকার, বিচার-বিভাগীয় স্বাতন্ত্র্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মার্কিন শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করেছে।
প্রশ্ন ২৯। ৪২-তম সংবিধান সংশােধনের দ্বারা ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সম্পাদিত পরিবর্তনগুলি উল্লেখ করাে।
উত্তর : ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪২তম সংশােধনের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রথম অংশে ‘সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ এবং শেষ অংশে ‘জাতীয় সংহতি’ কথাগুলি সংযুক্ত হয়েছে।
প্রশ্ন ৩০। ভারতের সংবিধানে প্রথাগত বিধান (Conventions)-এর ভূমিকা আলােচনা করাে।
উত্তর : বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত সংবিধান হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সংবিধান সর্বাংশে লিখিত নয়। যেমন— ভারতের শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে লােকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়ােগ, শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য, পার্লামেন্টীয় সুযােগসুবিধা অন্যান্য রীতিনীতি, রাজ্যপাল মনােনয়নে রাজ্যের মতামত জানার রীতি, আন্তঃরাজ্য সহযােগিতার জন্য রাজ্যপালদের সম্মেলন, মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন প্রভৃতি।
বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১) ক্রিপস প্রস্তাবের মূল বক্তব্য কী?
উত্তর : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে (Sir Stafford Cripps) ভাল রাজনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের জন্যে পাঠান। ক্রিপস ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সম্মুখে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তার মূল বক্তব্য নিম্নরূপ-
(i) যুদ্ধশেষে পূর্ণ ডােমিনিয়নের মর্যাদাসম্পন্ন একটি নতুন ভারত ইউনিয়নের সৃষ্টি করা হবে।
(ii) ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে। এ ব্যাপারে প্রধান দল ও সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মতবিরােধ হলে নির্বাচনের মাধ্যমে এই পরিষদ গঠিত হবে।
(iii) সংবিধান প্রণয়ন সংস্থায় দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতিটি প্রেরণ করতে পারে।
(iv) ব্রিটিশ ভারতের কোনাে প্রদেশ নতুন ব্যবস্থায় যােগ না দিয়ে পূর্ণ মর্যাদা সংরক্ষণ এবং পরবর্তী সময়ে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।
(v) সংবিধান প্রণয়ন সংস্থার সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের চুক্তি অনুযায়ী কমনওয়েলথ ও সদস্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারিত হবে।
(vi) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে (Proportional Representation) প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ সংবিধান প্রণয়ন সংস্থাকে নির্বাচন করবে।
(vii) সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষা বিষয়ক দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
প্রশ্ন ২) সংবিধানের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর : সংবিধানের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ রাষ্টবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে সমস্ত সংজ্ঞাগুলিকে আমরা দুটি মূল শেণিতে বিন্যস্ত করে পর্যালােচনা করতে পারি। (ক) সংকীর্ণ অর্থে এবং (খ) ব্যাপক অর্থে।
(ক) সংকীর্ণ অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা :
সংকীর্ণ অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, সংবিধান হল সেইসব আইন এবং রীতিনীতির সমষ্টি যেগুলির অধীনে থেকে রাষ্ট্রের জীবন পরিচালিত হয়। আবার অধ্যাপক কে. সি. হােয়ার (K. C. Whearo) বলেছেন, সংবিধান বা শাসনতন্ত্র হল দেশের নির্বাচিত কিছু বৈধ আইন বা নিয়ম যেগুলি সেই দেশের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যেগুলি একটি দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে।
(খ) ব্যাপক অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা :
অপরদিকে ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে বােঝায় লিখিত বা অলিখিত আইনকানুন যা দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। গিলক্রিস্টের ভাষায় সংবিধান হল এমন কিছু লিখিত অথবা অলিখিত নিয়মনীতির সমষ্টি যেগুলি সরকারের গঠন এবং বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ইত্যাদি বিষয়ে সম্পষ্টভাবে নিয়ম ও নীতি প্রণয়ন করে। স্যার আইভরজেনিংস বলেছেন, সংবিধান বা শাসনতন্ত্র হল লিখিত নিয়মকানুন, প্রথা ও সাংবিধানিক রীতিনীতির সমষ্টি।
উপরিউক্ত সংজ্ঞা ছাড়াও মার্কসবাদীদের সংজ্ঞা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকগণ সংবিধান বলতে শুধুমাত্র কয়েকটি সাংগঠনিক নিয়মকানুনের সমষ্টি বলে স্বীকার করেন না। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ অনুসারে এগুলি নিছক শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থায় শাসকশ্রেণি তার স্বার্থরক্ষার জন্য দলিলরূপে ব্যবহার করে। বৈষম্যমূলক তথা শ্রেণিভিত্তিক সমাজে বিত্তশালী ও প্রভুত্বকারী শক্তিগুলি তাদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে যে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কাঠামাে রচনা করে তাকেই বলে সংবিধান।
প্রশ্ন ৩) লিখিত সংবিধান-এর বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উত্তর : যে দেশের শাসনব্যবস্থা-সম্পর্কিত মৌলিক নীতিগুলির অধিকাংশ বা সবগুলি একটি বা কয়েকটি দলিলে লিপিবদ্ধ করা থাকে, তাকে লিখিত সংবিধান (Written Constitution) বলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এইসব শাসনতান্ত্রিক মৌলিক নীতিগুলিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য একটি সংবিধান পরিষদ (Constituend Assembly) বা কনভেনশন (Convention) আহ্বান করা হয়। এই পরিষদ বা কনভেনশন সংবিধান রচনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি ঘােষণা করে, নিম্নে এর বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল—
(i) এই ধরনের সংবিধান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি। নির্দিষ্ট সময়ে কনভেনশন (Convention) আহ্বান করে এই সংবিধান গড়ে ওঠে।
(i) এই ধরনের সংবিধান হয় গণপরিষদ, নয় সম্মেলনের মাধ্যমে প্রণীত হয়।
(iii) এরপ সংবিধানের মধ্যেই সংবিধান সংশােধনের পদ্ধতি লেখা থাকে।
(iv) লিখিত সংবিধানে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হয়েছে।
(v) লিখিত সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা থাকে।
প্রশ্ন ৪) অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উত্তর : শাসন-সংক্রান্ত মৌলিক নীতিগুলি যখন প্রথা, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ও বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তখন তাকে অলিখিত সংবিধান (Unwritten Constitution) বলা হয়। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত সংবিধানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিম্নে এর বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল-
(1) অলিখিত সংবিধানে শাসন-সংক্রান্ত মৌলিক নীতিগুলিকে কোনাে সংবিধান পরিষদ বা কনভেনশন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করে না।
(ii) এরুপ সংবিধান রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ক্ৰমবিবর্তনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়।
(iii) নির্দিষ্ট দলিলের আকারে এই সংবিধানকে পাওয়া যায় না।
(iv) অলিখিত সংবিধান প্রথা, রীতিনীতি, বিচারকের রায় ও দেশের রাজনৈতিক কৃষ্টির মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
(v) এই সংবিধানকে সহজেই পরিবর্তন করা যায়। এই ধরনের সংবিধান অনির্দিষ্ট। উল্লেখ্য, বাস্তবে কোনাে সংবিধানই পুরােপুরি লিখিত অথবা পুরােপুরি অলিখিত হয় না।
প্রশ্ন ৫) লিখিত সংবিধানের গুণ এবং দোষগুলি উল্লেখ করাে।
উত্তর : • গুণ
(i) সুস্পষ্টতা : এই সংবিধান সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট হয়। অনেক চিন্তাভাবনা, আলাপ-আলােচনার মধ্য দিয়ে এটি প্রণীত হয়।
(ii) স্থায়িত্ব : স্থায়িত্ব লিখিত সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লিখিত সংবিধানে সংবিধান সংশােধনের পদ্ধতি নির্দিষ্ট থাকে।
(iii) লিপিবদ্ধ অধিকার : ব্যক্তির অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। ফলে অধিকারগুলি সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা লাভ করে। জনগণও অধিকার সম্পর্কে বেশি সচেতন হয়।
(iv) সুবিচার : সংবিধান লিখিত হলে বিচার কাজের সুবিধা হয়। সংবিধানের নির্দেশ থাকায় বিচারপতিরা সহজেই সাংবিধানিক প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেন।
(v) যুক্তরাষ্ট্রে অপরিহার্য : এই ধরনের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রে অপরিহার্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে দু-ধরনের সরকার থাকে। সংবিধানের দ্বারা তাদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হয়।
• দোষ
(i) অনমনীয়তা : এই সংবিধান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রাখতে পারে না। জনগণের দাবি মতাে সংবিধানের কোনাে অংশ বর্জন করা বা কোনাে অংশ সংযােজন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
(ii) বিচারপতিদের ক্ষমতা বৃদ্ধি : বিভিন্ন আইনি ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে বিচারপতিরা অনেকসময় ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হিউজেস বলেছেন – “আমরা একটা সংবিধানের অধীন, কিন্তু সংবিধানটি হল বিচারপতিরা যা বলেন তাই।”(iii) ভাষার জটিলতা বৃদ্ধি : লিখিত সংবিধানে ব্যবহৃত ভাষার নানারূপ ব্যাখ্যা করা হয়। তা নিয়ে অযথা বিবাদ-বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
(iv) রীতিনীতি প্রথা উপেক্ষিত : একটি দেশের প্রথা ও রীতিনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সংবিধান লিখিত হলে এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি উপেক্ষিত হয়।
(v) অধিকার সংরক্ষিত হয়, সবসময় এ কথা ঠিক নয় : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল বলেছেন যে অধিকার বাস্তবে কার্যকর হবে কিনা, তা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর। (ক)—সংবিধানের নির্দেশ কত সহজে পরিবর্তন করা যায়, তার উপরে এবং (খ) বিচারব্যবস্থার উপর। সরকারের অসাংবিধানিক কাজকে বিচার বিভাগ প্রতিহত করতে না পারলে, অধিকার রক্ষা করা যায় না।
(vi) মার্কসীয় যুক্তি : মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, কোনাে একটি রাষ্ট্রের নাগরিকরা কি ধরনের অধিকার ভােগ করবে, তা নির্ভর করে সমাজব্যবস্থার প্রকৃতির ওপর।
প্রশ্ন ৬) অলিখিত সংবিধানের গুণ ও দোষগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর : গুণ
(i) অলিখিত সংবিধান দরকারমতাে সহজেই পরিবর্তন করা যায়। ফলে এইরূপ সংবিধান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সময় ও প্রয়ােজনমতাে। এরপ সংবিধান সংশোধনযােগ্য হওয়ায় সমাজে কোনােপ্রকার বিক্ষোভ দেখা যায় না।
(ii) হঠাৎ দেশের কোনাে বিশেষ প্রয়ােজনের সময় যদি সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়ােজন হয় তখন অতি দ্রুত সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে এই জাতীয় সংবিধান কার্যকর হয়।
(iii) এই ধরনের সংবিধান সংকীর্ণতার দোষে দুষ্ট নয়।
(iv) এই সংবিধান বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে পারে।
দোষ
(i) নমনীয়তা যেমন এর গুণ ঠিক তেমনিভাবে এই নমনীয়তাই এই সংবিধানের দোষ বলেও বিবেচিত হয়। কারণ, নমনীয়তার কারণে এই সংবিধানকে শাসকগােষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ও প্রয়ােজনে পরিবর্তন করতে পারে। নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(ii) এই সংবিধান স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। এই সংবিধানে শাসনতান্ত্রিক আইন ও সাধারণ আইনের পার্থক্য স্পষ্টভাবে বােঝা যায় না।
(iii) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় এই সংবিধান কার্যকর নয়। কারণ এই সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সম্ভব হতে পারে না।
(iv) অনেকে বলেন যে, এই সংবিধান যেখানে কার্যকর সেখানে বিচার বিভাগের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ, এক্ষেত্রে বিচার বিভাগ নিজের বিবেচনা অনুযায়ী সংবিধানকে ব্যাখ্যা করার সুযােগ পায়।
প্রশ্ন ৭) লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য লেখাে।
উত্তর : দুটি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে উভয়ের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য নজরে পড়ে। যেমন-
(i) লিখিত সংবিধানের উৎস লিখিত আইন, নিয়মাবলি। অন্যপক্ষে অলিখিত সংবিধানের উৎস প্রথা, রীতিনীতি ইত্যাদি।
(ii) লিখিত সংবিধান লিখিত দলিল হিসাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে এইরপ কোনাে দলিল পরিলক্ষিত হয় না।
(iii) লিখিত সংবিধান নির্দিষ্ট কোনাে সংস্থার দ্বারা প্রণীত হয়। অপরপক্ষে অলিখিত সংবিধান কোনাে সংস্থার দ্বারা প্রণীত হয় না। এটা ক্রমবিবর্তনের ফল।
(iv) সংবিধান কবে রচিত হয়েছে এবং কবে থেকে তা কার্যকর হয়েছে লিখিত সংবিধান স্পষ্ট করে লিপিবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে অলিখিত সংবিধানে রচনাকাল ও কার্যকাল লেখার কোনাে সুযােগ নেই।
(v) লিখিত সংবিধান সাধারণত অনমনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। অন্যদিকে অলিখিত সংবিধান সাধারণত নমনীয় হয়ে থাকে।
(vi) লিখিত সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আইনসভা এমন কোনাে আইন প্রণয়ন করতে পারে না যা এই সংবিধান বিরােধী। কিন্তু অলিখিত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় আইনসভার ক্ষমতা অসীম।
(vii) সংবিধান সংশােধন বিষয়েও উভয়প্রকার সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য আছে। লিখিত সংবিধানকে অলিখিত সংবিধানের মতাে সাধারণ আইন পাস করার পদ্ধতিতে সংশােধন করা যায় না। সংবিধান সংশােধন করতে হলে বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়।
(viii) লিখিত সংবিধানে আছে সংবিধানের প্রাধান্য। এখানে সাংবিধানিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সংবিধান যেখানে অলিখিত, সেখানে সাংবিধানিক আইনও সাধারণ আইনের মতাে প্রণয়ন করা যায়। দু-ধরনের আইনের মধ্যে মৌলিক কোনাে পার্থক্য থাকে না।
(ix) লিখিত সংবিধানে সরকারের প্রতিটি বিভাগের এক্তিয়ার নির্দিষ্ট করা থাকে। ফলে আন্তঃবিভাগ বিরােধের সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে বিভাগগুলির ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণে অস্পষ্টতা লক্ষ করা যায়।
(x) লিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিচার বিভাগ সরকারি আইনের ব্যাখ্যা দেয়। আইন সংবিধান-বিরােধী হলে তা বাতিল করে দেয়। যেসব দেশের সংবিধান অলিখিত, সেসব দেশে বিচার বিভাগের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায় না।
প্রশ্ন ৮) ভারতীয় সংবিধান সংশােধন পদ্ধতিটি বর্ণনা করাে।
উত্তর : ভারতের সংবিধান সংশােধনের পদ্ধতিটি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়-
(i) সংবিধানের কতকগুলি বিষয়, যেমন—নতুন রাজ্য গঠন, রাজ্য সীমানার পুনর্গঠন, অঙ্গরাজ্যে দ্বিতীয় কক্ষের প্রবর্তন বা বিলােপসাধন, নাগরিকতা অর্জন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের গঠন প্রভুতি পার্লামেন্ট সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে পরিবর্তন করতে পারে। পার্লামেন্টে সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে এই সংশােধন সম্ভব বলে এই অংশগুলি সুপরিবর্তনীয় বলা যেতে পারে।
(ii) সংবিধানের কতকগুলি বিষয় পরিবর্তনের জন্য এই বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। সংশােধনী বিল পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে পাস হওয়ার প্রয়ােজন হয়। সমগ্র সদস্যের অধিকাংশ এবং প্রত্যেক কক্ষের উপস্থিত এবং ভােটপ্রদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংশােধন প্রস্তাব পাস হওয়া প্রয়ােজন। তারপর বিলটিকে অঙ্গরাজ্যগুলির অন্তত অর্ধেক আইনসভার দ্বারা অনুমােদিত হওয়ার প্রয়ােজন হয়। রাজ্যের দ্বারা অনুমােদিত বিলটি রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভ করলে সংবিধানের সংশােধন সম্ভব হয়। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, কেন্দ্রে ও অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব, সংবিধানের সংশােধন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত ধারাগুলি পরিবর্তন করতে হলে এই বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।
(iii) সংবিধানের অন্যান্য ধারা ও উপধারা সংশােধনের জন্য পার্লামেন্টের যে-কোনাে কক্ষে বিল পেশ করা যায়। প্রত্যেক কক্ষের উপস্থিত ও ভােটপ্রদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্টতায় এবং সমগ্র কক্ষের সদস্যের অধিকাংশ দ্বারা সমর্থিত হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য দল পাঠানাে হয়। রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভে সংবিধানের সংশােধন হয়। সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণিত মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রপরিচালনায় নির্দেশমুলক নীতিসহ অন্যান্য অংশ এই পদ্ধতিতে সংশােধন করা যায়।
প্রশ্ন ৯) নমনীয় সংবিধানের গুণ ও দোষ আলােচনা করে।
উত্তর : গুণ
(i) এই সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায়।
(ii) এটি গতিশীল। এই সংবিধান কখনােই প্রাণহীন দলিলে পর্যবসিত হয় না।
(iii) এই সংবিধান রক্ষণশীল নয়।
(iv) এই সংবিধানে সহজেই জনগণের চাহিদা মেটায়। তাই বিদ্রোহ-বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকে।
(v) জরুরি অবস্থায় এটি উপযােগী। লর্ড ব্রাইস এই দিকটার প্রতি বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
দোষ
(i) রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, সুপরিবর্তনীয় সংবিধান, স্থিতিশীল হয় না। শাসকগােষ্ঠী প্রয়ােজনে ও অপ্রয়ােজনে সংবিধানকে পরিবর্তিত করে নিজেদের স্বার্থে।
(ii) সংবিধানের গুরুত্ব ও মর্যাদাহানি ঘটে।
(iii) ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হয়। বিচার বিভাগের গুরুত্ব হ্রাস হয়।
(iv) শাসকগােষ্ঠী ইচ্ছা করলেই সংবিধান সংশােধন করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে।
(v) এই সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনুপযােগী। সহজে সংবিধান পরিবর্তন করার ফলে ক্ষমতা বণ্টন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশঙ্কা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি বিঘ্নিত হয়।
প্রশ্ন ১০) অনমনীয় সংবিধানের গুণ ও দোষ আলোচনা করাে।
উত্তর : গুণ
(i) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান সুস্পষ্ট।
(ii) এই সংবিধান স্থিতিশীল। খেয়ালখুশি অনুযায়ী পরিবর্তন করা যায় না।
(iii) গণতন্ত্রের পক্ষে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(iv) মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হয়। শাসকগােষ্ঠী ইচ্ছানুসারে সংবিধান পরিবর্তন করে মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
(v) বিচার বিভাগের প্রাধান্য থাকে। আইনসভা যদি সংবিধান-বিরােধী কোনাে আইন পাস করে তবে বিচার বিভাগ তা বাতিল করে দিতে পারে।
(vi) যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উপযােগী। এখানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন সহজে
পরিবর্তন করা যায় না।
দোষ
(i) এই ধরনের সংবিধানের কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন—সংবিধান রক্ষণশীল হয়। গতিহীন হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে যায়।
(ii) অনেকসময় বিচারপতিরা, যারা বিশেষ শ্রেণি থেকে আসে তারা বড়ােলােক। স্বার্থবিরোধী আইনকে বাতিল করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট নিউ ডিল (New Deal) নামে পরিচিত যেসব সমাজকল্যাণকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা তা এভাবেই বাতিল করে দিয়েছিলেন।
(iii) জরুরি অবস্থার অনুপযােগী। জরুরি অবস্থায় প্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
(iv) সংখ্যালঘুদের স্বার্থের পরিপন্থী।
(v) সংসদীয় ব্যবস্থায় অনুপযােগী। কারণ, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে আইনসভা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না।
প্রশ্ন ১১) “ভারতীয় সংবিধান পরিবর্তনীয়তা ও দুষ্পরিবর্তনীয়তার সমন্বয় করেছে”—উক্তিটি ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর : সংবিধানের দুষ্পরিবর্তনীয়তা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই সংবিধান দুস্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান সংশােধন করতে হলে মার্কিন কংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশের ভােটের দ্বারা অথবা অঙ্গরাজ্যগুলির দুই-তৃতীয়াংশের আবেদন অনুসারে আহত এক সভার দ্বারা সংশােধনের প্রস্তাব আনা হয় এবং ওই প্রস্তাব অঙ্গরাজ্যগুলির তিন-চতুর্থাংশের দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়ােজন। অতএব দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি অতি জটিল। আবার আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব যে, ব্রিটেনের সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি অতি নমনীয়। ভারতের ক্ষেত্রে ক্ষমতা বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ে শাসনতন্ত্রকে দুষ্পরিবর্তনীয় বলা যেতে পারে। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা বণ্টন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, ইউনিয়ন ও রাজ্যগুলির শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়ে শাসনতন্ত্র সংশােধন করতে হলে অঙ্গরাজ্যগুলির আইনসভার সম্মতি প্রয়ােজন। আবার কতকগুলি ধারার পরিবর্তনের জন্য পার্লামেন্টের মােট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি নিলেই চলে, অঙ্গরাজ্যগুলির অনুমােদন প্রয়ােজন হয় না। আবার কতকগুলি বিষয় আছে, যা পার্লামেন্ট সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করতে পারে। সুতরাং সামগ্রিক বিচারে ভারতীয় শাসনতন্ত্রকে সুপরিবর্তনীয়তা ও দুষ্পরিবর্তনীয়তার সমন্বয় বলা
যেতে পারে।
প্রশ্ন ১২) ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করাে।
উত্তর : সংবিধানের ১(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, —“India, that is Bharat, shall be a Union of States”। অর্থাৎ ভারত হল রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন। তাহলে দেখা যাচ্ছে,—সংবিধানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র বলা হয়নি। তা সত্ত্বেও এখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি বর্তমান।
(i) ভারতের সংবিধান লিখিত। নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ২৬ নভেম্বর নির্দিষ্ট সভা অর্থাৎ গণপরিষদ দ্বারা এই সংবিধান গৃহীত হয়েছে।
(ii) এখানে দুই-ধরনের সরকার আছে—একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং ২৯টি রাজ্য সরকার।
(iii) সংবিধান উভয় সরকারের মধ্যে কেন্দ্রতালিকা, রাজ্যতালিকা এবং যুগ্ম তালিকার মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছে।(iv) ভারতের সংবিধান দুস্পরিবর্তনীয়। কারণ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংবিধান সংশােধন করতে গেলে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন দরকার, আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে এছাড়া অর্ধেক অঙ্গরাজ্যের সমর্থন প্রয়ােজন।
(v) এখানে একটি নিরপেক্ষ নির্ভীক যুক্তরাষ্টীয় আদালত আছে। এই আদালত বা সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের আভভাবক এবং চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা। সংবিধান-বিরােধী কোনাে আইন তৈরি হলে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করতে পারে।
(vi) এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার দুটি কক্ষ আছে—লােকসভা ও রাজ্যসভা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে,—ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগলি আছে। তা ছাড়া ডাইসি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গঠনের মূল দুটি শক্তি কাজ করে। একটি হল মিলনের ইচ্ছা এবং অপরটি হল পৃথক থাকার ইচ্ছা। ভারতে এই দুটি শক্তির মিলনে যুক্তরাষ্ট হয়েছে।
প্রশ্ন ১৩) ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্র প্রবণতা সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তর : আকৃতির দিক থেকে ভারত যুক্তরাষ্ট্র হলেও এখানে কেন্দ্র-প্রবণতা এতই বেশি যে, একে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র বলা যায় না। অধ্যাপক ডি, এন, ব্যানার্জি বলেছেন,— “ভারতীয় সংবিধান গঠনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র হলেও এর কেন্দ্র-প্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্ট।”
(i) ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায়,—কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রতালিকার বিষয়গুলির ওপর আইন তৈরি করে। আবার যুগ্ম তালিকায় তার প্রাধান্য বর্তমান। এছাড়া “অবশিষ্ট ক্ষমতা” তার হাতে আছে। কেন্দ্রের এই ব্যাপক ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধী।
(ii) কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যতালিকার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। ২৪৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, -রাজ্যসভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য কেন্দ্রকে অনুমতি দিলে কেন্দ্র রাজ্য তালিকার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এটি কেন্দ্রীয় প্রবণতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(iii) অঙ্গরাজ্যের প্রধান শাসক হলেন রাজ্যপাল। অথচ এঁকে নিয়ােগ করেন কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রপতির অধীনে থেকে তাঁকে কাজ করতে হয়। এতে রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হয়েছে।
(iv) সংবিধানের ২৫৬ ও ২৫৭ নম্বর ধারা অনুসারে কেন্দ্র রাজ্যকে নির্দেশ দিতে পারে। এই নির্দেশ অমান্য করলে রাষ্ট্রপতি রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে নিতে পারেন।
(v) দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষিত হলে,-ভারত সম্পূর্ণভাবে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। অধ্যাপক যােশির (Joshi) ভাষায়, -“ভারত ইউনিয়ন স্বাভাবিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু জরুরি অবস্থায় এককেন্দ্রিক হিসাবে কাজ করে।”
(vi) পার্লামেন্ট ভারতের যে-কোনাে অঙ্গরাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন করতে পারে। এটি নিঃসন্দেহে রাজ্যের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেছে।
(vii) সারা ভারতের জন্য একটিমাত্র নির্বাচন কমিশন, একটি কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন থাকায় রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন করেছে।
(viii) বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের প্রাধান্য বর্তমান। ভারতের সব আদালত সুপ্রিমকোর্টের অধীনে কাজ করে।
(ix) ভারতের অঙ্গরাজ্যের কোনাে সংবিধান নেই, এখানে দ্বিনাগরিকতা নেই। এগুলি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দাবি দুর্বল হয়েছে।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১) ভারতের সাংবিধানিক ক্রমবিকাশের ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করাে।
উত্তর : ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। অধ্যাপক বার্কার (Barker) আমাদের সংবিধানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। এই সংবিধান দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ফলে গড়ে উঠে। সেই বিকাশের ধারা নিম্নে আলােচিত হল :
(ক) ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন
মহাবিদ্রোহের পর ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট “ভারতশাসন আইন” তৈরি করে ভারতের শাসনক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে অর্পণ করে। সরকার তখন ভারতের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে “ভারতশাসন পরিষদ” নামে একটি সংস্থা গঠন করে। এটিই ভারতের সাংবিধানিক ক্রমবিকাশের প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়।
(খ) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত পরিষদ আইন
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত পরিষদ আইনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে ভারতীয়দের বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণের সুযােগ দেওয়া হয়। ভারতে নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল শাসন পরিষদেও ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
(গ) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ব্রিটেন বেকায়দায় পড়ে ভারতীয়দের সমর্থন পেতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন তৈরি করে। এই আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয় ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য হল—ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা চালু করা এবং প্রাদেশিক সরকারগুলিকে বেশি করে স্বাধীনতা দেওয়া।
(ঘ) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন
ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার দাবি ব্রিটিশ সরকার উপেক্ষা করলে মহাত্মা গান্ধি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের ব্যাপকতায় সরকার ভীত হয়ে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতশাসন আইন তৈরি করে। এই আইনের মাধ্যমে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা স্বীকৃত হয়।
(ঙ) ক্রিপস মিশন
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জাপান সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুন দখল করলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে ভারতের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠান। তিনি এসে বললেন, যুদ্ধ শেষ হবার পর পূর্ণ ডােমিনিয়নের মর্যাদা দিয়ে নতুন ভারত ইউনিয়ন তৈরি করা হবে এবং নিজস্ব সংবিধান রচনার জন্যে গণপরিষদ তৈরি করা হবে। তবে যদি কোনাে প্রদেশ পৃথক থাকতে চায় তাহলে তাকে সুযােগ দেওয়া হবে। জাতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে।
(চ) ক্যাবিনেট মিশন
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে ইংল্যান্ডে শ্রমিক দল ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেবার রূপরেখা তৈরি করতে পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে ভারতে একটি ক্যাবিনেট মিশন পাঠান। ভারতে এসে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব দেয়,—একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। তার হাতে সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরা গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করবে। হিন্দু, মুসলমান ও শিখরা নিজেদের সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিনিধি পাঠাবে। দেশীয় রাজ্যগুলিরও প্রতিনিধি পাঠাবে।
(ছ) গণপরিষদের ভূমিকা
ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী গণপরিষদ গঠিত হয়। এদের মধ্যে প্রদেশগুলির আইনসভা থেকে নির্বাচিত হয় ২৯২ জন। ৯৩ জন প্রতিনিধি আসেন দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে। চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশগুলি থেকে আসেন ৪ জন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। মােট ৫টি অধিবেশন বসে। অধিবেশন চলাকালীন মুসলিম লিগ পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই অবস্থায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪ মার্চ মাউন্টব্যাটেন ভারতে ভাইসরয় হয়ে আসেন। এই সময় তিনি মনে করলেন,—ভারতকে ভাগ করা ছাড়া অন্য কোনাে উপায় নেই। তাই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন ঘােষণা করলেন,—ব্রিটেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান—এই দুটি রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
এই ঘােষণার মতাে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারতের গণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসে। ভারতের জন্য একটি খসড়া (Draft) সংবিধান তৈরির উদ্দেশ্যে—ড. আম্বেদকরের সভাপতিত্বে একটি খসড়া কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়। দীর্ঘ আলােচনার পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি এই সংবিধান চালু হয়।
মূল্যায়ন :
সমালোচকরা বলছেন – এই গণপরিষদ প্রধানত উচ্চবিত্ত মানুষদের নিয়ে গঠিতহয়েছিল। তা ছাড়া গণপরিষদ জনগণের পরিষদ না হয়ে কংগ্রেসের পরিষদে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের আধিপত্য সম্পর্কে কোনাে বির্তকের অবকাশ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে নানা সমস্যার মধ্যে গণপরিষদ যেভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধান রচনা করেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রশ্ন ২) সংবিধানের সংজ্ঞা দাও। ভারতীয় সংবিধান রচনায় গণপরিষদের ভূমিকা মূল্যায়ন করাে।
উত্তর : রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যপূরণ করার জন্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কতকগুলি নিয়মকানুন গড়ে ওঠে। এই নিয়মকানুনের সমষ্টিকে বলা হয় সংবিধান। কিন্তু সংবিধানের সর্বসম্মত সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। অধ্যাপক কে. সি. হােয়ার (K. C. Wheare) বলেছেন,—সাধারণত দুটি অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে,—সংকীর্ণ অর্থে এবং ব্যাপক অর্থে।
সংকীর্ণ অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা
সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান বলতে বােঝায় দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে সেই সমস্ত মৌলিক নিয়মকানুন, যেগুলি নির্দিষ্টসভা কর্তৃক গৃহীত হয়ে লিখিত আকারে থাকে। কে. সি. হােয়ারের ভাষায়, সংবিধান হল কতকগুলি লিখিত নিয়মকানুন যা দেশের সরকারকে পরিচালনা করে এবং যা দলিল আকারে লিপিবদ্ধ থাকে।
ব্যাপক অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা
ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে বােঝায় কতকগুলি লিখিত বা অলিখিত নিয়মকানুন, যার দ্বারা দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। অলিখিত বলতে প্রথা, রীতি নীতি, আচার-আচরণ প্রভৃতিকে বােঝায়।
বর্তমানে ব্যাপক অর্থে সংবিধানের সংজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে। এই অর্থে গিলক্রাষ্টের (Gilchrist)সংজ্ঞাটি গ্রহণযােগ্য, তাঁর ভাষায় বলা যায়, – “কোনাে দেশের সংবিধান বলতে বােঝায় লিখিত বা অলিখিত আইনের সমষ্টি, যেগুলি সরকারের সংগঠন, বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও ক্ষমতা প্রয়ােগের নীতি নির্ধারণ করে।”
গণপরিষদের উদ্ভব ও গঠন
ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে স্বাধীন ভারতের জন্য সংবিধান রচনার গণপরিসর প্রতিষ্ঠাকে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা বলা হয়। ঐতিহাসিক দিক থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম যেদিন থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে পরিণত হয়। সেইদিন থেকেই ভারতীয় সংবিধান রচনার ভারতীয়দের অধিকার সম্পর্কে দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এই দাবি প্রবল আকার ধারণ করলে তদানীন্তন ভাইসরয় এই দাবিকে স্বীকৃতি দেন।
গণপরিষদের লক্ষ্য
অস্টিনের মতে, গণপরিষদের প্রধান লক্ষ্য ছিল গ্রহণযােগ্য এক সংবিধান রচনা করা, যা ভারতবর্গে সামাজিক বিপ্লবের চূড়ান্ত রুপ সফল করতে সাহায্য করবে। গণপরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘােষণা করেন যে, দুঃখ-দারিদ্র্যের অবসান, বৈষম্যের বিলােপ সাধন এবং সুন্দর জীবনের পরিবেশ সৃষ্টি করা হল গণপরিষদের প্রধান লক্ষ্য। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের লক্ষ্যকে সামনে রেখে গণপরিসদ যে সংবিধান রচনা করেছে তার কয়েকটি মৌলিক দিক রয়েছে। সেগুলি হল গণতান্ত্রিক সমাজবাদ, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে এবং বিচার বিভাগীয় পর্যালােচনা।
প্রথম অধিবেশন
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ২০ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার ঘােষণা করেন যে, ডিসেম্বর মাসে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। ৯ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের অধিবেশন চলে। সচ্চিদানন্দ সিংহ প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
দ্বিতীয় অধিবেশন
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গণপরিষদের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে দীর্ঘ আলােচনার পর নেহরু কর্তৃক উত্থাপিত উদ্দেশ্য সম্পর্কিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
তৃতীয় অধিবেশন
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা-সংক্রান্ত কমিটি এবং মৌলিকঅধিকার সংক্রান্ত কমিটির রিপাের্ট নিয়ে আলােচনা করা হয়।
চতুর্থ অধিবেশন
ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ভারতের স্বাধীনতা উপলক্ষ্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে১৪ আগস্ট গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসে। এরপর ২০ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত চতুর্থ অধিবেশন চলতে থাকে। এই অধিবেশনে ইউনিয়ন ক্ষমতা-সংক্রান্ত কমিটির রিপাের্ট, সংখ্যালঘু বিষয়ক কমিটির রিপাের্ট এবং গণপরিষদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিস্তৃত চিনা হয়।
শেষ অধিবেশন ও গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান গ্রহণ
বিভিন্ন কমিটির রিপাের্টের ভিত্তিতে ভারতের জন্য একটি খসড়া সংবিধান তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি এই কমিটি গণপরিষদের সামনে ভারতীয় সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন। এই খসড়ার উপর দীর্ঘ আলাপ আলােচনার ফলে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। এই সংবিধানে ৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তালিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি গণপরিষদের শেষ অধিবেশনে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৬ জানুয়ারি থেকে নতুন সংবিধান কার্যকারী হয়।
সংবিধান রচনায় গণপরিষদের ভূমিকা সমালােচনা মুক্ত নয়। কারণ-
প্রথমত, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের সংবিধান প্রণয়ন হয়নি।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় সংবিধান রচনায় যে গণপরিষদ সৃষ্টি হয় সেই গণপরিষদে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণির প্রতিনিধি ছিল। গণপরিষদের মধ্যে ৯৩ জন সদস্য রাজন্যবর্গ কর্তৃক মনােনীত হন।
কিন্তু এই সমস্ত সমালােচনা সত্ত্বেও গণপরিষদ কর্তৃক রচিত ভারতীয় সংবিধান হল ভারতীয় জনগণের রাজনৈতিক বিপ্লবের ফলশ্রুতি।
প্রশ্ন ৩) ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উত্তর : প্রত্যেক দেশের সংবিধানের কিছু কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। ভারতীয় সংবিধানেরও কতকগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি তা কার্যকর করা হয়। এর কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলােচনা করা হল।
(ক) বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম লিখিত সংবিধান
ভারতের সংবিধান লিখিত। মূল সংবিধানে ৩৯৫টি এবং ৮টি তপশিল ছিল। বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানে প্রায় ৪৫০টি ধারা এবং ১২টি তপশিল আছে। এই সংবিধান পৃথিবীর লিখিত সংবিধানগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম। তবে কিছু অলিখিত অংশও রয়েছে।
(খ) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা
ভারতের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয়। কারণ, দু-ধরনের সরকার, লিখিত সংবিধান, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন, দুম্পরিবর্তনীয় সংবিধান এবং নিরপেক্ষ আদালতের উপস্থিতি। ভারত যুক্তরাষ্ট্র। কারণ—লিখিত সংবিধান, দু-ধরনের সরকার, কেন্দ্র তালিকা, রাজ্য তালিকা এবং যুগ্ম তালিকার মাধ্যমে ক্ষমতার বণ্টন। এছাড়াও সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় এবং একটি নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত আছে। তাই ভারতবর্ষ হল যুক্তরাষ্ট্র। কাঠামােগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও এখানে কেন্দ্রপ্রবণতা স্পষ্ট। কারণ কেন্দ্র সাধারণ অবস্থায় রাজ্য তালিকার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কেন্দ্র মনে করলে রাজ্যকে বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারে। আবার রাজ্যপাল নিয়ােগ করে অথবা জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে কেন্দ্র রাজ্য প্রশাসনের উপর তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাই কে. সি. হােয়ার (K. C. Wheare) ভারতকে একটি আধা-যুক্তরাষ্ট্র বলেছেন।
(গ) সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সংমিশ্রণ
রাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন, নতুন রাজ্য গঠন প্রভৃতি কয়েকটি ধারা পরিবর্তন করতে গেলে পার্লামেন্টের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রয়ােজন। এটি সংবিধানের সুপরিবর্তনীয় পদ্ধতি। আবার মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারা পরিবর্তন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের মােট সদস্যদের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়ােজন। আবার ক্ষমতার বণ্টন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রভৃতি ধারার পরিবর্তনের জন্য পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের মােট সদস্যদের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভােটাদানকারী সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন ছাড়া অন্তত অর্ধেক অঙ্গরাজ্যের আইনসভার অনুমােদন প্রয়ােজন। এই দুটি দুম্পরিবর্তনীয় পদ্ধতির অন্তর্গত। তাই বলা যায় আমাদের সংবিধান ব্রিটেনের মতাে নমনীয় নয়, আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে দুষ্পরিবর্তনীয় নয়।
(ঘ) মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি
সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্তমানে ৬টি মৌলিক অধিকারের উল্লেখ আছে। যেমন—(ক) সাম্যের অধিকার, (খ) স্বাধীনতার অধিকার, (গ) শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (ঘ) ধর্মাচরণের অধিকার, (ঙ) সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার এবং (চ) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।মূল সংবিধানে ৭টি মৌলিক অধিকার ছিল। কিন্তু ৪৪তম সংশােধনের মাধ্যমে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে মৌলিক অধিকার অবাধ নয়। রাষ্ট্র যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরােপ করতে পারে। আবার জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে এই অধিকার সংকুচিত করা যায়।
(ঙ) মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ
সংবিধানের ৪২তম সংশােধনের মাধ্যমে ৫১(এ) ধারায় ১০টি মৌলিক কর্তব্য যুক্ত করা হয়েছে। এগুলি হল—সংবিধান মান্য করা, জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানাে, ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা, দেশরক্ষা করা, জাতির সেবায় আত্মনিয়ােগ করা, নারীর মর্যাদা রক্ষা করা, পরিবেশ সংরক্ষণ করা, সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করা প্রভৃতি। তবে এগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়।
(চ) নির্দেশমূলক নীতি
সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতির সংযােজন করা হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রকে কিছু কাজ করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়। তবুও এগুলির গুরুত্ব আছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এর উদ্দেশ্য। এই নীতিগুলির মধ্যে আছে— কর্মের অধিকার, বেকারদের সাহায্য পাবার অধিকার, নারী ও পুরুষদের সমান কাজের সমান বেতন পাবার অধিকার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করা প্রভৃতি।
(ছ) সংসদীয় গণতন্ত্র
ভারতীয় সংবিধান ব্রিটেনের অনুকরণে সংসদীয় গণতন্ত্র অর্থাৎ মন্ত্রীপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান। প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী মন্ত্রীসভা পার্লামেন্টের কাছে দায়িত্বশীল। লােকসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভাকে সরে যেতে হয়।
(জ) প্রস্তাবনার সংযােজন
প্রস্তাবনায় “আমরা ভারতের জনগণ”—এই কথাটি ব্যবহার করে জনগণের সার্বভৌমিকতার উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। আবার ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র”রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার শপথ নেওয়া হয়েছে।
(ঝ) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ
ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার স্বীকৃতি, ভারতের সুপ্রিমকোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এই আদালত মৌলিক অধিকার রক্ষা করে এবং সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও অভিভাবক হিসাবে কাজ করে। সংবিধান বিরােধী কোনাে আইন তৈরি হলে, এই আদালত বাতিল করতে পারে।
(ঞ) ধর্মনিরপেক্ষতা
ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এর অর্থ হল, প্রত্যেকে নিজের বিশ্বাস ও বুচি অনুযায়ী ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচার করবে। রাষ্ট্র ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে। রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না।
(ট) সর্বজনীন ভােটাধিকারের স্বীকৃতি
ভারতের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল,—সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের স্বীকৃতি। জাতি, ধর্ম, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক ১৮ বছর বয়স হলে এই অধিকার প্রয়ােগ করবে।
(ঠ) অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় সংবিধানের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, এক নাগরিকতা, অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রভৃতি।
মূল্যায়ন
ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলি সর্বদিক থেকেই অভিনব। বিভিন্ন দেশের সংবিধান অনুসরণ করে এটি তৈরি হলেও এর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য মৌলিকত্ব দাবি করতে পারে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এই মৌলিকত্বের একটি বড়াে উদাহরণ।
প্রশ্ন ৪) ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করাে।
অথবা, ভারতীয় সংবিধান আংশিকভাবে সুপরিবর্তনীয় এবং আংশিকভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় পর্যালােচনা করাে।
অথবা, তুমি কি মনে করাে যে ‘ভারতের সংবিধান কেবলমাত্র গঠনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কিন্তু কার্যত এককেন্দ্রিক’ তােমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
অথবা, ভারতীয় সংবিধান আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং আংশিকভাবে এককেন্দ্রিক। এই উক্তি পর্যালােচনা করাে।
উত্তর : সংবিধান রচয়িতারা ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এই যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি আলােচনা করতে হলে, প্রথম যুক্তরাষ্ট্র কাকে বলে তা জানা প্রয়ােজন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞা
যে শাসনব্যবস্থায় দু-ধরনের সরকার থাকে—কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার এবং যেখানে উভয় সরকারের মধ্যে এমনভাবে ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়, যাতে প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে এবং পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে, তাকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা।ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসংবিধানের ১(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, “India, that is Bharat, Shall be union of States” অর্থাৎ ভারত হল রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন। তাহলে দেখা যাচ্ছে,—সংবিধানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র বলা হয়নি। তা সত্ত্বেও এখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি বর্তমান।
প্রথমত, ভারতের সংবিধান লিখিত। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ দ্বারা এই সংবিধান গৃহীত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এখানে দু-ধরনের সরকার আছে,—একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং ২৮টি রাজ্য সরকার।
তৃতীয়ত, সংবিধান উভয় সরকারের মধ্যে কেন্দ্র তালিকা, রাজ্য তালিকা ও যুগ্ম তালিকার মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছে।
চতুর্থত, ভারতের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। কারণ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংবিধান সংশােধন করতে গেলে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন দরকার, আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে এছাড়াও অর্ধেক অঙ্গরাজ্যের সমর্থন প্রয়ােজন।
পঞ্চমত, এখানে একটি নিরপেক্ষ নির্ভীক যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত আছে। এই আদালত বা সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা। সংবিধান বিরােধী কোনাে আইন তৈরি হলে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করতে পারে।
ষষ্ঠত, এখানে কেন্দ্রীয় আইনভার দুটি কক্ষ আছে—লােকসভা এবং রাজ্যসভা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে,—ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আছে।
কেন্দ্রীয় প্রবণতা
আকৃতির দিক থেকে ভারত যুক্তরাষ্ট্র হলেও এখানে কেন্দ্রীয় প্রবণতা এতই বেশি যে, একে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র বলা যায় না। ভারতীয় সংবিধান গঠনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র হলেও কেন্দ্রপ্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ-
প্রথমত, ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায়—কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্র তালিকার বিষয়গুলির উপর আইন তৈরি করে। আবার যুগ্ম তালিকায় তার প্রাধান্য বর্তমান। এছাড়া “অবশিষ্ট ক্ষমতা” তার হাতে আছে। কেন্দ্রের এই ব্যাপক ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধী।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য তালিকার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। ২৪৯নং ধারায় বলা হয়েছে রাজ্যসভার দুই তৃতীয়াংশ সদস্য কেন্দ্রকে অনুমতি দিলে কেন্দ্র রাজ্য তালিকার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
তৃতীয়ত, অঙ্গরাজ্যের প্রধান শাসক হলেন রাজ্যপাল। একে নিয়ােগ করেন রাষ্ট্রপতি। এতে রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হয়েছে।
চতুর্থত, সংবিধানের ২৫৬ এবং ২৫৭নং ধারা অনুসারে কেন্দ্র রাজ্যকে নির্দেশ দিতে পারে। এই নির্দেশ অমান্য করলে রাষ্ট্রপতি রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে নিতে পারেন।
পঞ্চমত, ভারত ইউনিয়ন স্বাভাবিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু জরুরি অবস্থায় এককেন্দ্রিক হিসাবে কাজ করে।
ষষ্ঠত, পার্লামেন্ট ভারতের যে-কোনাে অঙ্গরাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন করতে পারে। এটি নিঃসন্দেহে রাজ্যের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেছে।
সপ্তমত, সারা ভারতের জন্য একটি মাত্র নির্বাচন কমিশন, একটি কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন থাকায় রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন করেছে।অষ্টমত, বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের প্রাধান্য বর্তমান। ভারতের সব আদালত সুপ্রিমকোর্টের অধীনে কাজ করে।
নবমত, ভারতের অঙ্গরাজ্যের কোনাে সংবিধান নেই, এখানে দ্বিনাগরিকতা নেই।
মূল্যায়ন
ভারতে কেন্দ্রীয় প্রাধান্য অত্যন্ত প্রবল। তাই ভারতকে একটি আধা-যুক্তরাষ্ট্র বলা যায়। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, এখানে কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী। সংবিধান রচয়িতারা ভারতের সংহতি ও ঐক্য রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা করে গেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আজ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এর প্রতিরােধের জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়ােজন। আবার পৃথিবীর সব যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রের ক্ষমতা বাড়ছে। ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র যথেষ্ট শক্তিশালী। তা সত্ত্বেও সেটি যুক্তরাষ্ট্র, তাই ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র না বলার কোনাে কারণ নেই। তবে একথা সত্য যে, ভারত তার নিজের সমস্যা মেটাতে নিজস্বভাবেই যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুর্গাদাস বসু বলেছেন, “এটি পুরােপুরি এককেন্দ্রিক নয়, আবার পুরােপুরি যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়। উভয়ের সংমিশ্রণে এর সৃষ্টি।”
See More
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি
- রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
- জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র
- আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচার
- গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র
- নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
- ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি
- রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকারের প্রকৃতি
- ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য
- ভারতের দলব্যবস্থা
- নির্বাচন কমিশন : গঠন ও কার্যাবলী নির্বাচন কমিশন : গঠন ও কার্যাবলী